কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার পর্ব -০৭

কিছু সমাপ্ত পূর্ণতার (পর্ব – ৭)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
মন খারাপ করে বসে আছে তানজিম, নাহিদা এবং আশফিয়া। মুখোমুখি বসে আছে ইফতেখার। প্রত্যেকজনের ভাবভঙ্গি আলাদা। সবার মুখে চিন্তার ছাপ। তবে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত তানজিম। সম্বন্ধী যে আটঘাট বেঁধে নেমেছে তা বুঝতে পারছে সে। কিন্তু ভাবনার বিষয়, ইফতেখার তানজিমের মুখ বারবার দেখতে হবে ভেবে এই ফ্ল্যাটে কখনও আসে না। প্রথমবার এসেছিল ফ্ল্যাট-টা দেখতে—ওটাই শেষ। নাহিদাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করলে সে কফিশপ অথবা কোনো রেস্টুরেন্টে ডেকে নেয়। তানজিম ইফতেখারের কাছে কেন ঘৃণার পাত্র, তা আজও যেমন ঘোলাটে, তেমনি ঘোলাটে হঠাৎ আজকে ইফতেখারের আগমনের কারণ।

অনেকক্ষণের আলোচনায় সব ঘটনার জট খুলে যায় ইফতেখারের কাছে। এক পর্যায়ে সে বলে ওঠে, ‘তানজিম, আমি তোমাকে পছন্দ করতাম না, এমনকি বিশ্বাসও করতাম না। ভাগ্যিস! নইলে আজ আমাকেও আমার বোনের মতোই মুখ মলিন করে বসে থাকতে হতো।’ নাহিদার দিকে তাকাল সে, ‘তোকে বলেছিলাম, তানজিম তোর জন্য সঠিক ছেলে নয়। কিন্তু মা-বাবা আর তুই কোনো কথা শুনিসনি। এবার ভুল বুঝতে পারছিস?’
শান্ত স্বরে বলা ইফতেখারের প্রতিটা শব্দ নাহিদার মনে আঘাত করছে। কিন্তু কিছু বলার চেয়ে মনে হচ্ছে চুপ থাকাই ভালো। কারণ, কথা কথাকে বাড়ায়।
দীর্ঘ এক ভাষণের পর ইফতেখার উঠে দাঁড়াল। চলে যেতে উদ্যত হয়ে বলল, ‘নাহিদাও আমার সাথে যাবে।’

নাহিদা বসেই থাকল। এখন তার নারী মনে দুইটি দুর্বলতা। প্রথমত, হাজারও হোক তানজিম তার স্বামী। তাকে খুব আগলে রেখে ভালোবাসে নাহিদা। বাড়িতে গিয়ে ইফতেখার খুব সুক্ষ্মভাবে বুঝিয়ে ডিভোর্সের ব্যাপারটা তুলবে; যা নাহিদার কাছে পছন্দনীয় হবে না। আর দ্বিতীয়ত, নাহিদা কখনও মা হতে পারবে না। তাহলে কেন এত ঝামেলা? ভুল তো হয়েই গেছে। তাই বলে ভুলে গর্ভে আসা ফুলকে তো আর ফেলে দেওয়া যায় না! আর না ছাড়া যায় তানজিমকে! ইতিমধ্যে একটা ভাবনা বারবার আসে নাহিদার মাঝে। সে মা হতে পারবে না যখন, তখন আশফিয়ার সন্তানকেই নাহয় নিজের মতো ভালোবাসবে। বাচ্চাটি তো তানজিমের’ই রক্ত। তাই এত সব চিন্তা করার পরে ইফতেখারের মতামত ভালো লাগল না নাহিদার।
নাহিদা উঠে দাঁড়াল। ইফতেখার চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আয়, তোকে এগিয়ে দিই।’
ইফতেখার বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ‘এখনও তানজিমের প্রতি এত টান তোর? যে তোর না, তার কেন তুই হতে যাবি?’
‘আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে সম্পূর্ণভাবেই ভালোবাসি ভাইয়া।’
‘নাহিদা—’
কথার মাঝেই ইফতেখারকে থেমে দিল নাহিদা, ‘আমার আরও কিছু সময় প্রয়োজন ভাইয়া। আমি ভেবে তোমাকে জানাব। তখন যদি ইচ্ছে করে, চলে যাব। জীবনকে আর একটু সময় দিতে চাই আমি।’
‘আবার মারাত্মক ভুল করছিস।’
নাহিদা আর কিছু বলল না। ইফতেখার একবার তানজিমের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকাল। সেই চোখ সামান্য শীতল হলো আশফিয়ার দিকে তাকিয়ে। আর দাঁড়াল না ইফতেখার। বেরিয়ে গেল।

বিকেলের দিকে এক টেবিলে নাস্তা করছে আশফিয়া আর নাহিদা। হুট করে আজ আশফিয়া রান্নাঘরে গিয়ে ভেজিটেবল রোল তৈরি করেছে। নাহিদাকে বেশি জোর করতে হয়নি। দুপুরে খাবার খায়নি বলে কয়েকবার বলেই তাকে রাজি করাতে পেরেছে আশফিয়া। আশফিয়ার প্রতি নাহিদার আচরণ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। নাহিদা হয়তো আশফিয়া আর তানজিমকে ঘৃণা করতে করতে ক্লান্ত।
কলিং বেলের শব্দে উঠে দাঁড়াল আশফিয়া। নাহিদা তাকে বসতে বলে নিজে এগিয়ে গেল দরজা খুলতে। এক গাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ইয়াসমিন। পাশে তার সুঠাম দেহের এক পুরুষ। মুখে বয়সের ছাপ নেই বলে বয়স বুঝা মুশকিল।
ইয়াসমিন মুখে হাসি রেখেই বললেন, ‘ব্যস্ত ছিলি নাকি?’
‘না। আসুন ভেতরে।’

ভেতরে ঢুকলেন ইয়াসমিন, ঢুকল সঙ্গে থাকা ছেলেটাও। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই বেশ কয়েকবার পরস্পরের সাথে চোখাচোখি করল তারা। আশফিয়াও খাবার ছেড়ে উঠে গেছে। ফাঁকা বৈঠকঘরে বসল তিনজন—নাহিদা, ইয়াসমিন এবং অপরিচিত ছেলেটা।
ইয়াসমিন বসতে বসতেই গদগদ হয়ে বললেন, ‘ও আমার ছেলে, অপু।’ নাহিদার দিকে ইশারা করলেন তিনি, ‘আর এই হচ্ছে নাহিদা। যার কথা তোকে বলেছিলাম। খুব লক্ষ্মী মেয়ে। কারো সাতে-পাঁচে থাকে না। একদম ঠাণ্ডা স্বভাবের। আর রান্নার হাত তো মাশাআল্লাহ্—’
আরও নানান সুখ্যাতি করতে থাকলেন ইয়াসমিন। নিজের কাছে নিজের সুখ্যাতি মানুষের কাছে খুব’ই শান্তির। কিন্তু নাহিদার এই মহূর্তে এটা ভালো লাগছে না। কারণ অপু ছেলেটার চাহনি পড়ে আছে তার মুখে। একজন বিবাহিতা নারীকে এভাবে দেখা খুব সুবিধাজনক নয়।
ইয়াসমিনের লম্বা কথা থামলে অপু নাহিদার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। বেশ জোরালোভাবে হেসে বলল, ‘আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগল। আপনি কে হচ্ছেন যেন? ও হ্যাঁ, ভাবি।’
অপুর হ্যাংলামো নাহিদার ভালো লাগল না। তবুও সৌজন্যতার খাতিরে হাত মিলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, ভাবি হচ্ছি আপনার।’
‘ভাবি আর দেবরের সম্পর্ক তো হাসব্যান্ড ওয়াফের থেকেও ভালো হয় তাই না?’
পরোক্ষভাবে অপুর এই ফ্লার্টিং নাহিদাকে অবাক করল। অবাকের সাথে অস্বস্তিও হতে লাগল ভীষণ। সে দ্রুত উঠে বলল, ‘আপনারা গল্প করুন। আমি চা, নাস্তার ব্যবস্থা করি।’

রান্নাঘরে এসে চা তৈরি করতে লাগল নাহিদা। এর আগে ইয়াসমিন কখনও নিজের ছেলেকে নিয়ে আসেননি। আর আসবেন’ই-বা কী করে! তার ছেলে নাকি স্কলার পেয়ে বিদেশে গেছিল। ছেলেটা দেখতে মাশাআল্লাহ্, কিন্তু তার আচরণ ভালো লাগছে না। নাহিদাকে ফ্লার্টিং করলে সে তা একদম পছন্দ করে না। তারউপর বিয়ের পর কেউ পরোক্ষভাবে ফ্লার্টিং করছে দেখে বিরক্ত লাগল তার। ছেলেরা এমন’ই নাকি?
জোর করে মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে চা তৈরিতে মন দিল নাহিদা। ফটাফট নতুন শেখা কিছু খাবার তৈরি করে নিল সে। তারপর দ্রুত সেগুলো নিয়ে বৈঠকঘরে গেল। ইয়াসমিন নেই। অপু জানালো তিনি ঘরের কাজে চলে গেছেন।
নাস্তা তৈরি করতে গিয়ে অনেকটাই দেরি হওয়ায় ইয়াসমিনকে বসে থেকে এভাবে খালি মুখে চলে যেতে হলো ভেবে লজ্জায় পড়ল নাহিদা। লজ্জা সুরে বলল, ‘দুঃখিত। দেরি হয়ে গেল।’
‘সমস্যা নেই। আপনার হাতের রান্না না কি খুব’ই দারুণ হয়। সেই স্বাদ নেওয়ার জন্য আরও কয়েক ঘণ্টা থাকতে বললে আমি তা-ও থাকতাম।’
আবার পরোক্ষভাবে ফ্লার্টিং!

খেতে খেতে অপু’ই ভালোভাবে আলাপচারিতা শুরু করল। নিজের সম্পর্কে যতটুকু বলা যায়, সবটুকুই বলল। নাহিদা নিজের ব্যাপারে কিছু বলল না, শুধু চুপচাপ শুনেই গেল। দীর্ঘ আলাপে নাহিদাও কিছুটা সংকোচ ছাড়ল। তাছাড়া এর মাঝে অপু আর ফ্লার্ট করেনি। তাই সেও কিছুটা আগ্রহে অপুর কথাগুলো গিলতে লাগল। অপুর কথা বলার ভঙিটা সুন্দর—একদম ভাই ইফতেখারের মতো। তানজিমের কথা বলার ভঙি এত সুন্দর নয়। কিন্তু তারপরও তানজিমের কথার ভঙিকে অসুন্দর বলা নাহিদার পক্ষে সহজ নয়। ভালোবাসার মানুষ বলে কথা! ব্যাপারটাই অন্যরকম হবে।

অপু আর নাহিদার কথার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠল।
‘এক্সকিউসমি।’ বলে উঠে দাঁড়াল নাহিদা।
আড্ডার মাঝে কে এভাবে জল ঢালল তা দেখতে বিরক্ত চোখ নিয়ে দরজার দিকে তাকাল অপু। তানজিম এসেছে। কিছু বলতেই যাচ্ছিল সে, এমনসময় অপুকে দেখে চুপ করে গেল। একা বৈঠকঘরে একটা অচেনা ছেলের সাথে নাহিদা? বুক কেঁপে উঠল তানজিমের। অন্য দিনের চেয়ে নাহিদাকে আজ একটু ফুরফুরে লাগছে৷ এই ফুরফুরে মেজাজের কারণ সাধারণ পোশাকে সোফায় বসে থাকা ছেলেটা নয়তো? ইতস্ততভাবে ভেতরে ঢুকল তানজিম।
অপু কথা শুরু করল, ‘তানজিম ভাইয়া না কি?’
তানজিম আড়চোখে নাহিদার দিকে তাকাল। নাহিদা অপুর দিকেই তাকিয়ে আছে। গলা খাঁকারি দিয়ে তানজিম বলল, ‘হ্যাঁ। আপনি?’
হ্যান্ডশেক করল অপু। বলল, ‘আপনি নয়, তুমি। আমি আপনার ছোট হব। আমি অপু।’
‘ইয়াসমিন আন্টির ছেলে?’
‘জি।’
একটু আশ্বস্ত হলো তানজিম। যাক, সে যেমনটা ভেবেছিল, তেমনটা হয়তো নয়।

তানজিম ঘরে এলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই খুলতে খুলতে আড়োচোখ বৈঠকঘরে তাকাল। সামনের সোফায় অপুর মুখোমুখি বসেছে নাহিদা। তাদের কথার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে, ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। তাদের বন্ধুত্ব তানজিমের কাঁধে যেন বোঝা হয়ে চাপলো। এত ভারী বোঝা যে দম ফেলারও উপায় হচ্ছে না। কিন্তু নাহিদা তা জানল না।

মাগরিবের আজানের আগে অপুকে কিছুতেই সরানো গেল না৷ আযানের ধ্বনি শুনে তবেই উঠে দাঁড়াল সে। কার সাথে যেন দেখা করার আছে। ভাগ্যিস অপুর কারো সাথে দেখা করার কথা ছিল, নইলে আজ রাতটা সে নির্বিঘ্নে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিত বুঝাই যাচ্ছিল। সবার শেষে স্বভাব অনুযায়ী ফ্লার্টিং করতে ভোলেনি। এবার বিরক্ত লাগলেও হেসেছিল নাহিদা। তারউপর আবার সম্পর্ককে এক প্রকার ধরে বেঁধে ‘তুমি’তে নামিয়েছে অপু। আর তারপর থেকেই তানজিমের মুখ ভার। কিন্তু সেটা এড়িয়ে গেছে নাহিদার চোখ। সে নিজের মতোই আড্ডা শেষে রান্নাঘরে চলে গেছে। এদিকে তানজিমের মাথায় যে কঠিন ক্রোধ ভর করেছে, সেটা দেখার সুযোগ’ই মিলল না নাহিদার।

(চলবে)

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here