#কুয়াশার_মতো
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -২ + ৩
প্রচন্ড রোদে পিচঢালা রাস্তা গরম হয়ে আছে, অতিরিক্ত তাপে শরীর ঘামতে শুরু করেছে। কয়েক মিনিট রোদের ভিতর হাঁটছি এতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অথচ রিকশাচালকরা সারাদিন রোদে পুড়ে রিকশা চালায়, তাঁদের কি কষ্ট হয় না? হ্যাঁ তাদেরও কষ্ট হয়, প্যাডেল দিতে দিতে পুরনো গামছার কপাল মুছতে থাকে। থামলে চলবে না, জীবিকার টানে ছুটতে হবে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখালাম রাস্তায় তেমন কেউ নেই, বেশিরভাগ লোক সূর্যের আলো থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। যাদের একান্তই অন্য উপায় নেই, তাঁরাই রোদে পুড়ছে।
সোহাগের এ সময় অফিসে থাকার কথা, সকালে কত ব্যস্ততা দেখিয়ে অফিসে চলে গেল। অথচ এখন কোন ব্যস্ততা নেই, দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। সবসময় সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করতে নেই। এতে লাভের পরিবর্তে ক্ষতিই বেশি। নানান চিন্তার মাঝে অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য নজরে পড়লো।
বয়স্ক একজন রিকশা চালাচ্ছে। অল্প বয়সী বাচ্চা মেয়ে উনার যাত্রী, সম্ভবত স্কুলে পড়ে। স্কুল ড্রেস পরে আছে। বাচ্চা মেয়েরটি একহাত দিয়ে লোকটার মাথার উপর ছাতা ধরে আছে, অন্য হাতে একটা শক্ত কাগজ নিয়ে বাতাস করার চেষ্টা করছে। লোকটা যথাসম্ভব আস্তে রিকশা চালাচ্ছে। মেয়েটার পায়ে রোদ লাগছে, নিজের পা দু’টোরে রোদ থেকে বাঁচাতে ছায়ায় নেওয়া চেষ্টা করছে। কিন্তু বারবার রোদের ভিতর চলে যাচ্ছে।
দৃশ্যটা অসম্ভব সুন্দর। আজ-কাল রাস্তাঘাটে এমন সুন্দর দৃশ্য খুব কমই নজরে পড়ে। রিকশাটা আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় কানে এলো বয়স্ক লোকটি বাচ্চা মেয়েটাকে বলছে, ” দিদি ভাই, বাতাস করতে হবে না। তোমার কষ্ট হচ্ছে। রিকশা চালালে এমনতেই গায়ে বাতাস লাগে।”
লোকটার কথায় তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট। এমন যাত্রী হয়তো কখনো উনার ভাগ্যে জোটেনি। এমন নয় ওরা আত্মীয়, মেয়েটার গলায় রুদ্রাক্ষমালা, লোকটার মাথায় টুপি। বাচ্চা মেয়েটার জায়গায় আমি থাকলেও উনার সাথে এমন ব্যবহার করতাম না। বরং তাড়া দিতাম, বাড়ি গিয়ে রান্না করতে হবে, চাচা একটু জোরে চালান। একবার জন্যও মনে হতো না উনার কষ্ট হচ্ছে। টাকা দিয়ে পরিশ্রম কিনছি এতে দরদ দেখানোর কি আছে! বাচ্চাদের মন বড়দের মতো হিসাব কষতে জানে না, এজন্যই ওরা নিষ্পাপ।
” এতো রোদের ভিতর হাঁটছ কেন? শরীর খারাপ হবে তো।”
চিরপরিচিত কণ্ঠস্বর। পাশ ফিরে দেখি সোহাগ, রিকশায় বসে আছে। সাথে চৈতী নেই, একাই কোথাও যাচ্ছে। রিকশাওয়ালা গামছায় মুখ মুছে কয়েক মুহূর্ত জিরিয়ে নিচ্ছে।
” কি হলো কথা বলছো না কেন? মাথা খা’রা’প হয়ে গেছে নাকি?”
” না, বাড়ি ফিরছিলাম। ”
” তো রিকশা বা সিএনজিতে যেতে, রোদের ভিতর হাঁটার কি দরকার? ”
” রোদ উপভোগ করার চেষ্টা করছি। এ সময়ে তুমি কোথায় যাচ্ছ? তোমার না অফিসে থাকার কথা?”
” সোহিনী কল দিয়েছিল, বললো আমাদের ওখানে আসছে। তাই বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। উঠে এসো। রোদে পুড়ে জ্বর বাঁধানোর তালে আছে। ”
” রোদে পুড়লে জ্বর হয় নাকি? জ্বর তো বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগালে হয়। ”
” কথা না বলে উঠে এসো। মামা চলেন। ”
সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। চৈতীর সাথে ঘুরতে বের হলে একা একা বাড়ি ফিরছে কেন? আবার অফিস দিয়ে বাড়ি ফিরতে হলে বাজারে কি কাজ? ছেলেটার কান্ডকারখানা মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। অবিশ্বাস করতেও পারছি না। বিশ্বাস – অবিশ্বাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি। যদিও অন্য কারণ আছে, আমার মন সোহাগকে অবিশ্বাস করতে চাইছে না। মনের মাঝে উদিত চিন্তাগুলোকে মিথ্যা প্রমান করতে চাইছে। এজন্য সামান্য কারণ পেলেও অবিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সোহাগ আমার ডান হাত ধরে আছে, আঙ্গুলের ভাঁজে নিজের আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে হাতটা চেপে ধরেছে। সাধারণত পরকীয়া আসক্ত পুরুষরা এমন কাজ করে না। তাঁদের কাছে বউদের সংস্পর্শ বিরক্তিকর লাগে, সবসময় অন্য চিন্তার ডুবে থাকে। এখন সোহাগের মাঝে সেসব কিছু লক্ষ্য করছি না। সুখী দম্পতির মতো হাত ধরে রিকশায় ঘুরছি।
” কোথায় গিয়েছিলে? কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে বলতে পারতে। সময়মতো দেখা না হলে মনে রোদের ভিতর বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে। ”
” সোহিনী চিংড়ি মাছ খেতে চেয়েছে। বাড়িতে চিংড়ি মাছ নেই, তাই বাজারে গেছিলাম। ”
” আমিও বাজারে গেছিলাম। তোমাকে তো দেখলাম না।”
” তোমার বাজারে কি কাজ?”
” এমনই আসার পথে কিছু বাজার-সদয় করে নিয়ে আসলাম, বাড়িতে বোধহয় বিশেষ কিছু নেই। ”
” তুমি কি করে জানো বাড়িতে বিশেষ কিছু নেই? আমি তো কিছু বলিনি। ”
” তুমি না বললেও আমিই তো বাজার করি। কোন বেলা কি রান্না হচ্ছে সে খবরও রাখি। তাই সামান্য বিষয়টা বোঝা কঠিন কিছু নয়। ”
” আচ্ছা বুঝলাম। ”
” তোমার একটা কথা রাখা হয়নি। ”
” কি কথা রাখা হয়নি?”
” চৈতী ভাবীর সাথে আবারও কথা বলে ফেলেছি। বাজারে দেখা হলো। উনি নিজে থেকে এগিয়ে এসে কথা বললেন, একসাথে বাড়ি ফিরতেও বলেছিলেন। আমি রাজি হইনি। ”
বাজারে ওকে দেখে ফেলেছি একথা ওর জানার বিষয় নয়। আমার দিকে খেয়াল করেনি। তাহলে কি আমি ভুল ভাবছি? না কি সোহাগ অভিনয় করছে? আবারও দুই রাস্তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না। চৈতীর ব্যাপারটা লুকালে অন্য বিষয় হতো কিন্তু এখন কি বুঝবো?
” কি চিন্তা করছো? ”
” কই কিছু না তো। ”
পরিবেশ স্বাভাবিক করতে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। এই মুহূর্তে কিছু বলা উচিত হবে না। বিষয়টা নিয়ে আর একটু দেখা প্রয়োজন। মিথ্যা অপবাদ হলে সোহাগের আমার উপর দিয়ে বিশ্বাস উঠে যাবে। সুন্দর সংসার নিজের হাতে নষ্ট করে ফেলবো। এমনটা হতে দেওয়া উচিত কাজ নয়। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই, সূর্যের তাপে শরীর ঘামছে। রিকশাওয়ালা বারবার কপালের ঘাম মুছচ্ছে। তীব্র গরমে উনার খুব কষ্ট হচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটার কথা মনে পড়লো। কাছে ছাতা নেই, থাকলে আজ আমিও অমন কিছু করে বসতাম। ভালো কিছু দেখে বাহবা দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়া হয় না। একটু সামনে একটা গলি আছে, ওই পথ দিয়ে ঘুরে বাসায় যাওয়া যায়। সময় বেশি লাগলেও রাস্তার দু’পাশে বড় বড় গাছ, পাতার ছায়ায় শীতল পরিবেশ তৈরি হয়।
” মামা সামনের গলিপথ দিয়ে ঘুরে চলেন, ওদিকে রোদ কম। গাছের ছায়া আছে। ”
” আম্মা ওই পথে বেশি ঘুল্লি পড়ে, দেরি হয়ে যাবে। ”
” সমস্যা নেই, আপনাকে ভাড়া বাড়িয়ে দেবো। ”
” আইচ্ছা। তাহলে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছি। কথা কি আম্মা আমরা গাছের ছায়া পছন্দ করি কিন্তু গাছ লাগতে চাই না৷ ”
সোহাগ উনার কথায় তাল মেলালো। এই প্রসঙ্গে নানান কথা বলবে এখন। আমি চুপচাপ শুনতে লাগলাম। লোকটা খুব কাজের কথা বলেছে, রাস্তার পাশে গাছ লাগাতে বেশিরভাগ লোকের অনিহা। নিজেদের মালিকানা থাকে না, প্রয়োজন হলেই হুটহাট গাছ কাটা যায় না। ওটা তখন রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। বিনা অনুমতিতে গাছে কাটলে জে’ল জরিমানাও হতে পারে। তাই সব গাছ লাগানো অহেতুক ঝামেলা মনে করে, কিন্তু হাঁটার সময় বেছে বেছে গাছের ছায়ায় হাঁটবে।
এ গলিতে রোদের তীব্রতা নেই বললেই চলে, চারদিকে গাছের ছায়া। কখনো কখনো পাতার ফাঁক দিয়ে রোদের গুঁড়ো রাস্তায় পড়ে আছে। পিচঢালা নীলচে-কালো রাস্তায় সোনালি রোদ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সোহাগ আমার হাত আঁকড়ে ধরে রিকশাওয়ালা সাথে গল্প করছে। মাঝেমধ্যে আমিও ওদের কথায় তাল মেলাতে লাগলাম।
বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়ে গেল। দুপুরের রান্না করতে দেরি হয়ে যাবে, এদিকে ননদীও চলে আসবে। সময় এতো হিসাব করা কেন? একদিকে বেশি সময় দিলে অন্যদিকে কম পড়ে যায়। সোহাগ দু’শ টাকার কচকচে একটা নোট রিকশাওয়ালার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এসেছে। লোকটার চোখে মুখে খুশির ছাপ, আজ হয়তো একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে পারবে। পরিবারের সময় দিতে পারবে, পরিবারকে সময় দেওয়া খিব জরুরি একটা বিষয়। অনেকেই এর গুরুত্ব বুঝতে পারে না।
ঘরে ঢুকে মিনিট পাঁচেক বিশ্রাম নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। সোহাগ গোশত নিয়ে এসেছে, আবার চিংড়ি মাছ কাটতে হবে। কোনটা আগে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। আগে পেঁয়াজ রসুন বেটে, সবকিছু গুছিয়ে নেবো। তারপর রান্না শুরু করবো।
” দেখি দেখি, আমার কাছে দেও। আজকের গোশতটুকু আমি রান্না করবো। ”
সোহাগ রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো বললো। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে রান্নার জিনিস খোঁজ করতে লাগলো।
” কি হলো? কোথায় কি রেখেছে? হাতের কাছে এগিয়ে না দিলে আমি কি সব খুঁজে পাই নাকি?”
” আমাকে সবকিছু খুঁজে দিতে হলে তুমি কি খুন্তি নাড়াবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? ”
” ওই আর কি! রান্নার অজুহাতে বউকে দেখবো। ”
” নিজের বউকে দেখতে অযুহাত লাগে নাকি? জানতাম না তো। ”
” তা লাগে না। তবে এভাবে দেখায় অন্য সুখ। ”
মুচকি হেসে কাজে মন দিলাম। বকবক করে সময় নষ্ট করলে কাজ হবে না। পেঁয়াজ কাটার সময় চোখ দিয়ে চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। এটা নতুন কিছু নয়। সকল গৃহিনীর কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার, আমার কাছেও তাই।
সোহাগ এগিয়ে এসে ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিলো। আদুরে গলায় বললো, ” এতো কাঁদলে হবে? ”
বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, এই নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করার কি প্রয়োজন। চোখে মুখে বিরক্তর ছাপ স্পষ্ট হলেও মনে মনে খুব খুশি হয়েছি। এই অতিরিক্ত ন্যাকামির ব্যাপারগুলো নিমেষেই মন ভালো করে দিতে পারে। সোহাগ আমার বেশ কাছে। কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম দরজায় চৈতী দাঁড়িয়ে। গোমড়া মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, সোহাগের ঠোঁটে লেগে থাকা হাসির রেখা মুছে গেছে। কি করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। চৈতী মলিন গলায় বললো, ” ভুল সময়ে এসে পড়েছি। আসলে দরজা খোলা ছিল তাই। সরি। ” কথাগুলো বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই দরজা দিয়ে সরে গেল।
সোহাগ আমাকে উদ্দেশ্য করে কড়া গলায় বললো, ‘ দরজা লাগতে মনে থাকে না তোমার? ”
চলবে
#কুয়াশার_মতো
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৩
বিষয়টা তুমিও খেয়াল রাখতে পারতে। তাছাড়া এখানে তেমন কিছুই হয়নি। ”
” আচ্ছা দুঃখিত। ”
সোহাগ নিজের মতো রান্না করতে লাগলো, মুখ দেখে মনে হচ্ছে রান্না করতে এসে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে। অতিভক্তি চো’রের লক্ষণ! সোহাগের ব্যবহার স্বাভাবিক নয়, যেন দু’দিকে ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। সোহিনী আসা পর্যন্ত দু’জনের ভিতর তেমন কথা হলো না। নিজে থেকে বাড়তি কিছু বলতে যাইনি৷ সোহিনী আসতে আসতে বেলা তিনটে, সবে গোসল সেরে ফ্যানের নিচে বসেছি। কোমর সমান চুল শুকাতে বেশ সময় লাগে। সোহাগ দরজা খুলে দিয়েছে, সোহিনী দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আদুরে গলায় বললো, ” কি খবর রূপবতী? কেমন আছো?”
” এইতো আলহামদুলিল্লাহ, তুমি কেমন আছো? ”
” আছি ভালোই, তবে ক্ষুধা লেগেছে। হাত-মুখ ধুয়ে আসছি। ”
সোহিনী আমার পাশে বসে নিজের মতো খাবার খাচ্ছে। কয়েক মিনিট পর পর রান্নার প্রশংসায় দুই-চারটে শব্দ বলছে। সোহাগ আমাদের মুখোমুখি বসে নিজের মতো খাবার খাচ্ছে।
” সোহিনী মা-বাবা কেমন আছে? জানিয়ে এসেছিস?”
” আছে ভালোই। হ্যাঁ বলে এসেছি। দাদি শুনে বললো ওই বাসায় কেন যাবি!”
” তুই কি বলেছিস?”
” বলেছি ভাবীর হাতের চিংড়ি মাছ রান্না খেতে যাব। ”
” তারপর?”
” উফফ! ভাইয়া একটু শান্তিতে খেতে দাও। পরে তোমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। ”
সোহাগ কপাল কুঁচকে সোহিনীর দিকে তাকিয়ে রইলো। সোহিনীর অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই।
।
দুপুরের খাওয়া শেষে ননদ-ভাবী গল্প করতে বসেছি। সোহাগ বাইরে কোথাও গেছে।
” এই যে রূপবতী কন্যা, কতদিন পর এলাম কিন্তু তুমি তো কথাই বলছো না।”
” একটা ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে। ”
” তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে চিন্তায় আছো, কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি?”
” আসলে..”
” কি?”
” আসলে তোমাকে বিয়ে দিতে হবে, ব্যাপারটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। ”
সোহিনী জোরে জোরে হাসতে লাগলো। আপাতত কাউকে কিছু বলা ঠিক হবে না, সবুরে মেওয়াও ফলে।
” ননদী তুমি একটু বসো, আমি একটা কাজ সেরে আসছি। ”
” তাড়াতাড়ি আসবে, ততক্ষণে তোমার গল্পের বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। ”
মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, ছাঁদে যাব। সোহাগ কোথায় জানতে হবে। এক পা দুপা করে ছাঁদের দিকে এগোতে লাগলাম। একটাই প্রার্থনা আমার চিন্তা যেন ভুল হয়।
ছাঁদের দরজা খুলে দেখলাম সোহাগ চৈতীর সাথে গল্প করছে।
মুচকি হেসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে, এখন থেকে কোন দ্বিধা দন্দ রইলো না। ওঁদের ভিতর কোন না কোন সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে।
।
।
সকাল আটটা। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি। সোহিনী মেয়েটা বড্ড অস্থির প্রকৃতির, কাল রাতেই বাড়ি ফিরে গেছে। বালিশের পাশে হাত দিয়ে মোবাইল খুঁজতে লাগলাম, রাতে তো এখানেই রেখেছিলাম। বিছানা ছেড়ে উঠবো এমন সময় সোহাগ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
” স’র্ব’না’শ হয়ে গেছে পিয়াসী। ”
” কি হয়েছে? ”
” চৈতীকে কেউ বাজেভাবে খু’ন করেছে। সারা ঘরে জিনিসপত্র ছড়িয়ে আছে। ”
” চৈতী মা”রা গেছে এতে তোমার স’র্ব’না’শ হবে কেন? প্রেমিকাকে হারিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছো বুঝি?’
‘ এসব কি বলছো? চৈতী আমার প্রেমিকা হতে যাবে কেন?’
‘ কারণে অকারণে এতো গল্প করো তাই ভাবলাম। যাইহোক ফ্রেশ হতে হবে। তুমি কিছুক্ষণ হাহুতাশ করে নাও। শত হলেও তোমার জীবনে একজন বিশেষ ব্যক্তি ছিলো ।”
সোহাগ হতভম্ব হয়ে আমাী দিকে তাকিয়ে রইলো, ওর দৃষ্টিকে গুরুত্ব না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। গতকাল সন্ধ্যের দিকে সোহাগ বাড়ি ছিল না, সোহিনীকে এগিয়ে দিতে বাসস্ট্যান্ডে গেছে। মেয়েটার কখন কেমন ইচ্ছে হয় বোঝা মুশকিল, সারা বিকেল থাকবো থাকবো বলে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফেরার বায়না। একা একা টিভি দেখছি, কিছু ভালো লাগছে না। দরজার কড়া নড়ছে, মনে হয় কেউ এসেছে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে দরজা খুলে দেখলাম চৈতী দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মাঝামাঝি সাইজের গামলা।
” কিছু বলবেন?”
” না, তেমন কিছু না। শুনলাম আপনার নন এসেছে তাই উনাকে দেখতে এলাম। ”
” আচ্ছা ভেতরে আসেন। ননদ এসেছিল কিন্তু কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। ”
” ওহ্! তাহলে আর কি হলো। উনার জন্য চিংড়ি মাছ রান্না করে নিয়ে এসেছিলাম। আপনারাই রেখে দেন। ”
” আমাদের নিয়ে আপনার এতো চিন্তা? বাবা গো বাবা! ”
” এভাবে কথা বলছেন কেন?”
” বরের প্রেমিকার সাথে কিভাবে কথা বলবো আপনি শিখিয়ে দেন তাহলে। ”
” পিয়াসী তুমি ভুল বুচ্ছো, আমাদের ভিতর কোন সম্পর্ক নেই। ”
“আমি চোখ থাকতেও অন্ধ ব্যক্তি নই, যে আপনি যা বলবেন বিশ্বাস করে নিবো। ”
” বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার, সত্যিটা বললাম। ”
” কি সত্যি? ”
“সোহাগের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে নেই, আমাদের ভিতর শুধুমাত্র বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ”
” আমাকে জ্ঞান দিতে আসবেন না। ”
” আপাত দৃষ্টিতে দেখা সবকিছু সত্যি হয় না। ”
” আপনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ”
চৈতী কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওঁদের কাউকেই বিশ্বাস করতে চাই না। তবে চৈতীর মৃ”ত্যু কাম্য ছিল না। ফ্রেশ হয়ে খু’নের জায়গায় চলে গেলাম। লোকের ভিড়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর ব্যাপার। সকলে চৈতীর লা’শ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিষণ বাজেভাবে মেয়েটাকে খু’ন করা হয়েছে, হাত-পায়ে নখের দাগ স্পষ্ট। মৃ’ত্যুর আগে খুনির সাথে ঘস্তাঘস্তি হয়েছিল বোধ-হয়। পুলিশ আসতে ঢের দেরি, চারদিকে নানান আলোচনা সমালোচনা চলছে। লোকের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। ঘরে চলে এলাম। সোহাগ আমার পিছন পিছন এলো।
” পিয়াসী কি হয়েছে তোমার? ”
” সবকিছু কেমন খাপছাড়া লাগছে!”
” আচ্ছা, একটু শান্ত হয়ে বসো। র”ক্ত দেখতে না পারলে ওখানে যাওয়ার কি দরকার ছিল?”
” জানি না। ”
ছোটবেলা থেকে র’ক্ত দেখতে পারি না। হাঁস-মুরগি জ’বা’ই করতে গেলেও কেমন অদ্ভুত লাগে। মাথা ঝিমঝিম করে, হাত-পা কাঁপতে থাকে। ভিষণ বাজে একটা রোগ। এই রোগের কারণে বাবা ডাক্তারি পড়াতে সাহস করেনি। আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে পড়ার খরচ দিতে পারলেও আমার পক্ষে মেডিকেল পড়া সম্ভব ছিল না।
সোহাগ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। শান্ত ভঙ্গিতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ” তুমি একটু বিশ্রাম করো। ”
” তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না বলো?”
” আরে পা’গ’লী, কেউ মা’রা গেলে খারাপ লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বাস করো চৈতীর সাথে আমার কোনপ্রকার বাজে সম্পর্ক ছিল না। চৈতীর স্বামী আমার ছোট বেলার বন্ধু। ”
” আগে তো কখনো শুনিনি। ”
” আমি নিজেও জানতাম না, কয়েকদিন আগে শুনেছি। ”
” ওহ্!”
সকাল দশটা। রাস্তা পর্যন্ত মানুষের ভিড় লেগে আছে। পু’লি’শ এসেছে লা’শ নিয়ে যাওয়ার জন্য। চৈতীর বাড়ির লোকদের খবর দেওয়া হয়েছে, বাড়ি দূরে বিধায় উনারা এখনও পৌঁছায়নি। সোহাগ চৈতীর স্বামীকে সবকিছু জানিয়েছে। উনিও নাকি দেশে ফিরছেন।
” সোহাগ ভাই দারোগা সাহেব কথা বলবেন, বিল্ডিংয়ের সবাইকে ডাকছে। ”
গেটের দারোয়ান হারুন ভাই এসে আমাদের ডেকে নিয়ে গেল। ওসি সাহেব সবাইকে জিজ্ঞেসাবাদ করছে, চৈতীর বাড়ির লোকদের খুঁজছে।
” আপনিই মিস্টার সোহাগ? ”
” হ্যাঁ, আমি। ”
” আপনার সাথে উনার সম্পর্ক কেমন ছিল?”
” বন্ধুত্বপূর্ণ, চৈতীর স্বামী আমার ছোটবেলার বন্ধু। ”
” শুনলাম আপনারা পরকীয়ায় জড়িয়ে ছিলেন। কথাটা কি সত্যি? ”
” না সত্যি না। ”
” কিছু মনে করবেন না সোহাগ সাহেব, তদন্তের খাতিরে অনেকেই এমন বিব্রতকর প্রশ্ন করতে হয়। তাছাড়া সকলের মতো উনার সাথে আপনার ঘনিষ্ঠতা ছিল। মাঝেমধ্যে আপনাদের একসাথে দেখা যেত। ”
” সমস্যা নেই, আপনি তদন্ত করতে পারেন। আমি নির্দোষ হলে নিশ্চয়ই সমস্যায় পড়বো না। ”
” আইনের উপর বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ। আপনাকে একটু আমাদের সাথে যেতে হবে। যেহেতু আপনি উনার পূর্বপরিচিত, উনার স্বামীকেও চেনেন। ”
” আচ্ছা। ”
পু’লি’শ চৈতীর লা’শ নিয়ে চলে গেল। সোহাগসহ বিল্ডিংয়ের দু’জন লোককে সাথে নিয়ে গেছে, কহসব জিজ্ঞেসাবাদ করবে। চৈতীর বাড়ির লোক আসলে থা’নায় যোগাযোগ করতে করতে বলেছে। পো’স্ট’ম’র্টে’মের পর লা’শ দা’ফ’ন করতে পারবে।
চেয়ারে হেলান দিয়ে আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছি। চৈতী মা’রা যাওয়ার সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। এ বাড়িতে চৈতী একা থাকতো। যতদূর শুনেছি ওর স্বামী বিদেশে থাকে, বছরের মাথায় বেড়াতে আসে। কিন্তু আমরা এখানে আসার পর একবারও ওর স্বামীকে আসতে দেখিনি। পরিবারের লোকজনেরও তেমন যাতায়াত নেই। সকলে নাকি অনেক দূরে দূরে থাকে। চৈতী অবশ্য মাসখানেকের মাথায় বাপের বাড়ি বেড়াতে যেত। গ্রাম থেকে নানান শাকসবজি ফলমূল নিয়ে আসতো। বিল্ডিংয়ের অনেকেই সেগুলোর কিছু অংশ হাদিয়া দিত।
মেয়েটার সাথে বিল্ডিংয়ের কারো অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা নেই। শুধুমাত্র আমাদের বাসায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো। কিছুদিন ধরে সোহাগের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমি নিজেই ওর বড় শ’ত্রু। তবে আমার পক্ষে মানুষ হ”ত্যার মতো এতো জ’ঘ’ন্য কাজ করা সম্ভব নয়। তবে কি সোহাগ খু’ন করেছে? এমনও তো হতে পারে সোহাগ চৈতীকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছিল, শেষ মুহূর্তে চৈতী ওর স্বামীকে ঠকাতে চায়নি। সে-ই রাগ থেকে চৈতীর খু’ন।
নানান চিন্তার মাথা ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে। পুলিশ যদি সোহাগকে সন্দেহ করে অথবা আমাকে? তখন কি হবে! চৌদ্দশিকের আড়ালে জীবন কাটতে হবে না তো? এসব ভাবতে পারছি না, সোহাগ ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কোথাও অনেক বড় রহস্য লুকিয়ে আছে।
চলবে