কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা পর্ব -০৭

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা💦(প্রথম পরিচ্ছদ)
–(পর্ব সংখ্যা-৭)

————————
ইহান ঘরের আশেপাশে চোখ বোলালো। নাহ! এখানে তো কিচ্ছু হয়নি। ঘুমে ঢুলুঢুলু পায়ে বেলকনির দিকে গেল। মুহূর্তেই সে চমকে উঠল। ঘুম ছুট্টে পালালো। নিঝুম মেঝেতে লুটিয়ে আছে। কিছুক্ষণের জন্য সে বাকহারা হয়ে পড়ল। পরপর বিচক্ষণ ইহান তার মস্তিষ্ক সার্প করে নিয়ে দ্রুত নিঝুমকে কোলে তুলে নিলো। বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিল। ক্ষনকাল অতিবাহিত হতেই নিঝুম পিটপিটিয়ে চোখ খুলল। ইহান তখন পানির গ্লাস হাতে নিঝুমের দিকে অতি আগ্রহ নিয়ে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। নিঝুম চোখ খোলা মাত্র ইহানকে এতটা কাছাকাছি দেখে আচমকা তড়িঘড়ি করে লাফিয়ে উঠতে নেয়। ঠিক তখনই ঘটে এক বিপত্তি। দু’জনের মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি লেগে যায়। নিঝুম “আহ” বলে মৃদু আর্তনাদ করে কপালে হাত রাখে। চোখ বন্ধ করে নেয়। ইহান এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে আপাতত ভীষণ রেগে গেছে। রাগ সংবরণ করতে সে হাতের গ্লাসটি টেবিলে রেখে বিনাবাক্যে ওয়াশরুম চলে গেল। এখন আর তার ঘুম হবে না। একবারে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পড়বে। এদিকে গ্লাস রাখার শব্দে আঁতকে ওঠে নিঝুম। এই লোকটা এমন কেন? আস্ত হনুমান একটা। আপনমনে বিড়বিড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ে নিঝুম। হাঁটা ধরে সামনে। উদ্দেশ্য ইরার ঘর।

—————–
ইরা এখনো ঘুমে বিভোর। নিঝুম চুপটি করে ওর মাথার কাছে গিয়ে বসে পরল। ওড়নার খোট ধরে ইরার কানে সুড়সুড়ি দিতে লাগল। ইরা ঘুমের মধ্যে কপালে ভাঁজ ফেলল। তবুও নিঝুম ক্ষান্ত হলো না। সে তার কাজে ব্যস্ত। অবশেষে বারকয়েক মোড়ামুড়ির পর ইরার ঘুম ছুটল। নিঝুমকে দেখে প্রসস্থ হাসল। নিঝুমের কোল টেনে শুয়ে পড়ল। নিঝুম হেসে ইরার মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগল।

ইরা ফ্রেশ হয়ে নিঝুমের সঙ্গে ওদের কলেজ সম্পর্কে আলোচনা করছে। ইরা চাইছে নিঝুম এখন থেকে ওর অধ্যায়নকৃত কলেজে পড়ুক। এতে করে দু’জনে একসঙ্গে থাকা যাবে। নিঝুমও রাজি। এখন শুধু ট্রান্সফার হওয়ার অপেক্ষা।

—————-
ডাইনিং টেবিলে সকলে একসঙ্গে বসেছে নাস্তা করতে। ইশান এখনো ঝিমচ্ছে। ব্রেড হাতে নিয়ে বসে আছে চোখ বন্ধ করে। অনিলা খান ধমকে উঠলেন। ততক্ষণাৎ ইশান ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁত কেলিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,

“হু হু খাচ্ছি তো।”

নিঝুম, ইরা এই দৃশ্য দেখে মুখ টিপে হাসল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নিঝুম বারকয়েক ইহানকে পর্যবেক্ষণ করল। ইহান খাওয়ায় ব্যস্ত কিন্তু তার নজর ফোনে। টেবিলেও ওপর ফোন রেখে আরামসে খাচ্ছে আর ফোন টিপছে। মনে হচ্ছে কোনো সিরিয়াস কিছু করছে। নিঝুম মনে মনে ভেংচি কাটল। কী এমন রাজকার্য করছে কে জানে? পরপর আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের খাওয়ায় মনোযোগী হলো। খাওয়া দাওয়ার এক পর্যায়ে অনিলা খান বললেন,

“ইহান তোর কী আজকে সময় হবে।”

ইহান ব্রেড মুখে পুড়তে পুড়তে অস্পষ্ট স্বরে বলল, “কী দরকার?”

“নিঝুমের আগের কলেজ থেকে টি.সি. এনে ইরাদের কলেজে ওকে ভর্তি করে দিতে হবে। বেশ ঝামেলাপূর্ণ হবে ব্যাপারটা। তোকেই হ্যান্ডেল করতে হবে।”

ইহান চুপ থাকল। সময় নিয়ে বলল,

“আজ সময় হবে না। কাল চেষ্টা করবো।”

নিঝুম মনে মনে ভেঙালো। অনিলা খান সম্মতি দিলেন ইহানের প্রস্তাবে। ইরা তখন আর একটি প্রস্তাব রেখে বসল। সে আজ নিঝুমকে নিয়ে তার কলেজে যেতে চায়। এমনিতেই বাড়িতে একা থেকে নিঝুম বোরিং হতো, টেনশন করত। এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হলেও তাকে যেতে হবে। অনিলা খানের সম্মতি ছিল এটাতেও। ইরা বেশ উৎফুল্ল হয়ে গেল।সঙ্গে নিঝুমও। ইশান এখনো থেকে থেকে ঝিমচ্ছে। ইরা সুযোগ বুঝে বেশ জোরেশোরে একটা খোঁচা দিয়ে বসল। অনিলা খানের দৃষ্টিগোচর। ইশান মৃদু আর্তনাদ করে বসল। অনিলা খান সহ সকলের দৃষ্টি ইশানের ওপর। ইরাও ভঙ্গি ধরে একই কাজ করল। ইশান রেগে তাকালো ইরার দিকে। অনিলা খান উদ্বীগ্ন কন্ঠে বললেন,’ কী হয়েছে।’ দেখা যায় ইশান কিছু বলতে নিবে তার আগেই ইরা বলে ওঠে, ‘মশা, মশা।’ ইরা ততক্ষণাৎ পিড়পিড় করে কেটে পড়ে। ইশান চেয়েও কিছু বলতে পারে না। অনিলা খান অস্ফুট স্বরে বলেন, ‘দিনে-দুপুরে মশা?’

——————
নিঝুম একটা ডার্ক খয়েরী রঙের জর্জেট থ্রি- পিস পড়ে নিলো। হালকা লিপস্টিক, হালকা করে কাজল লাগিয়ে নিলো। এটা তার অভ্যাস। ভারী সাজ একদম অপছন্দ তার। চুলগুলোতে বিনুনি পাকিয়ে বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। ততক্ষণে ইরাও নিচে নেমে গেছে।সে পড়েছে সাদা-কামিজ,মাথায় হিজাব। এই সাদা পড়ার কারণ এটা ইউনিফর্ম হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। অনিলা খানের থেকে বিদায় নিয়ে দু’জনে সমানতালে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছে।
অতঃপর বাড়ির গাড়িতে করেই তারা রওনা হয়ে যায় গন্তব্যে।

গাড়িতে ইরার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎই নিঝুমের মনটা ফের বিষন্নতায় ঘিরে ধরে। পরিবারের কথা মনে পড়ে যায়। দ্বিখন্ডিত মন পুনরায় খন্ড বিখন্ড হতে থাকে। এক পর্যায়ে ইরা ব্যাপারটা লক্ষ্য করে নিঝুমের কাঁধে হাত রেখে বলে,

“কী হয়েছে বউমনি তুমি মন খারাপ করে আছো কেন? বাড়ির কথা মনে পড়ছে বুঝি?”

নিঝুমের এতক্ষণের চেপে রাখা বিষাদ এবার কান্না হয়ে রুপ নিলো। সে ইরাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে উঠল। ইরা তাকে শান্ত করার ভঙ্গিতে বলল,

“কেঁদো না বউমনি। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বরং একটা ফোন দাও। দেখো তারা কী বলে। নিশ্চয়ই খুব শীঘ্রই মেনে নেবে। তুমি তাদের একমাত্র মেয়ে রাগ করে বেশিদিন থাকতে পারবো না।”

ইরার কথায় যেন নিঝুম ভরসা খুঁজে পেল। সে ততক্ষণাৎ চোখ মুছে নিল। ফোন লাগালো মায়ের নম্বরে। ফোনের রিং-এর ধ্বনির সঙ্গে সমানতালে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার অন্তরিক্ষ। বুকের ওপর ভারী যন্ত্রণা বিরাজমান। যেন কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। প্রথম বার রিং হয়ে কল কেটে গেল। তার মা এমনই সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকে। এত শত কাজের লোক থাকতেও তাকেই সবদিক দেখতে হবে। মোটকথা গোছানো সংসারী মহিলা সে। নিঝুম ফের ডায়াল করে এবারে খুব দ্রুতই রিসিভ হয়। ওপাশ থেকে উত্তি কন্ঠ শোনা যায়,

“কেমন আছিস মা। শরীর ঠিক আছে তো। তোর বাবা নেই বলে ফোনটা ধরতে পেরেছি। তুই কী করে পারলি এমন করতে। অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে মানলাম তাই বলে চলে কেন আসলি না? আমি মানিয়ে নিতাম তোর বাবাকে।”

নিঝুমের থমথমে কন্ঠ,”চলে আসতে চাইলেই কী আর আসা যায় মা। তুমি তো জানো বিয়ের পর মেয়েদের জীবন ঠিক কতটা পরিবর্তন হয়। চাইলেই কী মুক্তি অতটা সহজে সম্ভব হয়? তুমিই বলো। আমি কী করতাম। সমাজ কী আমায় ছেড়ে কথা বলতো? একবার বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে গেলে তারা কী আর কখনো ফিরতে দিতো আমায়। অযথাই ললাটে কালিমা লেপে নিয়ে ঘুরতে হতো। এখানে আমি বেশ ভালো আছি। তুমি চিন্তা করো না। এবার বলো তো তোমার অবস্থা ঠিক কী? বাবা কী খুব…… ”

কথা শেষ করতে পারে না নিঝুম। তার আগেই তার মায়ের ‘নাহ,নাহ’ ধ্বনি শোনা যায়। নিঝুম মলিন হাসে।

“মিথ্যে বলছ মা। আমি কিন্তু জানি। চিনি বাবাকে।”

তনিমা আহসান মেয়ের কথায় ডুকরে উঠলেন। চেয়েও পারলেন না চুপ থাকতে। এতদিনে কাউকে পেয়েছেন মনের কষ্ট দেখানোর জন্য। তিনি কিছু বলতে নিবে দেখা যাচ্ছে তার আগেই ফোনটা তার হাত থেকে নিয়ে নেওয়া হলো। পাশে তাকিয়ে দেখলেন আহসান সাহেব কড়া দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে। তিনি নিষ্প্রাণ
চোখে তাকিয়ে আলগা ঢোক গিলে কয়কবার। কলিজা শুকিয়ে আসছে যেন। পানির ভীষণ প্রয়োজন।

নিঝুম মা মা করতে থাকল এপাশ থেকে কিন্তু কোনো সাড়া আসল না। কিছু সময় বাদে কলটা কেটে গেল। নিঝুম আবারও কল করল কিন্তু এবার ফোন সুইচড অফ। অজানা ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার মস্তিষ্ক, অন্তরিক্ষ। না জানি কর হবে এখন।

——————-
কলেজের গেইটে দাঁড়িয়ে আছে ইরা, নিঝুম। দাড়িয়ে থাকার কারণ ইরার ফ্রেন্ড আসছে। একসঙ্গে ঢুকবে। একটু বাদেই ইরার বেস্ট ফ্রেন্ড তরু এসে উপস্থিত। হাসোজ্জল মুখে সে নিঝুমের সঙ্গে আলাপ করে নিলো। এমনিতেই সে বিয়েতে দেখেছে বলে চিনেছে। আজ পারসোনাল পরিচয়ও হয়ে গেল। অতঃপর তিনজন মিলে ভেতরে চলে গেল।

ইরা, তরু কেউ আজ ক্লাসে গেল না। ঠিক করল নিঝুমকে নিয়েই পুরো সময় টা পাড় করবে। তিনজন গেল ক্যাম্পাসের পূর্ব দিকটায়। ওপাশে কোলাহল কম। নিঝুমের ওএটাই বেস্ট মনে হলো। কলেজ টা বেশ সুন্দর। নিঝুমের বেশ মনে ধরেছে। তিনজন সবুজ অরণ্যের ওপর বসে গল্প করছে। থেকে থেকে দু একজন আসছে পরিচত হতে নিঝুমের সঙ্গে। এরা সকলেই ইরার পরিচিত। ইরার সঙ্গে নতুন মানুষ দেখে তাদের আগ্রহী বেশি।

গল্প করতে করতে তরু বলে উঠল,”আর কতো। এভাবে কথা বলতে থাকলে ক্ষিদে পায় না বুঝি?”

ইরা মুখ ভেংচি কেটে বলল,”ঢং না করে সোজাসুজি বললেই হয়। চল ক্যান্টিন।”

নিঝুম মুচকি হাসে। তার নিজেকে বেশ ফ্রেশ ফ্রেশ মনে হচ্ছে। ক্যান্টিনে ছেলে-মেয়েদের আনাগোনা প্রখর। সকলেই নিজেদের মতো আড্ডা দিচ্ছে৷ ছেলেদেরই বেশি নজরে পড়ছে। মেয়ের সংখ্যা নেহাৎই কম।” ছেলেরা একটু বেশিই উদাসীন হয় পড়াশোনার ব্যাপারে আর মেয়েরা একটু সিরিয়াস।” এই কথাটির মর্ম এখন এলে খুব ভালো ভাবে টের পাওয়া যায়।

ইরা,নিঝুম, তরু চেয়ার টেনে বসে পড়েছে। তরু গিয়ে অর্ডার দিয়ে এসেছে। খাবার শীঘ্রই চলে আসবে। ওরা এটা ওটা নিয়ে কথা বলছে ঠিক তখনই একটা ছেলে এসে ওদের সামনে দাড়ায়। একটা বললে ভুল অনেকগুলো। একটার পেছনে সবগুলো লাইন লাগিয়ে আছে। ইরা আর তরু বিরক্ত হলো এদের দেখে। নিঝুম দর্শকের ন্যায় চেয়ে আছে। তার অবশ্য রিয়েক্ট করার মতো কোনো কারণ নেই। সে তো নতুন। কাউকেই চেনে না।

——————-

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি

()

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here