কখনো হারিয়ে যেতে হয় পর্ব -০৩ শেষ

#কখনো_হারিয়ে_যেতে_হয়

পর্ব – ৩

মীরা তার জীবনে অনেক খারাপ সময় দেখেছে। বাবা ছোটবেলায় মারা যাবার পর ভাইদের রক্তচক্ষু আর কড়া শাসনে বড় হয়েছে। মুহিবের সঙ্গে সংসার টা কয়েক বছর ভালো চলল তারপর সন্তানহীনের অপবাদ নিয়ে সেই সংসারে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। সংসার থেকে বের হয়ে এসে আবার বাপের বাড়ির জীবনটা ছিল আরো বেশি যন্ত্রনাময়। দ্বিতীয়বার সংসারে নিজেকে কখনো মেলে ধরতে পারেনি। আষ্টেপৃষ্টে জড়তা, তার মধ্যে স্বামীর আগের পক্ষের শ্বাশুড়ি কারণে অকারণে কথা দিয়ে, ব্যবহার দিয়ে সারাক্ষণ বুঝিয়ে দেয় সে এই সংসারে একজন অনাহুত আগন্তুক। সংসার টা তার নয় । সামান্য একটা জিনিস একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরাতে গেলে কত তোলপাড় যে হয়ে যায়!
বাচ্চাদের সঙ্গে উচিত ব্যবহারটুকু করতেও হাজার বার চিন্তা করতে হয়। বেশি আদর করলে শুনতে হয় আদিখ্যেতা দেখাচ্ছে আবার শাসন করার আগেই শুনতে হয় সৎ মায়ের ব্যবহার এমন‌ই হয়।
এই তো কিছুদিন আগেই ঐশী বন্ধুদের সাথে পিকনিক করতে যাবে বায়না করলো। ওর বাবাকে জিজ্ঞেস না করে অনুমতি দেয়ার উপায় নেই কিন্তু রাকায়েত অফিসের মিটিং এ ব্যস্ত ফোন ধরছিল না। ঐশী জিদ করা শুরু করলো। এক পর্যায়ে মীরা একটু করা গলায় বলল, তুমি তো জানো তোমার বাবার অনুমতি না নিয়ে আমি তোমাকে যেতে দিতে পারি না তাহলে এত জিদ করছো কেন?
সঙ্গে সঙ্গে ঐশী চিৎকার করে উঠল, আমার সঙ্গে এভাবে রাগী গলায় কথা বলবে না।
মীরা আবাক হয়ে গেল ঐশীর রূপ দেখে!
আমি রাগী গলায় কথা বললাম কোথায়?
হ্যা তুমি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছো। বলেই ঐশী কান্নাকাটি শুরু করে দিল। দুই মিনিটের মধ্যে ওর নানু এসে মীরাকে শাসানো শুরু করলো।
রাতে রাকায়েত বাসায় আসার পর মীরার নামে যথারীতি বিচার দিল। ঐশী সারাদিন না খেয়ে থেকে পরিস্থিতি আরো খারাপ করলো। রাকায়েত মীরাকে ডেকে বলল,’ আমার মেয়েদের আদর না করলেও এভাবে খারাপ ব্যবহার করার অধিকার তোমাকে দেইনি মীরা। ভুলে যেও না শুধুমাত্র ওদের জন্যেই তোমাকে বিয়ে করেছি নয়তো আমার কোন স্ত্রীর দরকার ছিল না। ‘
মীরা বোঝাতেই পারল না কেন কিসের জন্য সে ঐশীর সঙ্গে করা গলায় কথা বলেছিল।
রাকায়েত এই ঘটনার জের ধরে তিন দিন কথা বলল না। এমনকি ঐশী আর ওদের নানুও।
মীরার কাছে এই সংসারটা অন্য কারো ছায়ায় সারাক্ষণ হাঁসফাঁস করা একটা জীবন মনে হয়।
সাবিনা যেন সারাক্ষণ ওর অদৃশ্য অস্তিত্ব নিয়ে ওর পিছু করে।
অসাবধানতাবশত মীরার হাত থেকে একটা কাঁচের ছোট বাটি পড়ে ভেঙে গেল একদিন। ঐশী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘আম্মুর সৃত্মিমাখা সব জিনিস কি তুমি না ভেঙ্গে শান্তি পাচ্ছো না?’
মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ঐশীর দিকে তাকিয়ে। সামান্য বাটির জন্যেও ঐশী এবং ওর নানু অনেক আফসোস করল।
রাকায়েত বলল, ‘তুমি এক কাজ করো সাবিনার জিনিস গুলো ব্যবহার না করে অন্য জিনিস নামাও।’
মীরা মাথা নিচু করে র‌ইলো।
যেদিন রাকায়েতের শ্বাশুড়ি টের পেলেন মীরা গর্ভবতী তিনি সকল সীমা অতিক্রম করে ফেললেন!
ঐশী মৌশীর ব্যাগ গুছিয়ে তিনি রাকায়েতের সামনে এসে হাজির হলেন।
রাকায়েত অফিসের জন্য বের হবে তখন।
তিনি রাকায়েতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রাকায়েত বাবা তুমি দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে চেয়েছো আমি তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি । কারণ আমার মনে হয়েছে তোমার এবং আমার নাতনিদের খেয়াল রাখার জন্য একজন কেউ দরকার। তুমি বললে বাজা একজন মেয়েকে বিয়ে করে আনবে তুমি। আমি বুকে পাথর চেপে তোমাকে বিয়ের অনুমতি দিলাম। আজকে দেখতে পাচ্ছি তোমার নতুন ব‌উ পোয়াতি। রাকায়েত আমি আমার নাতনি দের নিয়ে চলে যাব আমার বাড়িতে। কিন্তু সৎ মায়ের বাচ্চাদের সঙ্গে বড় হতে দিব না।’ তিনি বাড়িঘর কাঁপিয়ে আহাজারি করে উঠলেন।
রাকায়েত মাথা নিচু করে বসে রইল কতক্ষন।
‘তুমি তো বলেছিলে এই মেয়ের কখনো বাচ্চা হবে না তাহলে আজকে এই বাচ্চা আসতেছে কেমনে?’
মীরার তখন লজ্জায়, ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছা করছিল।
‘আম্মা আপনি শান্ত হয়ে বসেন প্লিজ।’
‘না রাকায়েত অনেক শান্ত হয়ে বসে ছিলাম এত দিন আর না।’
‘আমার ছেলেদের খবর দাও ওরা আসলে আমি আমার নাতনি দের নিয়ে বাড়ি চলে যাব।’
‘আম্মা আপনি এসব কি বলেন! আমার মেয়েদের বাবা এখনো জীবিত ওরা ওদের নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবে!’
‘তোমার নতুন ব‌উ এর ঘরে বাচ্চা জন্ম নিলেই তখন আর এই বাড়ি আর ওদের থাকবে না। শোন রাকায়েত আমার বয়স তো এমনি এমনি হয় নাই। আমি দুনিয়া দেখছি। আমার নিজের দেবর তার নিজের মেয়েদের ভুলে গেছে নতুন ব‌উ আর সেই ঘরের ছেলে মেয়ে পেয়ে। আমি এসব বহুত দেখেছি।’
‘আম্মা আপনি উনার সাথে আমার তুলনা দিচ্ছেন!’
‘হুম দিচ্ছি আর তো উপায় দেখতেছি না।’
রাকায়েত অনেক কষ্ট করে, অনেক অনুরোধ করে মহিলাকে শান্ত করে ঘরে পাঠাল।
সেদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরল যখন রাকায়েত মীরার শরীর টা খারাপ লাগছিল বলে মীরা ঘরে শুয়ে ছিল।
রাকায়েত কে দেখে মীরা উঠে বলল, ‘কাপড় বদলাও আমি চা নিয়ে আসি।’
মীরা ঘর থেকে বের হতে নিবে রাকায়েত মীরাকে বলল, ‘তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।’
‘চা টা নিয়ে আসি তারপর বলো।’
‘না এখুনি বলব।’
মীরা আবার খাটের উপর বসল।
রাকায়েত কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে বলে উঠলো, ‘শুক্রবার ময়মনসিংহ থেকে একজন ভালো গাইনির ডাক্তার আসে ‘।
মীরার চোখ মুখ চকচক করে উঠলো। সে ভেবেছিল রাকায়েত ওর একটা ভালো চেক‌আপ এর জন্য বলবে। এত বছর পর এই বয়সে বাচ্চা ও শুনেছে অনেক জটিলতা হয়। তারমধ্যে ও জানতেই পেরেছে চার মাস হবার পর। কিন্তু পর মুহূর্তেই রাকায়েত যা বলল শুনে ওর মাথা ঘুরে উঠলো!
‘মীরা আমি সিরিয়াল দিয়ে আসছি, শুক্রবার বাচ্চা টা নষ্ট করে ফেলব আমরা।’
মীরা উঠে দাঁড়ালো সঙ্গে সঙ্গে! সে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে রাকায়েতের দিকে!
‘এভাবে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই এই বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলা ছাড়া কোন উপায় নেই।’
‘তুমি এসব কি বলছো?’
‘যা তুমি শুনতে পাচ্ছো মীরা। আমার জীবনে জটিলতার শেষ নেই তুমি আর জটিলতা বাড়িয়ে দিও না।’
‘তোমার নিজের সন্তান তোমার জীবনের জন্য জটিলতা?’
‘হ্যা, আমার জন্য আমার মেয়েদের জন্য অনেক বড় জটিলতা। অনেক সামাজিক, পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি হবে। তার আগেই আমি সব শেষ করে দিতে চাই।’
মীরা রাকায়েতের হাত ধরে কেঁদে উঠলো। ‘আমার দিকে একবার তাকাও প্লিজ। আমি তো মা হতে চাই! একটা সন্তান আসছে তাকে খুন করতে পারব না! তোমার সন্তান, প্লিজ এমন করো না’। মীরা রাকায়েতের হাত ধরে ব্যাকুল হয়ে কান্না শুরু করলো।
রাকায়েত মীরাকে বিছানায় বসিয়ে বললো, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি মীরা আমার সিদ্ধান্ত বদল হবে না। কান্নাকাটি বন্ধ করো।’
রাকায়েত মীরার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মীরা সারারাত কাঁদল।
পরবর্তী দুই দিন মীরা অনেক ভাবেই রাকায়েত কে বোঝানোর চেষ্টা করল কোন লাভ হলো না। এমনকি রাকায়েতের শ্বাশুড়ির পায়ে ধরে কান্নাকাটি করল,’ তিনি তো মীরাকে কাছেই ঘেঁষতে দিলেন না।’
মীরার কেমন পাগল পাগল লাগছে।
আজ রাকায়েত বলল,’ আগামীকাল দুপুরে তোমার সিরিয়াল সকাল থেকে না খেয়ে থাকবে মনে থাকে যেন। ‘
মীরা শেষ বারের মত অনুরোধ করতে নেয়ার আগেই রাকায়েত বলল, ‘প্লিজ মীরা আমাকে কঠিন হতে বাধ্য করো না। আমার সংসার করতে হলে আগামীকাল তাই হবে যা আমি ঠিক করেছি।’ ‘তোমার ভাইদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারাও আমার সিদ্ধান্ত‌ই সঠিক বলেছেন তাই তুমি কোন অন্যায় আবদার নিয়ে আমাকে বিরক্ত করো না। যাও এখন রাতের খাবার রেডি করো।’

সেদিন রাতে রাকায়েত মেয়েদের সঙ্গে ঘুমাতে চলে গেল। আসলে মীরার কাছ থেকে কোন কিছু আর শুনতে চায় না সে।
রাতে মীরা চিন্তা করল, কি একটা জীবন তার! আগের সংসার টা ভেঙে গেল বাচ্চা হয় না বলে, আর এখন আবার সংসার ভাঙতে বসেছে বাচ্চা হবে বলে !
এমন পরীক্ষা জীবন একটা মেয়ের সঙ্গে নিতে পারে!
হঠাৎ মীরা শক্ত হয়ে গেল। চোখ মুছল। নিজেকে বলে উঠলো, অনেক হয়েছে কান্নাকাটি। আর না।
যে সন্তানের জন্য সে এতকাল এত কথা শুনে এসেছে। সেই সন্তান আসবে তার জীবনে সেই জন্য সে আর কারো হুমকি ধামকি শুনবে না। সে মা হবেই।

পরদিন রাকায়েতের বাড়ির কেউ মীরাকে খুঁজে পেল না। তবে মীরার একটা চিঠি বিছানার উপর পেল রাকায়েত।
সেখান ছোট্ট করে মীরা লিখেছে, ” আমাকে খোঁজার চেষ্টা না করাই ভালো। আমি কখনো এই বাড়ির কেউ ছিলাম না, তোমার স্ত্রী ও হয়তো হতে পারিনি। ছিলাম শুধু তোমার দুই মেয়ের কেয়ারটেকার। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি একজন মা হয়ে উঠেছি যাকে তুমি মেরে ফেলতে চাইছো। তাকে তোমাদের থেকে বাঁচানো আমার দ্বায়িত্ব । তাই চলে গেলাম। – মীরা ”
রাকায়েত চিঠিটা ছুড়ে ফেলে দিল মেঝেতে।

রাতেই মীরা তার বান্ধবী রোজীকে ফোন দিয়েছিল। একদিন এনজিও তে চাকরির কথা বলেছিল রোজী। আজ মীরার জীবনে চাকরি, মাথাগুজার ছাদ দুটোই দরকার।
ওর সব কথা শুনে রোজী বলল, চলে আয় কোন একটা ব্যবস্থা হবেই।
মীরা রোজীর কাছে কক্সবাজার এসে পৌছাল পরদিন।
রোজী মীরাকে তার বাসায় নিয়ে এলো বাস স্ট্যান্ড থেকে।
রোজীর বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গে মীরা প্রথমেই তার মোবাইল থেকে সীমটা খুলে ফেলে দিল। আসার সময় কয়েকবার তার দুই ভাই ফোন দিয়েছে কিন্তু মীরা ধরেনি। মোবাইল বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল।
এখন সে আর কোন পিছুটান রাখতে চায় না। সে সবার জন্য হারিয়ে গেছে আজ থেকে। এখন শুধু সে তার সন্তানের জন্য বাঁচবে। সন্তানের জন্য যা যা কষ্ট করার দরকার সে তাই করবে। কিন্তু তার সন্তানকে সে সব সুখ দিবে।
কখনো কখনো হারিয়ে যাওয়াই ভালো। যাদের জীবনে তার কোন মূল্য নেই, তাদের জন্য সে আর কোথাও নেই।
বিকেলে ছাদ থেকে দূরের সমুদ্র টার দিকে তাকিয়ে সে বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নিল। পেটে হাত দিয়ে অনুভব করল কেউ একজন তার ভেতর থেকে নড়াচড়া করে তাকে বলছে ধন্যবাদ মা তুমি আমাকে বাঁচিয়ে দিলে। আর একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি । এই পৃথিবীতে তুমি আর আমি শুধু আমাদের পরিচয়ে বাঁচব।
আমরা একসঙ্গে আমাদের যুদ্ধ টা করব। আর কারো প্রয়োজন নেই আমাদের।
মীরা নিজের ভেতর অন্যরকম একটা শক্তি অনুভব করছে। এবার আর সে হারবে না।

( সমাপ্ত )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here