#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_১৪
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
দুইদিন পর আজ নাফিস অফিসে এসেছে । এদিকে দুইদিন পর আজ জুঁইও অফিসে এসেছে । এক সাথে এক দিনে অফিসে দুজনের আগমনে স্টাফদের মাঝে হাজারো কথার জন্ম দিয়ে দিয়েছে । যা নাফিস আমলেও নেয় নি আর জুঁই যেটা নিয়ে ভয় বেশি পেয়েছে সেটাই হচ্ছে ভেবে আরও বেশি করে ভয় পাচ্ছে ।
আজ দুইদিন পর দুজনকে অফিসে দেখে মাহবুব সাহেব তাদের এক সাথে ডেকে রুমে পাঠান । নাফিস নিজের মত করেই আছে , ভয় পাচ্ছে জুঁই । আর তার রাগ হচ্ছে ভিষণ নাফিসের উপর । এতকিছুর কোন প্রয়োজন ছিল না সেদিন ।
অতঃপর দুজনই বসের রুমে দাঁড়িয়ে আছে । মাহবুব সাহেব দুজনকেই ইংগীত করে বললেন ,
– নাদিরা আপনু কি সুস্থ হয়েছেন ?
জুঁই বসের কথায় একটু ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে শক্ত রাখে । তারপর অত্যন্ত সাবলীল ভাবেই উত্তর দেয় ,
– আলহামদুলিল্লাহ স্যার । আমি ভালো আছি ।
তখন মাহবুব সাহেব নাফিসিকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
– নাফিস সাহেব , আপনার ঝামেলা শেষ হয়েছে তো ?
নাফিস তখন অত্যন্ত ভদ্রতার সহিত জবাব দেয় ,
– জ্বি স্যার , ঝামেলা শেষ হয়ে গেছে ।
তখন মাহবুব সাহেব দুজনকেই বলে ,
– অদ্ভুত ব্যাপার তাই না দুজনের কাজ এবং অসুস্থতা এক সাথেই শেষ হলো । যাক ভালো লাগলো শুনে । ওকে , নাদিরা আপনি যেতে পারেন ।
– জ্বি স্যার ,
– নাফিস সাহেব , আপনি দাড়ান । কিছু কথা আছে আপনার সাথে আমার ।
– জ্বি স্যার ।
মাহবুব সাহেব এর কথায় জুঁই চলে যায় আর নাফিস থেকে যায় । সেখানে মাহবুব সাহেব আর নাফিসের চোখে চোখে কথা হয় । তার কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙে মাহবুব সাহেব হেসে দেয় । সেই সাথে নাফিসও হেসে দেয় । আর তখন নাফিসকে মাহবুব সাহেব বলে ওঠে ,
– শালা বস এইখানে ,
– ভাইয়া বাঁচালে তুমি ।
– কি দরকার ছিল এত কিছু করার ?
– ওর যা অবস্থা ছিল তুমি জানো ?
– খালাম্মা কি বললো বাসায় যাওয়ার পরে ?
– তেমন কিছুই না ।
– দেখ নাফিস , তুই কি ভেবে চিন্তে এগুচ্ছিস ?
– হ্যাঁ ভাইয়া ।
– তোর মা মানবে বলে মনে হচ্ছে না । তখনই মানলেন না আর এখন তো জুঁইয়ের একটা মেয়েও আছে , এখন কি করে মানবেন ।
– মায়ের জন্যেই তিন বছর আগে অনেক ভুল করেছি ভাইয়া , আর না । আর হ্যাঁ তোমাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ বুঝলা , এইভাবে সাহায্য করার জন্যে ।
– ধুর , কি সব বলিস না । আচ্ছা যা কাজ কর গিয়ে ।
– ওকে ।
মাহবুব আর নাফিস খালাতো ভাই । জুঁইয়ের ব্যাপারে মাহবুব আগে থেকেই জানতো কিন্তু জুঁইকে কখনো দেখে নি সে । আর নাফিস এই অফিসে জয়েন হওয়ার পরেই নাফিস মাহবুবকে সব শেয়ার করে । অফিসের কোন কর্মচারীই জানেন না যে এরা দুজন সম্পর্কে ভাই হয় । মাহবুব তার নিজের দিক দিয়ে পুরো চেষ্টা করছে যাতে এই দুটো মানুষ আবার মিলিত হতে পারে ।
লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে বসে জুঁই ইফসিকে খাইয়ে দিচ্ছে । এমন সময় সেখানে নাফিস গিয়ে দাঁড়ায় । ইফসিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে । আর ইফসিও নাফিসের কোলে চড়ে বেশ মজা করে । তখন নাফিস জুঁইকে বলে ,
– কেমন আছো কাদম্বরী ?
-……………..
জুঁইয়ের স্তব্ধতা দেখে নাফিস আবারও প্রশ্ন করে ,
– কি হলো , কথা কেন বলছো না ?
– এটা অফিস নাফিস , এইখানে অন্তত ড্রামা করবেন না ।
– যা করি সবটাই ড্রামা মনে হয় তোমার কাছে ।
– হ্যাঁ , আজকাল যা করেন সবটাই ড্রামা লাগে আমার কাছে । আর কিছু ?
– রেগে যাচ্ছো কেন ?
– ইফসিকে নামান আর এখান থেকে যান । এমনিতেও অফিসে সবাই নানান কথা তুলে ফেলেছে । দয়া করে আমায় রেহাই দিন । নামান ও-কে ।
জুঁইয়ের কথা শুনে নাফিস অবাক হয়ে যায় নি । বরং জুঁইয়ের রাগান্বিত মুখটা দেখে যাচ্ছে । তারপর ইফসিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে জুঁইকে উদ্দেশ্য করে একটা কথা বলে নাফিস ,
– ভুল যখন করেছি আমি তার প্রায়শ্চিত্তও আমিই করবো । কথা যখন দিয়েছিলাম ফিরবো , ফিরে তো এসেছি । এইবার আমার শহরে তোমাকে আপন করে তোমার পায়ে শিকল পরানোর পালা ।
নাফিসের এমন কথায় জুঁই ভড়কে যায় । তৎক্ষনাৎ মেজাজ তার বিগড়ে যায় আর তখন সেও পালটা জবাব দিয়ে দেয় ।
– খবরদার , খবরদার নাফিস । আর যাই হিয়ে যাক না কেন আমায় করুণা কিংবা দয়া দেখাতে আসবেন না । আমার দুর্বল চিত্তে একবার আঘাত করেছিলেন । সেই আঘাতের ঘা টা আজ তিন বছর পরও সাড়ে নি । এই ঘা তে নতুন ঘা দিতে আসবেন না ।
তখন নাফিস একবার জুঁইয়ের দিকে তাকায় আবার এদিক ওদিক তাকায় । তারপর টুপ করে ইফসির সামনেই জুঁইয়ের কপালে চুমু খেয়ে নেয় । এই মুহুর্তে জুঁই কি রিয়েকশন দিবে তা তার অজানা । স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জুঁই নাফিসের সামনে । আর ইফসিও নাফিস আর জুঁইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে টুক টুক করে তাকিয়ে আছে । তারপর নাফিস আবার বলে ,
– ললাটে ভালোবাসার পরশ তো একে দিয়েছি । এখন শুধু তোমার রাজ্যে রাজ করার পালা । রেডি থেকো আমার কাদম্বরী ।
– জোর করছো নাফিস ?
– জোর না , অধিকার ফলাচ্ছি ।
– সব চুকে যাওয়ার পরেও অধিকারবোধ জন্মায় কি করে ।
– যেভাবে এখনও তোমার ওই মনে আমার নামটা খোদাই করা আছে সেইভাবে ।
এই বলে নাফিস চলে যায় । আর জুঁই তখন নিজের মনে জমাট বেঁধে থাকা কষ্ট গুলোকে পানি রূপে নিলাম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ।
পর মুহুর্তেই মোহি সেখানে উপস্থিত হয় । মোহি আচমকাই জুঁইয়ের চোখের পানি দেখে ফেলে । জুঁইও মোহিকে আচমকা দেখে ভড়কে যায় । চট করেই চোখের পানি গুলো মুছে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে সে । মোহি বুঝেও চুপ করে থাকে । কারণ মোহি তখন ১০০% এর মধ্যে ৭০% বিশ্বাস করে নিয়েছে নাফিস আর জুঁইয়ের মাঝে কিছু তো আছে ।
– তাহলে কি নাফিস স্যার আর ম্যাডামের মাঝে অবৈধ সম্পর্ক হয়ে গেছে ? কিন্তু ম্যাডাম তো বিবাহিত । আর দেখেও তেমন মনে হয় না । কিন্তু সেদিন পার্টির পরে যে ওনারা এক সাথে চলে গেলেন । আবার আজ দুজনই দুই দিন পর এলেন । এসব তো একটা দিকই নির্দেশ করে ।
পর মুহুর্তেই মোহি ইফসির দিকে নজর দেয় । কত নিষ্পাপ একটা বাচ্চা জুঁইয়ের পাশে । এখন মাইন্ড আবার অন্যদিকে ঘুরছে তার।
– নাহ নাহ , ছি ছি , কি সব বলছি আমি । ম্যাডাম তো মোটেও এমন চরিত্রের না । তাহলে অবৈধ সম্পর্ক কেন বললাম । আল্লাহ পাক আমায় ক্ষমা করুন । আমি কিসব ভেবে যাচ্ছি ।
ইফসিকে নিয়ে জুঁই তখন নিজের কেবিনে চলে যায় । ইফসিকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে জুঁই কাজে মন দেয় । কিন্তু কাজে তার মন নেই , মন শুধু একটা জিনিসের উপরই ঘুরপাক খাচ্ছে । কি হতে পারে তার ভবিষ্যৎ , কি হতে পারে তার বাচ্চার ভবিষ্যৎ । নাফিস কেন ফিরতে চায় । কেন দায়িত্ব নিতে চায় । কিছুই বুঝে আসে না তার ।
নানান টেনশন আর উদ্বেগের সাথে কেটে যায় প্রায় এক সপ্তাহ । নাফিস এই এক সপ্তাহে প্রতিদিন জুঁইয়ের বাসায় আসে । ইফসির সাথে খেলা করে , ইফসিকে নিয়ে বাহিরে যায় আর জুঁইকে আড় চোখে দেখে যায় ।
এর মাঝে জুঁই শত দুর্বল হয়েও নিজেকে নাফিসের সামনে তুলে ধরে নি । কারণ এই সময়ে এইসব সবাই ভালো ভাবে নিবে না । তার নিজের ভাই ভাবীই বা এই ব্যাপার টা কিভাবে মেনে নিবে । আর নাফিসের পরিবার যেই পরিবারের জন্যে মিথ্যা অজুহাতে সে জুঁইকে ছেড়ে গিয়েছিল সেই পরিবার তাকে কিভাবে গ্রহণ করবে ।
দিনটি শুক্রবার ,
নাফিস আজও এসেছে । বিকেলের দিকে নাফিসকে নিজের বাসায় থেকে খানিকটা অবাকই হয়ে যায় জুঁই । নাফিস হাতে করে ইফসির জন্যে অনেক কিছুই নিয়ে আসে । যা জুঁইয়ের চোখে লাগে । নাফিস সোজা ইফসির কাছে চলে যায় । জুঁই দরজা লাগিয়ে দিয়ে সোজা নাফিসের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ।
– নাফিস এইসব ঠিক না , কেন বার বার আসো তুমি এখানে ?
– তোমার কাছে আসি আমি ?
– আমার মেয়ের কাছে তো আসো । কেন আসো ?
– আমার মন চায় তাই আসি ।
– মানুষ নানান কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে নাফিস ।
– মানুষের কথায় আমি কান দেই না ।
– আমায় দিতে হয় নাফিস , আমায় দিতে হয় ।
– তুমিও দিও না , তাহলেই হয় ।
নাফিসের এমন বাকা বাকা কথা শুনে জুঁই রেগে যায় । তারপর নাফিসকে হুট করেই নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় জুঁই ।
– উফফফফফ নাফিস , আমার কথা শুনো তুমি । তুমি আর কোন দিন এখানে আসবে না , কোন দিন না ।
তখনই নাফিস জুঁইকে জড়িয়ে নেয় নিজের মাঝে । শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে সে । জুঁই যেন তার নিজের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে । নাফিসের গায়ের গন্ধটা সেই আগের মতই আছে । কোন পরিবর্তন হয় নি । নাফিস জুঁইয়ের ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে চুলের ভাজেই আলতো করে চুমু দিয়ে দেয় । জুঁইয়ের চুলের মাতার করা ঘ্রাণে নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল নাফিসের কাছে । তখন সে জুঁইকে আরও বেশি করে জড়িয়ে নেয় ।
– নাফিস ছাড়ো আমায় , ছাড়ো বলছি ।
– উহু ,
– নাফিস ছাড়ো , ইফসি এখানে । ছাড়ো আমায় ।
তারপর নাফিস জুঁইয়ের কপালে আরেকটা চুমু দিয়ে দেয় । তারপর বলে ,
– বিয়ে করে রঙিন বেনারসিতে রাঙিয়ে নিয়ে যাবো তোমায় , ভালোবাসি তোমায় আমি । ভালোবাসি বলেই ফিরে এসেছি আমি । ফিরিয়ে দিও না আমায় । কথা দিলাম ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবো । রাঙিয়ে দিবো তোমার জীবন ।
নাফিসের কথা গুলো শুনে জুঁইয়ের চোখের পানি গুলো গড় গড় করে বেয়ে পড়ে যায় । আর নাফিস হালকা হাসি বলে জুঁইয়ের দুচোখের পাতায় আলতো করে চুমু খায় ।।
.
.
চলবে………………………