#এখানে_আকাশটা_ভালবাসার
#লেখিকাঃ নয়নতারা নাতাশা
#পর্বঃ ২২
.
কাল রাতে বাবার বাড়িতে এসে পর্যন্ত দরজা বন্ধ করে পড়ে আছে রিদিমা। মেয়ের জন্য বেশ খারাপ লাগছে।
আরিফ নেই কিচ্ছু ভাল লাগছে না।
তাতে বাবা মা তাকে যে বড় বড় কথা গুলো বলেছে তা হজম হচ্ছে না।
রাতে এখানে এসেই কাঁদতে শুরু করেছিল সে।
বাবা মা ভাইয়া ভাবি সব ছুটে এসেছিল।
“কিরে রিদিমা তোর কি হয়েছে?”
“বাবা সায়ান আমাকে বের করে দিয়েছে?”
“বের করে দিয়েছে মানে? মায়া কোথায়?”
“ওরা মায়া কে আমায় দেয়নি বাবা, আমাকে চড় মেরেছে সায়ান, তারপর বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।”
“তোর শ্বশুরশাশুড়ি ছিল না?” প্রশ্ন করলেন রিদিমার মা।
মায়ের প্রশ্নে থতমত খেয়ে রিদিমা। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলে,
“না উনারা নিশিকার শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন”
“রায়ান নওশি কেউ ছিল না?”
“না বাবা, বাবা আমি আর ও বাড়িতে যাব না। ওদের মেয়ে ওরা রাখুক।” মেয়ের কথাটা বলতে একটু কষ্ট হলেও আরিফের কথা ভেবে কষ্টটা হজম করলো সে।
রিদিমার বাবা মতিন আর সহ্য করতে পারলেন না।
এক চড় মারলেন মেয়েকে। এই প্রথম তিনি মেয়ের গায়ে হাত তুললেন। বড় আদরের মেয়ে তার।
আজ আর রিদিমার মা ও বাঁধা দিলেন না।
অবাক চোখে রিদিমা বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।
“সায়ানের সাথে আমাদের কথা হয়েছে, শুধু সায়ান নয় পুরো ফ্যামিলির সাথেই আমাদের কথা হয়েছে! তুই কি মানুষ রিদিমা?”
পাশ থেকে বলে রিদিমার ভাই সামির।
চমকে উঠে রিদিমা।
কিন্তু নিজের দোষ ঢাকতে তাড়াতাড়ি বলে,
“তোমরা আমার চেয়ে ওদের কথা বেশি বিশ্বাস করো!”
“চুপ করো রিদিমা, নিজের পাপ আর বাড়িও না” এবার উত্তর দেয় রিদিমার ভাবি।
একসময় এই পরিবারের সবার আদরের ছিল সে। কিন্তু আজ!
সবার কাছেই হেনস্তা হচ্ছে রিদিমা।
আস্তে আস্তে মাথা নিচু করল সে।
মতিন হক মেয়ের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন,
“তোকে ছোট থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি আমরা, এই বাড়ির কেউ তোকে কম আদর করেনি। আমার অবস্থা টেনেটুনে চলার মতো, তবুও তোকে বড় আদরে বড় করেছি। কিন্তু তুই কি করেছিস! তোকে বিয়ে দিলাম তুই অনিকের বাবার কাছে থাকলিনা , অনিকের প্রতি কোনো মমতা তোর আসেনি, বল তো মা অনিকের বাবার কি দোষ ছিল!
বুঝলাম তখন তুই ছোট ছিলি বুঝিসনি, কিন্তু এখন?”
এত প্যাঁচাল ভালো লাগছে না রিদিমার। কিছু বলতেও পারছে না। কথা গুলো এক কান দিয়ে শুনছে আর আরেক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছে সে। ধূর! আরিফটা যে কখন আসবে!
মতিন হক কথা বলতে বলতেই বুঝলেন মেয়ে তার কথার গুরুত্ব দিচ্ছে না।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। বুঝতে পারছেন না আল্লাহ কেন তাকে এত অসম্মানের মাঝে ফেলছেন।
কথার মাঝপথেই উঠে ধীর পায়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
বাবা চলে গেলেই রিদিমা কারোর দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
গতরাতের কথা গুলো ভাবছে রিদিমা। বেশ বুঝতে পারছে এ বাড়িতে তার থাকা হবে না।
আরিফটা আসলেই হবে।
মেসেঞ্জার অন করে আরিফকে একটা মেসেজ পাঠালো রিদিমা।
“কবে আসছো তুমি? আমার আর ভালো লাগছে না”
মেসেজ টা দেখে আরিফের ইচ্ছে করছিল এই মুহূর্তে যদি রিদিমাকে ইচ্ছেমত মারতে পারত। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল আরিফ।
“এইতো আসব, আরেকটু ধৈর্য ধর প্লিজ, তোমার কাজেই তো এসেছি”
“হুম, ভাল লাগছে না আমার বাবার এখানে”
“কেন?” প্রশ্ন করে আরিফ।
“সায়ান বাবা মাকে সব বলে দিয়েছে। কাল থেকে বাড়িসুদ্ধ সবাই কানের কাছে প্যানপ্যানানি শুরু করেছে।”
মনে মনে খুশি হলো আরিফ। তবে লিখল অন্য কিছু,
“আরে চিন্তা করো না, আমি আছি তো।” আরিফের কথায় ভরসা পেল রিদিমা।
আরিফ ছাড়া এখন আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে না।
আচ্ছা সায়ান এত রাগী কবে থেকে হল!
একবারও আমাকে ফোন দিল না অথচ বাবা মা কে বলে দিল! রাগ হল রিদিমা।
একবার তো ফোন দিতে পারতো সায়ান।
না দেয় না দিক, আমার দরকার নেই ওর কাছে।
.
মায়া বেশ কথা বলতে পারে৷ বারবার মা কে খুঁজছে। ওর মা মা ডাক শুনে কেঁদে ফেললেন জাহরা।
তার হাতে গড়ে তোলা সংসারটা আজ কি হয়ে গেল!
ছেলে বউরাই তো সংসারের হাল ধরবে আর এ কি হলো!
সায়ান অফিস যায়নি। কিছুই ভালো লাগছে না সায়ানের। মায়ার সামনে যেতে পারছে না। যদিও মায়ার কাছে থাকাটা খুব দরকার।
মায়া রোশনি আর নওশির খুব পাগল। রোশনি না থাকলেও নওশি যেহেতু আছে তাই অসুবিধা খুব বেশি হচ্ছে না। তারপরেও মা তো মা-ই।
মায়ের জায়গা কেউ নিতে পারে না।
মায়াকে শান্ত করতে অনেকটা সময় গেল।
নওশি এই সংসার কাল থেকে একপ্রকার একাই দেখছে।
তার মা কিছুই পারছে না।
সায়ান নিজের রুম থেকে বের হচ্ছে না।
সাহরাফ বা রায়ান কেউই প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলছে না। সাহরাফ কলেজে চলে গিয়েছেন।
রায়ান মাঝে মাঝে নওশির কাছে এসে বসছে,
“নওশি ভাবি কে কি নিয়ে আসবে না?”
“না” শুকনো মুখে উত্তর দিলো নওশি।
চুপচাপ চলে গেল রায়ান।
রুমে ঢুকতেই ফোন বেজে উঠল রায়ানের।
সালাম দিয়ে
“আচ্ছা ঠিক আছে” বলে ফোন রেখে আবার রান্নাঘরে গিয়ে নওশির পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
“বাবার সাথে একজন গেস্ট আসবেন”
রায়ানের কথা শুনে একটু কেঁপে উঠল নওশি।
“কে?”
“জানিনা”
বলেই রায়ান পা বাড়াল মায়ের ঘরের দিকে গেস্টের কথাটা মাকে বলতে।
.
“মা আমি এখনই বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই” ঈশানের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন ঈশানের মা মারিয়া।
“কিন্তু তোর বাবা যে মেয়েটাকে খুব পছন্দ করেছে। তোর চাকরি আছে, ভালো স্যালারী পাচ্ছিস তাহলে?”
“কিন্তু আমি এখন প্রস্তুত নই,
বিয়ের কথা আরো পরে ভাবা যাবে।” শক্ত মুখেই বলল ঈশান।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কোনো কথা বললেন না মারিয়া ফেরদৌস।
প্রচন্ড বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন মহিলা তিনি। যেকোনো ব্যাপারেই তীক্ষ্ণ মেধার পরিচয় দেন তিনি। তার শক্তমুখ মুখ দেখলে স্নেহ শব্দটা মাথায় আসেনা। কিন্তু খুব স্নেহার্দ্র মানুষ তিনি।
আপাতত ছেলেকে কিছু না বলাই শ্রেয় মনে করলেন তিনি।
কিছুদিন পরেই ছেলে নিজেই বুঝতে পারবে। থাক কিছু দিন নিজের মতো।
কিছুক্ষণ পর আবার জানতে চাইলেন,
“নিষেধ করে দেয় তোর বাবাকে এখনই বিয়ের ব্যাপারে কথা না বলতে??”
“দাও”
তখনই কলিংবেল বেজে উঠল।
“ঈতিশা এলো মনে হয়” বলতে বলতে মারিয়া গেলেন দরজার দিকে।
“আরে তুমি! এখন তো তোমার আসার কথা নই” স্বামীকে দেখে একটু অবাক হলেন মারিয়া।
“বলছি..” বলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন তিনি।
ইরফান ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে বললেন,
“নওশিকে আজ ভালভাবে দেখে আসলাম, সাহরাফ সাহেবের বাসায় গিয়েছিলাম”
“সেকি!”
“কেন?”
“পরে বলছি, তা তুমি আমাকে যে যাবে তাতো আমাকে বললে না?”
“আরে আমিও জানতাম নাকি যে আমি যাবো! সুযোগ হয়ে গেল দেখে আসলাম”
“ও আচ্ছা তা মেয়েটা কেমন?”
“মাশাআল্লাহ, তোমার ছেলের সাথে হাইটে একটু বেমানান লাগলেও আর কোনো দিক থেকেই তোমার ছেলে তার সাথে পারবে না।”
“আরে হাইট তো তোমার সাথে আমারো বেমানান, তা হোক, মেয়েটার কথা বার্তা কেমন?”
“খুব ভদ্র আর গুছিয়ে কথা বলে, যদি আমার কথায় বিশ্বাস থাকে তবে বলছি ছেলে বউ বানিয়ে ঠকবে না। স্পষ্টবাদি মেয়ে কিন্তু বড্ড স্থিতিশীল, চোখমুখ দেখে মনে হল ধৈর্য্য আছে, আমার মানুষ চিনতে ভুল হয় না সে তুমি জানো”
“তোমার কথা শুনে আমারো খুব দেখতে ইচ্ছে করছে”
“যাবে তো, ছেলেকে নিয়ে যাবে”
“কিন্তু সেখানেই তো যত সমস্যা”
“কেন?”
“ছেলে রাজি হচ্ছে না এখনই বিয়ে করতে!”
“কোনো পছন্দ আছে নাকি? আগে তো বলল কেউ নেই”
“না, এমনিই এখন বিয়ে করবে না”
“মানে কি!”
“রাগ করো না, কদিন গেলে আপনিই ঠিক হয়ে যাবে।” মুখ টিপে হাসলেন মারিয়া।
“হুম, ছেলেকে ঠিক হতে বলো।”
“ঠিক আছে খাবার দিচ্ছি টেবিলে এসো”
বলে উঠে গেলেন মারিয়া।
স্বামীকে খাবার দিতে দিতে আবার প্রশ্ন করলেন,
“মেয়েটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, ছবি আছে?”
“আছে তো, একটা নিয়ে রেখেছিলাম ওর ভাইয়ের থেকে”
“ওম্মা এতক্ষণ বলবে না?” রাগ রাগ কন্ঠে বললেন মারিয়া।
“তুমি জানতে চাওনি, আমার কি আর মনে আছে!” হাসিমুখে অপরাধ সুরে বললেন ইরফান।
“এই জন্যই তো দরকার বউমা আনার, ছবি কোথায়?”
“মোবাইলে…”
মারিয়া বেগম ছবি দেখতে দেখতে বললেন,
“মাশাআল্লাহ! বড্ড মায়াবি চেহারা!”
“হুম, ছেলেকে দেখিয়ে নিও”
“অপছন্দ হবে না”
“তুমি জানো না মেয়েটা কত্ত গুনি, কবিতা বিতর্কে একেবারে টপ লেভেলে, হাতের লেখাও ভীষণ সুন্দর, সাহরাফ তো মেয়েকে নিয়ে এত কিছু বলেন না আজ আমি গিয়ে অবাক………” নওশির প্রশংসা করতে লাগলেন ইরফান।
এমন সময় তাদের মেয়ে ঈতিশা আসল বাসায়।
দরজা খুলে দিয়ে এসে মারিয়া বললেন,
“বলো এবারে…”
“বাবা কার কথা বলছে এত?” প্রশ্ন করে ঈতিশা। ঈতিশার বয়স নওশির মতোই, বাবার মতোই ঈতিশার গড়ন।
আহামরি সুন্দরী নয়, সাধারণ মেয়েদের মতই।
কিন্তু কথাবার্তা আর ভদ্রতায় বাকি সবকিছুকে জয় করে নিয়েছে। ফর্সা আর লম্বা মানেই যে সুন্দরী বা স্মার্ট নয় সেটা যাদের মাথাতে ঢুকে না তাদের ঈতিশাকে চোখে পড়বে না।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে ঈতিশা স্মার্ট। ঈতিশা নওশি আর রোশনির মতোই বাচ্চা পাগল। বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করতে খুব ভালবাসে।
“ঈশানের হবু বউয়ের কথা” হাসতে হাসতে ঈতিশার কথার উত্তর দিলেন মারিয়া।
“ওম্মা তাই নাকি?”
“এই ভাইয়া তুই নাকি দিল্লিকা লাড্ডু খাবি?” চেঁচিয়ে বলল ঈতিশা।
হেসে উঠলেন মারিয়া আর ইরফান।
“মার খাসনে যেন” রুম থেকে বলল ঈশান।
ঈতিশা বাবার কাছে থেকে নওশির সব কিছু ভালভাবে শুনে নিল। ভাইয়াকে নাড়তে খুব সুবিধা হবে।
ছবিটা নিতেও ভুল করল না।
.
“জাহরা, বাড়ির এই পরিবেশে নওশির বিয়ে ঠিক করা কি ভাল দেখাবে?”
“খারাপ দেখানোর কি আছে?” ঝাঁঝালো স্বরে জবাব দিল জাহরা। সত্যসত্যই সব কিছু তার ধৈর্য্যের বাইরে চলে যাচ্ছে।
“ভাল ছেলে পেয়েছ মেয়ের বিয়ে দিচ্ছ দাও, এখনো আরেকটা মেয়ে আছে, রায়ান আছে। আর তাছাড়া আমার এক ছেলের প্রভাব অন্য ছেলেমেয়েদের উপর পড়ুক এটা মা হয়ে কখনো চাইব না।”
সাহরাফ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন তিনিও আজ এই কথা গুলোই ভেবেছেন।
তাদের দুজনের মাঝে এত মিল বলেই হয়তো এতদূর আসতে পেরেছেন।
সবচেয়ে বড় কথা মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা দুজনেরই ছিল।
কিন্তু সায়ানের কি হল!
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
ঠিক করলেন নওশির বিয়ে তাড়াতাড়িই দেবেন তিনি।
বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে জয় নিশিকাকে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসতে বলবেন। রোশনিও ওখানে। রোশনির রেজাল্টের বেশি বাকি নেই।
“জাহরা?”
জাহরা সাড়া দিলেন না। ঘুমিয়ে গেছেন। সাহরাফ আর ডাকলেন না।
ঘুমাক, মনের উপর বড্ড ঝড় যাচ্ছে।
তারও তন্দ্রাভাব এসেছিল।
হঠাৎ মায়া কেঁদে ওঠায় উঠে পড়লেন।
মায়া নওশির কাছে ঘুমাচ্ছে দুইদিন।
“কি হল নওশি?” নওশির রুমে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করল রায়ান।
“আরে বাচ্চারা এমনিই তো উঠে যায়, তাতে মা নেই… কপালে যে কি আছে মায়ার!”
“আমরা আছি তো!”
“মায়ের অভাব পূরণ করতে পারবি?”
রায়ান আর কিছু বলল না। আর কোনো কথা বলতে পারলেন না সাহরাফ সাহেবও।
সায়ান রুমের কাছে এসে নওশির এসব কথা শুনে সায়ান আর ভিতরে ঢুকল না।
মেয়ের সামনে যেতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে এই সময়ে।
মেয়েকে মা দিতে পারল না।
তার মনে হয় মেয়ের কাছে এক পরাজয়!
রুমে গিয়ে আবার শুয়ে পড়ল সায়ান।
মোবাইল টা চেক করে মেসেজ দেখে উত্তর দিল,
“তুই তোর কাজ করে যা, ভুল করিস না যেন। আমি সব পরে বলব, তার আগে দেখা কর।”
.
(চলবে)