#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_১৮
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
দুই পরিবারের সম্মতিতে নাফিসের মায়ের একান্ত আপত্তিতে নাফিস আর জুঁইয়ের আজ বিয়ে । খুবই সাধারণ ভাবে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে । জুঁইয়ের ইচ্ছাকেই সম্মান জানিয়েছে নাফিস আর তার পরিবার । নাফিস নিজেও চায় নি বিয়েটা ধুমধাম করে হোক । তাই অফিসের কিছু কলিগ আর দুই পরিবারের মানুষ মিলেই ছোট করে বিয়ের আয়োজন করেছে জুঁইয়ের মায়ের বাসায় । বিয়েতে মাহবুব সাহেব এবং তার স্ত্রীও উপস্থিত হয়েছেন । ইফসির মুখে আজ হাসি । সে তার মাকে আজ বধূ বেশে দেখতে পাচ্ছে । যদিও তেমন সাজে নি জুঁই । নাফিসের দেয়া লাল বেনারসি আর সাথে একদম সিম্পল সাজ । আর নাফিসের একান্ত ব্যাক্তিগত অনুরোধে খোঁপায় বেলীফুলের মালা পরেছে । আর ইফসি বার বার জুঁইয়ের খোঁপার ফুল গুলো ধরছে । তবে নষ্ট করছে না ।
জুমার নামাজের পর নাফিস তার বাবা দুই বোন আর বোনের জামাই সাথে আরও দুজন মুরুব্বি নিয়ে জুঁইদের বাসায় আসেন । মাশা-আল্লাহ আজ নাফিসকে রাজপুত্রের মত লাগছিল । একটা পাঞ্জাবি আর চুড়িদার পরেছে সে আজ । ড্রইং রুমটা বেশ ভালো বড় সড় । সেখানেই ওনাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে । আর ভেতরে মহিলারা আছেন । নিজের জায়গায় একদম কমফোর্টেবল ভাবে বসে আছে নাফিস । মনে হচ্ছে কিছুই হয় নি । আজ যে তার বিয়ে সেটাও তার জন্য একদম সিম্পল ব্যাপার । কারণ এই তিনটা বছরে নিজের বুকের ব্যাথা নিজের কর্তব্য গুলো পালন করতে করতে এখন সব কিছুই তার কাছে নরমাল মনে হয় ।
নাফিসের কথায় শান্তা ভেতরে গিয়ে ইফসিকে নিয়ে আসে । এনে নাফিসের কোলে তুলে দেয় । আর নাফিসও তাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে রাখে । অন্যদিকে ইফসিকে এক নজরে দেখে যাচ্ছে আনিস বেপারি মানে নাফিসের বাবা । এখন থেকে নাতনি হিসেবে এই বাচ্চাটাকে নিজের সব ভালোবাসা বিলাবেন তিনি । এদিকে নাফিস ইফসির সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ।
– এইযে বুড়ি ,,,,,?
-………..
– এত সাজুগুজু করছেন কেন আপনি ?
-………..
– পাপা কথা বলি তো মা , কথা বলো পাপার সাথে ।
-………..
– ওইযে দেখো দাদান আসছে , তাকাও ওইদিকে মা । তাকাও তো
নাফিসের হাতের ইশারায় ইফসি নাফিসের বাবার দিকে তাকায় । নাফিস বার বার দাদান দাদান করছিল । প্রায় ৫ মিনিট পর ইফসি মিষ্টি হাসি দিয়ে দাদান বলে ওঠে । আর সেখানে উপস্থিত সবাই হেসে ।
কিছুক্ষণ পর কাজী সাহেব এসে যান । বিয়ে পড়ানো শুরু হয়ে গেছে । হুজুর বিসিমল্লাহ বলে বিয়ে পড়তে শুরু করেছেন । কিন্তু এখানে নাফিস বাঁধা দিয়ে দেয় । এই রুম আর ওই রুম , অল্প ফারাক । তাই এই রুমের সব কথা জুঁই ভেতর থেকেই শুনে নেয় ।
নাফিস তখন বলছিল ,
– হুজুর একটু অপেক্ষা করুন ।
– জ্বি বলুন ,
– এখানে আরও কিছু থাকবে ।
– যেমন ,
– এখানে শুধু নাদিরা ইয়াসমিন মানে জুঁইয়ের নাম নেয়া হচ্ছে কিন্তু সে তো একা নয় । তার সাথে আরও একটা প্রাণ জড়িত ।
– একটু পরিষ্কার করে বুঝালে ভালো হতো ।
– এখানে উল্লেখ করুন , যে নাদিরা ইয়াসমিন জুঁইকে স্ত্রীর সম্মান দেয়ার সাথে সাথে তার মেয়ে ইফসির সমস্ত দায়িত্ব আমার । এখন থেকে ইফসির বড় হওয়া এবং তার বিয়ে সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত তার সমস্ত দায়িত্ব আমার । ওর সমস্ত সার্টিফিকেট এবং ওর সমস্ত উপস্থিতিতে আমি নাফিস আহমেদ ওর বাবা । এক কথায় আজ থেকে ইফসি শুধু নাদিরা ইয়াসমিন জুঁইয়ের মেয়ে না ইফসি আমাদের মেয়ে হিসেবেই পরিচিতি পাবে ।
নাফিসের বলা কথা গুলো সেখানে উপস্থিত সবাই এতক্ষন মনোযোগ সহকারে শুনেছেন । নাফিস তখন হুজুরকে আবার বললেন ।
– হুজুর বিয়ের দেনমোহর ৫ লক্ষ টাকা করুন যার মধ্যে পুরো ৫ লক্ষ টাকাই নগদ যাবে ইফসির একাউন্টে ।
এ কথা ভেতরে জুঁই আরও অবাক হয়ে যায় । সেখানে উপস্থিত সবার মাঝে কেউ কেউ অবাহ হয় এটা ভেবে যে এই পুরুষ কি করে এত অনায়াসে আরেকজনের সন্তানকে এতটা আপন করে নিতে পারে । আর কেউ কেউ আনন্দ হয় তার এত উদারতা দেখে । আর ভেতরে থাকা নব বধূর সাজে বসে থাকা জুঁইয়ের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে যায় এটা ভেবে যে তার মেয়ের ভবিষ্যত এখন থেকে সুরক্ষিত ।
[ বিঃদ্রঃ এই অংশটুকু নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া । আমাদের জীবন কখনো কখনো গল্পের মত হয়ে যায় আর আমরা অনেকেই এমন কিছু গল্পের চরিত্র হয়ে যাই অথবা । আমাদের মত চরিত্র আর আমাদের জীবন থেকেই তৈরি হয়ে যায় এক একটা গল্প কিংবা উপন্যাস । যা লিখতে বসলে পাতা শেষ হয়ে যাবে কিন্তু উপন্যাসের সমাপ্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না । #কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে উপন্যাসটি তেমন একটি বাস্তবভিত্তিক উপন্যাস যেখানে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তুলে ধরা হচ্ছে । কখনো প্রেমে ঠকে যাওয়া , কখনো শ্বশুরবাড়ি স্বামী দিতে অসুখী হওয়া নতুবা আবারও বিচ্ছেদ অথবা পুরনো ভুল বুঝে ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নেয়া । এই উপন্যাসটিকে সেই সব চিরাচরিতয়তার মাঝে প্রতিকূলতার মুখোমুখি করে ফুটিয়ে তোলার আমার এক ছোট্ট প্রচেষ্টা মাত্র ]
অবশেষে বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেছে । সবার মুখেই আলহামদুলিল্লাহ । যেন এক ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন আজ জোড়া লাগলো । যেন কিছু ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক আবারও ভীত খুঁজে পেলো । ভালোবাসার সম্মান আর ভালোবাসার মানুষটার সম্মান বাঁচাতে তার অসহায়ত্বের শেকড়কে নিজের শেকড়ে পরিণত করে তার পাশে থাকাটা সবাই হয়তো পারে না । যা হয়তো নাফিস পেরেছে ।
সব অনুষ্ঠান শেষে জুঁই আর ইফসিকে নিয়ে বাসায় পা রাখে নাফিস । এমন ঘরে এসে পা রেখেছে জুঁই যেখানে নতুন সংকার উৎপন্ন ।
রেহানা পারভিন ছেলের বউ দেখে খুশি হওয়ার বদলে দুঃখী বেশি হয়েছে । তার চিন্তা পাড়া প্রতিবেশীরা এসে যখন দেখবে ছেলের বউয়ের আগের ঘরের বাচ্চা আছে তখন তার মুখ থাকবে কোথায় ?
জুঁই এসে সালাম দেয়ার পরেও তিনি তেমন একটা গুরুত্ব দেয় নি । জুঁই বেশ বুঝে গেছে তার নতুন শ্বাশুড়ির মনে কি চলছে এই মুহুর্তে । অন্যদিকে ছোট্ট ইফসিটাকে দেখেও না দেখার ভান করে আছেন তিনি । সবার মাঝে থেকে কাজ তো করে যাচ্ছেন সাথে বিষ হজম করছেন ।
শান্তা আর শাম্মি দুজন মিলে নাফিসের ঘরে জুঁইকে রেখে আসে । মায়ের কাছে থাকবে বলে ইফসিকেও জুঁইয়ের সাথে নাফিসের ঘরে রাখা হয় । রুমে ঢুকে অনেকটা অবাক জুঁই । পুরো রুমটাই শূন্য । এখানে যে বাসর হবে দেখে বোঝা যাচ্ছে না । সব সময়ের মত রুম যেমন থাকে তেমনি রাখা হয়েছে । ফুল তো দূরে থাক ফুলের ফ টাও খুঁজে পাবে না কেউ এই রুমে । ইফসি তখন গুটি গুটি পায়ে দৌড়ে নাফিসের বিছানায় উঠে বসে যায় । হাতে ইশারা করে মাকে দেখায় তার পাশে বসতে ।
প্রায় এক ঘন্টা পর জুঁইয়ের সাথে খেলতে খেলতে ইফসি ঘুমিয়ে যায় । ইফসি ঘুমানোর পরেই নাফিস দরজা ঠেলে রুমের মধ্যে আসে । নাফিসকে দেখে হাল্কা স্মিত হাসি দেয় জুঁই । হাসির উত্তর হাসি দিয়েই দেয় নাফিস । খাটের দিকে নজর করে দেখে ইফসি খাটের মাঝ বরাবর শুয়ে আছে । ইফসির এপাশে বসে জুঁইকে উদ্দেশ্য করে নাফিস বলে ,
– রাগ করো নি তো ?
– কেন ?
– এইযে ফুল বিহীন ফাঁকা বাসর উপহার দিলাম তোমায় ।
– হয়তো এটাতেই শান্তি ।
– ইফসির কথা ভেবেই আনি নি । আর হ্যাঁ আমি তো স্ট্রেট ফরওয়ার্ড মানুষ তুমি তো জানো । বিয়েটা আমার ইচ্ছায় করেছি । মা একটু ঝামেলা করবে জানতাম তাই ফুলের ব্যবস্থা করি নি ।
– সমস্যা নেই ।
– ক্লান্ত লাগছে কি ?
– উহু ,
– ইফসি খেয়েছে ?
– শান্তা খাইয়ে দিয়েছে , তুমি কোথায় ছিলে ?
– ছাদে ঘিয়েছিলাম , মাহবুব ভাইয়া আরও কয়েকজন বন্ধুরা ছিল ।
– ওহ ,
– সবাই শিখিয়ে দিল ।
– কি ?
– বললো আমাকে নাকি প্রথম রাতেই বিড়াল মারতে হবে ।
নাফিসের কথায় একটু জোরেই হেসে দেয়
জুঁই । তারপর বলে ,
– তুমি কি বললে ?
– আমি বললাম আমি তো আগেই বিড়ালের কাছে নিজেকে সারেন্ডার করে দিয়েছি ।
– হা হা ,
– হাসলে অনেক ভালো লাগে তোমাকে ।
নাফিসের কথায় হাসি থামিয়ে দেয় জুঁই । নাফিস আবারও বলে ওঠে ,
– এক কাজ করো , শুয়ে যাও ।
– ঘুমিয়ে যাবে ?
– তুমি ঘুমাও , সারাদিনের ধকলে শরীর ক্লান্ত তোমার ।
– আমি ভালো আছি ।
– হ্যাঁ , ঘুমিয়ে যাও ।
– নাফিস ,,,,,,,,?
– হ্যাঁ,
– আমায় দেখে কামনা জাগছে না মনে ?
– তুমি তো আমার কামনার খোড়াক নও কাদম্বরী । তুমি আমার চোখের খোড়াক , আমার মনের খোড়াক । এর বেশি আর হয়তো কিছু বলা লাগবে না তোমায় । আমি আসবো তোমার কাছে এটা ঠিক তবে অসময়ে নয় । সময় অনুযায়ী । যেখানে কামনার চাইতে ভালোবাসার স্থান বেশি থাকবে । কামনা তো শরীরের চাহিদা মেটাবে কিন্তু ভালোবাসা শরীর মন আবেগ সব কিছুর চাহিদা মেটাবে । ঘুমিয়ে যাও , কেমন ?
কথা গুলো বলে নাফিস শুয়ে যায় । নিজ সন্তানের মত ইফসিকে বুকের সাথে মিশিয়ে ঘুমিয়ে যায় নাফিস । ইফসির এপাশে শুয়ে এক ধ্যানে নাফিসকে দেখছে জুঁই । নাফিসটা বরাবরই এরকম । শরীরের চাইতে মনের দিকে টান বেশি তার । হয়তো পরিস্থিতির চাপে পড়ে মনকে শক্ত করে ফেলেছিল এই মানুষটা । হঠাৎ করেই ফারুকের কথা মনে পড়ে যায় জুঁইয়ের । বিয়ের প্রথম রাতেই রুমে ঢুকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিল , ” তুমি শারীরিক ভাবে সুস্থ তো ” স্বায় পেয়ে বাঘের মত নিজের পুরুষত্ব ফলিয়েছিল সেই পুরুষটা । প্রচন্ড যন্ত্রণায় কেঁদে দেয়া জুঁইয়ের ব্যাথাটা সেরাতে খেয়াল করেনি সেই পুরুষটা । সেদিনও তার বাসর ছিল আর আজও তার বাসর । শুধু তফাৎ সময় আর মানুষের । সেদিনের পুরুষটি তাকে চেয়েছিল শরীরের খোড়াক হিসেবে আর এই পুরুষটি তাকে চাইছে মনের খোড়াক হিসেবে । দুনিয়ার অদ্ভুত সব নিয়ম । কখনো দুঃখ তো কখনো সুখ ।
এইসব ভেবে ভেবে চোখে তার অঝোর শ্রাবণ । নাফিসকে দেখছে আর কাঁদছে সে । এ কান্না হয়তো সুখের কান্না । এ কান্না হয়তো পরিপূর্ণতার কান্না । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজে নিজে ভাবছে আর মনে মনে বলছে ,
এই পুরুষকে কোথায় রাখবো আমি
যে আমার মনের মাঝেই রাজ করে যাচ্ছে
এই পুরুষকে কোথায় রাখবো আমি
যে কিনা আমাকে রেখেছে তার হৃদয়ের গভীরে
.
.
চলবে……………………
[