কথা দিলাম পর্ব -৫২+৫৩

‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৫২||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

[বিঃ দ্রঃ কয়েকজন আছেন যাঁরা মন দিয়ে গল্পটা পড়ছেন না। আপাতত আমি একজনকে দেখেছি, সে না গল্পটা ঠিকভাবে পড়ছে তাই অর্থহীন কমেন্ট করছে, যদিও সে যা কমেন্ট করছে তার কিছুই হবে না গল্পে। গল্প গল্পর মতো চলবে। দ্বিতীয়ত সে আমি যদি কমেন্ট করে ভুল ধরিয়ে দি সেটারও রিল্পাই করছে না। এমন ব্যক্তিকে আমি নিজের পাঠক বলে মনে করি না। আর দুদিন দেখবো তারপর আমি তাঁকে আমার পেইজ থেকে ব্লক করে দেবো। এতে যে যা মনে করার করতে পারেন, সমালোচনা করার করতে পারেন।]

দুদিন পর,

দেবাংশু নিজের ফার্ম হাউজের ড্রয়িং রুমে বসে আছে। বেশ কয়েকদিন ধরে এখন সে এখানেই থাকছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে কিন্তু দেবাংশুর হুঁশ নেই। সোফায় বসে মাঝে মধ্যেই নিজের চোখ ডলছে। নেশার জন্য নয়, ঘুমের জন্য। গত কয়েকদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। চোখ বন্ধ করলেই সবকিছু চোখের সামনে ভাসছে। চোখ খোলা রেখে বা না রেখে, দেবাংশু কিছুতেই মাথা থেকে চিন্তাগুলো বার করতে পরছে না।

দেবাংশু: উফ, পাগল হয়ে যাবো মনে হচ্ছে এবার আমি। (দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে)

দেবাংশু উঠে গিয়ে বার সাইড থেকে একটা রেড হোয়াইনের বোতল এবং সিগারেট নিয়ে এলো। গ্লাসের জন্য সে কেয়ারটেকারকে ডেকে দিতে বললো এবং সিগারেটটা ধরালো। কেয়ারটেকার এসে গ্লাসটা রেখে দিয়ে, ইতস্তত করে বললো,

__জানি তুমি রাগ করবে। তাও বলছি, এভাবে কেন নিজের ক্ষতি করছো দাদাবাবু? গত কয়েকদিন ধরে ঠিকভাবে খাচ্ছো না, ঘুমাচ্ছো না। খাওয়ার মধ্যে এইসব নেশার জিনিস ছাড়া কিছুই পেটে যাচ্ছে না তোমার। একবার আয়নায় দেখেছো শরীরের, মুখের কি অবস্থা হয়েছে তোমার?

দেবাংশু: (তাচ্ছিল্য হেসে) আয়নায় নিজের মুখ দেখার মতো, নিজের চোখের চোখ রাখার মত কোনো কাজ আমি করিনি। যাই হোক, তুমি ছুটি নিয়ে নাও কদিনের জন্য। আমি এখানেই থাকবো।

__না না, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।

দেবাংশু: এটা আমার অর্ডার কাকা। তুমি দেশে ফিরে যাও। আমি শুনেছি তোমার বাড়ির লোক তোমাকে ফোন করেছিলো, অপেক্ষায় আছে তাঁরা। আমি তোমার জন্য একটা চেক লিখে দিয়েছি দেখো, এটা নিয়ে আজকেই বেরিয়ে পরো আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না।

__তাহলে তোমার দেখাশোনা কে করবে? রান্নার লোক না হয় আমি ঠিক করে দিয়ে যাবো কিন্তু…

দেবাংশু: ওতেই হয়ে যাবে। তুমি যাও এখন।

কেয়ারটেকারটি আর কোনো কথা বাড়ালো না কারণ দেবাংশুকে এখন কিছু বললেও সে শুনবে না। কেয়ারটেকার কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের জিনিস গুছিয়ে দেবাংশুকে বলে বেরিয়ে গেলো। দেবাংশু ডান হাতে হোয়াইনের গ্লাস ধরে, ওই হাতের দুই আঙুলের মাঝে সিগারেট ধরে রেখেছে। বাম হাতে রয়েছে একটা ছবি যা দেখার দরুণ দেবাংশুর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি লেগে আছে। টেবিলে আরও কয়েকটা ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেবাংশু ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ছবিটা টেবিলে রেখে পিছন দিকে মাথা এলিয়ে দিলো।

অন্যদিকে, দুর থেকে দাঁড়িয়ে কেউ একজন দেবাংশুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চুপচাপ। দেবাংশুকে এভাবে দেখে তাঁর মাথায় কিছু কথা চলতে লাগলো।

ফ্ল্যাশব্যাক…………………………….

সিয়ারা গাড়ি থেকে নেমে সোজা একটা অ্যাপার্টমেন্টের ভিতর ঢুকে গেলো। লিফট থেকে বেরিয়ে রুমের সামনে গিয়ে কলিং বেল প্রেস করতেই কিছুক্ষণের মধ্যে একজন দরজা খুললো।

সিয়ারা: দিয়া আছে? আমি ওর দিদি।

__হ্যাঁ দিদি তো ঘরে আছেন। আসুন।

সিয়ারা আর কথা না বাড়িয়ে দিয়ারার ঘর কোন দিকে জেনে এগিয়ে গেলো। ঘরে গিয়ে দেখলো দিয়ারা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। সিয়ারা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ওর মাথার কাছে বসতেই ও ধরফর করে উঠে বসলো।

দিয়ারা: দি তুই? তুই এখানে কি করছিস? কখন এলি? (চোখ মুছতে মুছতে)

সিয়ারা: (দু গালে হাত রেখে) কি অবস্থা করেছিস এটা নিজের? কেঁদে কেঁদে চোখ, মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিস কিন্তু দিদিকে একবারও কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করিসনি তাই না?

দিয়ারার ঠোঁট কাঁপতে শুরু করেছে। সিয়ারা আরেকবার ও’কে জিজ্ঞেস করতেই ও কোনো কিছু না বলে সিয়ারাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। কান্না মিশ্রিত জড়ানো গলায় বললো,

দিয়ারা: আ..আমার, আমার সব শেষ দি! স.. সব শেষ। আমি, আমি আর পারছি না দি! আমি, আমি সত্যি পারছি না। কেন, কেন করলো আমার সাথে এমন ও? কীভাবে করলো? কীভাবে?

সিয়ারা দিয়ারার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ও’কে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

সিয়ারা: কিচ্ছু শেষ হয়নি। সবটা বল আমাকে কি হয়েছে, একদম কাঁদবি না। তাকা, তাকা আমার দিকে। (দিয়ারাকে সোজা করে চোখ মুছে দিয়ে) বল, কি হয়েছে? কে কি করেছে?

দিয়ারা নিজেকে কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বললো,

দিয়ারা: আমি, আমি দেবদাকে ভালোবাসি দি।

দিয়ারা কথাটা বলেই একটা হিঁচকি তুললো আর নাক টানলো। সিয়ারা টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে দিয়ারাকে দিলো। দিয়ারা একটু অবাক হলো সিয়ারার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে।

সিয়ারা: আগে শান্ত হ। তারপর সবটা খুলে বল।

দিয়ারা: দি আমি দেবদার ব্যবহারে ভেবেছিলাম ও নিজেও আমাকে ভালোবাসে। অর্জুনের সাথে কিছুদিন আগে আমাকে দেখে ও এতো পরিমাণ রেগে গেছিলো যে আমি ও’কে সামলাতে ওর পিছু নিয়ে, ওর ফার্ম হাউজে গেছিলাম।

সিয়ারা: তারপর?

দিয়ারা: (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) সেদিন সারারাত আমার সাথে কাটানোর পরে, পরেরদিন ও আমাকে বলে যে সেসব নাকি মিস্টেক ছিলো।

দিয়ারা আবারও ফুঁপিয়ে ওঠে। সিয়ারা ওর কথা শুনে মনে মনে হিসেব মিলাতে থাকে। এই বিষয়েই দেব ও’কে বলেছিলো সেদিন। দিয়ারা আবারও বলে,

দিয়ারা: গতকাল আমি জানলাম যে এইসব ও ইচ্ছা করে করেছে দি? সবটা প্রি প্ল্যালন্ড ছিলো।

সিয়ারা: (অবাক হয়ে) কি??

দিয়ারা: হ্যাঁ। অর্জুনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলো ও যে, ওর ইউজ করা জিনিসই অর্জুন পাবে। আমাকে, আমাকে ব্যবহার করেছে দি ও, আমাকে ব্যবহার…(দিয়ারা আবারও কেঁদে উঠলো) আর আমি ভেবেছিলাম ও আমাকে ভালোবাসে।

সিয়ারা কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই বিষয়টা সম্পর্কে তো ও জানে না? তবুও দেবাংশুর অতীতের বিষয়ে জানার দরুন ও কিছুটা আন্দাজ করলো কি হতে পারে। ও নিজেকে সামলে নিয়ে দিয়ারাকে জিজ্ঞেস করলো,

সিয়ারা: কি কি বলেছিলো দেব তোকে সেদিন? শুধুই মিস্টেক বলে চলে গেছিলো নাকি আরো কিছু…

দিয়ারা: আমি নাকি খারাপ মেয়ে। আমার নাকি, আমার নাকি অনেক ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে… আমি…

দিয়ারা আর কিছু না বলে মুখে হাত চেপে কাঁদতে থাকে। এদিকে সিয়ারা নিজের চোখ বন্ধ করে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জানো সে জানে এমনই কিছু বলবে দিয়ারা।

সিয়ারা: (মনে মনে — যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে। দেব এতো বড়ো ভুল করলো কীভাবে তুলনা করে? অবশ্য ওর’ই বা কি দোষ? ও’ও তো পরিস্থিতির শিকার। ভেবেছে অতীত ওর সাথে রিপিট হচ্ছে কিন্তু একবারও এটা ভাবেনি ওর মাথায় দিয়ারার ক্ষেত্রেই কেন এই জিনিসগুলো এসেছে। আমিও বা কি বলছি, এইসব দেখার পর নিশ্চিত ওর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এদিকে দিয়া তো কিছু জানেও না। এখন..এখন কি করবো আমি? সবটা জানিয়ে দেবো? না, আগে জানতে হবে দিয়ারা কি ফীল করেছে দেবের কাছ থেকে।)

সিয়ারা চোখ খুলে নিজে চোখের জল মুছে নেয়, নিজের অজান্তেই যা কখন গাল গড়িয়ে পরেছে জানে না সিয়ারা। দিয়ারার মুখটা দু-হাতের মাঝে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

সিয়ারা: আচ্ছা দিয়া, তুই কেন সেদিন দেবকে কাছে আসতে দিয়েছিলি? দেব কি তখন বলেছিলো ও তোকে ভালোবাসে আর তারপরে…

দিয়ারা না বোধক মাথা নাড়লো যার ফলে সিয়ারা চুপ করে গেলো। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,

সিয়ারা: দেব কি জোর করেছিলো তোকে?

দিয়ারা আবারও না বোধক মাথা নাড়লো।

সিয়ারা: তাহলে তুই কেন আটকাসনি ও’কে?

দিয়ারা: কারণ আমার মনে হয়েছে ও আমাকে ভালোবাসে। ইভেন আমার এখনও সেটাই মনে হয় কারণ আমি ফীল করেছি দি! আমি ওর স্পর্শে কোনো রকম লালসা বা চাহিদা অনুভব করিনি। আমি ওর প্রত্যেকটা স্পর্শে ভালোবাসা অনুভব করেছি, ওর চোখে আমাকে হারানোর তীব্র ভয় অনুভব করেছি। আমার উপর শুধুমাত্র ওর অধিকার আছে, আমি শুধু ওর এটাই বলছিলো ও খালি। আমাকে নিজের করতে চাইছিলো ও। ওর আমাকে চাই, আমাকে প্রয়োজন ওর।

দিয়ারা জড়িয়ে ধরে দিদিকে। দিদির কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে থাকে,

দিয়ারা: আমি কিছুতেই মানতে পারছি না দি যে দেবদা আমায় ভালোবাসে না। আমার জন্য ওর কোনো ফীলিংস নেই। এসব প্রি প্ল্যান, চ্যালেঞ্জের জন্য এমন করেছে। আমি কিছুতেই পারছি না মানতে! আমার খালি মনে হচ্ছে হয়তো এমন কিছু আছে যেটার জন্য ও এমন করছে। ও কিছুতেই এমন করতে পারে না আমার সাথে। আমি প্রথম থেকেই অনুভব করেছি আমার উপর ওর অধিকার বোধ, আমাকে নিয়ে ওর চিন্তা, আমাকে সব খারাপ কিছুর থেকে আগলে রাখা। এসব আমাকে অনুভব করিয়েছে ও,ও আমাকে ভালোবাসে।

দিয়ারা অঝোরে কাঁদতে শুরু করলে সিয়ারা আর সহ্য করতে পারে না। দিয়ারাকে সোজা করে বলে,

সিয়ারা: তুই ঠিকই ধরেছিস দিয়া। দেব এসব শুধু শুধু করেনি, পরিস্থিতির শিকার হয়ে করেছে যার জন্য ও নিজেও পস্তাচ্ছে। সবথেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। আমি মানিনা দেব কোনো মেয়েকে নিয়ে এমন চ্যালেঞ্জ করতে পারে। অসম্ভব!

দিয়ারা: তুই, তুই জানিস ও কেন করেছে?

সিয়ারা: আন্দাজ করতে পারছি। এমন অনেক কিছু আছে দেবের জীবনে যা জানাটা তোর দরকার। সব জানার পর তুইও বুঝতে পারবি দেব কেন করেছে এসব।

দিয়ারা: আমাকে বল না দি, কেন করেছে ও এমন? বল না?

সিয়ারা: আমি পারবো না দিয়া। এটা দেবের জীবনের এমন একটা অধ্যায় যা দুজন ছাড়া কেউ জানে না। আভিও না। আমি পারবো না এটা তোকে জানাতে। দেব যদি তোকে ভালোবেসে থাকে তাহলে ও নিজে তোকে সবটা বলবে। কথা বল ওর সাথে।

দিয়ারা: না দি, আমি যাবো না ওর সাথে কথা বলতে। আমার আত্মসম্মান বোধে আঘাত করেছে ও। আমি কিছুতেই ওর সাথে কথা বলতে যাবো না।

সিয়ারা মাথা নিচু করে নিলো দিয়ারার কথা শুনে। দিয়ারা কথাগুলো অন্যদিকে তাকিয়ে বলেছে। বলতে বলতে চোখ দিয়ে আবারও জল গড়াচ্ছে ওর।

সিয়ারা: পরিস্থিতিটাই এমন যে না আমি তোকে দোষ দিতে পারছি আর না দেবকে। সবটা জানার পরেও যদি আমি দেবকে দোষ দি তাহলে সেটা আমার অন্যায় হবে। তবে আমি বলবো না যে ও কোনো ভুল করেনি। নিজের অনুভূতি না বুঝে ও ভুল করেছে। তবে যে ছেলেটা কখনও কাওকে ভালোবাসেনি সে কীভাবে এতো সহজে অনুভূতি বুঝবে? তোকে ভালোবাসে দেখেই তোকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে, তোকে অন্যকাওর সাথে সহ্য করতে না পেরে অত কিছু বলেছে। সাথে অতীত তো আছেই। এটাই ওর তোকে সঙ্গে সঙ্গে বলা উচিত ছিলো কিন্তু নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে এখন ও তোর সামনেই আস্তে চাইছে না। আমি, আমি, আমি আর কিছু বলছি না তোকে। তোর যেটা ভালো মনে হয় সেটাই কর।

সিয়ারা উঠে দরজার কাছে চলে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে দিয়ারার দিকে তাকিয়ে বলে,

সিয়ারা: একটা জিনিস ভেবে দেখিস দিয়া, যদি ভালোই না বা তাহলে কি অনুতাপ করতো? যদি অপমান, অসন্মান করারই হতো তাহলে কি সেটা আগে করতে পারতো না? অর্জুনের ক্ষেত্রেই কেন এতটা প্রতিক্রিয়া দেখালো? এসবই কি কাকতালীয়?

সিয়ারা চলে যায় ওখান থেকে কিন্তু ওর বলা কথাগুলো দিয়ারার মনে ঝড় সৃষ্টি করে। দেবাংশুকে দোষ দেওয়া যায় না? কেন? এমন কেন বললো তাঁর দিদি? সে তো কখনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না তাহলে?

ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড……………………………

দিয়ারা চোখ খুললো এবং নিজের চোখের জল মুছে নিলো। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো দেবাংশুর দিকে। দেবাংশু চুপ করে শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। দিয়ারা লক্ষ্য করে হাতে থাকা গ্লাস আর সিগারেটের দিকে। এরপর ওর চোখ যায় দেবাংশুর মুখের দিকে। চোখের তলায় কালি পরে গেছে, মুখটাও শুকিয়ে গেছে। কপালের দু পাশের শিরা ফুলে উঠে, দপদপ করছে যা দেখে বুঝলো দেবাংশুর মাথা যন্ত্রণা করছে।

নিজের অজান্তেই দিয়ারা দেবাংশুর পাশে বসে ওর কপালে হাত দিলো। দুই আঙুল দিয়ে কপালটা টিপে দিতে শুরু করার সাথে সাথেই দেবাংশুর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে যা লক্ষ্য করে দিয়ারার ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু নিমিষে দেবাংশুর ঠোঁট থেকে হাসি গায়েব হয়ে গিয়ে চোখ খুলে ফেলে সোজা হয়ে বসে।

দেবাংশু: দিয়া তুই? তুই এখানে?

দিয়ারার হুঁশ আসে সে কি করছিলো। নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে ইতস্তত বোধ করতে লাগলে দেবাংশু কিছু একটা মনে করে তাচ্ছিল্য হাসে।

দেবাংশু: তোর বয়ফ্রেন্ডের সাথে আলাপ করাতে নিয়ে এসেছিস বুঝি?

দিয়ারা: নাহ, বরকে আলাপ করাতে নিয়ে এসেছি। (দাঁতে দাঁত চেপে)

দিয়ারার কথা শুনে দেবাংশুর মুখটা চুপসে গেলেও ওর কথা শুনে দিয়ারার সারা শরীরে আগুন জ্বলে গেছে। দিয়ারার মন তো চাইছে টেনে দুটো চড় বসিয়ে দিতে কিন্তু নিজেকে সংযত করল সে। দেবাংশু উঠে দাঁড়িয়ে নিজের গ্লাসের ড্রিংকটা শেষ করে সিগারেটে টান দিয়ে বললো,

দেবাংশু: আমি তৈরী, নিয়ে আয়। তবে নিজের বরকে সুস্থ ভাবে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবি কি না সেটা বলতে পারছি না।

দিয়ারা সাথে সাথে দেবাংশুকে ঘুরিয়ে ওর কলার চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে আনে। চোখে চোখ রেখে, দাঁতে দাঁত চিপে জিজ্ঞেস করে,

দিয়ারা: আমি এখানে তোমার থেকে আমার প্রশ্নের উত্তর নিতে এসেছি। কেন করেছো আমার সাথে নাটক?

দিয়ারার কথাটায় দেবাংশুর চোখে জল চলে এলো যার দরুন ও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই চোখ নামিয়ে নিলো যেটা দিয়ারার চোখ আড়াল হলো না।

দিয়ারা: কি হলো? চুপ করে আছো কেন? কে অধিকার দিয়েছে তোমাকে আমার সাথে নাটক করার? আমাকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ করার? কে দিয়েছে বলো? (জোর দিয়ে)

দেবাংশু: ন..নাটক করিনি। (মাথা নিচু করেই)

দিয়ারা পারছে না নিজেকে শক্ত রাখতে। সে দেবাংশুর সামনে নরম হয়ে পরছে। যেটা দূরে থাকতেই মনে হচ্ছিলো সেটা আরো বেশি করে এখন মনে হচ্ছে সামনে থেকে। সত্যি এই ছেলেটা তাঁকে ভালোবাসে না? এটা হতে পারে? এইটা ভেবেই দিয়ারা সোজা সাপটা জিজ্ঞেস করে বসলো,

দিয়ারা: আমাকে ভালোবাসো তুমি?

দেবাংশু ঝট করে একবার তাকিয়েই আবার মাথা নিচু করে নিলে দিয়ারা দু হাত দিয়ে কলারটা ঝাঁকিয়ে বললো,

দিয়ারা: ভালোবাসো আমাকে?

দেবাংশু না বোধক মাথা নাড়ে। এর ফলে দিয়ারার হাত আলগা হয়ে যায় তবুও নিজেকে শক্ত রাখে ও। শক্ত করে কলারটা আবার চেপে ধরে বলে,

দিয়ারা: তাহলে নাটক তাই তো?

দেবাংশু: (চোখের দিকে তাকিয়ে জোর দিয়ে) নাটক নয়! আমি, আমি ভালোবাসতে জানি না। আমি শুধু কষ্ট দিতেই পারি। আমি তোকে, তোকে ভালোবাসি না। ভালোবাসার মানুষকে কি কেউ অসন্মান, অপমান করতে পারে? আমি ভালোবাসি না তোকে, ভালোবাসি না। ভালোবাসলে তোকে অসন্মান, অপমান করতে পারতাম না।

দিয়ারার চোখে জল চলে এলো দেবাংশুর কথায়। সত্যি ছেলেটা অনুতপ্ত। দিয়ারা নরম গলায় বললো,

দিয়ারা: আর না ভালোবাসলে অনুতাপ করতে না। কষ্ট পেতে না এভাবে আমার কথা ভেবে। ভালো যখন বাসোই না তখন এতো কেন যায় আসছে তোমার? কেন মুখ দেখতে পারছো না নিজের? শুধু একটা মেয়েকে অসন্মান করেছো বলে নাকি আমি কষ্ট পেয়েছি দেখে? আমাকে হারিয়ে ফেলেছো দেখে?

দেবাংশু দিয়ারার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে অন্যদিকে ফিরে ঘন ঘন নিশ্বাস নিয়ে শুরু করে। সে চায় না দুর্বল হতে দিয়ারার কাছে। দিয়ারা আবারও দেবাংশুকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,

দিয়ারা: আগেও বুঝি যেই মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করতে তাঁদের সাথে এমন বিহেভ করেছো? তাঁদের দিকে কেউ খারাপ দৃষ্টিতে দেখলে তোমার খারাপ লাগতো? তাঁদের মুখে অন্য কোনো ছেলের কথা শুনলে রাগ হতো? নাকি তাঁদেরকে অন্য কোনো ছেলের কাছাকাছি যেতে দেখলে সহ্য করতে না পেরে যা নয় তাই বলে দিতে রাগের বশে?

দেবাংশু: না না না! আমি কখনও কোনো মেয়ের সাথে এমন করিনি! আমার কোনো যায় আসেনি কোন মেয়ে কি করছে না করছে! কেন আসবে? কেউ হয় না ওরা আমার।

দিয়ারা: তাহলে আমার বেলা কেন যায় আসছে? কে হই আমি?

দেবাংশু দিয়ারার প্রশ্ন শুনে ওর দিকে তাকালো ঠিকই কিন্তু কোনো উত্তর দিতে পারলো না। মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে।

দিয়ারা: তুমি যা বলেছো ভুল বলেছো। কিন্তু তুমি কি ইচ্ছা করে কিছু করেছো? আমরা যখন রেগে যাই তখন সেই মুহুর্তে মাথায় যেটা চলে আমরা সেটাই বলি। নিয়ন্ত্রণ থাকে না তাতে আমাদের উপর। তবে যদি সেটা ভালোবাসার মানুষ হয়ে থাকে তখন আমাদের মাথায় একবার হলেও আসে আমরা কি বলছি। কিন্তু তোমার মাথায় তো এটাই চলছিলো যে তুমি আমাকে হারিয়ে ফেলছো, আমার উপর অন্যকাওর অধিকার আছে। অন্য কেউ আমাকে স্পর্শ করতে পারছে তুমি ছাড়াও। এইটা কোন মানুষ মেনে নিতে পারবে নিজের ভালোবাসার মানুষের ক্ষেত্রে? যদি তুমি জানতে পারতে যে কেন আমি কাজগুলো করেছি তাহলে কি এই একই কথা আমাকে বলতে পারতে? তোমার কাছে বিষয়গুলো ক্লিয়ার ছিলো না আর হয়তো কোনো কিছুর সাথে রিলেটেডও ছিলো?

দেবাংশু চমকে উঠে দিয়ারার দিকে তাকায় আর দু পা পিছিয়ে যায়। চোখের সামনে নিজের অতীতটা আবারও ভেসে ওঠে আর দেবাংশুর চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। দিয়ারা নরম ভাবেই দেবাংশুর হাত ধরতে গেলে দেবাংশু হাত তুলে বলে,

দেবাংশু: আমি তোকে ভালোবাসি না। তুই চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে, আমার সাথে থাকলে তুই শুধু কষ্টই পাবি। চলে যা।

দিয়ারা: একবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো না? (দেবাংশুর মুখটা দু হাতের মাঝে নিয়ে)

দেবাংশু: বাসি না। আমি তোকে ভালো… বাসি না।

দিয়ারার হাতটা আলগা হয়ে নীচে নেমে এলো। চোখ থেকে টপ টপ করে জল গড়াচ্ছে এইবার। দিয়ারা পিছিয়ে গেলে দেবাংশুও মুখ নামিয়ে চোখের জল আড়াল করে নেয়। দিয়ারা নিজের কান্না গিলে নিয়ে বলে,

দিয়ারা: আমারই ভুল এত কিছুর পরেও তোমার কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসা। এত কিছুর পরেও আমার এটাই মনে হচ্ছিলো যে না তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমারই ভুল! আমারই দোষ! ঠিক আছে, আর কখনও তুমি আমাকে নিজের চোখের সামনে দেখতে পাবে না। আমি আর কখনও তোমার সামনে আসবো না। কখনও না।

দিয়ারা নিজের চোখের জল মুছে সমানে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে ওর। কিন্তু কোনো মতে নিজেকে সামলে একবার মাথাটা হালকা পাশ ফিরিয়ে আড় চোখে দেবাংশুকে সে দেখলো। একভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেবাংশু, নীচের দিকে তাকিয়ে নিজের হাত মুঠো করে। দিয়ারা আর ভাবলো না, কারণ সে যে আশার আলো নিয়ে এসেছিলো তা হয়তো সম্পুর্ণ রূপে নিভে গেলো। বলা ভালো নিভিয়ে দিলো দেবাংশু। নিজের চোখের জলটা মুছে নিয়ে ধীর পায়ে এগোতে লাগলো। কিন্তু আচমকাই দিয়ারার পা থেমে গেলো একটা কাচ ভাঙার আওয়াজে। দিয়ারা ভয় পেয়ে চমকে ওঠে। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর পিছন ফিরতে যাবে তার আগেই একটা হাত ওর কোমরে জড়িয়ে যায় এবং আরেকটা হাত ওর কাঁধ। মানুষটার কাঁপা কাঁপা নিশ্বাস নিজের ঘাড়ে অনুভব করতে পারে দিয়ারা। একটা অজানা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে আসে দিয়ারার মাঝ থেকে।

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]’ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৫৩||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

দেবাংশু: যাস না দিয়ু, যাস না প্লিজ। এতটা অসহায় নিজেকে আগে কখনও মনে হয়নি আমার। যতটা তোর চলে যাওয়ায় মনে হচ্ছে। তোর এক একটা স্টেপ আমার কাছে এক এক মাইল মনে হচ্ছে। যাস না আমায় ছেড়ে। আজ এত ভুল করেছি একটা বিষয় ভেবেই যে তুই দূরে চলে যাবি, তোকে হারিয়ে ফেলবো। এখন সেই বিষয়টাই তুই সত্যি করে দিস না। আমি বাঁচতে পারছি না, প্রত্যেকটা মুহুর্ত নরকযন্ত্রণার সমান লাগছে। শেষ হয়ে যাচ্ছি ভিতরে ভিতরে ওই কথাটা ভেবে, তোকে কষ্ট দিয়েছি সেটা ভেবে। ভেবে ভেবেই বাঁচতে পারছি না, সত্যি হয়ে গেলে হয়তো মরেই যা…

দিয়ারা দেবাংশুর হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে তৎক্ষণাৎ ঘুরে দেবাংশুর কথা বন্ধ করলো নিজের হাতের দ্বারা। দিয়ারা বিশ্বাস করতে পারছে না ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কাঁদছে। কিছুক্ষণ দেবাংশুর ভেজা মুখটা দেখে নিয়ে দিয়ারা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো দেবাংশুকে। এইবার হয়তো দেবাংশুর একটু শান্তি লাগছে, স্বস্তিবোধ করছে। দিয়ারার কাঁধে দেবাংশু মাথা ঠেকিয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিতেই দিয়ারা দেবাংশুর পিঠে হাত ওঠা নামা করতে করতে ধীরে ধীরে ওর কানের কাছে বললো,

দিয়ারা: আমি যাচ্ছি না কোথাও তোমাকে ছেড়ে, যাচ্ছি না। তুমি যেসব ভাবছো, ভয় পাচ্ছো ভেবে সেসব কখনও সত্যি হবে না, কখনও না।

দিয়ারা কথা শেষ করে চোখ বুঁজে নিতেই দেবাংশু হালকা কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে। দেবাংশুকে বাচ্চাদের মতো ফুঁপাতে দেখে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয় দিয়ারার। মনে হয়, আরেকটু আগে আসলে দেবাংশুরও কষ্ট কম হতো সাথে ওর নিজেরও। ঠিক আছে, দেরী হয়েছে তো কি হয়েছে, এখন একবার এসে যখন পরেছে তখন সব ঘটনা জেনেই এখান থেকে যাবে। সবটা জলের মতো পরিষ্কার না হলে দিয়ারা হাল ছাড়বে না।

পরিস্থিতি একটু শান্ত হতেই দিয়ারা দেবাংশুর থেকে দূরে সরে এসে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দেয়। দিয়ারা সোফায় বসতেই দিয়ারাকে অবাক করে দিয়ে দেবাংশু ওর কোলে মাথা রেখে, দিয়ারার এক হাত নিজের হাতের মাঝে শক্ত করে ধরে শুয়ে পরে। দিয়ারা হালকা হেসে ওপর হাত দেবাংশুর চুলের মধ্যে রাখলে দেবাংশু দিয়ারার হাতটা নিজের মুখের সামনে এসে ঠোঁট ছোঁয়ায়।

দেবাংশু: আমি জানি না কখন কীভাবে তোকে নিয়ে এতটা ভাবতে শুরু করেছি। তোকে নিয়ে ফীল করতে শুরু করেছি। আমি শুধু এটাই জানি তোর সাথে প্রথমবার দেখা হওয়ার পর থেকেই আমার কিছু একটা হয়ে গেছে। প্রথমদিন তোকে দেখার পর থেকেই তোকে অন্য কোনো ছেলের সাথে আমি মেনে নিতে পারছি না। আমার সহ্যই হচ্ছে না। বিশ্বাস কর, আমি কোনো নাটক করিনি। না করেছি চ্যালেঞ্জের জন্য। সেদিন আমার মাথায় এতো কিছু চলছিলো যে..একের পর এক ঘটনা আমাকে ভাবার সময় তো দেয়ইনি বরং আমাকে পাজেলড করে দিয়েছে।

দিয়ারা: প্রথমদিন বলতে তো সেই পার্টিটা তাই না? কি হয়েছিলো সেদিন?

দেবাংশু: (অন্যদিকে রেগে মুখ ফিরিয়ে) তুই ওই অর্জুনের সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলি। ও তোকে টাচও করেছিলো, তারপর তুইও চলে গেলি ওর সাথে কোন একটা ঘরে।

কথাগুলো বলার সময় দেবাংশুর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। দিয়ারা বুঝতে পারে ঘটনাটা মনে করেই দেবাংশু আবারও রেগে যাচ্ছে। হালকা হেসে বলে,

দিয়ারা: তুমি শুধু শুধু রাগ করছো। তুমি যেমনটা ভাবছো তেমন কিছুই হয়নি। আমি অর্জুনের সাথে ঘরে গেছিলাম কিন্তু সেখানে আভাস আংকেল ছিলেন। উনিই আমাকে বলেছিলেন অর্জুনকে নিয়ে আসতে।

দেবাংশু: তো তোকে টাচ কেন করবে? হাউ ডেয়ার হি? তুই কিছু বললিও না? তোর প্রিয় অর্জুন চ্যাটার্জী বলে কথা তাই না? হাগ করলো এসে আর তুইও সেটা করতে দিলি। ডিসগাস্টিং!

দিয়ারা: আব, তখন তো আমি তোমাকে নিয়ে তেমন কিছু ভাবিনি দেবদা। আর এটা তো সত্যি যে আমি অর্জুনকে পছন্দ করি…. ন..না মানে..মানে…

দেবাংশু দিয়ারার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে বসলে দিয়ারা ঘাবড়ে যায়। নিজের চোয়াল শক্ত করে দিয়ারার দিকে তাকিয়ে থাকলে দিয়ারা দেবাংশুর কাছে এগিয়ে যায়। দেবাংশু একদম শান্ত ভাবে দিয়ারার দিকে তাকিয়ে আছে তাই দিয়ারা জানো আরো বেশি নার্ভাস হয়ে গেছে, কি বলবে গুলিয়ে ফেলছে।

দিয়ারা: আমি বলতে চাইছিলাম যে, মডেলিংয়ে আসার পর থেকেই অর্জুন চ্যাটার্জীর সাথে কাজ করাটা আমার ইচ্ছা ছিলো। তো ও…

দেবাংশু: ও?

দিয়ারা: মানে উনি..(মনে মনে — উফ ভগবান, কার পাল্লায় পরেছি!) উনি যখন নিজে আমার কাছে এসে প্রপোজাল দিলেন…

দেবাংশু: কিসের প্রপোজাল? কিসের প্রপোজাল দিয়েছে তোকে? (উত্তেজিত হয়ে)

দিয়ারা: কাজের আবার কিসের? উফ! (দেবাংশুর মাথাটা একটু ঠেলে দিয়ে) মডেলিংয়ে থাকা বেশিরভাগ মেয়ের ইচ্ছা অর্জুন চ্যাটার্জীর সাথে কাজ করার। সেখানে উনি নিজে যেচে আমাকে সুযোগ দিয়েছেন তাই আমি এক্সসাইটেড হয়েই হাগ করেছিলাম। তো তুমি যদি তোমার ফেভারিট পারসনের সাথে এমন সুযোগ পাও তুমি এক্সসাইটেড হবে না?

দেবাংশু: এক্সাইটমেন্ট মাই ফুট! (অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে)

দিয়ারা হাসে তবে শব্দ হয় না। কেউ ও’কে নিয়ে এতটা পজেসিভ এটা ভাবতেই অবাক লাগছে দিয়ারার। কিন্তু দেবাংশু তো এরকম নয়? মানে এতটা পজেসিভ যে ইন্ডাস্ট্রির মানুষ হয়েও এইসবে রাগ করবে? দিয়ারার কিছু মনে পরে গেলো তাই ও কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললো,

দিয়ারা: আর? আর কি নিয়ে রাগ ছিলো তোমার। শুনি!

দেবাংশু: সেদিন ক্লাবে কেন গেলি অর্জুনের সাথে? আমার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললি যখন বললাম আমার সাথে থাকিসনি কেন। খুব ভুল বলেছিলাম আমি? (দিয়ারার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে মুখ সামনে ফিরিয়ে নিলো)

দিয়ারা: (দেবাংশুর কাঁধে মাথা রেখে) আসলে সেইসময় আমি নিজের অনুভূতিগুলো বোঝার পর তোমার অনুভূতি কি আমাকে নিয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। বুঝতে পারছিলাম যে আমি যেমন অনুভব করি তুমিও হয়তো তাই কিন্তু সিওর হতে পারছিলাম না। সেই জন্যেই ওই প্রশ্নটা করেছিলাম যাতে তুমি আমাকে বলো তুমি কি অনুভব করো আমার জন্য। আর আমার এই ট্রিকটা কাজেও লেগেছে, তাই না?

দেবাংশু দিয়ারার দিকে তাকালে দেখে দিয়ারাও মাথা উঠিয়ে ওর দিকে তাকালো। দুজনের চোখ একে অপরের সাথে আবদ্ধ হতেই সেদিন রাতের কথা দুজনের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ধীরে ধীরে একে অপরের দিকে এগোতে এগোতে দুজনের দূরত্ব প্রায় যখন মুছে গেছে সেইসময়ই দেবাংশুর দিয়ারাকে বলা নিজের তিক্ত কথাগুলো মনে পরে যায়। মুহুর্তের মধ্যে সরিয়ে আনে নিজেকে সে।

দেবাংশু: তুই কীভাবে আমাকে ক্ষমা করতে পারছিস? আমি নিজেই যেখানে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না? আমি যেই কথাগুলো তোকে বলেছি সেসবের পর কীভাবে…

দিয়ারা: আমি ক্ষমা করতে পেরেছি কারণ আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। সেদিন রাতে আমি তোমার অনুভূতিগুলো বুঝে নিয়েছি। তুমি হয়তো এখনও…

দেবাংশু: আই লাভ ইউ!

দিয়ারা দেবাংশুর চোখের দিকে তাকালে দেবাংশু দিয়ারার হাতটা নিজের হাতের মাঝে শক্ত করে ধরে তাতে ঠোঁট ছোঁয়ায় এবং দিয়ারার চোখে চোখ রাখে। বলে,

দেবাংশু: আই লাভ ইউ সো মাচ দিয়ু। আমি হয়তো বলে বোঝাতে পারবো না আমি তোকে কতটা ভালোবাসি। আমি যা বলেছি তারপর আমার বলার মুখও নেই কিন্তু বিশ্বাস কর আমি সেদিনের বিষয়টাকে মিসটেক বলতে চাইনি। আমার মাথা কাজ করছিলো না, আমি ভেবে নিয়েছিলাম তুই হয়তো বিষয়টার জন্য আমাকে ভুল বুঝবি। আমার থেকে দূরে চলে যাবি তাই আমি বলে ফেলেছিলাম। আমার মাথায় এটাই ঘুরছিল যে তুই লিখেছিলিস তুই এই রাতের কথা কখনও ভুলতে পারবি না। তোর সাথে কথা বলার সময় যখন তুই এড়িয়ে যাচ্ছিলিস তখন তো আরো বেশি করে মনে হচ্ছিলো যে আমি হয়তো তোকে হারিয়ে ফেললাম। কিন্তু যখন তুই আমাকে বললি যে তুই ভেবেছিলো আমি তোকে ভালোবাসি তখন আমি বুঝলাম যে তুই সেটা পজিটিভলি বলেছিলিস। এছাড়া আর কোনো কারণ ছিলো না ওরকম বলার। ওই রাতটা কখনও আমার কাছে মিসটেক হতে পারে না, যেই রাতে তোকে আমি ফীল করেছিলাম। আমার বুকের মাঝে তুই থাকায় সবচাইতে বেশি রিলিফ ফীল করেছিলাম এটা ভেবে যে তুই আমার, শুধু আমার।

দিয়ারা লজ্জায় মুখ গুঁজে দেয় দেবাংশুর বুকে। দেবাংশু দিয়ারাকে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় ঠোঁট ছোঁয়ায়। দিয়ারা দেবাংশুর বুক থেকে উঠে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

দিয়ারা: আমি মনে করি তুমি ওই সময় যা যা বলেছিলে সেইগুলোর পিছনে কারণ আছে। তুমি এভাবে কোনো মেয়েকে অসন্মান করতে পারোই না। তুমি যদি ভেবে থাকো ওইসব কথার জন্য নিজেকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিলে আমি ভালো থাকবো তাহলে ভুল ভাবছো। দূরে সরে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না দেবদা। এতে আমি আরও বেশি কষ্ট পাবো কারণ আমার মনে হবে তুমি ইচ্ছা করেই অমন করেছিলে।

দেবাংশু: না জান, আমি ইচ্ছা করে করিনি। সত্যি কারণ ছিলো। আমার সামনে ঘটা ঘটনাগুলো এমনভাবে আমাকে আমার অতীতটা মনে করে দিয়েছিলো যে…যে আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মধ্যা কথা তোকে ভালোবাসি, নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসি দেখেই অন্য একজনের সাথে তোকে মেনে নিতে পারিনি। আমার চোখের সামনেই তুই অন্যকাওর হয়ে যাবি, আমি ব্যতীত তোকে অন্য কেউ স্পর্শ করবে, সেটা মেনে নিতে পারিনি।

দিয়ারা দেবাংশুর কোমর নিজের দুহাতে পাশ থেকেই জড়িয়ে ধরে এবং গালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।

দিয়ারা: আচ্ছা? আমাকে অন্য ছেলের কাছাকাছি মেনে নিতে পারোনি, কিন্তু এমন কেন মনে হলো যে আমার একটা না অনেক ছেলে লাগে? অন্য ছেলেদের সাথে আমি সময় কাটাই? এমন কিছু তো তুমি দেখনি, শুধুমাত্র তো অর্জুনের সাথেই দেখেছিলে তাহলে অন্য “ছেলেদের” কেন বললে? এটা কি আমাকে বলতে চেয়েছিলে নাকি অন্য কাওকে দেবদা?

দেবাংশু মুখ ফিরিয়ে নিলে অন্যদিকে। ওর নিশ্বাস ঘন হতে শুরু করেছে। দিয়ারা বুঝতে পেরেছে সে সঠিক জায়গায় তীরটা মেরেছে।

দিয়ারা: এটা তোমার অতীতের প্রভাব ছিলো তাই না? আমাকে কি বলা যায় না কি এমন হয়েছিলো তোমার অতীতে যার জন্য তুমি এতটা এফেক্টেটেড? আমার কি অধিকার নেই সে সম্পর্কে জানার?

দেবাংশু: (চোখ বন্ধ করে ঢোঁক গিলে) আমি মনে করতে চাইনা সেসব।

দিয়ারা: মনে যদি না’ই করতে তাহলে এসব হতো না। এতটা কষ্ট পেতে না তুমি। আমাকে ওসব বলে নিজেই সব থেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছো তুমি যার কারণে আরেকটা ভুল করতে যাচ্ছিলে। আমার থেকে দূরে সরে যেতে চাইছিলে যাতে তোমার কষ্ট তো মিটতই না আরো বেড়ে যেতো।

দেবাংশু: (সামান্য হেসে) এতো বুঝিস কীভাবে আমাকে?

দিয়ারা: ভালোবাসি তাই! আর সবথেকে বড়ো কথা রাগের মাথায় আমাদের নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সেখানে প্রসঙ্গ যদি আসে ভালোবাসার মানুষকে অন্য কাওর সাথে দেখার তখন তো ছেড়েই দাও।

দেবাংশু দিয়ারাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখলো। দিয়ারা বুঝতে পারলো সবটা বলার জন্য হয়তো দেবাংশু নিজেকে প্রস্তুত করছে। তাই ওর চুলে বিলি কাটতে লাগলো দিয়ারা। একটু সময় পর দেবাংশু উঠে সোজা হয়ে বসলো এবং একটা নিশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,

দেবাংশু: আমার তখন আট বছর মতো বয়স। আমি লন্ডন থেকে ছুটিতে বাড়ি এসেছি। বাড়ি আসার জন্য ছটফট করছিলাম একজনের জন্য। বাড়িতে এসেই কোনো মতে জুতো খুলে সেই মানুষটার উদ্দ্যেশ্যে ছুটে গেছিলাম কিন্তু…

দেবাংশু পারছে না কথা বলতে। চোখ বুজলেই যখন সেই দৃশ্যটা ভাবছে তখন সে আর কিছু বলতে পারছে না।

দেবাংশু: কিন্তু ঘরে গিয়ে দেখলাম আমার…মা একটা অন্য পুরুষ মানুষ যাকে আমি চিনি না তার সাথে ঘনিষ্ট অবস্থায়।

দিয়ারা আঁতকে উঠে দেবাংশুর হাত চেপে ধরলো। সে ভাবেনি দেবাংশু এমন কিছু বলবে। এখনই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আগে আর কি কি শুনতে হবে এটা ভেবেই নিজেকে প্রস্তুত করছে দিয়ারা।

দেবাংশু: আমি চুপচাপ দরজা চাপিয়ে সরে আসি। ওরা নিজেদের মধ্যে এতটাই ব্যস্ত ছিলো যে আমাকে লক্ষ্য করেনি। ছোটো ছিলাম, অত কিছু বুঝিনি। আর এটা প্রথমবার ছিলো না, আর আগেও যখন আমি একদম ছোট ছিলাম তখনও একই দৃশ্য দেখেছিলাম। আমার মা নামক মানুষটা যখন শুধু অজুহাত দিতো কাজে যাওয়ার তখন দেখেছিলাম।

দিয়ারা: মানে? কাজে যাওয়ার অজুহাত দিতেন মানে?

দেবাংশু: মানে এটাই যে আমার মায়ের কাছে আমার জন্য কখনও সময় ছিলো না। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি কখনও আমার মাকে আমার কাছে পেয়েছি বলে আমার মনে পরে না। একটু বড়ো হয়ে শুনেছিলাম আমার মা বলেছিল তাঁর সময় নেই, কাজ আছে তাঁর। পেশায় একজন মডেল ছিলেন কি না।

দিয়ারা: তোমার মা, তোমার মা একজন মডেল ছিলেন?

দেবাংশু: হ্যাঁ। আমি খেলতে গেছিলাম, ফিরে এসে দেখেছিলাম আমার মা তাঁর কাজে ব্যস্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেটা মডেলিং বিষয়ক কিছু ছিলো না। (তাচ্ছিল্য হেসে) আমি এসে পরায় ওদের কাজে বাঁধা পরেছিলো দেখে, আমাকে দুটো চড় মেরেছিলো। ব..বলেছিলো আমার জন্য নাকি মায়ের অনেক সমস্যা। আসলে আমিই একটা সমস্যা মায়ের জন্য। (একটু থেমে) আমি জানো ড্যাডকে কিছু না বলি। কতই বা বয়স তখন আমার? ৪ বা ৫ বছর। তবুও কথাগুলো কেন জানো অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে। আসলে আমাকে মারার পর কথাগুলো বলেছিল তাই হয়তো কথাগুলো মনে থেকে গেছিলো আর বড়ো হয়ে মানে বুঝেছিলাম যখন তখন আর মুছতেই পারিনি কথাগুলো মন থেকে।

দিয়ারা: তারপর? তুমি বলনি তোমার ড্যাডকে?(ভেজা গলায়)

দেবাংশু: না। মা ভয় দেখিয়েছিল আমার থেকে এতো দূরে চলে যাবে যে আমি কখনও মাকে দেখতে পাবো না যদি বলে দি। সেই ভয়ে আর বলিনি। তারপর আমাকে বোর্ডিং পাঠিয়ে দেয় মা। এরপর যখন বাড়ি ফিরতাম মা থাকতো না বেশিরভাগ সময়। আর যখন থাকতো তখনও তেমন কথা বলত না। দ্বিতীয়বার যখন অমন দেখলাম, তারপরে একটু চুপচাপ হয়ে গেছিলাম কারণ কিছুটা হলেও তখন বুঝি। এরপরেই একদিন আমরা তিনজন পার্টিতে গেছিলাম। সেই পার্টিতে আমি হঠাতই দেখলাম আমার সাথে কথা বলতে বলতেই ড্যাডকে রেগে যেতে। ড্যাডের তাকানো অনুসরণ করে তাকাতেই দেখলাম যে মা অন্য একটা লোকের সাথে ক্লোজ হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে এবং তারপরে দুজন দুজনকে হাগ করে একটা ঘরের দিকে চলে যেতে।

দেবাংশু থামে। চোখ বন্ধু করতেই যেই দৃশ্যটা ভেসে আসে তার মাঝেই দিয়ারা বলে ওঠে,

দিয়ারা: ঠিক যেভাবে আমাকে আর অর্জুনকে দেখেছিলে?

দেবাংশু: (হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে) সেদিন রাতে মায়ের সাথে ড্যাডের অনেক ঝামেলা হয়। মাকে কখনও আমি দেখিনি ড্যাডের সাথে ভালো ভাবে কথা বলতে, কখনও না। ড্যাড বাদে যেকোনো ছেলের সাথে ভালো ভাবে কথা বলতো বাট ড্যাডের ক্ষেত্রে? শুধু এড়িয়ে যাওয়া।

দিয়ারা: তোমারও এইজন্য রাগ হতো আমি তোমার সাথে কথা বলতাম না দেখে? এড়িয়ে যেতাম দেখে তোমায়?

দেবাংশু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। দিয়ারা মনে মনে ভাবলো পরে সে বুঝিয়ে বলবে যে কেন সে দেবাংশুকে এড়িয়ে যেতো কথা বলতো না। দেবাংশু আবারও বলতে শুরু করলো,

দেবাংশু: অনেক রাত ড্যাডকে এইজন্য চোখের জল ফেলতে দেখেছি। আমার ছোটো বেলার বুদ্ধিতে এটাই মনে হয়েছিলো যে আমি যদি সব বলি তাহলে ড্যাড আর মায়ের মধ্যে ঝামেলা হবে আর মাকে আমি কখনও দেখতে পাবো না তাই কখনও কিছু বলিনি। (একটু থেমে) আমার সেই ছুটিটা আমার জীবনটাকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছিল।

দিয়ারা: আরও কিছু হয়েছিলো সেইবার?

দেবাংশু: কিছু? হাহ! আমার পুরো জীবনটা বিষিয়ে গেছিলো। আমি ভিকির বাড়িতে গেছিলাম, ওর বাড়ি থেকে ফিরতেই লক্ষ্য করি বাইরে অন্য একটা গাড়ি দাঁড়ানো। আমি তাড়াতাড়ি করে ভিতরে গিয়ে মায়ের ঘরের বাইরে দাঁড়াই। একই জিনিস বারবার দেখতে আমার ভালো লাগতো না। ভিতরে দুজন মানুষের হাসি, কথা বলার আওয়াজ পেতেই আমি বুঝে গেছিলাম অন্য কেউ আছে ভিতরে। আমি চুপচাপ নীচে চলে আসতেই দেখলাম ড্যাড আসছে। আমি ভয় পেয়ে যাই যে ড্যাড যদি মাকে অন্য একজনের সাথে দেখে তাহলে আবারও আগের দিনের মতো ঝামেলা হবে।

দিয়ারা: কি হয়েছিলো তারপর?

দেবাংশু: ড্যাডকে আটকাতে পারিনি। ড্যাড মনে হয় জেনে গেছিলো দেখেই সেই সময়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল যা কখনও আসেনি। ঘরে ঢুকতেই ড্যাড দেখে যে…

দিয়ারা দেবাংশুর হাতটা শক্ত করে ধরে এইভেবে যে দেবাংশু যা দেখেছে সেটাই দেখেছেন হয়তো ওর বাবা। নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যকাওর সাথে অন্তরঙ্গ ভাবে দেখাটা যে কতটা কষ্টকর সেটা সবাই জানে যাঁরা ভালোবেসেছে। দিয়ারার অনেক খারাপ লেগেছিলো যখন তানিশা দেবাংশুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল সেখানে দেবাংশুরও অর্জুনকে নিয়ে রাগ করাটা স্বাভাবিক। তাই তো দিয়ারা কিছু মনে করিনি সে নিয়ে, বুঝেছে বিষয়টা। কিন্তু দেবাংশু যা দেখেছে নিজের মায়ের ক্ষেত্রে তা তো আরো ভয়ানক।

দেবাংশু: (দিয়ারার হাতের উপর হাত রেখে) আমি যা দেখেছি ড্যাড তা দেখেনি, ভাগ্যিস দেখেনি! ড্যাড যা দেখেছিলো সেটাও সমান কষ্টদায়ক ছিলো।

দিয়ারা: কি, কি দেখেছিলো?

দেবাংশু: (চুপ করে থেকে) মায়ের একমাত্র ভালোবাসা, তাঁর হাজবেন্ড এবং ছেলেকে।

দিয়ারা: (অবাক হয়ে) মা..মানে?

দেবাংশু: মানে এটাই যে ছোটোবেলায় আমাকে দেখাশোনার বদলে কাজের যে বাহানা মা দিতো তখন কাজে যেতো না। তাঁর প্রমাণ তো আমি পেয়েইছিলাম সেদিন ড্যাডও সবটা জানতে পারে। মা কিছু লুকায়নি তখন, জানো সবটা জানাতেই চেয়েছিলেন। আমি কখনওই মায়ের কাছে ছেলে ছিলাম না। আমাকে জন্মই যা দিয়েছিলো, ড্যাডকে বিয়ে করেছিলো, কাছে এসেছিলো শুধু ইন্ডাস্ট্রিতে চান্স পাওয়ার জন্যে। তারপরেও অনেকের সাথেই এমন করেছে যেমনটা তোমাকে পার্টির ঘটনাটা বললাম। কিন্তু সেইসময় মায়ের বিয়েও হয়ে গেছিলো, বেবিও। এর আগেও পার্টিতে এমন হয়েছে।

দিয়ারা: মানে, একটা সম্পর্কে থাকাকালীন এসব…??

দেবাংশু: হ্যাঁ। যেকোনো ছেলের সাথে ক্লোজ হয়ে কথা বলাটা আমার মায়ের কাছে কোনো বড়ো ব্যাপার ছিল না। ড্যাডকে বলত, যে সে মডেল, তাঁকে এসব করতেই হয়। নাহলে সে চান্স পাবে কীভাবে? ভালো তো শুধু ড্যাডকেই বাসে। তাই তখন ড্যাড মেনে নিত, বিশ্বাস করেছিলো। আর সেই বিশ্বাসের ফল মা খুব ভালো ভাবে দিয়েছেন। এই রকম করতে করতেই মা আবার একদিন প্রেমে পড়েন আর বিয়ে করেন। তখন হয়তো আমার বয়স দু বছর হবে। মাঝে মা ড্যাডকে বলেছিলো একটা ফ্যাশন শোয়ের জন্য মা বিদেশে যাচ্ছে। সেইসময় প্রেগন্যান্ট ছিলো একচুয়ালী। এক দুমাস পরে ড্যাড যখন জানতে চায় ফ্যাশন শোয়ের ব্যাপারে তখন বলে যে সেটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবেই চলতে চলতে একটা টাইম বলে ক্যানসেল হয়ে গেছে আর তারপরে ফিরে আসে।

দিয়ারা মুখ ঢেকে ফেলে। মাথা উঠিয়ে বলে,

দিয়ারা: আমার মাথায় আসছে না এইসব করার কারণটা কি? এতো কিছু কেন করলেন? সিধে বলে দিতেই পারতেন উনি থাকতে চান না। তখনও কষ্ট হতো কিন্তু এইভাবে ঠকিয়ে কষ্ট দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার মানে কি?

দেবাংশু: সম্পত্তি। মা যাকে ভালোবেসেছে সে একটা সাধারণ ঘরের ছেলে ছিলো। ড্যাডের কাছ থেকে সমস্ত সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে সবটা জানায় ড্যাডকে। থাকার জন্য এই বাড়িটা আর কিছু টাকা পয়সা ছেড়ে দিয়েছিলো। এরপর ভিকি আর আভাস আংকেল অনেক হেল্প করেছিলো আমাদের তাই জন্যেই ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিলাম।

দিয়ারা: (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) আচ্ছা, তুমি যাকে দেখেছিলে তোমার মায়ের সাথে সেই কি..??

দেবাংশু: হ্যাঁ। এই একজনকেই দেখেছি। শুধু পার্টিতে অন্য কেউ ছিলো। আসল ব্যাপারটা হলো, মা সবকিছু করেছিলেন ওনার ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য, তার সাথে ভালো থাকার জন্য। একবারও ভাবেননি ঠিক কি কি করছেন, কতজনের মন নিয়ে খেলছেন।

দেবাংশু উঠে যেতে নিলেই দিয়ারা ওর হাত ধরে বাঁধা দেয়। দেবাংশু দিয়ারার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

দেবাংশু: সব প্রশ্নের উত্তর তো নিজেই বুঝে নিয়েছিস আমার বলার সাথে সাথে। কেন অমন বলেছি। তাহলে আর কি জানতে চাস?

দিয়ারা: অর্জুনের সাথে কিসের রেষারেষি তোমার?

দেবাংশু: (তাচ্ছিল্য হেসে) আমার ভাগের সমস্ত ভালোবাসা তো ওই পেয়েছে সবসময়। ভেবেছিলাম এইবারও হয়তো ওর কপালেই লেখা আছে আমার ভালোবাসার মানুষটা।

দেবাংশু দিয়ারার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো দিয়ারা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হয়তো কনফার্ম হতে পারছে না। দেবাংশু বাঁকা হেসে সম্মতি জানিয়ে বলে,

দেবাংশু: সৎ ভাই হয় আমার।

দেবাংশু উঠে চলে যায় আর দিয়ারা সেখানেই বসে থাকে ঠায়। ধীরে ধীরে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে দু হাত দিয়ে।

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here