কিশোরী কন্যার প্রেমে পর্ব -২২+২৩

#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_২২
.
সোডিয়াম আলোয় আলোকিত রাস্তা। মোটামুটি নির্জন পরিবেশ। আকাশে থেমে থেমে মেঘের গর্জন ভেসে আসছে। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে নীরদ ও অর্ঘমা। কফিশপ থেকে তারা একা বেরিয়েছে। বাকিরা সবাই যার যার মতো চলে গেছে। নিধি অভ্রর সাথে বাসায় চলে গেছে। মূলত তাদের কিছুটা একান্ত সময় কাটাতে দেওয়ার জন্যই সকলের চলে যাওয়া। দু’জনই বেশ চুপচাপ। একে অপরের ভেতরে চলা অনুভূতি নীরবে অনুভব করার চেষ্টায় আছে দু’জনে। অর্ঘমার হাতের সাথে বারবার নীরদের হাতের ছোঁয়া লাগছে। মৃদু হাসি লেপ্টে আছে তার ঠোঁটে। নীরদ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে ধীর গতিতে অর্ঘমার হাতের আঙুলের ফাঁকে নিজের হাতের আঙুল গুঁজে দিল। চমকে হাতের দিকে একপলক তাকিয়ে নীরদের দিকে তাকাল অর্ঘমা। অপর হাতে কপালের সামনে আসা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে লাজুক হেসে রাস্তার দিকে তাকাল। প্রশ্রয় পেয়ে শক্ত হলো নীরদের হাতের ভাজ। অন্য হাতে মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে আবারও ঠিক করল।

মেঘের গর্জনের পাশাপাশি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। নীরদ আশেপাশে তাকিয়ে কিছুটা দূরে টং দোকান দেখে অর্ঘমার হাত ধরে সেদিকে দৌড় দিল। ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে নিজের জামা ঝেড়ে নিল অর্ঘমা। নীরদ পকেট থেকে রুমাল বের করে কিছু না বলে চুপচাপ অর্ঘমার চুলে লেগে থাকা পানি মুছে দিল। মুগ্ধ চোখে তাকে দেখল অর্ঘমা। নিজের জামাকাপড়ে লেগে থাকা পানি ঝাড়তে ঝাড়তে নীরদ দোকানের ভেতরে তাকিয়ে অর্ঘমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“চা খাবে?”
-“হ্যাঁ, খাওয়া যায়।”
-“বৃষ্টি দেখতে দেখতে চা খাওয়ার মজাই আলাদা।”
দোকানিকে দু’কাপ চা দিতে বলে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে দাঁড়াতেই কিছু একটা মনে পড়ল নীরদের। পকেট হাতরে আড়চোখে অর্ঘমার দিকে তাকাল। অর্ঘমা তখন গলার স্কার্ফ ঠিক করতে ব্যস্ত।
-“অর্ঘ!”
নীরদের ডাকে থেমে গেল অর্ঘমার হাত। পাশে তাকিয়ে দেখল নীরদ দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
-“কিছু বলবেন?”
প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে অর্ঘমার সামনে এনে হাতের মুঠ খুলল। চেইনের খুব সুন্দর একটা ব্রেসলেট তার হাতে। অর্ঘমা এবার সরাসরি তাকাল নীরদের দিকে।
-“প্রথম বেতন পেয়ে সবার জন্যই কিছু না কিছু নিয়েছিলাম। এটা নিয়েছিলাম তোমার জন্য। কিন্তু দিতে সাহস পাইনি। কারণ এটা আলাদা। তোমার ফ্যামিলি স্বাভাবিকভাবে নিত না এই ব্যাপারটা। আর আসল কথা হলো আগে দিলে তুমিই নিতে না এটা। কিন্তু এখন তো নিতে সমস্যা নেই। আর তোমার বাবা-মা কিছু জিজ্ঞেস করলেও অভ্র ভাই সামলে নিতে পারবে।”
অর্ঘমা কিছু না বলে মৃদু হেসে নিজের হাত এগিয়ে দিল। নীরদের চোখজোড়া খুশিতে চকচক করে উঠল। ব্রেসলেটটা দ্রুত অর্ঘমার হাতে পরিয়ে দিল। ব্রেসলেটটা ভীষণ পছন্দ হলো অর্ঘমার।
-“আমার আসলে মেয়েদের জিনিসপত্রের ব্যাপারে তেমন কোনো আইডিয়া নেই। তাই কী নিব বুঝতে পারছিলাম না। অনেক খোঁজার পর এটা এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল বলে নিয়েছি। তোমার পছন্দ হয়েছে?”
-“খুব পছন্দ হয়েছে। থ্যাংক ইউ।”
ঠোঁট কামড়ে হাসল নীরদ। দোকানদারের ডাকে এগিয়ে গিয়ে চা নিয়ে এসে একটা কাপ অর্ঘমার দিকে এগিয়ে দিল। অর্ঘমা সেটা নিতেই নীরদ পকেট থেকে রুমাল বের করে অর্ঘমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“রুমাল দিয়ে কাপটা পেঁচিয়ে ধরো। তাহলে আর হাতে গরম লাগবে না।”
মুচকি হাসল অর্ঘমা। এতগুলো বছরে এসবে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ছেলেটা বড্ড কেয়ারিং। নুসরাতের কাছে শুনেছে, যে মেয়ে নীরদের লাইফ পার্টনার হবে সে নাকি ভীষণ ভাগ্যবতী হবে। তখন অর্ঘমা মনে মনে হাসত। কারণ ইতোমধ্যে সে নীরদের সকল কেয়ারিং উপভোগ করেছে। নীরদের লাইফ পার্টনার হিসেবে নিজেকে কল্পনা করত প্রায় সময়। আজ সে অফিশিয়ালি নীরদের গার্লফ্রেন্ড হয়েছে। স্ত্রী হতেও সময় লাগবে না এখন।
নীরদের কথা মতো রুমাল দিয়ে কাপটা পেঁচিয়ে ধরে বৃষ্টি দেখতে দেখতে চা পান করতে লাগল। এর মধ্যে অভ্রর কল এসেছিল। নীরদ তার সাথে কথা বলে নিয়েছে। বৃষ্টি কিছুটা কমতেই অর্ঘমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে রিকশা খুঁজতে গেল। রিকশা পেতেই দু’জনে রিকশায় উঠল। প্রত্যেকবারের মতো এবারও অর্ঘমা রিকশায় ওঠার পর তার জামা, ওড়না ঠিক করে দিয়ে তারপর রিকশায় উঠল নীরদ। রিকশা চলতে আরম্ভ করলে এবার অর্ঘমা নিজে থেকেই নীরদের হাত ধরল। অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল নীরদ। অর্ঘমা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে দেখে মৃদু হাসল। হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে আশেপাশে ভালো করে দেখে নিয়ে অর্ঘমার হাতের উপর চুমু খেল। কেঁপে উঠে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল অর্ঘমা। এবার নীরদ অন্যদিকে তাকাল। অর্ঘমার বিস্ময় ভাব তখনো কাটেনি। রিকশার বেলের শব্দ শুনে বিস্ময়ের ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো। লজ্জায় গাল গরম হয়ে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগল। কিন্তু অধর জুড়ে ছেয়ে গেল হাসির রেখা। বিরবির করে বলল,
-“আমিও আপনাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি নীরদ ভাই।”
___
বাসার সকল জিনিসপত্র গোছগাছ করা হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় অল্প কিছু জিনিস বাইরে আছে। চারদিন পর অর্ঘমারা এই বাসা ছেড়ে নিজেদের বাসায় উঠবে। এখান থেকে প্রায় দুই ঘন্টার পথ অতিক্রম করে তাদের বাসায় যেতে হয়। তবে একটা জিনিস ভালো হয়েছে। ভার্সিটি একদম কাছে তাদের বাসা থেকে। দশ মিনিটের মতো লাগে যেতে। এসবের মাঝেও নীরদের জন্য তার মন খারাপ করছে। এখন তো প্রতিদিন দেখা করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কী করবে? তখন তো আর প্রতিদিন দেখা হবে না। আর নীরদের পক্ষেও প্রতিদিন অফিস শেষে ক্লান্ত শরীরে উলটো ঘুরে এসে তার সাথে দেখা করা সম্ভব নয়। অবশ্য যদি অর্ঘমা বলে তাহলে নীরদ প্রতিদিন অবশ্যই আসবে। কিন্তু এটা ঠিক হবে না ভেবে বলার কথা মাথাতেও আনেনি।

বিকালে অর্ঘমা বেলকনিতে বসে ফোন টিপছিল। বেলের আওয়াজ শুনে রুমের দিকে তাকাতেই দেখল নিধি ইতোমধ্যে রুম ছেড়ে বের হচ্ছে দরজা খোলার জন্য। তাই আর সেদিকে গেল না। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে ফোনে ভিডিও দেখতে লাগল। নীরদের সাথে সকালে কথা হয়েছিল। আজ অভ্রর ছুটি থাকায় সে বাসায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। ইয়ারফোনে টান লাগায় সামনে তাকিয়ে নিধিকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে?”
-“নীরদ ভাইয়ের বাবা-মা আর বোন এসেছে।”
-“হঠাৎ?”
-“তা তো জানি না। তুই ভাইয়াকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখ।”
নিধির বলতে দেরি অর্ঘমার কল লিস্টে ঢুকতে দেরি হয়নি। নীরদের নাম্বারে কল দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে নিরাশ হতে হলো। কারণ ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো না। পর পর বেশ কয়েকবার কল দেওয়ার পরও হদিস মিলল না নীরদের। বিরক্ত হয়ে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল বিছানায়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে নিজেকে কিছুটা পরিপাটি করে বের হলো রুম থেকে। অর্ঘমাদের পারিবারিক ব্যাপারে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে নিধি রুমেই রইল।

ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখল অভ্র আর তার বাবা কথা বলছে নীরদের বাবা-মা আর বোনের সাথে। অর্ঘমা গিয়ে তাদের সালাম দিল। নুসরাত তার পাশে জায়গা করে দিল বসার জন্য। অর্ঘমা মুচকি হেসে নুসরাতের পাশে বসে তার সাথে গল্প করা শুরু করল। মিনিট পাঁচেক পর সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করল নীরদ। তার দু’হাত ভরতি মিষ্টি ও ফল। অভ্রর সাহায্যে সেগুলো টেবিলে রেখে এসে সোফায় বসল সবার সাথে। চোখাচোখি হলো দু’জনার। অর্ঘমা চোখের ইশারায় এসবের মানে জিজ্ঞেস করলে নীরদ কিছু বলল না। শুধু রহস্যময় ভাবে হাসল। পাশ থেকে নুসরাত অর্ঘমাকে ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“তলে তলে তোমাদের কাহিনী এতদূর গড়িয়ে গেল। আর আমরা জানতেও পারলাম না?”
-“কিসের কাহিনী? কিসের কথা বলছ আপু?”
-“তোমার আর আমার ভাইয়ের প্রেম কাহিনীর কথা।”
চোখ বড় বড় করে বিস্ময় নিয়ে তাকাল অর্ঘমা। নুসরাত কীভাবে জানল? অর্ঘমার অবস্থা দেখে নুসরাত হেসে বলল,
-“নীরদ জানিয়েছে কালকে রাতে। বাবা-মা তো তোমার কথা শুনে এক পায়ে রাজি। তবে আমরা সবাই এই ভেবে বিস্মিত হয়েছি যে এতগুলো বছরে আমাদের কারও চোখে পড়েনি বিষয়টা।”
-“কী বলেছেন নীরদ ভাই?”
-“ভাই? তুমি নীরদকে ওর সামনেও ভাই বলে ডাকো নাকি?”
থতমত খেয়ে গেল অর্ঘমা। আমতা আমতা করে বলল,
-“হ্যাঁ, ওই আরকি!”
-“নীরদ তোমায় কিছু বলে না এই নিয়ে?”
-“না। আসলে অভ্যাস হয়ে গেছে।”
-“তোমরা রিলেশনে আছ কবে থেকে? কয় বছর হলো? আগে কে কনফেস করেছে?”
-“রিলেশনে আছি সপ্তাহ তিনেক হলো। কনফেস আগে নীরদ ভাই করেছে।”
-“তুমি রাজি হলে কীভাবে?”
-“আমিও পছন্দ করতাম তাকে। তাই না করার কোনো অপশন ছিল না।”
লাজুক হেসে আড়চোখে নীরদকে একবার দেখে নিল। অভ্রর সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে ছেলেটা। নুসরাত তা খেয়াল করে বলল,
-“ভাই আমার একেবারে ডুবে গেছে প্রেমের সাগরে।”
অর্ঘমার গাল দু’টো লাজে রাঙা হয়ে উঠল।
___
নীরদের বাবা কথা বলার এক পর্যায়ে বললেন,
-“এতক্ষণ তো অনেক কথাবার্তা হলো। তাহলে এখন আসল কথায় আসি।”
অর্ঘমার বাবা সিরিয়াস হয়ে বসলেন। বললেন,
-“জি, বলুন।”
-“নীরদকে তো চিনেনই। অভ্রর সাথে বেশ ভালো খাতির আছে ওর। আমার ছেলে বলে বলছি না। নীরদ আসলেই ছেলে হিসেবে খুব ভালো।”
-“হ্যাঁ, আমরাও জানি ও খুব ভালো ছেলে। তাই তো অল্প সময়ে আমাদের এত প্রিয় হয়ে উঠেছে।”
-“নীরদের জীবনসঙ্গী যে হবে তাকে সে মাথায় তুলে রাখবে।”
-“যে মেয়ে আপনার ছেলের বউ হবে, সে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী।”
-“বলছেন?”
-“জি।”
-“আপনার কী মনে হয়, যেকোন মেয়ে চাইলেই পাবো আমার ছেলের জন্য?”
-“যদি মেয়ের পরিবার বিচক্ষণ হয়, খাঁটি হীরে চিনতে পারে তাহলে অবশ্যই রাজি হবে।”
ছেলের দিকে তাকিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে হাসলেন নীরদের বাবা। নীরদও মৃদু হাসল। নীরদের বাবা অর্ঘমার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“তাহলে আপনার মেয়েটাকে আমাদের দিয়ে দিন।”
-“জি!”
বিস্ময় সুরে প্রশ্ন করলেন। নীরদের বাবা সহাস্যে হেসে বললেন,
-“আমরা নীরদের জীবনসঙ্গী হিসেবে আপনার মেয়েকে চাই। অর্ঘমার মতো লক্ষ্মী আর আদুরে মেয়ে থাকতে আমরা আর অন্য কোনো মেয়েকে দেখতে চাচ্ছি না। আমাদের অর্ঘমাকে পছন্দ। তাছাড়া নীরদ, অর্ঘমাও একে অপরকে পছন্দ করে।”
অভ্রর বাবা নিজেকে স্বাভাবিক করে একবার নীরদের দিকে তাকিয়ে পরে অর্ঘমার দিকে তাকালেন।

চলবে…

নোটঃ খুব শীঘ্রই গল্পটা শেষ হতে চলেছে।#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_২৩
.
অর্ঘমা মাথানিচু করে বসে আছে। সে এসবের ব্যাপারে কিছুই জানে না। এখানে যা হচ্ছে সব তার মাথার তিন হাত ওপর দিয়ে যাচ্ছে। নীরদের বাবার এসব কথায় অর্ঘমার বিস্ময়ের পাহাড় যেন হিমালয় পর্বতের সমান হয়ে গেছে। তার রাগ হচ্ছে নীরদের ওপর। আজ যে ওরা এই ব্যাপারে কথা বলতে আসবে আগে থেকে জানাল না কেন? আগে থেকে জানালে একটু প্রস্তুতি নিয়ে থাকা যেত। এভাবে কিছু না বলে হুটহাট এসব কাজের মানে কী? এখন যে সে অপ্রস্তুত হয়ে বসে আছে! বাবা কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলবে সে?

অর্ঘমাকে মাথানিচু করে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে অভ্রর বাবা আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলেন না। যা বুঝার বুঝে গেলেন তিনি। অভ্রর দিকে তাকাতেই অভ্র গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল,
-“আমি ওদের ব্যাপারটা জানতাম। নীরদ ভালো ছেলে তাই আমার আপত্তি ছিল না। মানে আপত্তি করার কোনো কারণ ছিল না। তাছাড়া আসল ব্যাপার হলো ওরা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে। তাহলে আমি কেন আপত্তি করব?”
বাবা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকলেন। মনে মনে চিন্তাভাবনা করছেন হয়তো। পরিবেশটা হুট করেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। এই ফাঁকে নিধি এসে সকলকে চা-নাস্তা দিয়ে হালকা কুশলাদি বিনিময় করে আবারও রুমে চলে গেল। অভ্রর বাবা গলা ঝেড়ে বললেন,
-“আমার তরফ থেকেও কোনো আপত্তি নেই।”
পরিবেশটা আবারও আগের মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠল। অর্ঘমা প্রথমে বিস্ময় নিয়ে বাবার দিকে তাকালেও পরক্ষণেই নীরদের দিকে তাকাল। নীরদ আড়চোখে আশেপাশে দেখে নিয়ে চোখ টিপ মারতেই লজ্জায় অন্য দিকে তাকাল। দুই পরিবারের সকলে একে অপরকে মিষ্টি মুখ করাল। নীরদের বাবা এবার আরেকটা আবদার রাখলেন।
-“আমি চাইছিলাম আজই আংটি পরানোর কার্যক্রমটা সেরে ফেলতে। আমরা দেরি করতে চাইছি না। সামনে অর্ঘমার পরীক্ষা আছে শুনলাম। পরীক্ষার পর বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছি।”
-“এত তাড়াতাড়ি?”
-“জি। ওরা দু’জন যখন দু’জনকে পছন্দই করে তখন আর দেরি করার দরকার কী?”
-“একটা মাত্র মেয়ে তো তাই আমি চাইছিলাম সময় নিয়ে সবকিছু করতে।”
-“চিন্তা করবেন না। এর মধ্যেই সব হয়ে যাবে। আমরা আছি তো।”
-“ঠিক আছে। আপনারা যখন এত করে বলছেন, আর ছেলেমেয়েরও কোনো আপত্তি নেই তখন আর না করব না।”
পরক্ষণেই আবার বললেন,
-“হাতে তো তাহলে একদমই সময় নেই।”
-“চিন্তা করবেন না। হয়ে যাবে সবকিছু। আপাতত নাহয় আংটি বদলটা হয়ে যাক।”
-“হ্যাঁ, অবশ্যই। দাঁড়ান আমি আসছি।”
অভ্রর বাবা ভেতরে রুমে গেলেন। ফিরে এলেন কিছুক্ষণ পর হাতে একটা ছোট বক্স নিয়ে। সোফায় বসে বললেন,
-“মেয়ে এখন বড় হয়েছে। এমন একটা দিন আসবে ভেবেই এই আংটিটা কিছুদিন আগে বানিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু দিনটা যে এত তাড়াতাড়ি আসবে সেটা ভাবিনি।”
অর্ঘমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“তুমি কী চেঞ্জ করবে মামণি?”
নুসরাত বাঁধ সেধে বলল,
-“দরকার নেই আঙ্কেল। এভাবেই ভালো লাগছে। স্কার্ট আর শার্টে ওকে খারাপ লাগছে না।”
-“আচ্ছা, তাহলে শুরু করা যাক।”

অর্ঘমাকে বসানো হলো তার বাবা আর ভাইয়ের মাঝে। মিনা বেগম এখানে অনুপস্থিত। তিনি ঘুরতে গিয়েছেন তার বান্ধবীদের সাথে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে মাকে ছাড়া শুভ কাজ সারতে একদমই ভালো লাগছিল না অর্ঘমার। কিন্তু কিছু করার নেই। মায়ের সাথে তার সম্পর্ক খুব জঘন্য ভাবে একেবারে শেষ হয়ে গেছে। মিনা বেগম এখন আর তাকে মেয়ে বলে পরিচয় দেয় না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে তার একটা মাত্র ছেলে। এসব শুনে খুব কষ্ট হয় অর্ঘমার। মিনা বেগমের এই দুর্ব্যবহার যে শুধু নিধিকে এই বাসায় নিয়ে আসার জন্য না তা অর্ঘমা অনেক আগেই টের পেয়েছে। নিধি তো শুধু নামমাত্র। কিন্তু আসল ঘটনা অন্য জায়গায়। এই নিয়ে বছরখানেক আগে ভীষণ বড় রকমের একটা ঝগড়া লেগেছিল বাসায়। সেদিন অর্ঘমা প্রচন্ড ভেঙে পড়েছিল। সেদিনের কথা ভাবলে এখনো অর্ঘমার দু’চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়তে চায়।
দুরুদুরু বুকে বাবা, ভাইয়ের মাঝে বসে চোখ তুলে তাকাল নীরদের দিকে। নীরদের মুখে খুব সুক্ষ্ম এক হাসির রেখা। সেটা কেউ বুঝতে না পারলেও অর্ঘমার চোখ এড়ালো না। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে ঘাড় উঁচু করে আশেপাশে তাকাল। নিধি নেই কোথাও। অভ্রর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“নিধি কোথায়? ওকে ডেকে নিয়ে এসো ভাইয়া। আম্মু তো নেই। এখন আমার এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে যদি নিধিও না থাকে তাহলে..”
-“মন খারাপ করিস না। আমি তোর বান্ধবীকে নিয়ে আসছি।”
অর্ঘমা মাথা নাড়িয়ে সায় জানাতেই অভ্র সোফা ছেড়ে উঠে গেল।

নিধিকে পাওয়া গেল রুমের বারান্দায়। গ্রিলের সাথে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটাকে সে হাতে গোণা কয়েকবার মাত্র হাসতে দেখেছে। কথাও বলে খুব কম আর আস্তে। মেয়েটার চাপা স্বভাব দিন দিন যেন আরও বাড়ছে। বাইরে বের হলে রাস্তায় কোনো পরিবার দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ে। বাবা-মা যখন তাদের বাচ্চাদের আদর করে তখন নিধির চোখ দু’টো টলমল করে ওঠে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে কাঁদে মেয়েটা। সবই খেয়াল করেছে অভ্র। তার খারাপ লাগে নিধির জন্য। এমন কপাল কেন হলো মেয়েটার? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অভ্র। এগিয়ে যায় সামনে। গলা ঝাড়তেই পেছনে তাকাল নিধি।
-“বাইরে চলো। অর্ঘমা তোমায় ডাকছে।”
-“কেন?”
-“ওর এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ও তোমাকে পাশে চায়। অ্যাজ আ বেস্টফ্রেন্ড, এটা তোমার দায়িত্ব।”
-“গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত মানে? কী হচ্ছে ওখানে?”
-“অর্ঘমাকে আংটি পরাতে এসেছে। সামনে তোমাদের এক্সাম আছে। সেটা শেষ হলেই বিয়ের আয়োজন শুরু হবে।”
নিধির মুখটা বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। অভ্রর হাসি পেল নিধির অবস্থা দেখে। হাসি চেপে বলল,
-“জলদি চলো। তোমার জন্য আংটি পরানো স্থগিত রয়েছে।”
-“সত্যি সত্যি আজ অর্ঘমার এনগেজমেন্ট?”
-“হ্যাঁ।”
-“কিন্তু এভাবে হঠাৎ?”
-“মূলত ওদের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে এসেছিল। এখন নীরদের বাবা চাচ্ছেন আংটি পরিয়ে যেতে। বাবাও রাজি।”
-“যাক, ভালোই হলো। অর্ঘমা তো আজ হাতে ইদের চাঁদ পেয়েছে।”
হাসল অভ্র। নিধি মৃদু হেসে বলল,
-“চলুন।”
নিধি আগে আগে যেতেই অভ্র হাসিমুখে তার পেছন পেছন গেল।
___
নীরদরা চলে যেতেই অর্ঘমা রুমে এসে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মনের ভেতর এক অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে। একটু আগে তার বাগদান সম্পূর্ণ হয়েছে। কথাটা যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। প্রথমে নীরদের ওপর রাগ লাগলেও এখন তার ভীষণ ভালো লাগছে। আজকের এই সারপ্রাইজের জন্য নীরদকে একটা টাইট হাগ করতে মন চাচ্ছে। ফোন হাতে নিতেই স্ক্রিনে নীরদের ম্যাসেজ দেখতে পেল।
-“সারপ্রাইজ কেমন লাগল?”
অর্ঘমা মৃদু হেসে রিপ্লাই করল,
-“ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালো।”
তৎক্ষনাৎ নীরদের থেকে আবারও ম্যাসেজ এলো।
-“এত ভালো একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আমাকেও তো তোমার কিছু দেওয়া উচিত।”
কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে অর্ঘমা রিপ্লাই করল,
-“রাতে ছাদে আসবেন। দেখা করে ভাববো কী দেয়া যায় আপনাকে।”
-“ওকে। এখন তাহলে বিশ্রাম নাও। আমাকে একটু বের হতে হবে। কাজ আছে।”
-“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
একটা লাভ ইমোজি পাঠিয়ে নীরদ অফলাইন হয়ে গেল। তা দেখে অর্ঘমাও ফোন রেখে চোখ বন্ধ করে নিল। ঠোঁটে মৃদু হাসি। আংটি বদলের মুহূর্তটা কল্পনা করতে করতে সেভাবেই ঘুমিয়ে গেল একসময়।
___
চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। সামনের নিম গাছের ডালে দুটো চড়ুইপাখি বসে আছে। একজন আরেকজনের মাথা চুলকিয়ে দিচ্ছে। হাসি ফুটে উঠল নিধির মুখে। পাখিরাও ভালোবাসা বোঝে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। তার জীবনে কেউ নেই কেন? অর্ঘমা যেমন সহজেই নীরদকে পেয়ে গেল, ঠিক তেমন করেই সে-ও তো কাউকে পেতে পারত। কিন্তু তার জীবনে কখনো কেউ আসতেই চায়নি। তার জীবনে শূন্যতার অভাব নেই। সবচেয়ে বড় শূন্যতা হলো বাবা-মায়ের শূন্যতা। নিধি নিজ ভাবনায় এতটাই মগ্ন ছিল যে রান্নাঘরে অভ্রর উপস্থিতি একদমই টের পায়নি।
-“তুমি কী চা বানাচ্ছ?”
হঠাৎ প্রশ্নে ভীষণভাবে চমকে উঠল নিধি। বুকে হাত দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। অভ্র বুঝতে পারল না এর কারণ। সে তো এমন কিছু বলেনি যে চমকে উঠতে হবে। নিধি পেছন ঘুরে অভ্রকে দেখে বলল,
-“কিছু বলেছেন?”
-“তুমি কী কিছু ভাবছিলে? চমকে উঠলে যে হঠাৎ?”
-“না, তেমন কিছু না। আপনি কী বলছিলেন?”
-“চা বানাচ্ছ কিনা জিজ্ঞেস করছিলাম।”
-“হ্যাঁ। আপনার জন্যও বানাব?”
-“বানালে ভালো হয়। আসলে অফিসে প্রতিদিন এই সময়ে চা খাওয়া হয়। অভ্যাস হয়ে গেছে।”
-“আচ্ছা, দিচ্ছি। আপনি বসুন গিয়ে।”
অভ্র চলে যেতেই চায়ের পাতিলের দিকে তাকাল। পানি শুকিয়ে অল্প হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি আবারও পাতিলে পানি দিয়ে পানি বলক আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল।

চায়ের কাপ নিয়ে অভ্রর সামনের টেবিলের উপর রেখে বলল,
-“আপনার চা।”
-“তোমারটা কই?”
-“রান্নাঘরে রাখা আছে।”
-“চা নিয়ে এসে এখানে বসো। সঙ্গ দাও আমাকে।”
অবাক হয়ে গেল নিধি। অভ্র এই ধরনের কথা আগে কখনো বলেনি। নিধিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভ্র বলল,
-“কী হলো? যাও গিয়ে তোমার চা নিয়ে এসো।”
কোনো প্রতিত্তোর না করে মূর্তির মতন রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল নিধি। সে সবসময় অভ্রকে কিছুটা এড়িয়ে চলেছে। আশেপাশের লোকজনের কানাঘুষা আর অভ্রর মায়ের ভয়ে সবসময় তটস্থ থেকেছে। কখনো চায়নি তার জন্য অভ্রর সম্মানহানি হোক। এছাড়াও অভ্রকে দেখলে তার কেন যেন একটু ভয় ভয় করে। মনে হয় এক্ষুনি বুঝি তাকে বকবে। যদিও তার এসব ভাবনা অযৌক্তিক। কারণ অভ্র খুব শান্ত আর বড্ড প্রাণোচ্ছল ছেলে। সবসময় হাসিখুশি থাকাই এই ছেলের স্বভাব। অর্ঘমা আর অভ্র যখন দুষ্টুমি করে তখন মাঝে মাঝে নিধির বড্ড আফসোস হয় তার একটা ভাই নেই বলে।

চায়ের কাপ নিয়ে অভ্রর সামনের সোফায় বসল নিধি। অভ্রর একহাতে চায়ের কাপ, অন্য হাতে রিমোট নিয়ে এক এক করে টিভির চ্যানেল বদলাচ্ছে। গরম চায়ে ফুঁ দিতে দিতে সেদিকে তাকাল নিধি। অভ্র চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“পড়াশোনা কেমন চলছে?”
-“ভালো।”
-“কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
-“না। সমস্যা হলে ক্লাসে টিচারকে জিজ্ঞেস করে নিই।”
-“হুম। ভবিষ্যতে কী হওয়ার ইচ্ছা আছে?”
-“এখনো ঠিক করিনি। এই ব্যাপারে আমি বরাবরই কনফিউজড।”
-“ব্যাপার না। সময় আছে অনেক। পড়াশোনার পাশাপাশি ভাববে এই ব্যাপারে।”
সম্মতি জানিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে টিভির দিকে তাকাতেই বিষম খেল নিধি। টিভির চ্যানেল পাল্টানোর সময় বলিউড মুভির নায়ক-নায়িকার আপত্তিকর দৃশ্য দেখে তার গলায় চা আটকে গিয়েছে। অভ্র নিজেও থতমত খেয়ে গেছে। দ্রুত হাতে চ্যানেল পাল্টাতে গিয়ে টিভিই বন্ধ করে দিল। নিধি খুকখুক করে কেশে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। ভীষণ লজ্জা পেয়েছে সে। অভ্র নিজেও লজ্জা পেয়েছে। এরপরে কেউ আর কোনো কথা বলল না। অস্বস্তি কাজ করছে দু’জনের ভেতরে। চা খেয়ে কাপ টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে অভ্র চুপচাপ চলে গেল সেখান থেকে। নিধি তৎক্ষনাৎ নিজের গালে হাত দিল। গাল গরম হয়ে গেছে তার। তখনকার দৃশ্যটা মনে পড়তেই এবার নিঃশব্দে হেসে উঠল। নিজের চা শেষ করে কাপ দুটো নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here