কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার পর্ব -০২

কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার (পর্ব – ২)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
রান্নাঘরে আপনমনে কাজ করছিলেন জাফরিন বেগম। এমন সময় পাশের ঘর থেকে চাপা কান্নার সুর এসে কানে বিঁধল তার। কপালে ভাঁজ ফেলে আবার কাজে মনোযোগ দিলেন তিনি। আজ উত্তরে বাতাস বইছে। হালকা বাতাস আসছে রান্নাঘরে। এতে জাফরিনের হাত-পা জমে যাওয়ার জোগাড়। তারমধ্য আবার নাহিদার চাপা কান্নার সুর অন্তরও জমিয়ে দিচ্ছে। আজ সন্ধ্যায় হঠাৎ করে তার আগমন বেশ চিন্তায় ফেলেছে জাফরিনকে। এর আগে নাহিদা কখনোই না বলে আসেনি। আর তানজিমও তো কখনও তাকে একা ছাড়েনি। আজ হঠাৎ কী হলো?
জাফরিন নাহিদাকে এর মাঝেই শতবার জিজ্ঞাসা করেছে কী হয়েছে, কিন্তু নাহিদা চুপচাপ থেকেছে। কখনো-বা রূঢ় কণ্ঠে বলেছে, ‘আমি এসেছি বলে কি তোমাদের বোঝা বেড়ে গেছে?’
সরে এসেছেন জাফরিন। নাহিদাকে একটু একা রাখা দরকার। নিজেকে সামলে নিতে পারলেই সে সব বলবে হয়তো। সেই সময়টার’ই অপেক্ষায় আছেন জাফরিন।

রান্না শেষে জাফরিন বেগম নাহিদার ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন। ভেজানো দরজা ঠেলে মাথা বাড়ালেন। দেখলেন, নাহিদা দুই হাঁটুর মাঝে মুখ রেখে কাঁদছে এখনও। ওপরে খুব জোরে সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে। মহূর্তে মহূর্তে আসা এক দলা করে বাতাস আছড়ে পড়ছে নাহিদার ওপর। চুলগুলো চারপাশে উড়াউড়ি করছে। শব্দ না করে দরজা লাগিয়ে সরে এলেন জাফরিন। নিজের ঘরে এসে চাদর জড়িয়ে বসে থাকলেন। হঠাৎ বাটন ফোনের স্ক্রিনটা আলোকিত হয়ে উঠল—তানজিম কল করেছে।
জাফরিন হন্তদন্ত হয়ে কলটা ধরেই বললেন, ‘আমি তোমাকে কল করতেই চাইছিলাম, বাবা। আজ হঠাৎ নাহিদা এভাবে চলে এলো যে?’
তানজিম সালাম দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকল। নিজের ভেতর কিছু কথা গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘আসলে মা, আমাদের মাঝে একটু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। তাই ও রাগ করে চলে গেছে। এখন দেখুন আমার কল-ও ধরছে না।’
‘কী হয়েছে?’
‘তেমন কিছু না মা। ব্যাস একটু ভুল বুঝাবুঝি।’
জাফরিন স্মিত হেসে বললেন, ‘আমার মেয়েকে আমি চিনি বাবা। ও কখনও একটু ভুল বুঝাবুঝির জন্য এতটা অবুঝ আচরণ করবে না।’ তানজিমকে একটু সময় দিয়ে তিনি আবারও বললেন, ‘ভুল বলেছি কী?’
তানজিম নিরুপায় স্বরে উত্তর দিল, ‘না। মা, আপনি কী একবার ওকে ফোনটা দেবেন?’
‘ফোনে ওকে বোঝাবে? এটাও সম্ভব? তোমরা আজকালকার ছেলে-মেয়েরা ফোনেই সব কাজ সারার চেষ্টা করো। এটাই তোমাদের একে অপরের থেকে দূর করে দেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ তোমরা এই ফোনকেই বেশি বিশ্বাস করো।’
‘তাহলে?’
‘সামনাসামনি এসে কথা বলো কাল।’ তানজিম কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে জাফরিন বললেন, ‘কিছু কিছু ঘটনা সামনাসামনি ঘটে যাওয়াই ভালো।’
‘ঠিক আছে, মা। আমি কাল আসব। আজ রাখি। আসসালামু আলাইকুম।’
জাফরিনের উত্তর না শুনেই কলটা কেটে দিল তানজিম। আজ কথা বলতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল তার। কারোই কর্মকাণ্ড ঠিক লাগছে না জাফরিনের। ঘটনা কী, তা তো এখনও অজানার চাদরে জড়িয়ে রইল।
__________

জানালায় দু’পা রেখে বিছানায় শুয়ে আছে তানজিম। জানালার লোহার শিকে গোড়ালি রাখা আছে প্রায় দুইঘণ্টা হয়ে গেল। গোড়ালিগুলো ব্যথায় টনটন করছে। হিমশীতল শিরশিরে বাতাস জমিয়ে দিচ্ছে প্রায়। তারপরও জানালা থেকে পা সরাচ্ছে না তানজিম। নিজেকে হয়তো শাস্তি দিতে চাইছে সে। কিন্তু এত অল্প শাস্তির কথা ভাবতেই ঠোঁটের একপাশ প্রসারিত হলো তার। জাফরিন বেগমের সাথে কথা বলে কিছুটা স্বস্তি হচ্ছে তার। আবার চিন্তাও হচ্ছে।

বিকেলে কখন যে নাহিদা বের হয়ে গেছে, জানতেই পারেনি তানজিম। নইলে কোনোভাবে তাকে আটকাতো সে। এখন ওই বাড়িতে গিয়ে নাহিদাকে ফিরিয়ে আনা দুষ্কর। তানজিম শ্বশুর-শাশুড়ি ভালো পেলেও সম্বন্ধী পেয়েছে ধানি লংকা। রাত নয়টায় ফিরে সে যখন নিজের বোনকে বিমর্ষ দেখবে, তখন বড় সড় একটা হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলবে। নাহিদা চাপা স্বভাবের। সহজে কিছু বলতে চাইবে না। কিন্তু সম্বন্ধী ঠিক বুঝে যাবে তানজিম কিছু করেছে। সে তো তানজিমকে সহ্যই করতে পারে না। কেন, তার কারণটা অজানা।

সম্বন্ধী ইফতেখার এবং তানজিম এক’ই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ইফতেখার ছিল অনার্স চতুর্থ বর্ষে। আর তানজিম সবে ভর্তি হয়ে পড়ালেখার প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল বেশ করে। বলা বাহুল্য, ইফতেখার রাজনীতি করত। ছাত্র নামক কিছু গুণ্ডা দলের সাথে মিশে নানান অপকর্ম করে বেড়াত। একবার তো চাঁদাবাজি করতে গিয়ে হোস্টেলের একটা ছেলেকে পিটিয়েছিল সে। কিন্তু তানজিম কখনোই এসব ব্যাপারে নাক গলায়নি। বড় ভাই হিসেবে ইফতেখারকে সন্মান দিয়ে দু’হাত সরে চলেছে সে। এমনকি এখনও সন্মান করে তানজিম। কিন্তু তারপরও ইফতেখার তানজিমের উপর কেন এত ক্রোধ পুষে রেখেছে তা অজানা। কাল গিয়ে প্রথমেই যে ইফতেখারের সামনে দাঁড়াতে হবে, সেটা জানে সে। সেজন্য এখন থেকেই দুশ্চিন্তা হচ্ছে তানজিমের। তারউপর নাহিদার কান্নায় ভেজা চোখ দু’টো স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে বারংবার। কষ্ট হচ্ছে, হৃদয় পুড়ে যাওয়ার মতো যন্ত্রণা হচ্ছে। সুখের সংসারটা এক মহূর্তে কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পায়ে জুতা পরে হুডিটা গায়ে দিল তানজিম। বিরান বাড়িতে একা আর ভালো লাগছে না। সবখানে নাহিদার ছোঁয়া তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। একটু বাইরে থেকে ঘুরে এলে ভালো লাগবে ভেবে দরজা খুলতেই দেখল, সামনে আশফিয়া দাঁড়িয়ে!
ভূত দেখার মতো চমকে উঠল তানজিম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার, ‘তুমি? এখানে কী তোমার?’
আশফিয়া মুখ মলিন করে বলল, ‘এত রূঢ়ভাবে কথা বলো না তানজিম। আমি সহ্য করতে পারি না।’
‘সহ্য করতে পারো না যখন, তখন আসো কেন? আমার সুখের সংসারে আগুন লাগিয়ে তোমার সাধ মেটেনি? কী চাই আবার?’
‘তোমার সুখের সংসারের জন্য আমাকে বলি দিতে চাও?’ তানজিমের থেকে দৃষ্টি সরালো আশফিয়া, ‘নাহিদা কোথায়?’
‘তোমার তা জেনে লাভ কী?’ কণ্ঠ আরও শক্ত হলো তানজিমের, ‘তুমি বেরোবে এখান থেকে? নাকি সিকিউরিটি গার্ডকে ডাকব?’
দুর্বোধ্য এক অস্পষ্ট হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল আশফিয়া। এমন হাসি আশফিয়ার মুখে এই প্রথম। তার মাথায় কী চলছে এখন? সে কি কিছু করতে চলেছে?
__________

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাহিদা। চোখে জলের স্রোত চলছে বলে নিজের মুখকে ঘোলা দেখতে পাচ্ছে সে। তবুও দৃষ্টির আড়ালে লুকালো না তার ফুলে লাল হয়ে যাওয়া দুই নেত্র। মুখ শুকিয়ে গিয়ে কালচে হয়ে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো, মুখে অবসন্নের চিহ্ন। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই মুখের অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেছে। চিন্তায় চিন্তায় মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে। চুলোগুলোকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বসে পড়ল নাহিদা। এখন কেউ একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই হয়তো ভালো লাগত। সহসা কারো হাতের স্পর্শ পেতেই মাথা তুলল নাহিদা। দেখল জাফরিন একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে বসলেন তিনি। নাহিদার মাথার চুলের ভেতরে পাঁচটি আঙুল ঢুকিয়ে এলোমেলোভাবে বুলিয়ে দিতে থাকলেন।
‘এত ঠাণ্ডা, তারউপর ফ্যান ছেড়েছিস?’
জাফরিনের প্রশ্নের উত্তর দিল না নাহিদা। প্রসঙ্গ উল্টে বলল, ‘তানজিম তোমায় কল করেছিল?’
মেয়ের চোখের জল মুছে দিয়ে, ডান হাতে কোলের মাঝে আগলে নিয়ে জাফরিন বললেন, ‘তুই নাকি ফোন ধরিসনি?’

নিজের ফোনটা হাতে নিল নাহিদা। দেখল, ৩৪৭ টা মিসড কল। ফোনটা বন্ধ করে চোখ মুছে জাফরিনকে জড়িয়ে ধরল সে।
জাফরিন বললেন, ‘তোর বাবার সাথে তো আমার কত কিছুই হয়, কই আমরা তো এত অভিমান করে থাকি না।’
‘তানজিমের সাথে আমার যা হয়েছে, তা কখনও তোমাদের সাথে হয়নি।’
‘কী হয়েছে?’
মিষ্টি গলা ভারী হয়ে গেল নাহিদার, ‘পরে বলি তোমায়? এখন ভালো লাগছে না।’
‘আচ্ছা। এখন আমার সাথে একটা দোয়া পড় তো।’
‘কিসের দোয়া?’
‘চিন্তা থেকে হেফাজতের দোয়া।’
নাহিদা জানে না সুরা তাওবা’র ১২৯ নম্বর আয়াতের শক্তি কতটা। তবে জাফরিনের সাথে মিলিয়ে কয়েকবার পড়তেই চিন্তাটা অনেক কম মনে হলো। মাথা ফেটে যাওয়ার মতো যন্ত্রণাটাও কমে গেল অনেক। জাফরিনকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে কোলে মাথা রাখল নাহিদা৷ আল্লাহর সাহায্য আর মায়ের কোল—একটু শান্তি পেতে আর কী লাগে?

কলিংবেল বাজল। আওয়াজ শুনে তড়িৎ গতিতে দাঁড়ালেন জাফরিন। দেয়াল ঘড়িতে সময় নয়টা কুড়ি। ইফতেখার এসেছে। নাহিদা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বসল। দরজা খোলার আওয়াজ শেষে সব চুপচাপ। তারপর জুতার খটখট শব্দ শোনা গেল। শব্দ এসে থামল নাহিদার ঘরের দরজায়। নাহিদা মুখ তুলে তাকাল। দরজায় একজন সুগঠিত সুদর্শন পুরুষ দাঁড়িয়ে। ফর্মাল পোশাকে অসাধারণ দেখতে লাগছে।
দাঁড়িয়ে পড়ল নাহিদা, ‘ভাইয়া, কেমন আছিস?’
‘নাহিদা…’ ছোটখাটো একটা চিৎকার দিয়ে নাহিদাকে জড়িয়ে ধরল ইফতেখার। শুধুমাত্র এক নাহিদার প্রতিই সে দুর্বল। একমাত্র বোন বলে কথা!
নাহিদাও জড়িয়ে বলল, ‘কেমন আছিস বল?’
‘ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?’
‘আল্লাহ্ ভালোই রেখেছেন।’
নাহিদার থুতনিতে অনামিকা আঙুল দিয়ে মুখটা উঁচু করে নিল ইফতেখার, ‘মনমরা লাগছে কেন?’
‘না তো।’ হাসার চেষ্টা করল নাহিদা।
‘তানজিম কিছু বলেছে?’
একবার নাহিদার ইচ্ছে করল সব বলে দিতে। কিন্তু ইফতেখার যে প্রচণ্ড রেগে কিছু করে বসবে না তার ঠিক নেই। তারচে’ বরং এসব লুকিয়ে রাখাই ভালো। যা’ই হয়ে যাক না কেন, স্বামীর ঘরে তো ফিরতেই হবে। তবে আগে একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন।
‘কী রে? তানজিম কিছু বলেছে?’ এবার সুদর্শন ইফতেখারের মুখে চিন্তার ছাপ।
নাহিদা ভাইয়ের ডান হাত পরম মমতায় জড়িয়ে বলল, ‘ও আবার কী বলবে?’ ইফতেখার কিছু বলতে চাইতেই নাহিদা ফের বলে উঠল, ‘অনেক ক্ষুধা লেগেছে। চল খেতে যাই।’
‘তুই এগো, আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি।’

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নাহিদা। ইফতেখার হাত-মুখ ধুয়ে বেরোতেই ফোনের ভাইব্রেটের শব্দ পেল। ফোনটা খুঁজতে গিয়েই কলটা কেটে গেল। কাঁথার নিচ থেকে নাহিদার ফোনটা পেতেই হাতে নিল সে। ৩৪৮ টা মিসড কলের নোটিফিকেশন স্ক্রিনে ভেসে আছে। সবগুলো তানজিমের কল ছিল। তানজিমের এতগুলো কল আসবে আর নাহিদা ধরবে না—এমনটা হতে পারে বলে ইফতেখারের ধারণা ছিল না। নাহিদা তানজিমকে একটু বেশিই ভালোবাসে। তাই এই ঘটনা ইফতেখারের মনে দাগ কেটে দিল। তারউপর নাহিদা যখন ঘরে ঢুকেই ছোঁ মেরে ফোনটা হাতিয়ে নিল, তখন আরও দাগটা স্পষ্ট হলো। কিছু না বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল নাহিদা। আনমনে একগাল হাসল ইফতেখার। কী ঘটেছে এবার তার খোঁজ নেওয়া দরকার।
নিজের ফোনটা পকেট থেকে বের করে ‘আশফিয়া’ নামে সংরক্ষণ করা নাম্বারে কল করল ইফতেখার। শোনা গেল তার কণ্ঠ, ‘তানজিম কী করছে?’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here