কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার পর্ব -১৬

কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার (পর্ব – ১৬)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
কপাল কুঁচকে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে এক অবয়ব। পায়ের মধ্যে পা লেগে যাচ্ছে সে খেয়াল তার নেই। চিন্তিত স্বরে কী যেন বিড়বিড় করে বারবার মুখে আঙুল বোলাচ্ছে। তার ভঙিমা দেখেই বুঝা যাচ্ছে প্রচণ্ড চিন্তা প্রসারিত হাতে আঁকড়ে ধরেছে৷ ঘরের কোণে থাকা ল্যাম্পটা জ্বালালো সে। অপুর মুখ স্পষ্ট হলো৷ চিন্তারা দলছুট হয়ে অপুর সারা মুখে শত উদভ্রান্তি নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল। ল্যাম্পটা বন্ধ করল অপু৷ চিন্তায় মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সেই সকাল থেকে নাহিদা আর তানজিমের খবর নেই। নাহিদাকে অনেক কয়বার কল করেও কোনো লাভ হয়নি। তবুও বিকেলের আগ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু বিকেলে ঘুম ভাঙার পর থেকে নিজেকে এই ঘরে বন্দি আবিষ্কার করল অপু। তারপর কতবার দরজায় আঘাত করল, জাফরিনকে ডাকল কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। নিজের ফোনটাও অতিরিক্ত আদর দেখাতে গিয়ে অধরাকে খেলতে দিয়েছিল সে। সেজন্য বিচ্ছিরী ফেঁসে গেছে৷ বাড়িতে কেউ আছে বলে মনেও হচ্ছে না। কিন্তু সবাই গেল কোথায়? এদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।

টেবিল ল্যাম্পটা কয়েকবার অন-অফ করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল অপু। কয়েকবার ধাক্কাধাক্কি করে ডাকল, ‘কেউ আছেন?’
কেউ নেই।
নিজের ডাকের প্রতিধ্বনি নিজের কানে এসে বিঁধল। আবারও অপু নিরুপায় হয় বিছানায় বসে পড়ল। এবার বিষয়টা ভাবার মতো। একটু অস্বাভাবিক লাগছে। তার বিরুদ্ধে কোনো চক্রান্ত চলছে না তো? কেউ জানতে পারেনি তো, আশফিয়ার খুনি সে? শিউরে উঠল অপু। চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকিয়ে সব খেয়াল সরিয়ে ফেলতে চাইল সে। কিন্তু হলো না। এবার আফসোস হচ্ছে এ বাড়িতে নাহিদার আশায় বসে থাকার জন্য।

একটা সত্যি কথা কখনোই নিজের থেকে লুকোয়নি অপু—সে নাহিদার প্রতি একরকম টান অনুভব করে। সোজাসুজি বলতে গেলে প্রেমে পড়ে গেছে। এমতবস্থায় নাহিদাকে তানজিমের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার কথা নিজের কাপুরুষত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাই তানজিম আর নাহিদার মাঝে বারবার ফাটল ধরিয়ে নাহিদার হাতটা নিজের হাতে নেওয়ার নানারকম ফন্দি এঁটেছিল অপু৷ কিন্তু সাময়িকভাবে সফল হলেও প্রকৃতপক্ষে সে ব্যর্থ রয়ে গেছে। শেষে এসে কী হলো? সেই তো স্বামী-স্ত্রী একসাথে। এজন্য হয়তো লোকে বলে, ‘বিবাহিত জীবনে আল্লাহর রহমত থাকে।’
__________

‘তানজিম, তুমি ঘরটাকে কী করে রেখেছ?’ কোমরে ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে জিজ্ঞাসা করল নাহিদা।
তানজিম নিজের দৃষ্টি নাহিদার থেকে সরিয়ে ঘরে ফেলল। প্রথমেই চোখে পড়ল টিভির ওপরে থাকা অগোছালো শার্ট। তারপর একে একে আলমারির খোলা পাল্লা, কোঁকড়ানো বিছানা, ময়লা বালিশের ওয়্যার, দরজার কাছে নোংরা জুতা, চেস্ট ড্রয়ারের উপর উল্টে পড়া পার্ফিউম, ড্রেসিং টেবিলের উপর এলোমেলো প্রসাধনী। নাহিদার লম্বা শ্বাসে সারা ঘরের উপর চোখের ভ্রমণ শেষে হাসল তানজিম।
নাহিদা চোখ মিরমির করে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘হাসি পাচ্ছে?’
তানজিম সযত্নে নাহিদাকে জড়িয়ে ধরল। আদুরে কণ্ঠে বলল, ‘কিছু জিনিস অগোছালোই ভালো।’
‘অলস কোথাকার!’
তানজিম হেসে চুপ করল।
নাহিদা কিছু মনে পড়ার ভঙিতে বলল, ‘অপুর খবর কী?’
‘আর কী? আমরা যতক্ষণ ফিরছি না, ততক্ষণ ও বন্দি। এখানে থেকে গিয়ে প্রথমে ওর নাক বরাবর দুইটা ঘুষি মারব। একটা আশফিয়াকে মারার জন্য, আরেকটা তোমার দিকে হাত বাড়ানোর জন্য। তারপর ওর থেকে সব কারণ শুনে পুলিশের হাতে দিয়ে দেবো।’
‘ছেলেটাকে ভালো ভেবেছিলাম।’
নাহিদার দিকে আড়চোখে তাকাল তানজিম। নাহিদা বেশ কিছুক্ষণ পরে সে চাহনির অর্থ বুঝল। কিন্তু কিছু বলল না।

নাহিদা অনিচ্ছা নিয়ে তানজিমের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর দ্রুত ঘর গোছানোর কাজে লেগে পড়ল। তানজিম শুধু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকল৷ নাহিদার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চোখে আকাশ সমান ব্যস্ততা৷ অনেকদিন পর নাহিদাকে পাক্কা ঘরনির রূপে দেখছে সে; তাই সম্পূর্ণ আগ্রহ নাহিদার মাঝেই আবদ্ধ করে রাখল।
সহসা একসময় তানজিম বলে উঠল, ‘এত কষ্ট করে গোছানোর কোনো মানে হয়?’
‘কেন?’ কাজের গতি ধরে রেখে পাল্টা প্রশ্ন করল নাহিদা।
‘ইয়াসমিন আন্টি যখন জানবেন তাদের ছেলের পরিনতির জন্য আমরা দায়ী, তখন এই ফ্ল্যাটে আর থাকা হবে না। অন্য কোথাও যেতে হবে।’
কাজের ব্যস্ততা কমিয়ে দিল নাহিদা। কী যেন ভেবে ফের কাজে মন দিল। বলল, ‘তাতে কী?’
সদুত্তর দেওয়ার কিছু খুঁজে পেল না তানজিম। তাই চুপ করে রইল।

নিজেদের ঘর গুছিয়ে নাহিদা এগিয়ে গেল আশফিয়ার ঘরে। দরজা খুলতেই একটা স্মৃতির ঝড় এসে জানান দিল আশফিয়ার কথা। পুরো ঘরটা একবার দেখে নিল নাহিদা। না, কিচ্ছু অগোছালো নেই—সবকিছু গোছানো, পরিপাটি। এই ঘরে তানজিমের পা পড়েনি বলে যেমন ছিল, তেমন’ই আছে। শুধু দিনে দিনে ধুলোর আস্তরণ পড়েছে। এমনভাবেই যদি আশফিয়া মেয়েটিকে নিয়ে স্মৃতিগুলোর উপর ধুলোর আস্তরণ পড়ত, তবে ভালোই হতো। অন্তত বোনের মতো একজনকে হারানোর মতো কষ্টটা নাহিদা লুকিয়ে রাখতে পারত।

ঘরের ভেতরে ঢুকে প্রথমেই একটা বাঁধানো ছবি হাতে নিয়ে পরিস্কার করল নাহিদা। ছবিটা নাহিদা নিজে এবং আশফিয়ার হাস্যরসে ভরপুর মুখ; পেটে অধরা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছবিটার দিকে নীরব হয়ে তাকিয়ে থাকল নাহিদা। চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল কত শত স্মৃতি। মনে হতে লাগল, এই তো ক’দিন আগের কথা এসব। কী করে এত অতীত হয়ে গেল?
ঘর ঝাড়ু দেওয়ার মাঝেই বেডসাইড ড্রয়ার খুলল নাহিদা। আশফিয়ার ব্যবহৃত কিছু জিনিস আর একটা ডায়েরি দেখা গেল। নাহিদার চোখ সব ছাড়িয়ে ডায়েরিতে নিবদ্ধ হয়ে গেল। দ্রুত সেটা হাতে নিয়ে দেখল, এক কোণে নীল রঙের জেল পেন দিয়ে লেখা আশফিয়ার নাম। খুব যত্নে ডায়েরিটা হাতে নিল নাহিদা। উপরের কভারটা কয়েকবার স্পর্শ করে কিছু ভাবল৷ তারপর যথাসম্ভব ধীর গতিতে একটার পর একটা পাতা ওল্টাতে লাগল। মনে পড়ল, প্রথম দিন আশফিয়া ফ্ল্যাটে এসে এই ডায়েরিটাই তানজিমের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল। তানজিমকে বিভ্রান্ত করতে কিছু মিথ্যা কাহিনী লিখে রেখেছিল সে। কিন্তু পরবর্তীতে সেসব পাতা ছিঁড়ে ফেলে ফাঁকা রেখে দিয়েছিল বাকি না লেখা পাতাগুলো। এতদিনে আশফিয়া যে ডায়েরিতে কিছু লিখে রেখেছে বা লিখে রাখতে পারে, তা মাথায় আসেনি নাহিদার।

নাহিদা ডায়েরি খুলল। প্রথম কয়েকটা পাতায় অধরাকে নিয়ে হওয়া অনুভূতি, তারপর নাহিদার বড়ত্ব নিয়ে কিছু লেখা,

আর তারপর অপুকে নিয়ে কয়েকটা পাতা। হঠাৎ অপুর নাম দেখে চমকে ওঠে নাহিদা। সময় নষ্ট না করে পড়তে শুরু করে।
আশফিয়া যা লিখেছিল তার সারমর্ম এই, আশফিয়ার সাথে অপুর পরিচয় হয় জাকারবার্গের নীল-সাদার ফেসবুক দুনিয়ায়। তখন অপু সর্বক্ষেত্রে নিজের ভালো নাম ব্যবহার করত—তামিম ইকবাল। একদিন, দুইদিনে হুটহাট কথা শেষে তাদের সম্পর্কটা চলে যায় প্রেম পর্যন্ত। তবে তা শুধু প্রেমেই থেমে থাকেনি; গড়িয়ে গেছে বিছানা পর্যন্ত। আশফিয়া অপুকে নিয়ে মোটামুটি সিরিয়াস থাকলেও অপু ততটা ছিল না। তার স্বপ্ন ছিল বিদেশে পড়ালেখা শেষ করার। তা’ই করতে যায় অপু। দেশে থেকে নাহিদা শুধু অপেক্ষা করতে থাকে। নীরব অপেক্ষা। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে যখন ক’মাসের জন্য অপুর ফেরার কথা চলতে থাকে, তখন নিজের গর্ভে কোনো এক ফুলের মতো সন্তানের আগমন বার্তা দেয় আশফিয়া। অপু এতে মোটেও খুশি হয়নি বরং রাগ করে বাচ্চাটিকে নষ্ট করতে বলেছিল। এও বলেছিল, বাচ্চার বাবার পরিচয় সে নিতে পারবে না। এরচেয়ে ভালো হবে বাচ্চা নষ্ট করে ফেলা। হাজারও হোক, আশফিয়া তো মা। তাই অপুর কথা না রাখার দৃঢ়তা ধরে রাখে সে। পারেও। অপুর সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় আশফিয়া। অপু ফেরত এসে আশফিয়ার বাচ্চা নষ্ট করার জন্য তাকে খুঁজতে থাকে। কারণ, আশফিয়াকে খুব ভালো করেই চিনত সে। অথচ সে জানত’ই না—আশফিয়া সেই ফ্ল্যাটেই আছে, যে ফ্ল্যাটে তার নিত্য আসা-যাওয়া শুরু হয়েছিল। একদিন নাহিদার সাথে অপুকে কথা বলতে দেখে ফেলে আশফিয়া। ভয় পেয়ে যায় সে। পড়ে যায় দোটানায়। যতটা সম্ভব অপুর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে আশফিয়া, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তানজিমের জন্মদিনের আয়োজন করতে গিয়ে দেখা হয় একে-অপরের। সে সময় আশফিয়ার চেয়ে অপু অবাক হয়েছিল বেশি। তবে পরে কৌশলে তা এড়িয়ে অপু বাচ্চাটাকে নষ্ট করার কথা বারংবার বলতে থাকে। আশফিয়া আশ্বাস দেয়, সে তার অনাগত সন্তানের পরিচয় অপুর মতো নিকৃষ্ট মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দেবে না।

অবাক, বিস্ময়, রাগে চোখে জলের বিন্দু এসে জমতে লাগল নাহিদার। সবটুকু জানার পরে কেমন এলোমেলো লাগছে পৃথিবীটা। পৃথিবীর সর্বোচ্চ খারাপ মানুষ হিসেবে অপুকে আবিষ্কার করে ফেলছে মস্তিষ্ক। এসবের মাঝে কখন তানজিম এসে পাশে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালও নাহিদার নেই।
যখন তানজিমের উপস্থিতি আশফিয়ার দৃষ্টিতে পড়ল, তখন সে মিনমিন করে বলল, ‘অপু আশফিয়াকে বিশ্বাস করতে পারেনি। ওর রাগ, সন্তানের পরিচয়ের ভার বহনের ভয়, আশফিয়ার প্রতি ঘৃণা ক্রমে ক্রমে বাড়তে থাকে। আর তারপর ও এই জঘন্য কাজটা করে।’
নাহিদাকে জড়িয়ে ধরে তানজিম। কাঁপা কাঁপা থুতনিতে চুমু দিয়ে বলে, ‘এর শাস্তি অপু পাবে। তুমি চিন্তা করো না।’
তানজিম পাশের থানায় কল করল। একজন পরিচিত অফিসার আছে। তারা যতক্ষণে বাসায় পৌঁছাবে, ততক্ষণে পুলিশও পৌঁছে যাবে। অপুর মুখটা আর দেখার ইচ্ছে নেই। বর্তমানে তার জন্য বরাদ্দ কেবল এই দম্পতির ঘৃণা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here