কথা দিয়েছিলে ফিরবে পর্ব ১৭

#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_১৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

রুদ্ধশ্বাস নিয়ে প্রতিটি সেকেন্ড অপেক্ষা করে আছে জুঁই । নাফিসের অপেক্ষায় নিজেকে আজ চাতক পাখি মনে হচ্ছে তার । নাফিসের ভালোবাসায় নিজেকে আজ রাঙিয়ে নিলে ক্ষতি কিসে । জীবন আরও একবার তাকে সুযোগ দিয়েছে । এই সুযোগ লুফে নিতে ক্ষতি কোথায় ?

সময় বয়ে যাচ্ছে কিন্তু নাফিসের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না । আজ প্রায় দুই বছর পরে জুঁই সাদা শাড়ি ছেড়েছে । আজ নাফিসের পছন্দের সেই হলুদ রঙের শাড়িটা পরেছে জুঁই । সাদা শাড়িটা খুলে হলুদ শাড়িটা পরার সময় কেন যেন আপনা আপনি চোখ থেকে পানি ঝরে যায় জুঁইয়ের । হয়তো কিছু পুরনো স্মৃতি মনে গেছে । সাদা শাড়িতে অনেক বেদনার স্মৃতি লুকায়িত আবার হলুদ শাড়িতেও অনেক কষ্টের মুহুর্ত লুকায়িত । একদিকে নিজেকে যার কাছে সপে দেয়া হয়েছিল তার সারাজীবনের জন্যে চলে যাওয়াতে বুকে চাপা ব্যাথা । অন্যদিকে অতীতের ভালোবাসার মানুষটা সব ছেড়ে দিয়ে সেই ভালোবাসার অধিকার নিয়ে তাকে আপন করে নেয়ার সকল প্রচেষ্টার জন্য একটুকরো সুখের অনুভূতির প্রকাশ । সব মিলিয়ে জুঁই যেন দিশেহারা ।

শাড়ি পরে অনেক্ষণ অপেক্ষায় রত থাকা মন যেন আস্তে আস্তে বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছে৷। প্রায় দু’ঘন্টা হয়ে গেছে । রাত প্রায় ১১ টার উপর বেজে গেছে । অথচ নাফিস আসে নি । নাফিসের পথ পানে চেয়ে থেকে থেকে দুচোখ যেন প্রায় বুজেই আসে তার । এ অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকা ওই ফাঁকা রাস্তার পানে । এই তাকিয়ে থাকা যেন এক অন্যরকম ভালো লাগার স্পর্শ পেতে শিহরিত হয়ে থাকা ।

অপেক্ষার পালা বদলের সময় হয়ে গেছে । রাত প্রায় সাড়ে ১২ টা । প্রায় ৪ ঘন্টা হয়ে গেছে অথচ নাফিসের দেখা নাই । বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জুঁইয়ের চোখে যেন কুয়াশা ভর করে আছে । চোখের পানি গুলো আপন ইচ্ছায় ঝরে যাচ্ছে । মন থেকে শুধু কিছু কথা বেরিয়ে আসছে তার ।

– তাহলে কি নাফিস আবারও ঠকালো আমায় ? সেই আগের মত নাফিস আবারও আমায় কষ্ট দিলো । আমার ভালোবাসার কি তাহলে আরও একবার মিথ্যা প্রমাণিত হলো ?

এইসব ভেবে নিয়ে রুমে গিয়ে আয়নার সামনে নিজেকে দেখে জুঁই । চোখের পানি গুলো মুছে শাড়ির সেফটিপিনে হাত দেয় জুঁই । যার জন্যে এই শাড়ি সেই যখন আসে নি তাহলে আর এই শাড়ি কেন । শাড়ির সেফটিপিন খুলতে যাবে এমন সময় জুঁইয়ের মোবাইলে ম্যাসেজ আসে । চমকে গিয়ে মোবাইলের দিকে তাকায় জুঁই । নাফিসের নামটা দেখে চমকে গিয়ে মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে যায় জুঁই । সেখানে লিখা আছে ,

– নিচে দাঁড়িয়ে আছি আমি , তুমি আস্তে করে বেরিয়ে আসো । ইফসিকে আন্টি দেখবে । অপেক্ষা করছি আমি ।

ম্যাসেজটা দেখে দৌড়ে বারান্দায় যায় জুঁই ।
দেখে নিচে নাফিস বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । শালটা শাড়ির উপরে দিয়ে আস্তে করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় জুঁই । বাসায় তখন ইফসি আর তার মা ঘুমাচ্ছিলো । দরজায় তালা দিয়ে
জুঁই নিচে নেমে আসে । কেচি-গেইটের তালা খুলে বেরিয়ে নাফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় জুঁই । আর এদিকে জুঁইকে দেখে নাফিস অবাকই হয় নি ভাষা হারিয়ে ফেলেছে । চিরচেনা সেই হলুদ শাড়িটা যা আজ জুঁই তার অঙ্গে জড়িয়েছে । জুঁইকে দেখে চোখের পানি গুলো চিক চিক করছিল নাফিসের । অসাধারণ বললেও কম হয়ে যাবে আজ । মুখে যেন দুজনেই কুলুপ এঁটে দিয়েছে । কোন কথা নেই কারো মুখে । অজান্তেই জুঁইয়ের হাতটায় স্পর্শ করে নাফিস । নাফিসের স্পর্শে ধ্যান ভেঙে যায় জুঁইয়ের ।

– এত দেরি কেন করলে নাফিস ?
– কিছু কাজ ছিল ।
– আমি ভেবেছিলাম,,,,,,,,
– ভেবেছিলে নাফিস বুঝি আবারও তোমায় ঠকালো ?

নাফিসের এমন কথায় একদম চুপ হয়ে যায় । মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে নাফিসের সামনে । জুঁইয়ের নিচু মাথা দেখে জুঁইয়ের থুতনিতে হাত দিয়ে তার মাথাটা উঁচু করে দেয় নাফিস । তারপর হাল্কা হেসে বলে ওঠে ,

– এই নাফিস আর বদলাবে না কাদম্বরী । এই নাফিস তার কাদম্বরীকে আর ঠকাবে না । এখন চলো ,
– কোথায় ?
– যাবো এক জায়গায় ।
– কোথায় নিয়ে যাবে আমায় ?
– যেথায় বিরাজ করবে শুধু নিস্তব্ধতা
যেথায় আমার মনে রাজ করবে তোমার
ভালোবাসা !!

নাফিস কথা বলার সাথে সাথে জুঁইয়ের হাত ধরে তাকে বাইকে উঠিয়ে দেয় । আর তারপর বাইক স্টার্ট দিয়ে দেয় ।

গভীর রাতে প্রকৃতিও চুপ হয়ে আছে । একা রোডে নাফিসের বাইক ছুটে চলছে এক অজানা গন্তব্যে । জুঁই বার বার চাইছে নাফিসের কাঁধে হাত রাখতে । কিন্তু কোথাও যেন একটা বাঁধা কাজ করছে তার মাঝে । নিজেকে এখনও লজ্জায় ঢেকে রেখেছে সে । অন্যদিকে নাফিস চাইছে জুঁই তার কাঁধে হাত রাখুক । একটু ভরসা করুক যদিও সে জুঁইয়ের ভরসা একবার ভেঙে দিয়েছিল অনায়াসে ।

– জুঁই,,,,,,,,?
– হু ,
– ভরসা করেই দেখো না ?
– মানে ?
– তোমার মন বলছে আমার কাঁধে হাত রাখতে , কিন্তু তোমার বিবেক বলছে কার কাঁধে হাত রাখবি , যে তোকে ছেড়ে চলে গেছে তার কাছেই ভরসা খুঁজছিস ?

নাফিসের কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায় জুঁই । ওর মনের কথা নাফিসের মুখে শুনে সে আসলেই অবাক হয়ে গেছে । নাফিস কি তাহলে আসলেই বদলে গেছে ।

– নাহ মানে আসলে,,,?
– একটা বার হাত রেখে দেখো , যদি ভরসা খুঁজে না পাও তাহলে হাতটা সরিয়ে নিও , আমি কিছুই মনে করবো না ।

নাফিসের কথার পেচে পড়ে গিয়ে নাফিসের কাঁধে হাত রাখতে বাধ্য হয় জুঁই । নিজের কাঁধে কাদম্বরীর হাত পড়ায় আনন্দের অনুভূতি গুলো নাফিসের হৃদয়কে হাল্কা শিহরিত করে দিয়ে যায় ।

প্রায় অনেক্ষন পর একটা নদীর পাড়ে এসে নাফিসের বাইক থামে । বাইক থামিয়ে জুঁইয়ের হাত ধরে জুঁইকে নদীর পাড়ে নিয়ে দাঁড় করায় নাফিস । এত রাতে এখানে নদীর পাড়ে এসে অবাক হয়ে যায় জুঁই । আরেকটু অবাক হয় ঘাটে একটা নৌকা দেখে ।

– নাফিস , এত রাতে এখানে নিয়ে এলে যে ?

জুঁইয়ের শান্ত গলার মিষ্টি প্রশ্নে অভিভূত হয়ে নাফিস জুঁইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । তারপর সে তার হাতখানা দিয়ে তার কাদম্বরীর হাতে স্পর্শ করে অত্যন্ত শান্ত গলায় আস্তে করে মিষ্টি ভাবে বলে ওঠে ,

নিশিরাতে কবো কথা
তোমারও সনে
প্রিয়া মোর শুনো তবে
আমি আছি তোমারও মনে

নাফিসের বলা কবিতায় আজ যেন আগের মত হাসি ফুটে উঠে জুঁইয়ের ঠোঁটে । আজ যেন প্রাণ খুলে হাসতে মন চাইছে তার । নাফিস তখন জুঁইয়ের হাতে নিজের হাত জোড়া একটু চেপে ধরে বলে ,

– হাসো কাদম্বরী , আজ হাসো । আজ আমি দেখি আবার আমার সেই কাদম্বরীর মিষ্টি হাসিখানা ।
– হাসতে বড্ড বেশি মন চাইছে আমার ।
– হ্যাঁ , আজ থেকে তুমি হাসবে । আর কখনো ওই চোখে পানি আসতে দিবো না তোমার ।
– আমায় একটু জড়িয়ে নিবে তোমার বই বুকে ?

জুঁইয়ের এমন আবদারে নাফিস যেন হাজারো সুখ তার হাতের মুঠোয় পেয়ে যায় । দিক বিক না ভেবে নিজের কাছে টেনে নেয় নাফিস জুঁইকে । তারপর কোলে তুলে নেয় তার কাদম্বরীকে । এগিয়ে যায় নৌকার দিকে ।

– নাফিস ,
– হু ,
– রাতের বেলায় নদীতে নিয়ে এলে কেন আমায় ?
– আজ রাতে তোমার সাথে জোছনা বিলাস করবো ওই নৌকার মধ্যে নদীর মাঝখানে ।
– আমার যে ভয় হয় নাফিস ?
– আমি তো আছি , আরেকটু ভরসা করো আমায় ।
– লোকে যদি জানে কি হবে ?
– সাহস করো নারী , একবার সাহস করো
ভালোবাসায় আপন করে আদর সোহাগে
ভরিয়ে দিবো ।

জুঁই তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে নি । কোলে চড়ে থাকা অবস্থাতেই নাফিসকে জড়িয়ে ধরে সে । নিজের কোলে রেখে জুঁইকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে নৌকায় উঠে নাফিস ।

নদীর শান্ত ডেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে নৌকা বয়ে যাচ্ছে তার আপন গতিতে । গভীর রাতে নিস্তব্ধ নদীতে শুধুই পানির শব্দ । ঢেউগুলো একে অপরের সাথে খেলে যাচ্ছে । মাঝি বৈঠা বাইছে । আর নাফিস আর জুঁইকে পরখ করছে । অন্যদিকে নাফিস যেন তার পলক ফেলছে না । এক দৃষ্টিতে তার কাদম্বরীকে দেখে যাচ্ছে সে । নাফিসের এইভাবে তাকিয়ে থাকা জুঁইকে যেন ডুবিয়ে দিচ্ছে । থাকতে না পেরে নিজের হাত দিয়েই নাফিসের চোখ বন্ধ করে দেয় জুঁই ।

– এভাবে তাকিও না , আমি মরে যাবো ।
– মরতে দিবো না তোমায় । আমার হৃদয় মাঝে বন্দী করে রাখবো ।
– পাগল করো না আমায় ।
– উহু আমি যে তোমাতে পাগল প্রায় ।
– দেখো , ঢেউ গুলো শব্দ করছে ।
– তোমার কথার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে ।

জুঁই নাফিসের কথার সাথে পেড়ে উঠতে পারছে না । নাফিস যেন সব কথা সাজিয়ে রেখে দিয়েছে । তাই জুঁই চুপ করে যায় । কিছুক্ষণ পর নাফিস একটা ফানুশে আগুন ধরায় । ফানুশ দেখে জুঁই যেন দিশেহারা হয়ে যায় । কারণ ফানুশ যে তার খুব প্রিয় । আর এর সাথে সাথে ওদের দুজনের প্রথম দেখার কথাটা মনে পড়ে যায় জুঁইয়ের । প্রথম দেখায় নাফিস এইভাবেই ও-কে সাথে নিয়ে ফানুশ উড়িয়েছিল ।

নাফিস তখন জুঁইকে কাছে টেনে নিয়ে দুজন মিলে ফানুশটা উড়িয়ে দেয় । তারপর জুঁইয়ের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে দেয় । এইসবই জানো জুঁইয়ের কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে । নিজেকে নাফিসের সাথে জড়িয়ে রেখে পরম শান্তিতে চোখ বুজে জুঁই । আর নাফিস তার কাদম্বরীকে জড়িয়ে রেখেই বলে ওঠে ,

ভালোবাসি মোর প্রিয়া তোকে
অনেক ভালোবাসি
এই ভালোবাসার জন্যে আমি
দিব হাজার নদী পাড়ি

ওগো মোর কাদম্বরী
আমি তোকেই ভালোবাসি
আমার ভালোবাসার মাঝে যে তোর
আছে বশত বাড়ি

মিষ্টি হেসে জড়িয়ে ধরিয়ে
চোখটা তুই বুজ
আমার বক্ষের মাঝে যেন
পাস অনেক সুখ

নাফিসের কথার পর পরই জুঁই নাফিসের শার্টটা আরও শক্ত করে ধরে নাফিসের বুকে নিজেকে আরও লেপ্টে নিয়ে যায় । এ যেন সুখের ভেলায় চড়ে এক জোড়া পাখির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলার শান্তিময় মুহুর্ত ।।

.
.

চলবে………………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here