ছাঁদের দরজা খুলতেই নজরে এলো আমার স্বামী অন্য মেয়ের কাছাকাছি বসে গল্প করছে। মেয়েটি সোহাগের বাহু ধরে ওর দিকে ঝুঁকে আছে। সোহাগ আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলো। মেয়েটার চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। বেশ কয়েকদিন ধরে ওদের ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়ছে। ব্যাপারটা গুরুত্ব না দিয়ে শুঁকনো কাপড়গুলো নিয়ে রুমে চলে এলাম। আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নামবে। একটু দেরি হলে কাপড়গুলো ভিজে যেত। কাপড়গুলো ভাজ করে আলমারিতে তুলে রাখলাম, শরীরটা খারাপ লাগছে। সোহাগের ব্যাপারটা খুব ভাবাচ্ছে।
আজ-কাল পাশের বাসার চৈতী ভাবির সাথে সোহাগের খুব ভাব হয়েছে। সোহাগ আমার স্বামী। ভালোবেসে বিয়ে করেছি প্রায় দু’বছর হতে চললো। দু’জনের সংসারে সুখের অভাব নেই, তবে আজ-কাল ভালোবাসার রং ফিকে হতে শুরু করেছে। যাকে নিজের থেকে বেশি বিশ্বাস করি, সে নিশ্চয়ই আমাকে ঠকাবে না। এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছিল বিধায় সবকিছু দেখেও না বোঝার ভান করছিলাম। চৈতী ভাবীর স্বামী বিদেশে থাকে। বছর- দু’বছরে একবার দেশে বেড়াতে আসে। মাসখানেক থেকে আবার ফিরে যায়। ভাবী দেখতে খুব সুন্দরী, দেখে বোঝাই যায় না উনার বিয়ে হয়েছে।
” পিয়াসী, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? এক কাপ চা বানিয়ে দেও তো। হঠাৎ করে মাথাটা ভিষণ জ্বালা করছে। ”
“শরীর ভালো লাগছে না, একটু কষ্ট করে নিজেই বানিয়ে নাও। ”
” আজ-কাল তুমি বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছ। কোন কথাই শোনো না, কিছু বললেই নিজে করে নেও। সবকিছু আমাকে করতে হলে তুমি থাকবে কি জন্য? ”
আর কিছু বলার আগে চৈতী ছুটে এলো। হাতে চায়ের কাপ, কাপ থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। কোমল গলায় বললো, পিয়াসীকে বিরক্ত করার দরকার নেই, আমিই তোমার জন্য চা করে নিয়ে এসেছি। তোমার পছন্দের আদা-চা। ”
সোহাগ চৈতীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে চায়ের কাপটা নিল, তারপর দু’জনে কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শূন্য দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখ জ্বালা করছে, কিছুক্ষণ কাঁদতে পারলে ভালো লাগতো।
সোহাগের চিৎকারে ঘুম ভাঙে দেখি ঘড়িতে রাত নয়টা। বিকালে শুয়ে ছিলাম, কখন চোখ লেগে এসেছিল বুঝতে পারিনি। রাতের জন্য রান্না করতে হবে। রাত নয়টা বাজতে না বাজতেই সোহাগের খিদে পায়। সেজন্য হয়তো ডাকাডাকি শুরু করছে। প্রয়োজন ছাড়া আজ-কাল তেমন খোঁজ নেয় না আমার। ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে ড্রয়িং রুমে গেলাম।
” অবশেষে মহা রানীর ঘুম ভাঙলো তাহলে। ক্ষুধা লেগেছে, খাব। ”
” একটু অপেক্ষা করো। আমি খাবার বাড়ছি। ”
এখন রান্না করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। ফ্রিজে একজনের খাবার মতো ভাত আছে, তা-ই আপাতত গরম করে দেবো। সাথে ডিম ভাজা আর জলপাইয়ের আচার। রাইস কুকারে ভাভ গরম করে দিতে ডিম ভাজতে গেলাম। মিনিট দশেকের মধ্যে সবকিছু রেডি।
” আরে পিয়াসী, কি করছ?”
” সোহাগের জন্য খাবার বাড়ছি। এতো রাতে আপনি কি জন্য এসেছেন? রাত-বিরেতে অন্যের ঘরে চলে আসেন কেন?”
চৈতী মুখ কালো করে সোহাগের দিকে তাকিয়ে রইলো। সোহাগ ধমকের সুরে বললো, ” কেউ বাড়িতে এলে এভাবে কথা বলতে হবে তোমার? কোন দরকারও তো থাকতে পারে। ”
সোহাগের আশকারা পেয়ে চৈতী আহ্লাদী গলায় বললো, ” দরকারেই এসেছিলাম। তুমি বিকেলে বললে না চাপা শুঁটকির ভর্তা খেতে ইচ্ছে করছে। তাই তোমার জন্য বানালাম। ঘরে শুঁটকি মাছ ছিল না, বাজার থেকে কিনে আনতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। ”
” বাহ্! ভালোই তো শুরু করেছেন দু’জনে মিলে, চালিয়ে যান। ”
রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আর সহ্য করতে পারছি না, একটা মেয়ে কি করে স্বামীর সাথে অন্য মেয়ের আহ্লাদ সহ্য করতে পারে! কেউ পারে না। আমিও পারছি না, কষ্টে বুক ফে’টে যাচ্ছে। চোখের পানিতে বালিশ ভিজে একাকার।
কলেজে পড়া অবস্থায় সোহাগের সাথে পরিচয় হয়েছিল। সেখান থেকেই প্রেম, বছরখানেক প্রেম করে পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলাম। সোহাগের ভালোবাসা আমায় কষ্ট পেতে দেয়নি এতোদিন। তবে এখন আর সোহাগ আমাকে ভালোবাসে না। হয়তো অন্য কারো প্রেমে পড়েছে, বা আমাকে এখন আর ভালো লাগে না। চৈতীর সাথে ঘনিষ্ঠতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। হয়তো চৈতী সাথেই…
” দরজা লাগিয়ে দিয়েছ কেন? সবকিছু নিজের ইচ্ছে মতো করবে নাকি? ”
কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। দরজা খুলতেই সোহাগ আমায় ঠেলে ঘরে ঢুকে এলো। বিছানায় শুয়ে হুকুমের সুরে বললো, ” লাইট নিভিয়ে দেও। ”
লাইট নিভিয়ে সোহাগের পাশে বসলাম। ভাঙা গলায় বললাম, ” কিছু কথা ছিল। ”
” অনেক রাত হয়েছে, সকালে শুনবো। ”
” কথাগুলো খুব জরুরি, বেশি সময় লাগবে না। ”
” কি কথা? ”
” তুমি কি আমায় ভালোবাসো না?”
” হঠাৎ এমন কেন মনে হলো তোমার? তোমার জন্য মা বাবার থেকে আলাদা হয়েছি। বাবার অতো বড় বাড়ি থাকতে ভাড়ায় বাসায় থাকি। এতোকিছুর পরেও তোমার মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবাসি না?”
” তুমি ভালোবাসতে বলেই নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে তোমার সাথে সংসার করতে এসেছি। তবে আজ-কাল তোমার চোখে ভালোবাসা দেখতে পাই না। ”
” চোখের ডাক্তার দেখাও, হয়তো তোমার চোখে সমস্যা হয়েছে। সকালে অফিস আছে, ঘুমাতে হবে। ফা’ল’তু কথা শুনে সময় নষ্ট করার ইচ্ছে নেই। ”
” বেশ ভালোই বললে! আচ্ছা ঘুমাও। ”
সোহাগ ঘুমিয়ে পড়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। আমার চোখে ঘুম নেই, নানান রকমের চিন্তা এসে মস্তিষ্কে ভীড় করছে। অনেক সময় খুব সহজ জিনিসগুলো বুঝতে ইচ্ছে করে না। সবসময় চোখের দেখা সত্যি হয় না। সোহাগ আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছে চৈতী ভাবী ওর খুব ভালো বন্ধু। প্রথম দিকে চৈতীর সাথে খুব ভাব ছিল আমার, আমার অযুহাত ধরে বাসায় আসতো। ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে কাটাতাম। সোহাগ থাকলে চৈতীর কাজের তাড়া থাকতো না। এখন বুঝতে পারছি, কত বড় ভুল করেছি। খাল কেটে কুমির ডেকে এনেছি।
সকালের মিষ্টি রোদ চোখে পড়ছে, ইচ্ছে করলেও চোখ বন্ধ করে রাখার উপায় নেই। অবশ্য এখনই বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে, সকালের নাস্তা রেডি করতে হবে। চোখ মেলে দেখলাম সোহাগ খুব মনযোগ সহকারে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। স্ক্রিনের উপর আমাদের বিয়ের ছবিটা।
” কি করছো?”
সোহাগ চমকে উঠলো। তরল গলায় বললো, ” এমনই পুরনো ছবি দেখছিলাম। আগে কত ভালো সময় কাটাতাম আমরা। আজ-কাল মনে হয় তোমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। ”
” এখানে আমার কি দোষ?”
” তোমার কোন দোষ নেই, আমার নিজের ব্যবহার বদলে যাচ্ছে। অফিসের টেনশনে তোমাকে সময় দিতে পারছি না। ”
” চৈতীর সাথে গল্প করার সময় টেনশন থাকে না তাই না?”
” বউয়ের বুঝি হিংসে হচ্ছে! আচ্ছা এরপর থেকে চৈতীর সাথে কথা বলবো না। ”
” সত্যি? ”
” হুম সত্যি। ”
খুশি হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। তৃতীয় ব্যক্তির জন্য নিজের সংসার নষ্ট করতে চাই না। সোহাগও পরম যত্নে বুকে আগলে নিলো।
অনেকদিন পর দারুণ সময় কাটলাম । যেন নতুন বিয়ে হয়েছে দু’জনের । সোহাগ অফিসের জন্য বেরিয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। একা-একা বসে গল্পের বই পড়ছি। লেখকরা কি করে এতোকিছু চিন্তা করে কে জানে!
বেশ কিছু সময় ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। কে কল করেছে কে জানে! গল্পের এ অংশে টানটান উত্তেজনা, একটু শেষ করে তারপর দেখবো কে কল দিচ্ছে। কিন্তু মোবাইল থামার সময় নিচ্ছে না, একের পর এক কল আসছে। দৌড়ে গিয়ে কল রিসিভ করলাম, জরুরি কিছু হতে পারে। এই নিয়ে ১৭বার কল দিয়েছে, এতোবার কল দেওয়ার পরও কল রিসিভ না করলে যে কোন মানুষের বিরক্ত হওয়ার কথা।
” ভাবি আজ দুপুরে তোমার সাথে খাওয়া-দাওয়া করবো। একটা প্রয়োজনে ওদিকে আসছি, ভাবলাম দেখা করে যাই। তোমার হাতে তৈরি স্পেশাল চিংড়ি মাছ খেতে ইচ্ছে করছে। ”
” ঠিক আছে, রাতে থাকবে তো?”
” না ভাবি রাতে থাকতে পারবো না। তোমার শাশুড়িকে তো চেনোই! ”
” আচ্ছা, তাহলে তো এখন রান্নার ব্যবস্থা করতে হয়। ”
” রাখছি, টাটা। ”
সোহিনী আসছে, আমার একমাত্র ননদ। শশুর বাড়ির দিকে একমাত্র ননদই আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছে। বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না বিধায় অন্য কেউ বাড়ির বউ হিসাবে মেনে নিতে চায়নি। বিশেষ করে সোহাগের দাদি, তিনি তার বোনের নাতিতে সোহাগের বউ হিসাবে ঠিক করে রেখেছিলেন। সুন্দরী, শিক্ষিত, পয়সাওয়ালা মেয়েকে ছেলের বউ হিসাবে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু সোহাগ আমাকে পছন্দ করেছে। আমায় দেখতে খুব ফর্সা না হলেও মোটামুটি সুন্দরী বলা যায়।
বিয়ের পর থেকে সোহিনী আসা-যাওয়া করে। দু’জনের সম্পর্ক তথাকথিত ননদ – ভাবীর থেকে বেশ আলাদা। অনেকটা বান্ধবীর মতো। এক জায়গায় হলে গল্পই শেষ হতে চায় না।
ফ্রিজে চিংড়ি মাছ নেই। মেয়েটা এতো শখ করে খেতে চেয়েছে। বাজার একটু দূরে, তবুও
রেডি হয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রিকশায় যেতে আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
প্রচন্ড রোদে চারদিক গরম হয়ে উঠেছে, সূর্যের তাপে সবকিছু ঝলসে যাবে মনে হয়। রাস্তার পাশে শুঁকনো কৃষ্ণচূড়া ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে আছে। বেশ কয়েকদিন আগে বোধহয় ফুল শেষ হয়ে গিয়েছে। এজন্য নতুন পাপড়ি ছড়িয়ে নেই।
মাছ কেনা শেষ, রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি। বাজারের মধ্যে রিকশা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর ব্যাপার। বেশিরভাগ রিকশায় লোক থাকে।
মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর রিকশার দেখা পেলাম। তড়িঘড়ি করে রিকশায় উঠতে যাব এমন সময় সোহাগের দেখা মিললো। চৈতীর সাথে দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। চৈতী কথায় কথায় সোহাগের গায়ের উপর ঢলে পড়ছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ড কারখানা দেখতে লাগলাম, দেরি হচ্ছে দেখে রিকশাওয়ালা বিরক্ত হয়ে চলে গেছে। কোন যাত্রীর জন্য এতো সময় অপেক্ষা করলে ওদের পোষাবে না।
নতুন করে রিকশা খুঁজতে ইচ্ছে হলো না। রোদের ভিতর হাঁটা শুরু করলাম।
চলবে
সূচনা পর্ব
#কুয়াশার_মতো
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল