কবি বর পর্ব ২

গল্প : কবি বর | পর্ব : দুই

ডাক্তারের প্রশ্নে ইতস্তত করে আদ্রিতা। কয়েকবার ঢুক গিলে এধার ওধার দেখে নেয়। একটু দূরে একটা অ্যাম্বুলন্স দাঁড়িয়ে আছে। সেটার হেডলাইটের আলোয় চারপাশ খানিক আলোকিত। হেলিকপ্টারটা উড়ে যাবার সময় এক ঝাপটা তীব্র বাতাস ছড়িয়ে দিয়ে গেছে আদ্রিতার গায়ে। তার এখন শীত লাগছে। শীতল বাতাস বইছে চারপাশে। আদ্রিতা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

“উনি আমার কেউ নন। রিকশা করে বাসায় যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। তাই হাসপাতালে নিয়ে আসি।”

ডাক্তার মুচকি হেসে বলেন,

“এমন কিছুই আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু এই মানুষটাকে আপনি চেনেন? নাম-পরিচয় কিছু?”

“না।” আদ্রিতা সংক্ষেপে জবাব দেয়।

“উনি বর্তমান সময়ের মন্ত্রী আবেদ হাসানের ছেলে হিমেল হাসান।”

“হিমেল হাসান!” বলে চমকে উঠে আদ্রিতা।

ডাক্তার মাথা নেড়ে বলেন,

“হ্যাঁ, হিমেল হাসান। বাংলাদেশের নামকরা গায়কের মধ্যে একজন। আপনি হয়তো উনার মুখটা ভালো করে দেখেননি।”

“পুরো মুখে রক্ত লেগে ছিল। তাই চিনতে পারিনি। না হলে আমি উনাকে চিনি।”

ডাক্তার আবারো মুচকি হেসে বলেন,

“সেটাই স্বাভাবিক।” বাঁ হাত উঁচিয়ে ঘড়ি দেখে বলেন, “দু’টো বেজে গেছে। এত রাতে গাড়ি পাবেন বলে মনে হয় না। আসুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেই। অ্যাম্বুলেন্সে করে যেতে অসুবিধা হবে না তো আপনার?”

আদ্রিতা কোনোরকম দ্বিধা না করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠে বসে।

এক মাস পর।
সকালে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছিল আদ্রিতা। সাদিপুর প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করে সে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও একটি ছাতা হাতে ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছিল। মাথার উপর উত্তপ্ত সূর্য। হঠাৎ খুব জোরে ছুটে এসে আদ্রিতার পাশে ব্রেক করে একটি সিলভার গাড়ি। না, সিলভার নয়, সাদা। গাড়ির ভেতর থেকে একজন মাথা বের করে জিজ্ঞেস করে,

“এইযে আপু, সাদিপুর প্রাইমারী স্কুল কোনদিকে বলতে পারেন?”

আদ্রিতা ফিরে তাকায়। তাকিয়েই আঁতকে উঠে। সে এতটাই শক খায় যে, হাতের ছাতাটা বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায় সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে। কারণ সেই ছেলেটা আর কেউ নয়, স্বয়ং হিমেল!

“কী হলো? বলুন?”

হিমেলের কথায় চেতনা ফিরে পায় আদ্রিতা। ইতস্তত করে স্কুলের যাবার রাস্তা দেখিয়ে দেয়। হিমেল আন্তরিকভাবে হেসে থ্যাংক ইউ দিয়ে চলে যায়।

আগের দিন হেডস্যার বলেছিলেন, বিশেষ কেউ স্কুলে আসবে। সবাই যেন স্কুল-ড্রেস পরে আসে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বলেছিলেন সবাই যেন পরিপাটি হয়ে আসেন। কারণ যিনি আসবেন, তিনি সাধারণ কেউ নন। সুতরাং সবাই হেডস্যারের কথামতো পরিপাটি হয়েই এসেছে। আদ্রিতা একটি কালো শাড়ি পরেছে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। মুখে একটু মেকআপ করে নিয়েছিল। কিন্তু হিমেলকে দেখার পর তার ভেতরটা কাঁপছে। গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে। অগত্যা সে আড়ালে গিয়ে টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছে নেয়।

স্কুলের সামনে বিশাল ফাঁকা জায়গা। সেখানে চেয়ার পেতে সব ছাত্র-ছাত্রীদের বসতে দেওয়া হয়। সামনে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেয় হিমেল। বলে, একসময় সে-ও এই স্কুলে পড়েছে। নিজের জন্য দোয়া চেয়ে বক্তব্য শেষ করে সে।

গাড়িতে করে খাবার এনেছিল হিমেল। সেগুলো সে নিজ হাতে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে বিলিয়ে দেয়। তার ডান হাত গলার সাথে ঝুলানো। তাই বাঁ হাত দিয়ে খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। ড্রাইভার তাকে সাহায্য করে। টিচাররাও তাকে সাহায্য করেন। শুধু কাছে যায় না আদ্রিতা। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। কেন জানি তার নিশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। হাত পা কাঁপছে। সে যতবার হিমেলের দিকে তাকাচ্ছে ততবারই তার বুক কেঁপে উঠছে।

চলে যাবার আগে আদ্রিতার সামনে এসে দাঁড়ায় হিমেল। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,

“আপনাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি মনে হচ্ছে। কোথায় দেখেছি বলুন তো?”

সহসা আদ্রিতা দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। হিমেল তাকে চিনতে পারেনি। এখন কি তার পরিচয় দেওয়া উচিত হবে? সে কি সেদিন রাতের ঘটনার কথা বলে দেবে? বললে কী ভাববে হিমেল?

আকাশ পাতাল ভেবে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেয়, সে তার পরিচয় দেবে না। তাই মৃদু আওয়াজে বলে,

“একটু আগে রাস্তায় দেখেছিলেন। আমি আসছিলাম। আপনি স্কুলের রাস্তাটা কোনদিকে জানতে চেয়েছিলেন।”

“ও হ্যাঁ, তাইতো!” বলে চলে যায় হিমেল। সে চলে যাবার পর আদ্রিতার ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে যায়। মনে হয়, সত্যিটা বলে দেওয়াই উচিত ছিল।

বিশাল বেডরুমের আরামদায়ক বিছানায় শুয়েও ঘুম আসে না হিমেলের। তার মাথায় সারাক্ষণ একটা ভাবনা ঘুরে বেড়ায়। আজ থেকে মাসখানেক আগে এক রাতে বাইক নিয়ে বেরিয়েছিল সে। হঠাৎ একটা কুকুর রাস্তা পার হতে গিয়ে হিমেলের বাইকের সামনে চলে আসে। যার ফলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তায় উল্টে পড়ে যায় হিমেল। তখন আশপাশে কেউ নেই। হিমেলের মাথাটা ধীরে ধীরে ঝিম মেরে আসে। আস্তে আস্তে ঘোলাটে হয়ে আসে চারপাশ। আর তখনই ছুটে আসে একটি মেয়ে। মেয়ে বললে ভুল হবে, সেই বিপদের সময় ছুটে আসে একটি পরী। হলুদ পরী। দৌড়ে এসে হিমেলকে কোলে তুলে নেয়। তখনও হিমেল পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। একা একটি মেয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়েছিল, সে ব্যাপারটা আজও ভাবায় তাকে। তার ওজন কি একটু কম? না কি মেয়েটির শক্তি বেশি?

ভাবতে ভাবতে উঠে বসে হিমেল। মেয়েটির চেহারা আবছা মনে পড়ে। চোখ বন্ধ করে আবছা আবছা দেখতে পায় সে। কিন্তু পুরো চেহারা বুঝতে পারে না। হিমেল আবার চোখ বন্ধ করে সেদিনের কথা ভাবে। অ্যাক্সিডেন্ট করে রাস্তায় পড়ে আছে সে। একটি মেয়ে দৌড়ে এল। তারপর দু’হাত বাড়িয়ে দিলো। চোখের পলকে দু’হাত দিয়ে তুলে ফেলল শূন্যে। তারপর আস্তে করে রিকশায় নিয়ে বসাল। তার কাঁধে মাথা রেখে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল হিমেল। কিন্তু সেই মেয়ের চেহারা কোনোভাবেই মনে করতে পারে না সে। শুধু ভাবে, কে সেই হলুদ পরী? কোথায় আছে এখন?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here