কুড়িয়ে পাওয়া পদ্ম পর্ব -০১

রাত১২টা বাজে চুপিচুপি ঘর থেকে বের হয়ে অভ্র ভাইয়ার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। দরজা কিঞ্চিত ফাঁক থাকায় উঁকি ঝুঁকি দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করছি। ভেতরে অভ্র ভাইয়া আছে কি নেই। ঘরের মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার তেমন কিছুই নজরে পরছে না। হাত বাড়িয়ে দরজাটা হাল্কা ধাক্কা দিতে যাবো ঠিক সেই সময়ে পিছন থেকে তার গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে আসলো। সে রাগী গলায় বলে,

‘তুই এখানে কি করছিস?’

আমি দরজার সাথে খানিকটা ঝুঁকে ছিলাম বলে, তার কণ্ঠস্বর শুনে দরজার উপরে গিয়ে পরলাম। কেটকেট শব্দ করে দরজাটা খুলে গেলো আর আমি ঘরের মধ্যে উপুড় হয়ে পরে গেলাম। অন্ধকারে উনার পুরুষের অভয়ব ঠাহর পাওয়া যাচ্ছে না। আমি এখন ফ্লোরে বসে আছি। ঘাড় কাত করে আঁড়চোখে বার কয়েক পিছুনে তাকিয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো অভ্র ভাইয়া এসে আমার দু-হাত ধরে টেনে তুলবে কিন্তু সে ওটা করেনি বরং আমাকে ডিঙিয়ে রুমের ভেতরে চলে যায়। রমের মধ্যে ঢুকে সর্বপ্রথম লাইট জ্বালালো তারপর হেঁটে গিয়ে পায়ের ওপরে পা তুলে বিছানায় বসলো। আমার দিকে ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে তাকিয়ে আছে। আমি তার দিকে এক পলক দেখে চোখ জোড়া নামিয়ে নিয়েছি। ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছি। অভ্র ভাইয়া পা নাচাতে নাচাতে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘কি হল? কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেনো? এত রাতে তুই আমার ঘরের সামনে এসে রুমের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি পারছিস কেন?’

অভ্র ভাইয়া বড্ড বদমেজাজি সারাক্ষণ রাগী মুডে থাকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে কারো নেই। ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। শুঁকনো ঢোক গিলে মাথা তুলে তার দিকে তাকালাম। এমন সময় দেখি উনি রাগান্বিত হয়ে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম। মনে মনে নিজেকে কষতে লাগলাম, কেন যে আসতে গেলাম?

জিহ্বার মাথা দিয়ে শুঁকনো ঠোঁট জোড়া হালকা ভিজিয়ে নিয়ে আমতা আমতা করে বলি,

‘আমি ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে তোমার রুমে চলে আসছি।’

অভ্র ভাইয়া জেনো ক্ষিপ্ত হলো, তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘এর আগে তোকে ঘুমের ঘোরে কখনো হাঁটতে দেখিনি৷ ফান করছিস তুই আমার সাথে? দাঁড়া এখনই আমি সেজো মাকে ডেকে তোর উঁকি ঝুঁকি দেওয়ার কথা জানাচ্ছি।’

মা আমার ভীষণ রাগী। মা যদি জানতে পারে আমি এত রাতে অভ্র ভাইয়ার রুমে আসছি। তাহলে আমাকে গরম পানি ছাড়াই সি’দ্ধ করবে। ভয়ে লাফ দিয়ে ওঠে দাঁড়ালাম। অভ্র ভাইয়া উদ্দেশ্য চেঁচিয়ে বললাম,

‘আমার ভুল হইছে ভাইয়া। তুমি মা’কে কিছু বইলো না।’

কথাটি বলে এক ছুটে ঘরের সামনে থেকে পলায়ন করলাম।

ভ্রুকুটি কুঁচকে অভ্র মৃধা বর্ষার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,

‘বর্ষ্যু শোন!’

কে শোনে কার কথা যার মাথা তার ব্যাথা। এক দৌঁড়ে রুমে চলে আসলাম। দরজা ভেতর থেকে লক করে দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ঘনঘন ভারী নিঃশ্বাস ফেললাম। ইচ্ছে করছে এক বালতি ঠান্ডা জল অভ্র ভাইয়ার মাথায় ঠেলে দিতে। রাগে মনে হচ্ছে, নাক দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ঠোঁট জোড়া বাঁকা করে মুখ ভেংচি কেটে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলাম। শুয়েও শান্তি নাই এদিক ওদিক নাড়াচাড়া করেও ঘুম আসছে না। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওঠে বসলাম। রাগে ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে বসে রইলাম। রাগে ফুসফুস করে বলে ওঠলাম,

‘আস্তো একটা ব’জ্জা’ত বে’ডা!’
______________
‘বর্ষা ঘুম থেকা ওঠ দেখ সকাল কয়টা বাজে। ঘুম থেকা ওইঠা কিছু কাজকাম কর। আর কত ঘুমাইয়া থাকবি? সারাদিন ঘুমাই থাকছ আর সারা রাত মোবাইল টিপছ। ওঠ দেখ তোকে ডাকতাছে?’

ঘুমের সময় ডিস্টার্ব বড় বোন কানের কাছে ডাকাডাকি করছে ভীষণ রাগ উঠছে। শোনেও না শোনার মত করে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে রইলাম। কানের মধ্যে ঢুকলো সে জেনো বলল তোকে ডাকছে। কান খাড়া করে ন্যাকা কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লাম,

‘কে ডাকছে?’

সুমি আপু চেঁচিয়ে বলে,

‘তোকে তোর অভ্র ভাইয়া ডাকছে জলদি ঘুম থেকে ওঠ।’

সুমি আপুর মুখ থেকে অভ্র ভাইয়ার নামটি শুনে এক লাফে ওঠে বসলাম। চোখের পাতা থেকে ঘুম জেনো উধাও হয়ে গেছে। ফ্যালফ্যাল করে আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘অভ্র ভাইয়া আমাকে কেন ডাকছে?’

সুমি আপু ডোন্ট কেয়ার এটিটিউট দেখিয়ে বলে,
‘আমি কি জানি? আমাকে কি বলছে নাকি তোকে কেন ডাকছে? যা ওঠে ফ্রেশ হয়ে নে তারপর শুনে আয় কেন ডাকছে। নয়তো তোর কপালে শনি মঙ্গল বুধ সব আছে।’

সুমি আপু কথাগুলো বলে রুম থেকে চলে গেলো। আমি এখনও বিছানার ওপরে নাক ফুলিয়ে বসে আছি। কি জানি কিসের জন্য ডাকছে? মনের মধ্যে কোকিলা কু কু ডাকছে। নির্ঘাত উল্টাপাল্টা কিছু একটা করছি।
দশ মিনিট পর ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলাম। অভ্র ভাইয়ার রুমে গিয়ে দেখলাম মহাশয় রুমে নেই। পুরো রুম পরিপাটি ও গুছানো। ভাইয়ার রুম দেখে একবার নিজের রুমের কথা পরিকল্পনা করলাম। ছিহ! মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানালাম। ছেলে হয়েও উনার রুম কি সুন্দর ও গোছানো। আর আমার রুম জেনো আসতো এক গোয়াল ঘর।

পিছন থেকে বড় আম্মু গলা শুনলাম। বড় আম্মু শুধালো,
‘বর্ষা তুমি এখানে কি করছো?’

আমি পিছনে ঘুরে বললাম,
‘বড় আম্মু অভ্র ভাইয়া কোথায়? আমাকে নাকি ভাইয়া ডাকছে?’

খেয়াল করলাম বড় আম্মুর হাতে অনেক গুলা শার্ট-প্যান্ট ভাজ করা। নিশ্চয়ই অভ্র ভাইয়ার পোশাক ভাজ করে তার রুমে দিতে আসছে। আমি বড় আম্মুর উদ্দেশ্য আরও বললাম,

‘বড় আম্মু অভ্র ভাইয়ার পোশাক আশাক এইগুলো তুমি কোথা থেকে নিয়ে আসছো?’

বড় আম্মু মুচকি হেসে বলে,
‘তোর অভ্র ভাইয়া এখনও নিজের পোশাক আশাক নিজে ভাজ করতে পারে না। তাই তো আমি রাতে নিয়ে রাখছিলাম। সময়ের অভাবে দিয়ে যেতে পারি নাই। সবে দু’দিন হল হোস্টেল থেকে বাড়ি আসছিস কিছুদিন থাক তোর অভ্র ভাইয়ার হাবভাব নিজের চোখেই দেখতে পাবি।’

কথাটি বলে বড় আম্মু রুমে ঢুকে যায়। আমি আগের ন্যায় পিছু ডেকে বলি,
‘বড় আম্মু বললে না, অভ্র ভাইয়া কোথায়?’

বড় আম্মু থেমে গেলেন পিছনে তাকিয়ে বলে,
‘দেখ গিয়ে সব ক’টা মিলে বাড়ির আঙিনায় বসে আছে।’

বড় আম্মুর কথা শুনে দ্রুত বাড়ির পিছন দিকে চলে আসলাম। খুশিতে আপ্লূত হচ্ছি, হয়তো বা অন্য কোনো কারণে ডাকছে। এমনও তো হতে পারে আজ স্পেশাল কিছু বলবে। ভাবতে ভাবতে নজর বন্ধি হলো অভ্র ভাইয়ার মুখের হাসি৷ এই প্রথম আমি তার মুখে হাসি দেখছি, ফোনে কথা বলতে বলতে হাসছে তিনি। আমি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। কেনো জানি না তার ঠোঁটের হাসিটা আমার ধ্যান মন সব কেঁড়ে নিচ্ছে। আমি বিচলিত হচ্ছি, মনে হচ্ছে অভ্র ভাইয়াকে যদি সারাক্ষণ আমার সামনে বসিয়ে রাখতে পারতাম। সে এভাবে হাসতো আর আমি তা দেখতাম। কি দারুণ হত না বিষয় টা?

আচমকা ঠাসসসস করে একটা শব্দ হল, আমার সব ভাই বোন গুলো শব্দ শুনে আমার দিকে তাকালো। অভ্র ভাইয়া কান থেকে ফোনটা খানিক সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মূহুর্তেই সব ক’টা খিলখিল করে হাসতে লাগল। তাদের হাসির শব্দ শুনে আমার ভীষণ রাগ উঠছে।
হাসতে হাসতে একটা আরেকটার উপরে পড়ে যাচ্ছে, একটা আরেকটারে জড়িয়ে ধরে হিহি করে হাসছে, ওদের হাসি দেখে আম গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অভ্র ভাইয়া নিজেও হাসছে।

মেজাজটা তিরতির করে বেড়ে যাচ্ছে। আমি না হয় স্লিপ কেটে ঠাসস করে পরে গেছি তাই বলে কী সবাইকে দাঁত ৩২টা বের করে হাহা করে হাসতে হবে? ছিহহ! মানবতা আজ তুমি কোথায়?
কেউ একটু সাহায্য করলো না। নিজে নিজে কোমরে হাত দিয়ে ওঠে দাঁড়ালাম। অভ্র ভাইয়া হাসতে হাসতে একহাত দিয়ে পেট চেপে ধরছে। মনে হচ্ছে হাসতে হাসতে আজ শহীদ হয়ে যাবে। কোনো রকম জোরপূর্বক হাসি থামিয়ে বলে,

‘বর্ষ্যু তুই পরে গেলি কি করে রে? ব্যাথা পাইছিস হেল্প লাগবে নাকি?’

অভ্র ভাইয়ার কথাখানি জেনো আগুনে ঘি ঢালার মত লাগছে। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম আমি। মাত্রাতিরিক্ত রাগে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,

‘উঠানে কলার ছেঁকলা কে ফেলছে?’

চলবে?
#কুড়িয়ে_পাওয়া_পদ্ম
লেখনীতে : শারমিন আক্তার বর্ষা
পর্ব : ০১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here