কাছে দূরে পর্ব ৫৭+৫৮

#কাছে_দূরে 🌸🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৫৭

—-‘ স্যার! হীরের ফোন ট্রাক করা গেছে।’

বাতাসের গতি ডিঙিয়ে মাহদীর কথাটা সাবাবের কানে আসতেই চকিত নজরে তাকালো সাবাব। মীর একপ্রকার লাফিয়ে পড়লো মাহদীর পাশে। ইভান দু’ধাপ এগিয়ে এসে মাহদীর পেছনে দাঁড়ালো। সাবাব আর বসে না থেকে ঝড়ের বেগে এসে বসলো মাহদীর পাশে। একবার ল্যাপটপের দিকে ব্যস্ত নজর বুলিয়ে ফের মাহদীর দিকে তাকালো সবাই। মীর প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে বলল,

—-‘ লোকেশন। লোকেশন টা দেখো?’

মীরের আদেশে তৎক্ষনাৎ মাহদী মাথা নাড়লো। কি-বোর্ড বাটন প্রেস করে এদিকে-সেদিক দেখে মাহদী চিন্তা মগ্ন কন্ঠে বলল,

—-‘ এখান থেকে ৯০কিলোমিটার দূরে দেখাচ্ছে। স্যার, এখান থেকে ৫০ কিলোমিটারের পরে তো প্রায় ৪০-৫০ কিলোমিটার শুধু জঙ্গলই পড়ে। ভয়ানক জঙ্গল। মনি হীরকে নিয়ে সেখানে রেখেছে?’

সাবাব ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

—-‘ আভিক গাড়ি বের করো।’

সাবাবের অর্ডার পেয়ে আভিক দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত ভঙ্গিতে উপর নীচ করে মাথা নেড়ে বলল,

—-‘ ওকে স্যার।’

আভিকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মীর বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মলিন মুখে বলে,

—-‘ মনির পেছনে একটা মোক্ষম মাথা আছে রে ভাই। কিন্তু কে সে? মনির হাজবেন্ড নাকি তৃতীয় কেউ?’

মীরের প্রশ্নে কপালে চিন্তার সুক্ষ্ম ভাজ পড়লো সাবাবের। চিন্তাক্লিষ্ট কন্ঠে বলল,

—-‘ রহস্যের পর্দা এখনও উঠছে না! মনি বাবাই কে ভালোবাসার প্রতিশোধ নিতে খুন করেছে। অথচ বাবাইকে খুন করার দুইবছর আগে বিয়ে করে একটা মেয়েও জন্ম দিয়েছে। তাহলে মনি বাবাইকে মারলো কেন? তখন তো সেও বাবাইয়ের মতোই হয়ে গেছিলো তাই না? সেও বিয়ে করে মা হয়েছিল। তাহলে তো সবটা মিটেই গিয়েছিলো। নিজেও একই কাজ করে বাবাইকে খুন করলো। ঠিক এখানটাতেই মিলছে না রে!’

মীর গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। দু’হাতে পুরো মুখ মালিশ করে ক্লান্ত স্বরে বলল,

—-‘ মনিকে যতক্ষণে ধরা না যাচ্ছে ততক্ষণে কোনো রহস্যই ঠিকঠাক ভাবে সামনে আসবেনা।’

সাবাব চিন্তামগ্ন হয়ে পূনরায় ল্যাপটপের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ল্যাপটপের স্ক্রিন দেখতে দেখতে ভাবল হীরের দেওয়া সেই ধাঁধা টা,

—-‘ মনে রেখো কেউ আমাকে মারতে চায় আবার কেউ আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কেউ মারতে চায় ভালোবাসা হারানের ক্ষোভে আর কেউ বাঁচিয়ে রাখতে চায় সম্পত্তি পাওয়ার লোভে।____

সাবাব ফট করে চোখ বুঁজে নিলো। মন দিয়ে ভাবতো চেষ্টা করলো,

—-‘ কে মারতে চায় আর কে বাঁচিয়ে রাখতে চায়?__মারতে চায় কে? কে? কে? মনি! হ্যাঁ। মনি মারতে চায়। কারন মনি খুব সহজে তার ভালোবাসার মানুষ টার সন্তানকে মেনে নিতে চাইবে না। সে যদি ভালোবাসা হারানোর ক্ষোভে তার নিজের বোনকেও মেরে ফেলতে পারে তবে হীর তার তার কাছে কিছুই না! তাই মনি খুব সহজেই চাইবে হীরকে মেরে ফেলতে। তাহলে এতদিন হীরের উপর সরাসরি মার্ডার হওয়ার যতগুলো এট্যাক হয়েছে সেগুলো সব ছিলো মনির প্ল্যান। আর বাকি যে এট্যাক গুলো হয়েছে মানে, একজন ছিলো যিনি হীরকে বেঁধে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো,আর একজন ছিলো নার্স যে হীরকে বাঁধতে চেষ্টা করেছিলো! তারা ছিলো দ্বিতীয় ব্যাক্তির লোক। কিন্তু তৃতীয় ব্যাক্তি কোনো এট্যাক করেনি। তবে কি তরী আর কিরনকে তুলে নেওয়ার প্ল্যান তৃতীয় ব্যাক্তির? ওদের কিডন্যাপ করিয়ে মনিকে দিয়ে আমাকে আর হীরকে ফাঁদে ফেলে মালয়েশিয়া নিয়ে আসার প্ল্যান তার? আর এখন যে হীরকে কিডন্যাপ করা হয়েছে সেটাও কি তার প্ল্যান? হ্যাঁ। হতেই পারে। কেননা, মনি হীরকে তুলে নিয়ে গেলে বেশিক্ষণ বাঁচিয়ে রাখবে না। আর তৃতীয় ব্যাক্তি হীরকে তুলে নিয়ে গেলে তার কাজ হাসিল না হওয়া অব্দি হীরকে মারবে না। রাইট। তবে এই সব কিছুর পেছনে সেই তৃতীয় ব্যাক্তিই আছে। যার মূখ্য উদ্দেশ্য হীরের থেকে সেই চাবির গুচ্ছের ছোট বক্সটা নেওয়া। আর বাবাইয়ের সমস্ত সম্পত্তির দলিল গুলো নিজের নামে করে নেওয়া। কিন্তু এসব যদি উনার একারই উদ্দেশ্য হয় তবে দ্বিতীয় ব্যাক্তি কোথায়? উনিও তো সম্পত্তির জন্যই মেরেছে বাবাইকে। তবে উনি কেন এসব কিছুর মাঝে নেই? আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে আমাদের বংশীয় এত খবর এরা তিনজন কি করে জানলো? ছোট মা কি মনিকে বলেছিলো? মনে হয়না। কারন ছোট মার বিয়ের পরে মনি কেবল দু’বার এদেশে এসেছিলো। এই দু’বার কি ছোট মা সবটা মনিকে জানিয়ে দিয়েছিলো। জানিয়ে দিলেও এতো ছোট ছোট ব্যাপার গুলো মনি জানলো কি করে? আর বাকি দু’জন? তারাও বা কি করে জানলো? ওদের মার্ডারের প্ল্যান এমন ভাবে হয়েছিল যেন তারা তিনজনই যুগযুগ ধরে ছোটমা আর বাবাইকে জানতো। আমাদের বংশের ইতিহাস সম্মন্ধে জানতো। যেন সবটা তাদের ঠোঁটের গোঁড়ায় মুখস্থ ছিলো। তাতে হতে পারে এক. ছোটমা মনিকে বোন হিসেবে সবটা বলেছিলো আর মনি সেটারই সুযোগ নিয়ে বাকি দু’জনকে জানিয়েছিলো। আর দুই. হতে পারে তারা দু’জনই বাবাইয়ের খুন ঘনিষ্ঠ ছিলো। যার কারনে খুব সহজেই তারা পেছন থেকে বাবাইকে ছুরিকাহত করতে পেরেছিলো।’

—-‘ কি রে কি ভাবছিস এতো? চল?’

পেছন থেকে মীর সাবাবের কাঁধ চাপড়ে বলল কথাটা। হঠাৎ ভাবনার সুতো ছিঁড়তে ক্ষনিকের জন্য চমকে উঠলো সাবাব। তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে আশেপাশে দেখতে মীর কপাল কুঁচকে বলল,

—-‘ কি হলো চমকালি কেন? কি ভাবছিস?’

সাবাব পেছন মুড়ে মীরের মুখের দিকে একবার তাকালো। উদাসীন চাহনি নিভিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-‘ কিছু না রে। চল আমরা এবার বেরোই। মাহদী,ল্যাপটপ টা সঙ্গে করে নিয়ে এসো।’

মাহদী অর্ডার পেয়ে ‘জি স্যার’ সম্মোধনে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। মীর আর সাবাব একসাথে বেরিয়ে গেলে ইভান আর মাহদী তাদের পেছন পেছন চলে যায়।

_________________

বাইরে থেকে দরজার খোলার শব্দ হচ্ছে। শব্দ পেয়ে হীর মনেমনে প্রস্তুত হয়ে নিলো। হাতে চকচকে একটা নতুন তালা নিয়ে ঘরে ঢুকলো রোজ। মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে চোখ-মুখ প্রায় ঢেকে রেখেছে। রোজ হাতের তালাটা পাশের ছোট্ট বেডটার উপর ফেললো। ডান হাতে মাথার চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে হীরের দিকে তাকালো। হীর ক্লান্ত চোখে রোজকে দেখছে। পাতলা শরীরে টাইট হয়ে এঁটে আছে ছোট্ট টপস টা। টপসের লেন্থ হাঁটুর প্রায় ১০-১২ ইঞ্চি উপরে গিয়ে আঁটকে আছে। আবার পেটের কাছে বেশির ভাগ জায়গা উদাম। পায়ে হাই হিলস। কাঁধে লম্বা শিকল বিশিষ্ট পার্স। কাঁধ থেকে ঝুলে কোমর অবধি এসে ঠেকেছে। পাতলা সরু ভ্রুর নীচে রংবেরঙের আইস্যাডোর বাহার। ঘন আইলেস,মোটা আইলাইনার,গাঢ়ো লিপস্টিক সবটাই দক্ষ হাতে আঁকা। রোজ হীরের চাহনিকে উপেক্ষা করে হেলতেদুলতে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। রোজের এগিয়ে আসায় হীরের মনোযোগ ভঙ্গ হলো। রোজ পাশের বেডের উপর আধুনিক ভঙ্গিতে বসতে বসতে হীরের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো,

—-‘ নাম কি তোমার?’

হীর নিঃসংকোচে উত্তর দিলো,

—-‘ হীর।’

নামটা শুনতে রোজের কপাল কুঁচকে এলো। হীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,

—-‘ তুমি?’

—-‘ রোজ।’

হীর মৃদু হাসলো। রোজের পা থেকে মাথা অব্দি পুনরায় একবার দেখে নিয়ে বলল,

—-‘ ফরহাদ রেজার একমাত্র কন্যা।’

রোজ চকিত নয়নে তাকালো। বিস্ময় নিয়ে বলল,

—-‘ ড্যাডকে তুমি চিনো?’

—-‘ হু চিনিতো। তোমাকেও চিনি আর তোমার মমকে তো আরও ভালো করে চিনি।’

রোজের বিস্ময় কাটলো না। সে আগের মতোই বলল,

—-‘ হাউ? তুমি কি মম ড্যাডের পূর্ব-পরিচিত?’

—-‘ হু।’

—-‘ তুমি আমাকেও চিনো?’

—-‘ হু।’

—-‘ আমার না তোমাকে প্রথমবার দেখাতেই ভীষণ চেনাচেনা লাগছিলো। মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে চিনি। কোথাও যেন দেখেছি। আচ্ছা তুমি কি বলতে পারবে আমি তোমাকে কোথায় দেখেছি?’

হীর স্মিত হাসলো। বলল,

—-‘ বলবো। তার আগে তুমি আমায় এটা বলো তুমি এঘরে কেন এলে? তোমার মম যদি জানতে পারে-

—-‘ মম ড্যাড কেউ বাসায় নেই। তোমাকে এখানে নিয়ে আসার পর তারা দু’জনেই কোথাও বের হয়েছে-

রোজের বলার মাঝেই হীর প্রশ্ন করে উঠলো,

—-‘ কোথায়?’

রোজ থেমে গেলো। হীরের দিকে একবার তাকিয়ে ভাবুক কন্ঠে বলল,

—-‘ মে বি কোনো মিটিংয়ে। আমি জানিনা। মম ড্যাড বের হওয়ার পরে আমিও বেরিয়ে গেছিলাম। বাট ফর দ্যা ফার্স্ট টাইম মম ড্যাডের কিডন্যাপ করা কোনো মেয়েকে নিয়ে আমি ভাবছি। আমি ক্লাবে গিয়ে এক মুহুর্তের জন্যেও সেখানে কনসেনট্রেট করতে পারিনি। আমি শুধু ছটফট করেছি কখন আমি বাসায় ফিরবো কখন আমি তোমার সঙ্গে কথা বলবো। আচ্ছা বলবে আমায় কে তুমি?’

হীর রোজের আচরন ও কথায় হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো। রোজের মম ড্যাডের নিকৃষ্টতার কোনো ছাপ নেই তার মাঝে। পোশাকে অতিরিক্ত অত্যাধুনিকতার ছোঁয়া থাকলেও মনের দিকটা ভীষণ কোমল তার। হীর মুগ্ধ হয়ে গেলো তার বোনের স্নিগ্ধ কোমল আচরনে। মনেমনে তৃপ্তিদায়ক শান্তি নিয়ে ভাবলো,’যদি এক বোন অন্য বোনের মৃত্যুর কারন হতে পারে তবে ইতিহাস ঘুরে সেই এক বোন অন্য বোনের বাঁচার কারন কেন হতে পারে না?’

হীরকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে রোজ অধৈর্য্য হয়ে হীরের চেয়ারের কাছে নেমে এলো। হাঁটু ভেঙে বসে হীরের হাতের উপর হাত রেখে অস্থির কন্ঠে বলল,

—-‘ বলো না আমি তোমায় চিনি কি না?’

হীর ঘোর কাটিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকালো রোজের দিকে। রোজ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। হীর মায়া জড়ানো কন্ঠে বলল,

—-‘ আমি তোমার বোন। বড় বোন।’

হীরের জবাবে যেন হোঁচট খেয়ে পড়লো রোজ। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,

—-‘ মানে? তুমি আমার বোন! কিভাবে? আমার তো মনে পড়েনা আমার পরে আমার আর কোনো ভাই বোন ছিলো কি না। বা আমার আগে থাকলেও মম কখনও বলেনি সেটা। তাহলে তুমি আমার বোন কি করে হলে?’

—-‘ আমি তোমার মমের বোনের মেয়ে। মানে তোমার মনির মেয়ে। তুমি যেমন আমার মনির মেয়ে ঠিক তেমনই আমিও তোমার মনির মেয়ে। আমি কনিকা এবং রিয়াদ আহমেদের মেয়ে হীর।’

হীরের কথা শুনে ছিটকে পড়লো রোজ। কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে হীরের দিকে। যেন এক্ষনি হীর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছে এখানে। রোজের ছিটকে পড়া দেখে হীর অবাক চোখে তাকালো। কিছু বলতে নিলেই রোজ এগিয়ে এসে হীরের গালে হাত রাখলো। হীর বিস্মিত চোখে দেখে চলেছে রোজকে। রোজের চোখ জোড়া হঠাৎ টলমলিয়ে উঠলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,

—-‘ তুমি আমার বোন। তুমি রিয়াদ স্যারের মেয়ে হীর। ইয়েস আই গট ইট। তুমিই হীর। হীর। আমার বোন।’

হীর অবাক কন্ঠে বলল,

—-‘ তুমি আমার বাবাকে চিনো? রিয়াদ আহমেদকে-

হীর কথাটা সম্পূর্ণ শেষ করার আগেই রোজ তাকে থামিয়ে দিলো। কারোর পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। রোজ কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করলো। যখন নিশ্চিত হলো সত্যি কেউ আসছে এদিকে তৎক্ষনাৎ বেড থেকে তালাটা উঠিয়ে বেরিয়ে গেলো। বাইরে থেকে ঠিক আগের মতো তালাবন্ধ করে হারিয়ে গেলো সে। হীর এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে রোজের যাওয়া দেখলো। রোজ বেরিয়ে যেতে যেতে হীরও শুনতে পেলো কারোর পায়ের শব্দ। তাই রোজকে ডাকতে নিয়েও আর ডাকতে পারলো না। থম মেরে গেলো। পূনরায় কান সজাগ করে বসলো। এবার কে আসবে এ ঘরে? ঝনঝন শব্দ করে তালা খুলে এবার ভেতর প্রবেশ করলো স্বয়ং মনিকা। মনিকে দেখতেই হীর মুখের ভঙ্গিমা বিস্ময়কর করে তুললো। পূরনায় নাটক করতে হবে বলে মনে মনে পস্তুত হয়ে নিলো। কন্ঠে করুন সুর তুলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ডেকে উঠলো হীর,

—-‘ ম..ম মনি। মনি তুমি এখানে? তুমি এখানে কি করে এলে মনি? মনি দেখো না কারা যেন আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছে! আমি চিনি না ওদের। মনি তুমি প্লিজ আমাকে এখান থেকে বের করে নাও। আমাকে এখান থেকে বের করো মনি! মনি?’

হীরের করুন সুরে মনিকা পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। যেন কত যুগ পরিয়ে গেলো এই দিনটার আশায়। আজ অবশেষে সেই দিন এসে হাজির হলো। যেন এক প্রশান্তি। মনিকা চোখ বুঁজে টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মনিকার আচরন হীর মন দিয়ে দেখছে। দক্ষ অভিনয়ে পূনরায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে লাগল,

—-‘ মনি? ওরা কি তোমাকেও কিডন্যাপ করে নিয়ে এলো? এবার কি হবে? মনি! মনি তুমি কথা বলছো না কেন? তোমার তো হাত পা বাঁধা নেই মনি! আমাকে খুলে দাও না তুমি? আমার এভাবে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে মনি!’

মনিকা আচমকা হীরের খুব কাছে চলে এলো। দাঁত কেলিয়ে হেসে ফিসফিসিয়ে বলল,

—-‘ খুব কষ্ট হচ্ছে হীরপরি? খুব কষ্ট হচ্ছে?’

মনির আকস্মিক আচরনে ভড়কে গেলো হীর। বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

—-‘ খুব কষ্ট হচ্ছে গো। প্লিজ আমায় খুলে দাও।’

মনিকা দূরে ছিটকে পড়লো। বিকট শব্দ তুলে হাসতে লাগলো। হীর ঢোক গিলে কুটিল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মনির দিকে। মনি হাসতে হাসতে হীরের দিকে তাকাতেই হীর চোখ নামিয়ে নিলো। দৃষ্টিতে ঢেলে দিলে একরাশ অসহায়ত্বতা। মনি আবারও ছুটে এলো হীরের সম্মুখে। হীরের খুব কাছে এসে বলল,

—-‘ কি যে শান্তি হচ্ছে হীরপরি তোমায় বলে বুঝাতে পারছিনা। তোমার কষ্ট হচ্ছে শুনে বুকের আগুন নিভে যাচ্ছে। কত বছরের দাউদাউ করা আগুন একটু একটু করে নিভে যাচ্ছে।’

হীর কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,

—-‘ মনি তুমি এসব কি বলছো? পাগল হয়ে গেলে নাকি? আমাকে খুলে দাওনা মনি? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!’

মনিকা ফট করে হীরের মুখ চেপে ধরলো। হীর ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলেই মনিকা রাগে কটমট করে বলে,

—-‘ তোর সাহস কি হলো আমাকে পাগল বলার? তুই জানিস এই মুহুর্তে আমি তোর সাথে কি করতে পারি? আমি তোকে মেরে ফেলতে পারি! মারবো? হু বল? বল বল বল? হাহাহাহা। বল মারবো?’

হীর জ্বলে উঠলো ভেতর ভেতর। আক্রোশে তার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠলো। মনি যে পুরোপুরি সাইকো হয়ে গেছে সেটা তার বুঝতে বাকি রইলো না। কিন্তু এক্ষনি তা প্রকাশ করলো না। মুখ বুঝে সহ্য করতে লাগলো।

মনিকা পাগলে মতো করতে করতে রিভলবার তাক করলো হীরের মাথায়। হীর চমকে উঠে কিছু বলতে নিলেই বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো কেউ। পেছন থেকে মনিকাকে হেঁচকা টান দিয়ে ফেলে দিলো নীচে। অগ্নি দৃষ্টিতে মনিকার দিকে তাকিয়ে থেকে টান মেরে তার থেকে রিভলবার টা কেঁড়ে নিলো। রিভলবার হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই তার মুখটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো হীরের চোখে। হীর মনে মনে বলে উঠলো, ‘ফরহাদ রেজা।’
#কাছে_দূরে 🌸🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৫৮

জঙ্গলের পাশের মেইন রোডে এসে গাড়ি থামাতে হলো আভিককে। মাহদী চেঁচানো সুরে বলল, ‘হীরের লোকেশন এখানেই বলছে।’ এটুকু শুনতেই গাড়ি থামালো আভিক। সাবাব ছটফট করে উঠলো মাহদীর বার্তায়। বুকের ভেতরটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন শিথিল হয়ে গেলো। কিন্তু সেই শিথিলতা ক্ষনকালেই কেটে গেলো। মীর গাড়ির কাচ ভেদ করে জঙ্গলের দিকে দৃষ্টি পাত করে বলল,

—-‘ এখানে তো কেবল জঙ্গল। কোনো মানুষ থাকে বলে মনে হচ্ছে না।’

মীরের কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়লো আভিক আর ইভান। কয়েক মুহুর্তের জন্য হীরকে খুঁজে পাওয়ার আশায় বুকটা ভরে উঠলেও সেই আশা নিভে যেতে মীরের যুক্তিসঙ্গত কথাটাই যথেষ্ট হলো। মাহদী ল্যাপটপটা তুলে ধরে সবাইকে দেখিয়ে বলল,

—-‘ এই যে দেখুন স্যার। লোকেশন এটাই। আমাদের বের হয়ে একবার দেখা উচিৎ!’

মাহদীর কথায় সবাই সায় দিলো। সাবাব দ্রুত নেমে গেলো গাড়ি থেকে। ল্যাপটপ থেকে সঠিক লোকশনটা দেখে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেলো সে। সাবাবের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়াতে ভড়কে গেলো সবাই। আচমকা গাড়ি থেকে নেমে কোথায় হারালো! ইভান বলল,

—-‘ স্যার বোধহয় জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেছেন। আমাদেরও যাওয়া উচিৎ। এমন একটা সিচুয়েশনে কেউ একা থাকা মানের লাইফ রিস্ক।’

ইভানের কথায় সবাই সম্মতি দিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে ছুটলো সেদিকে। দিনের ফকফকা আলোতেও জঙ্গলের ভেতর থেকে মনে হচ্ছে সন্ধ্যে নামতে চলেছে। এই জঙ্গল কোনো সাধারণ জঙ্গল নয়। এ যেন এক ভয়ানক মৃত্যুপুরী। যত ভেতরে এগোনো হচ্ছে ততই হচ্ছে জঙ্গলেের শুরু হচ্ছে। চারপাশ টা কাঁটাঝোপে ভরপুর। সামনে পা ফেলতেই বুক কাঁপছে সাবাবের। যেদিকেই এগোনে হচ্ছে সেদিক থেকেই হাত টা কেটে ছিঁড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সমানে কেউ ব্লেড দিয়ে শরীর চিঁড়ে দিচ্ছে। সাবাবের গালের ডান পাশে একাধারে অনেক গুলো দাগ পড়লো কাঁটাবনের আঘাতে। কপালের কোন টাতেও কেটে গেছে। মরিচ লাগার মতো জ্বলছে তার পুরো শরীর। তবুও এগোচ্ছে। কি আছে এই জঙ্গলের আড়ালে? তাকে বের করতেই হবে।

আরও কিছু পথ অতিক্রম করতে হঠাৎ কাঙ্ক্ষিত কোনো জিনিস দেখতেই থমকে গেলো সাবাব। কাঁটাবনের উপর পড়ে আছে হীরের ফোনটা। সাবাব হুমড়ে পড়ে ফোনটা উঠালো। ফেনটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে নিশ্চিত হলো এটা হীরেরই ফোন। চারপাশে তৃষ্ণার্থের মতো দৃষ্টি ঘোরালো। এই ভয়ানক জঙ্গলের শেষ কোথায়? কোথায় আছে তার হীর?

—-‘ ভাই? ভাই পেলি কোনো ক্লু?’

পেছনে থেকে দৌড়ে এসে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে কথাটা জিজ্ঞেস করলো মীর। সাবাব পেছনে তাদের অস্তিত্ব পেয়ে সেদিকে না ফিরেই হীরের ফোনটা উঁচিয়ে ধরলো। মীর হীরের ফোনটা দেখতেই নিজের দিকে কেঁড়ে নিলো। অসহায় কন্ঠে বলল,

—-‘ ক..কার রে?’

পেছন থেকে মাহদী উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

—-‘ স্যার,এটাই তো লোকেশন দিচ্ছে। তার মানে এটা হীরের ফোন।’

ইভান আর আভিক বিষ্ময় নিয়ে দেখলো ফোনটা। সামনে থেকে সাবাব অধৈর্য্য হয়ে চাপা নিঃশ্বাস ফেললো। নিজেকে সংযত করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

—-‘ তবে কি হীরকে এই জঙ্গলের ভেতর থেকে নেওয়া হয়েছে? আর যেতে যেতে ওর ফোনটা এখানে পড়ে গেছে? নাহ্! হিসেব মিলছে না! এই জঙ্গলের শুরু তো আছে কিন্তু শেষ নেই। সুতরাং, এখান থেকে হীরকে নিয়ে কোনো দিকে যাওয়াই পসিবল না। হতে পারে হীরকে ঐ রোড থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! আর ওর ফোনটা কেউ ইচ্ছে করে এদিকে ফেলে রেখে গেছে। যেন আমরা ওর লোকেশন ট্রাক করতে চাইলেও ভুল লোকশনে এসে পড়ি। আর আমাদের মূল্যবান সময় গুলো এসব মিথ্যে ক্লু খোঁজার পেছনেই ব্যায় হয়ে যায়। আর ওদিকে থেকে ওরা ওদের কাজ টা সারতে পারে।’

সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লো। ভাবুক কন্ঠে আভিক বলল,

—-‘ তবে তো স্যার আমরা ঠিক লোকশনেই এসেছি।’

আভিকের কথা বুঝতে না পেরে সবার কপাল কুঁচকে এলো। ইভান আর মাহদী মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলে উঠলো,

—-‘ মানে?’

আভিক মাহদী আর ইভানের দিকে এক পলক দেখে সাবাবের দিকে তাকালো। সাবাব উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

—-‘ বুঝয়িে বলো?’

আভিক হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলতে আরম্ভ করল,

—-‘ দেখুন স্যার, ওরা ভেবেছিলো হীরের ফোনটা এখানে ফেলে দিয়ে গেলে আমরা ভুল লোকশনে এসে হীরকে খুঁজব। কিন্তু ওরা এটা ভাবেনি রাস্তা তো একই। ওরা হীরকে নিয়ে মেইন রোড থেকে গিয়েছে আর আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেছে হীরকে নিয়ে ওরা জঙ্গলের ভেতর থেকে গেছে। অথচ এই জঙ্গলের আগা গোড়া কোনোটাই নেই। শুধু বাড়তেই থাকে। কিন্তু বের হওয়ার পথ নেই। তবে আমরা যদি রোড ধরে এই জঙ্গলের শেষে যেতে চাই তাহলে তো অবশ্যই এ জঙ্গলের শেষ মাথায় পৌঁছাতে পারবো। কেননা,জঙ্গলের ঘনত্ব এতো বেশি যে আমরা চাইলেও মাথা ঠিক রেখে জঙ্গলের শুরু শেষ বের করতে পারবোনা। সুতরাং আমাদের এখন মেইন রোড ধরেই জঙ্গলের শেষ মাথায় পৌঁছাতে হবে। তাহলে আম সিওর আমরা কোনো না কোনো উপায় ঠিক পাবো। হীর,তরী আর কিরন ওদেরকে ঠিকই খুঁজে বের করতে পারবো।’

আভিকের কথায় সবার মুখেই হাসির রেখা ফুটলো। সবাই একসাথে গলা মিলিয়ে বলল,

—-‘ ইয়েস পসিবল।’

তারা পূনরায় রওনা হলো জঙ্গলের শীর্ষে পৌঁছাতে।

________________🌸

হীরের বাঁধা হাত দুটোতে ভর দিয়ে হীরের সম্মুখে এগিয়ে গেলো ফরহাদ রেজা। বাঁধা হাতে অতিরিক্ত ভর এবং চাপ সহ্য করতে না পেরে কাতরে উঠলো হীর। হীরের কাতর কন্ঠে রেজা শকুনি দৃষ্টিতে তাকালো। হীরের হাতের উপর থেকে ভর ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হীর ব্যাথা থেকে মুক্তি পেয়ে যেন দম ছেড়ে বাঁচল। হাত দুটো নাড়াতে চেষ্টা করলো। বিষাক্ত ব্যাথা করছে হাত দুটোয়। হীরকে নড়তে চড়তে দেখে রেজা বাঁকা হাসলো। হাতের রিভলভারটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,

—-‘ সেই চোখ,সেই মুখ। সেই চাহনি। তোমায় দেখে আমার বরাবরই মনে হয়েছে এ যেন রিয়াদ-কনিকার সম্মিলিত এক অনন্য রূপ। যার মাঝে তারা দু’জনেই আছে। একদম জীবন্ত।’

হীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে শুঁকনো গলায় ঢোক গিলল। ক্লান্ত চোখে তাকালো রেজার দিকে। শান্ত কন্ঠে বলার চেষ্টা করল,

—-‘ যাদের তুমি নিজের হাতে খুন করেছো তাদেরকে যে কারোর মাঝে হ্যালুসিনেট করাটাই স্বাভাবিক। তাই না ফরহাদ রেজা?’

হীরের শান্ত ভঙ্গিতে বুক কাঁপানো কথায় কেঁপে উঠলো রেজা। কেঁপে উঠলো মনিকাও। আকষ্মিক হীরের থেকে এমন ধরনের কথা তারা কস্মিনকালেও আশা করেনি।
রেজা মনিকার দিকে তাকালো। মনিকাও রেজার দিকে তাকালো। দু’জনের হতবিহ্বল রিয়াকশনে হীর হেসে উঠলো। মনিকা আর রেজার মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে বলল,

—-‘ কি? আমার থেকে এধরনের কথা তোমরা আশা করোনি তাই তো? না করাটাই স্বাভাবিক! কারন হীর যে গভীর জলের মাছ মনি। তাকে এতো সহজে ধরতে পারা___ হাহাহা হাস্যকর বটে।’

রেজা হীরের কথা হতবাক হয়ে শুনছে। তার চোখেমুখে চড়াও হয়েছে ভয়ানক বিষ্ময়। হীর একই ভঙ্গিতে পূরনায় বলল,

—-‘ তুমি না ঠিকই বলেছো। আমার ভেতরে আমার বাবা আর মা দু’জনই আছে। আর একদম জীবন্ত। আমার বাবা বেঁচে আছে জলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মতো আর মা বেঁচে আছে ঠান্ডা বরফের মতো। বাবা বেঁচে আছে রেজা,মনিকা আর আজিম আহমেদকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে। আর মা বেঁচে আছে তোমাদের মৃত্যুকান্ডের সাক্ষী হয়ে ঐ জলন্ত শিখায় বরফের পানি ঢালতে। তবে যতক্ষণে মা তোমাদের পানি দিবে ততক্ষণে তোমরা জ্বলেপুড়ে খাক।’

রেজা কেঁপে উঠলো। পিছিয়ে গেলো দু-কদম। মনিকা উঠে এসে রেজার পাশে দাঁড়ালো। হীর তাদের আচরন দেখে হাসতে লাগলো। তার হাসির শব্দে ঝনঝন করে কাঁপছে ঘরময়। তার পাগলের মতো হাসির শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো মনিকা আর রেজা। মনিকা রেগে-মেগে ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে গেলো হীরের দিকে। রাগ আর চাপা ক্ষোভে স্ব জোরে চড় বসালো হীরের গালে। হীর চড় খেয়ে ঝুঁকে গেলো পাশ ফিরে। মনিকা রাগে কাঁপতে কাঁপতে হীরের চুলের মুঠি চেপে ধরে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে আনলো। দু’জনের চোখের জলন্ত আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। মনিকা হীরের রক্তিম চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও থাপ্পড় মারে। হীর অসহ্য ব্যাথায় চোখ বুঁজে নিয়ে গিলে খেলো ব্যাথা। মুখে চুপ রইলো। মনিকা হীরের মুখ টা শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—-‘ একদম নয় হীর। বাবার মতো ওভারস্মার্ট হওয়া চলবে না। জানোই তো তাদের শেষ পরিনতি। কিভাবে মরতে হয়েছিলো আমাদের হাতে? মনে করো? তোমার মা,তোমার বাবা! ঠিক ওভাবেই মরবে তুমিও! আমি মারবো! আম-

মনিকা কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই হীর করে বসলো এক অভাবনীয় কাজ! মনিকা তার উপর চড়ায় হওয়ায় মনিকার পা তার পায়ের কাছে থাকাতে সে নীচ থেকেই মনিকার পায়ে লাথিয়ে বসিয়ে দিলো। আচমকা এমন হামলাতে মনিকা নিজের ব্যালেন্স রাখতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে নীচে পড়লো। প্রচন্ড ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলেই চমকে উঠলো রেজা। মনিকাকে তুলতে গিয়ে অবাক চোখে দেখলো একবার হীরকে। এ কেমন ধূর্ততা হীরের। মনিকা রাগে ক্ষোভে চিৎকার করে উঠলো। হীর মনিকার অবস্থা দেখে হেসে উঠে বলল,

—-‘ নিজেকে কি ভাবছো বলোতো মনি? তোমার থেকে ওয়েল ট্রেইনড কিন্তু আমি। কোথায় কখন কোন এঙ্গেলে আঘাত করতে হয় সেটা তোমার থেকে ভালো রপ্ত করেছি আমি। ইশশ, ব্যাথা পেলে গো?’

মনিকা নিজের রাগ আর ক্ষোভ কোনোটাই সংযত রাখতে পারলো না। কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে এবার হীরের চেয়ার বরাবরই লাথি দিলো। হীর নিজেকে সামলাতে গিয়ে চেয়ার নিয়ে ঢলে পড়লো নীচে। নীচে পড়ে ফ্লোরে স্লিপ কেটে অনেক দূরে চলে গেলো চেয়ার। বা হাতটা একদম নিচে পড়ায় সাদা চুরিদারের জামার হাতাটা ছিঁড়ে হাতের চামড়া ছিলে গেলো বেশখানিকটা। ব্যাথায় প্রানটা ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও মুখ বুঝে সহ্য করে নিলো হীর। রেজা চেঁচিয়ে উঠে কাউকে ডাকলো। দুটো লোক ভেতরে এসে হীরকে আবারও চেয়ার সুদ্ধ টেনে তুললো। হীরের অসহনীয় অবস্থা দেখে মনিকা খেঁকখেঁক করে হেসে উঠলো। বলল,

—-‘ আমার থেকে ওয়েল ট্রেইনড হলেও প্রফেশনে তুমি একদম নতুন হীর। আর আমি তো অভ্যস্ত এসবে। তোমার থেকে বেশি অভিজ্ঞ আমি। এই যে দেখছো না? উনি? উনি কিন্তু তোমার বাবার খুব কাছের এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফরহাদ রেজা। উনার থেকেই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত আমি। বারো বছরের অভিজ্ঞতা।’

হীর ব্যাথা নিয়েই হেসে পড়লো। রেজার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-‘ তোমার বউ বারো বছর ধরে অভিজ্ঞ ফরহাদ রেজা। আর আমার জন্মই তো হয়েছে এসব নিয়ে। আমি তো জন্মগত ভাবেই ওয়েল ট্রেইনড এন্ড ওয়েল ট্রেইনার!’

মনিকা ফুঁসে উঠে হীরের দিকে তেড়ে যেতে নিলেই রেজা তার হাত ধরে ফেলে। কর্কশ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠে বলে,

—-‘ শান্ত হও মনি! এখন এসব করার সময় নয়। ওকে মারার সময় অনেক পাবে। আমাদের আগে নিজেদের কাজ হাসিল করতে হবে। এসো?’

মনিকা ছিটকে উঠে বলল,

—-‘ না আমার কোনো কাজ করার নেই। আগে আমি ওকে মারবো এটাই আমার আসল কাজ।’

রেজা দাঁতে দাঁত চেপে তাকালো মনিকার দিকে। মনিকাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে টেনে নিয়ে বাইরে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো। হীর রেজার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ক্ষেপা কন্ঠে বলে উঠলো,

—-‘ দাঁড়াও ফরহাদ রেজা। আমার বাবা-মাকে খুন করার পেছনে বাকি দু’জনের স্বার্থ তো একদম পরিষ্কার কিন্তু তুমি? তোমার কি উদ্দেশ্য ছিলো ওদের দু’জনকে মারার? তুমি তো বাবার খুব কাছের মানুষ ছিলে? যাকে বাবা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারত? সেই তুমি-! কেন করলে এমন?’

হীরের প্রশ্নে দাঁড়িয়ে গেলো রেজা। পেছন মুড়ে হীরের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

—-‘ সিক্রেট।’

বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো রেজা। রেজার হাসি দেখে হীরের শরীরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। সমস্ত শরীরে ভর করলো খুনের নেশা। পৃথিবী থেকে ফরহাদ রেজার মতো বিশ্বাসঘাতক বন্ধুকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলার নেশা। ভয়ানক নেশা।

#চলব___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here