এলোমেলো হাওয়া পর্ব -১৪

#এলোমেলো_হাওয়া
#পর্ব_১৪
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

দোলনা ঝুলানো হয়েছে। শিকলের দোলনা না, মোটা রশির দোলনা। আমগাছের পুষ্ট ডালে দড়ি ঝুলিয়ে, মাঝখানে মোড়া দিয়ে বানানো দোলনায় গ্রামের ছেলেমেয়েরা হুটোপুটি খাচ্ছে। আমেনাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আদ্র বাড়ি নেই, বেলা দশটার কাছাকাছি সময়। কোথাও একটা গিয়েছে তীহাকে না জানিয়ে। ঘরে একা একা ভালো লাগছিল না,তাই উঠোনে নামতেই ছেলেমেয়েদের দলটাকে দেখতে পেল তীহা। উঠোনের একপাশ জুড়ে রয়েছে তারা। আপাতত খেলার মধ্যমনি আমেনা। দোলনায় সে দুলছে। তীহা এগিয়ে গেল আগ্রহ নিয়ে। উৎসুক কণ্ঠে বলল, “তোমাদের ভয় করে না? যদি ছিঁড়ে যায়।”
“ছিঁড়তো না ভাবী। আমরা এর আগেও এমনে কইরা দুলছি।” উত্তর দিলো শাপলা নামের এক পিচ্চি। তীহা তার থুতনি ধরে বলল, “তাই! আমিও চড়তে পারব?”
এবার জবাব এলো আমেনার পক্ষ থেকে। সে দোল খাওয়া থামিয়ে বলল, “আসেন ভাবী। আমি আছি, আমি আপনারে ধইরা রাখবো। বেশি নড়াচড়া না করলে সমস্যা হবে না আপনার। আরামে দুলতে পারবেন।”

কিছুটা ভয়, অনেকটা উৎসাহ নিয়ে দোলনায় বসে তীহা। আমেনা দুটো দোল দেয়,তীহা উচ্চ স্বরে বলল, “ব্যস,ব্যস। আর না.. ভয় লাগছে।”
আমেনা হাসে, “কিচ্ছু হবে না ভাবী। আপনি উপভোগ করেন শুধু।”
এমনি সময়ে তিনজন মহিলা এলো। আমেনা তাদেরকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যায়। শাপলা তীহাকে দোল খাওয়াচ্ছে আপাতত। কিন্তু অতিরিক্ত ভয় লাগায় তীহা দোলনা থেকে নেমে পড়ল। সুযোগ পেয়ে শাপলা উঠে বসল আর তাতেই অন্য বাচ্চাদের কিচিরমিচির শুরু হলো। শাপলা কেন বসল, এখন অন্য একজনের বসার পালা- এই নিয়ে তর্কবিতর্ক চললো। তীহা ওদের থেকে সরে এসে আমেনার কাছে গেল। শুনতে পেল, আমেনা বলছে, “আপনি কার কথা জিজ্ঞেস করতেছেন? আমাদের বাসায় তো কোনো পুরুষ মানুষ নাই।”
তীহা উৎসুক হলো। উপস্থিত মহিলাদের একজন লাল ঠোঁটে বলল, “তাইলে ওই পোলাডা কেডা? গ্রাম ঘুইরা বেড়ায় যে। তোমগো বাড়ির না? তোমগো বাড়ির হুইনাই তো আমরা আইছি।”
আমেনা তীহার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বলল, “আপনি কী আদ্র ভাইয়ার কথা বলতেছেন?”
“এঁ..কী নাম?” নামটা উচ্চারণ করতে পারল না আরেকজন।
“আদ্র।” এবার উত্তর দিলো তীহা।
উপস্তিত সব ক’জনের চোখ এবার তীহার দিকে ঘুরলো।। “তুমি কেডা? ওই পোলার ছোডো বইন নাকী?” পান খেয়ে লাল হয়ে যাওয়া ঠোঁটের মহিলাটি প্রশ্নটি করতেই আমেনা ফিক করে হেসে দিলো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তীহার। সে কটমট করে বলল, “আপনি জানেন আমি তার বোন কীনা! না জেনে এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন করেন কেন?”
“এত বেত্তমিজ ক্যান তুমি?” পালটা রুক্ষ প্রশ্নে তীহার রাগ মাথায় উঠে গেল। সে বলল, “ছেলেটা কোন বাড়ি থাকে সেই খবর নিয়ে আসতে পারছেন আর কাকে নিয়ে এসেছে সেই খবর নিতে পারেন নাই?”
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আমেনা বলল, “উনি আদ্র ভাইয়ার বউ হয় চাচী।”

“আদ্র’র বউ” কথাটি তীহা ও আমেনা বাদে বাকী তিনজনকেই স্তব্ধ করে দিলো যেন। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল তিনজনে। তীহাও আমেনার মুখের দিকে তাকাল। তাদের হঠাৎ বজ্রাহত চেহারার কারণ টা ঠিকঠাক ধরতে পারছে না সে।

একজন বলল, “আইচ্ছা, আমরা আসি তাইলে।”
“আসবেন মানে! ঘরে বসুন না… আম্মা চড়ে গেছে। চড় থেকে ডেকে আনি।” ব্যতিব্যস্ত দেখালো আমেনাকে। মহিলাটি বলল, “না থাক, যেই কামে আইছি সেই কাম যেহেতু আর হইতেছে না..”
“কী জন্যে আসছেন আপনেরা? তাই তো বললেন না এখনো।” আমেনা পুনরায় প্রশ্ন করে। একজন হেসে দিয়ে বলল, “আমরা আইছিলাম তোমার ভাইয়ার লগে একজনের প্রস্তাব নিয়া৷ ও যে বিয়াত্তা তা তো আর জানতাম না। যাই হউক,মনে কিছু নিও না তোমরা। আহি এখন।”
বলে আর দেড়ি করল না। হুড়োহুড়ি করে চলে গেল তিনজনে। রেখে গেল আমেনার হতবাক এবং তীহার থমথমে মুখ। এলাকা ঘুরতে গিয়ে মেয়েদেরকেও নিজের দর্শন দিয়ে আসছে জনাব! রাগ হলো তীহার। মনটাই নষ্ট হয়ে গেল। মনে মনে বলল, “আজ আসুন আপনি.. আপনার কপালে আমি শনি, রবি, সোম- সবকিছু লিখে দিবো।”

আমেনা ডাকলো, “ভাবী আসেন। দোলনায় চড়বেন না?”
তীহা গুমোট মুখে বলল, “ইচ্ছে নেই। আমি ঘরে গেলাম।”

____

টেলিফোন বাজছে। আহসান খান লেপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে ফোনটা তুলে নিলো, “হ্যালো..”
“স্যার একটি মেয়ে এসেছে। আপনার সাথে দেখা করতে চাইছে।” রিসিপশনে কর্মরত মেয়েটি কথাটি বলতেই আহসান খানের ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল।
“মেয়ে এসেছে! কী নাম?”
“মালোতি নাম স্যার। বলছে আপনার সাথে তার খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে নাকী।”
আহসান খান বেশ অবাক হলেন। রাশভারি কণ্ঠস্বর টেনে অনুমতি দিলেন, “ভেতরে পাঠিয়ে দাও।” তারপর ফোন রেখে দিলেন। অনিন্যকে একবার ফোন করতে চেয়েও করলেন না। আগে শোনা যাক,মেয়েটি কী বলতে এসেছে। সরাসরি তার কাছে এসেছে যখন, এর মানে কিছু জরুরি কথাই বলতে এসেছে। কিন্তু তার সাথেই এই রক্ষিতার কী এমন জরুরি কথা থাকতে পারে!আহসান খান ভেবে পেলেন না।

মোটা থাই দরজায় থপথপ আওয়াজ হলো। আহসান খান ভাবনার গতিপথে লাগাম টানেন। মোটা কণ্ঠে বললেন, “কাম ইন।”
জুবুথুবু অবস্থায় মালোতি দরজা টেনে ভেতরে প্রবেশ করল। থাই দরজা থপ করে আঁটকে যাওয়ার আওয়াজে মালোতি কেঁপে ওঠে। আহসান খান বিরক্তি চাপিয়ে বললেন, “আমার সাথে তোমার কী এমন জরুরি কথা আছে যেটা বলতে এখানে অবধি এসেছো! তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি।”
মালোতি অসহায় গলায় বলল, “আমি আপনার কাছে নিরাপদ আশ্রয় চাইতে এসেছি।”
“কী! নিরাপদ আশ্রয়!” আহসান খান নড়েচড়ে বসলেন।
মালোতি কাঁদোকাঁদো মুখে বলতে শুরু করল, “আপনার ছেলে আমাকে ভালোবাসার রূপ দেখিয়ে তার সাথে রিলেশনশিপে যাওয়ার জন্য আগ্রহী করে তোলে। সে বলেছিল, আমাকে বিয়ে করবে। আমাকে পরিচয় দিবে। তার উপর বিশ্বাস রেখেই আমরা একত্রে থাকতে শুরু করেছিলাম। এখন.. এখন আমি প্রেগন্যান্ট। ভুলবশত এটা হয়ে গেলেও এই বেবিটাকে আমি মারতে চাই না। অনিন্যকে আমি বলেছি। আমার ভয় হচ্ছে,ও কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না। আমি এখন জানি ওর মনে আমার জন্য কোনো ভালোবাসা নেই। তাই এই বেবি নিয়েও ওর কোনো ব্যাকুলতা নেই বরং আমি আর এই বেবি এখন ওর মাথাব্যথা। মাথাব্যথার এই কারণ ও বাঁচতে দিবে কীনা, তাই নিয়ে আমি টেনশনে আছি। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না কী করব,কই যাব৷ তাই আমি আপনার কাছে এসেছি৷ ওর হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারলে সেটা একমাত্র আপনিই পারবেন। আপনি এর জন্য যা-ই বলবেন আমি করব। বিনিময়ে আমাকে স্থান দিন অথবা এমন কোথাও পাঠিয়ে দিন যেখানে আমার আর এই বাচ্চার কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে না। আমি জীবনে অনেক ভুল করছি,পাপ করছি। এই সন্তানের মুখ দেখে বাকী জীবনটা অনুতপ্ততায় কাটিয়ে দিতে চাই৷ আমাকে সাহায্য করুন… প্লিজ!”

মালোতি দরজার কাছেই বসে পড়ল। ডুকরে কেঁদে উঠল দু’হাত মুখে চেপে ধরে। আহসান খান ধমকের সুরে বললেন, “শশশ! আস্তে.. কেউ শুনলে কী ভাববে? এখানে আমার একটা রেপুটেশন আছে!”
ধমক খেয়ে মালোতির কান্নার আওয়াজ কমে কিন্তু থামে না। চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে ভয়ে। যদি অনিন্য’র মতো এই লোকও তার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়! তখন!
সে ভয়ার্ত চোখজোড়া আহসান খানের দিকে নিবদ্ধ করল। আহসান খান আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়েছেন। তার এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে ফোন টিপছেন। মালোতি উঠে ছুটে গিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরল। আকুতির স্বরে বলল, “অনিন্যকে কিচ্ছু জানাবেন না দয়া করে। ও জানতে পারলে আমাকে মেরেই ফেলবে।”
“কী করছো কী! পা ছাড়ো.. পা ছাড়ো বলছি।” আহসান খান ঝটকে মেরে উঠে দাঁড়ান। মালোতি পুনরায় হাউমাউ শব্দে কেঁদে উঠল। মুখ দিয়ে ‘চ’কারান্ত বিরক্তির শব্দ বেরিয়ে এলো আহসান খানের। কিছু একটা ভেবে তিনি বললেন, “ঠিক আছে। আমি তোমাকে স্থান দিবো। বিনিময়ে আমি যা বলব,তাই করতে রাজী?”
কোনোকিছু না ভেবেই মালোতি বলল, “রাজী।”
আহসান খানের মুখে একচিলতে হাসি ফুঁটে উঠল। তিনি কোথাও একটা ফোন লাগালেন তৎক্ষনাৎ।

____
ভারাক্রান্ত মুখখানা আদ্র’র নজর এড়ালো না। সে আসার পর থেকেই দেখছে তীহা কেমন গুমোট হয়ে বসে আছে। টিভি দেখছে,কিন্তু তার মন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। ব্যাপার কী! আদ্র সংকোচ ঝেড়ে বলল, “মানুষের মুখ ফুলানো স্বভাব টা আমার একদম ভালো লাগে না।”
তীহা ঝট করে মুখটা ফিরে তাকাল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, “আপনি কী আমাকে কিছু বললেন?”
আদ্র নির্লিপ্ত গলায় বলল, “আমি তোমাকে কখন কী বললাম!”
“আপনি একটু আগে যে মুখ ফুলানো নিয়ে কিছু একটা বললেন, সেটা নিশ্চয়ই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন।”
“তার মানে তুমি সত্যিই মুখ ফুলিয়ে আছো?”
তীহা সে কথার জবাব না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পূর্বের চাইতে আরও বেশি ভার মুখ করে রইলো। আদ্র তীহাকে উদ্দেশ্য করে দায়সারা ভাবে বলল, “অর্ধেক কথা বলে অর্ধেক বলো না। অর্ধেক টয়লেট করে অর্ধেক বাদ দিয়েই উঠে যাও নাকী?”
উত্তপ্ত তেলের ভেতর এক ফোঁটা পানি পড়লে যেভাবে ছ্যাৎ করে ওঠে,তীহাও সেভাবেই জ্বলে উঠল। নাকমুখ কুঁচকে বলল, “ছি! এত খারাপ কথা বলেন আপনি!”
“তো কী করব? পুরা কথা বলো না কেন?”
“কী বলব আমি হ্যাঁ,কী বলব?” চেঁচিয়ে বলল তীহা। আদ্র ঠিক ততটাই নরম গলায় বলল, “মুখটা ভার করে বসে থাকার রিজন।”
“জানতে হবে না আপনার।” আচানক তীহার কণ্ঠটা দুঃখী শোনালো। সে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আদ্র ডাকলেও শুনল না। হন্য পায়ে হেটে গিয়ে দাঁড়ালো আমগাছটার নিচে৷ এখন কেউ নেই, দোলনা খালি পড়ে আছে৷ মৃদুমন্দ সমীরণ বইছে। একটা চিন্তা তীহার বক্ষপিঞ্জরকে গ্রাস করে নিচ্ছে। মেয়েলি কারণে আদ্র’র উপর এভাবে রাগ জন্মানোটার পেছনে কী অন্যকোনো কারণ আছে তবে? যদি থেকেই থাকে তাহলে কী সেই কারণ! কেন তীহার বুকের ভেতর এতটা অভিমান জন্মে গেল আদ্র’র প্রতি?

(চলবে)
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here