এলোমেলো হাওয়া পর্ব -১৩

#এলোমেলো_হাওয়া
#পর্ব_১৩
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

তীহা ঘুমিয়ে পড়েছে। নিভে যাওয়া গলায় আদ্র ডাকলো, “তীহা..”
তীহার সাড়া নেই। আদ্র মিটিমিটি হাসে। তীহার মাথাটা তার কোল থেকে সরিয়ে বালিশের উপর রেখে দেয় আলগোছে,পাছে তীহা জেগে যায়! কিন্তু না,তীহার কোনোই সাড়াশব্দ নেই। বুকের ঘন ঘন উঠানামা সাক্ষ্য দেয়,সে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। আপাতত বোমা ফুটলেও উঠার গ্যারান্টি নেই। আদ্র’র ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ হয়। মেয়েটা দিনকে দিন বুকের ভেতর অনবদ্য এক অনুভূতির সৃষ্টি করছে। যতই সময় গড়াচ্ছে,ততই মায়াজালে আঁটকে পড়ছে সে। আদ্র একজন সচেতন পুরুষ, অথচ অচেতন মনে কী করেই না তীহার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে! এই যে চোখের পাতা মুদে,ঠোঁট হালকা ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো করে গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে তীহা,এই ঘুমন্ত মুখটাও দেখতে বড় ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে,এই মুখের দিকে তাকিয়েই এক যুগ পার করে দেওয়া যাবে অনায়াসে! আহা, এত টান,এত মায়া- কবে সৃষ্টি হলো! নিজের করা প্রশ্নে নিজেই ঠোঁট বাকিয়ে উত্তর দিলো, “কে জানে!”
পরমুহূর্তেই হেসে উঠল। কী আজব, সে তো দেখছি পাগলাটে ধরনের হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ভালোবাসা এত ভয়ংকর কেন! বড় বড় বুড়োকেও যৌবনের স্বাদ দেয় নতুন করে…

.
রাত ফুরোলো। শেষরাতে মোরগের কর্কশ ডাকে তীহা পিটপিট করে চোখ মেলে চাইলো। আবার বুজল,ঘুমের দেশে হারিয়ে গেল। মিনিট খানেক পর পুনরায় তাকে চোখ মেলতে হলো মোরগের বিকট চিৎকারে। আযান দিয়ে দিয়েছে। আযানের পর আর একমুহূর্তও মোরগ,মুরগী,হাস- এসব ঘরের ভেতর থাকতে চায় না। যতক্ষণ না তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে, ততক্ষণ যাবত এই চিৎকার চেঁচামেচি চলবে। সবচেয়ে বেশি চিৎকার করে মোরগ গুলো। তীহার কপালে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ভাঁজ, পাশ ফিরে দেখল আদ্র ঘুমিয়ে আছে। সংক্ষিপ্ত এলো চুল কিছু ছড়িয়ে আছে উন্মুক্ত কপালে। তীহার অমসৃণ কপাল মসৃণ হয়। আদ্র’র লেপ্টে থাকা চুলগুলো গুছিয়ে দেয় নিজ হাতে। এরপর মৃদু সুরে ডাকে, “এই,শুনছেন?”
আদ্র’র সাড়া নেই। ঘন্টাখানেক আগেই ঘুমিয়েছে। তীহার চেহারার মাপ নকশা মুখস্থ করতে গিয়ে বেচারার সারারাত ঘুম হয়নি! তীহা তো আর তা জানে না!

মোরগটি আবারও ডেকে উঠল। তীহা ভ্রু কুঁচকে একটা রামধমক মারলো, “এই চুপ!”
মোরগ কী আর মানুষের ভাষা বোঝে? সে সেকেন্ড কতক পর ফের ডাকলো। তীহার নাসিকাপথ ভেদ করে বেরিয়ে এলো হতাশামিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস। গলার স্বর খানিকটা বাড়িয়ে সে আবার ডাকলো, “এইযে… শুনছেন?”
আদ্র শুনলো। চোখ মেললো না,ঢুলুঢুলু কণ্ঠে জবাব দিলো, “উঁ, কী? টয়লেটে যাবা?”
তীহা বিব্রত কণ্ঠে বলল, “আমি কী টয়লেটে যাওয়ার জন্য ডাকছি আপনাকে?”
চোখজোড়া বন্ধ রেখেই আদ্র উত্তর করে, “তোমার সাহস আছে একা টয়লেটে যাওয়ার?”
তীহা এবার কঠিন সুরে বলল, “হ্যাঁ,অবশ্যই আছে।”
“তাহলে যাও,আমাকে ডাকছো কেন?” বলে আদ্র অন্য পাশ ঘুরলো। তীহা এক হাতে আদ্রকে টেনে সোজা করে বলল, “সাধে তো আর ডাকিনি! ওই মোরগটা অনেক চিল্লাচ্ছে। ওকে কিছু করেন। আমি ঘুমাতে পারছি না।”

“কী? মোরগ?” আদ্র চোখ খুললো এইবার।
তীহা মাথা দুলিয়ে বলল, “হুম, ওই খোপের ভেতর যে ফুপুর মোরগ মুরগী আছে না,আমি ওদের কথাই বলছি। মুরগী গুলোর কককক তাও সহ্য করা যায়। কিন্তু মোরগের এত কর্কশ চিৎকার সহ্য হচ্ছে না। ওই হারামি ব্যাটার জন্যেই আমার ঘুমটা ভাঙছে।”

আদ্র ড্যাবড্যাবে চোখে তীহার দিকে তাকিয়ে রইলো। একসময় নিস্তরঙ্গ গলায় বলল, “ওর গলাটা টিপে ধরো গিয়ে,নাহলে ওর মুখ ভেঙে দাও। তাহলে আর চিৎকার করতে পারবে না।”
“ইশ! আমি কী তা বলছি নাকী? একটা প্রাণীর গলা টিপে ধরতে বলতেছেন আপনি! কী খারাপ আর পাষাণ আপনি,হু? ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন যেন চিল্লাচিল্লি না করে,তাহলেই তো হয়।” তীহা আকুতির স্বরে কথাগুলো বলতেই আদ্র ভ্যাবাচ্যাকা কণ্ঠে বলল, “তাই তো,তাই তো! আমি কী বোকা…” বলতে বলতে সে উঠে বসল। তীহা প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কী ব্যাপার! কই যাচ্ছেন?”
আদ্র শক্ত গলায় বলল, “মোরগ মহাশয়ের কাছে যাচ্ছি। তার পা ধরে রিকোয়েস্ট করে আসব,আর যেন না চিল্লায়। তার কারণে আমার বউয়ের ঘুম হচ্ছে না। আশা করি,সে আমার রিকোয়েস্ট বুঝবে এবং রাখবে।”

তীহা নিভে গেল,লজ্জা পেল। তার মাথায় কিচ্ছুটি নেই! এটা কী বলল সে! আদ্রকে বলেছে মোরগকে বুঝিয়ে বলে আসতে.. আর আদ্রও তাই করতে চলে যাচ্ছে! শিট! তীহা দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বলল, “ইয়ে মানে,সরি! আমি আসলে কী বলতে কী বলেছি..”
“না, না, আমার রিকোয়েস্ট সে অবশ্যই রাখবে। আমি আর ও জাতভাই তো। আমার ভাষা ও বোঝে,ওর ভাষাও আমি বুঝব।” দাঁতে দাঁত চেপে কথা গুলো বলল আদ্র। তীহা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “প্লিজ! আর লজ্জা দিয়েন না। কোত্থাও যেতে হবে না আপনাকে। আসুন, আপনি ঘুমান। আমি আর ডিস্টার্ব করব না,প্রমিস।”
আদ্র’র রাগ তবুও কমলো না। ঘুমের মধ্যে ডিস্টার্ব হওয়ায় তার মাথা আউলে গেল। সে একা একাই গজগজ করতে করতে শুয়ে পড়ল এবং একসময় ঘুমিয়েও গেল। তীহাও তার পাশে শুয়ে পড়ল। যেই মাত্র চোখটা বন্ধ করল,ওমনি মোরগের ভয়ংকর ডাকে উঠে পড়ল।
“আর ঘুমাবোই না শালা..” বলে তীহা উঠে পড়ল। মুরগীর খোপে রাগ নিয়ে একটা লাথি মারতে গিয়ে নিজেই নিজের পায়ে ব্যথা পেল। উঁহু,আহা করতে করতে বেচারি তীহা দরজা খুলে ঘর থেকেই বেরিয়ে পড়ল…

____

ভয়ে আড়ষ্টভাবে বসে রয়েছে মালোতি। টেবিলের ওপর পাশে অনিন্য, কিছু কাগজপত্রে চোখ বুলাচ্ছে সে। একটা খবর জানাতেই অনিন্য’র অফিস রুমে এসেছে মালোতি। খবরটা এতই জরুরি যে, বাসায় বসে অনিন্য’র জন্য অপেক্ষা করতেও তর সইলো না তার। তাই একপ্রকার ছুটেই এসেছে এখানে। অনিন্য’র চোখে রাগ,ঠোঁটে বিরক্তি। শুধুমাত্র রাতের আঁধারেই এই মেয়েটাকে ভালো লাগে। দিনের আলোয় একে দেখলে মাথায় চারশো ভোল্টের আগুন জ্বলে ওঠে! এর কারণ কী,অনিন্য জানে না। প্রায় মিনিট বিশেক পর কাগজপত্র গুলো ঠেলে পাশে সরিয়ে রাখে অনিন্য। মালোতির দিকে তাকাল। মালোতি মাথানিচু করে বসে আছে। গমগমে কণ্ঠে অনিন্য প্রশ্ন করল, “বাসায় কী ডাকাত পড়ছে? কী এমন কথা যেটা বলতে এখানে ছুটে আসতে হইছে তোমাকে?”

মালোতির গলা দিয়ে একটুও আওয়াজ বের হলো না। অনিন্য টেবিলের উপর খুব জোরে বারি মারলো হাত দিয়ে। তার হাতের থাবার শব্দে মালোতি কেঁপে উঠল। অনিন্যকে বাঘের চাইতেও বেশি ভয় পায় সে। আর এরই ভেতর এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল কী করে! এখন এই খবর কীভাবে দেবে সে অনিন্যকে! আর অনিন্যও বা এটা শোনার পর কী রকম রিয়েক্ট করবে! কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
অনিন্য বলল, “মুখে তালা দিয়ে বসে থাকার জন্য এখানে আসছো?”
মালোতি এদিক ওদিক মাথা নাড়লো, “আ..আমি বলতে পারব না। আসলে,আসলে আমার অনেক ভয়ে লাগছে।”
“ঢং বাদ দিয়ে যা বলার দ্রুত বলো।”
মালোতি ঢোক গিলে বলল, “একটা কাগজ আর কলম হবে?”
“কী?” ভ্রু কুঁচকে গেল অনিন্য’র। অগ্নি চোখে মালোতির দিকে তাকিয়ে রইলো সেকেন্ড চারেক। এরপর একটা নোটপ্যাড ও কলম এগিয়ে ধরল। ঘষঘষ আওয়াজে কিছু একটা লিখলো মালোতি। সেটা টেবিলের উপর রেখেই সে উঠে দাঁড়াল এবং দৌড়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। অনিন্য হতবাক, দ্রুত নোটপ্যাড টা টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করল।
মালোতি লিখেছে,
অনিন্য, একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। কীভাবে কী হলো আমি জানি না। তুমি তো সবসময় সেফটি ইউজ করতে,তারপরও.. এই খবরটা কিছুতেই তোমাকে বলতে পারব না আমি। তাই লিখে দিলাম। অনিন্য.. অনিন্য আমি প্রেগন্যান্ট। আ..আমি, আমি তোমার বাচ্চার মা হতে চলেছি। তোমার বেডরুমে ড্রেসিং টেবিলের উপর আমি প্রেগন্যান্সি টেস্টের কিট টা রেখে এসেছি। ওখানে স্পষ্ট দুটো লাল দাগ অনিন্য। আমি খুশি হবো নাকী কাঁদবো জানি না। শুধু তোমার পায়ে পড়ি, বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে বলো না অনিন্য। আমি দরকার পড়লে দূরে কোথাও চলে যাব। জীবনে অনেক পাপ করছি,এবার সেগুলার প্রায়শ্চিত্ত কর‍তে চাই।

অনিন্য’র হাত থেকে কাগজটা পড়ে গেল। একটা হাত কখন যে মাথার উপর উঠল,অনিন্য টের পেল না।

(চলবে)
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here