কুয়াশার মতো পর্ব -০৪

#কুয়াশার_মতো
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৪

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো সোহাগ এখনও ফেরেনি। চৈতীর বাপেরবাড়ির, শশুরবাড়ির লোকজন এসেছে। কত আত্মীয় মেয়েটার, কত আপনজন! পনেরো- বিশজনের মতো এসেছে। ক্ষ’ত-বি’ক্ষ’ত লা’শের জন্য অপেক্ষা করছে অথচ বেঁচে থাকতে একবার দেখে আসেনি। দৃষ্টি শূন্য চোখের দিকে তাকিয়ে কি লাভ ! দুপুরের পর লোকজনের ভিড় কমতে শুরু করেছে। বয়স্ক মহিলা মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছে, কয়েক মিনিট পর পর বিলাপ করছে। কেউ কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে, কেউ বা দৃষ্টি উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে।

সোহাগ ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে গেল। রাতের আঁধার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।

” পিয়াসী, সকলের ধারণা আমি চৈতীর সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলাম। খু’নের সাথেও জড়িত। বিল্ডিংয়ের বেশ কয়েকজন লোক এমন জবানবন্দি দিয়েছে। শেষবার চৈতীকে আমাদের বাসা থেকে বের হতে দেখা গেছিল। ”

” দিনের পর দিন ছাঁদের কোণে বসে গল্প করতে দেখলে এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া চৈতীর স্বামী দূরে থাকে, এমনটা মনে হওয়া খুব বেশি অস্বাভাবিক কিছু নয়। ”

” তোমারও কি তাই মনে হয়?”

” আমার মনে হওয়া না হওয়ায় তোমার সমস্যা মিটবে না। ”

” তবুও জানতে ইচ্ছে করছে। বিশ্বাস করো আমাকে?’

‘ বিশ্বাস – অবিশ্বাস মুদ্রায় এ পিঠ -ওপিঠের মতে। কখন বদলে যায় বোঝা কষ্টকর বিষয়। ”

‘ অযথা তর্ক করার ইচ্ছে নেই। পারলে এক কাপ কফি বানিয়ে দাও। সকাল থেকে না খেয়ে আছি। ”

‘ সারাদিন কিচ্ছু খাওয়া হয়নি তোমার? ‘

‘ নিজের মামার বাড়িতে গেছিলাম নাকি! ‘

সোহাগের মন মেজাজ ভালো নেই। বাড়তি তর্ক করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সারাদিন না খেয়ে থাকার কারণে মেজাজ বিগড়ে আছে। তারপর বাড়তি ঝামেলা। অপরাধী কখনো চাইবে না তাঁকে কেউ সন্দেহ করুক।

সোহাগ গম্ভীর হয়ে সোফায় বসে আছে। ধীর-স্থিরভাবে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে, মাঝেমধ্যে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে।

” পিয়াসী। ”

” হ্যাঁ, বলো। ”

” এই খু’নের সাথে তুমি জড়িয়ে নেই তো?”

” তোমার আমাকে স”ন্দে’হ হচ্ছে কেন?”

” নারী শখের পুরুষের পাশে কাউকে সহ্য করতে পারে না। চৈতীর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা তোমার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ”

” বিরূপ প্রভাব পড়েনি। আমি খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ছিলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই জানতে পারতে। ”

” যেমন?”

” তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যেতাম। যাইহোক সেসব কথা বাদ দাও। চৈতীর লা’শ ফেরত পাবে কখন?”

” পো”স্ট”ম”র্টে”ম শেষে। কাল বিকেলে সম্ভবত। লা”শ কা’টার লোক পাওয়া যাচ্ছে না, যে ব্যক্তি লা’শ কা’ট’তো সে ছুটিতে। আজ ফিরবে না। ”

” চৈতীর বাড়ির লোকের সাথে কথা হয়েছে? কিম্বা ওর স্বামীর সাথে? ”

” রাতুলের সাথে কথা হয়নি, কে এসেছে ওর বাড়ি থেকে?”

” সঠিক বলতে পারছি না, কারো সাথে কথা হয়নি। তবে অনেকেই এসেছে। ”

” একটু খোঁজ-খবর রাখতে পারতে, কি খাচ্ছে না খাচ্ছে।”

” বেঁচে থাকতে যাঁরা খোঁজ নিতে সময় পায় না, ম”র”লে তাঁদের কান্না মানায় না। ”

” সবকিছু এতো কঠিন করে দেখার কিছু নেই। সমস্যা থাকতেই পারে। ”

” না সমস্যা থাকতে পারে না। ”

” তুমি নিজের মা-বাবার সঙ্গে বছর দুই হলো যোগাযোগ বন্ধ রেখেছ। পারলে এখন সবকিছু মিটিয়ে নাও। আমিও কাল মা’য়ের কাছে যাচ্ছি। ”

প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না। বিয়ের পর কখনো মা-বাবার সাথে কথা হয়নি, তাঁদের খোঁজ খবরও বিশেষ জানা নেই৷ পৃথিবীতে মা-বাবার চেয়ে আপন কেউ নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম সকালেই বাবা-মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে আসবো। তাঁদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন কাজ করার বড্ড কষ্ট পেয়েছে।

রাতে সোহাগের সাথে তেমন কথা হয়নি। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল, ওর নাকি ঘুম আসছে। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ফেসবুক চালাচ্ছি। ঘড়িতে রাত নয়টা, এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাতে ইচ্ছে করে না৷ কিছু সময় ফেসবুক চালালে মন্দ হয় না, অনেক কিছু জানা যায়। কত মানুষ কত রকমের পোস্ট করে, নিজেদের সমস্যা কথা লেখে, আনন্দের মুহূর্ত শেয়ার করে।
নিউজফিডে ঘুরতে ঘুরতে একটা গল্প সামনে এলো। ‘তৃণভূমি’ নামে, অনেক লেখক-লেখিকারা ফেসবুকে গল্প আপলোড করে। তৃণভূমি গল্পের কাহিনীর সাথে আমার জীবনের খানিকটা মিল আছে। আশা করি শেষটাও যেন গল্পের মতো সুন্দর হয়।

সকাল নয়টা। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প পড়েছি। দেরি করে ঘুমানোর কারণে সকালবেলা উঠতে পারিনি। সোহাগ বাড়িতে নেই, সারা বাসা খুঁজে কোথাও তার দেখা মিললো না। হয়তো কাজে বেরিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে তো আমায় ডাকতে পারতো।

” পিয়াসী এসো, নাস্তা করি।’

” মাত্র ঘুম দিয়ে উঠলাম। কিছুই রান্না হয়নি। ”

” বাইরে থেকে কিনে এনেছি, তোমাকে ঘুমতে দেখে বিরক্ত করতে ইচ্ছে করছিল না। ”

” ওদিকে খবর জানো কিছু? ”

” আপাতত বিশেষ কোন খবর নেই, লা’শ আসবে বিকেলে। ওসি সাহেব কল দিয়েছিল, পো’স্ট’ম’র্টে’ম রিপোর্ট না এলে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। ”

” তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ”

সোহাগ খাবার সাজিয়ে বসে আছে, পিয়াসী বাথরুমে। ছেলেটা একমনে কিছু একটা চিন্তা করছে। চৈতীর সাথে কাটানো সময়ের স্মৃতিও মনে করতে পারে। হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের কথা খুব বেশি মনে পড়ে।

” এসে গেছি, খাওয়া শুরু করো। ”

” তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। ”

সোহাগের ভাব-লক্ষণ বুঝতে পারছি না। কি করতে চাইছে কে জানে! খাওয়ার সময় কথাও বলছে না, চুপচাপ খাচ্ছে।

” সোহাগ আমি একটু বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চাই। উনাদের দেখতে ইচ্ছে করছে। ”

” ইচ্ছে হলে যাবে। উনাদের বাড়ি তো খুব বেশি দূরে নয়। তবে বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবে। বিল্ডিংয়ের অন্যকেউ ব্যাপারটা স’ন্দেহের চোখে দেখতে পারে। এমনিতে সকলের আমায় নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে। ”

” অ”প”রা”ধ না করলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ”

” আজ-কাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তি ফেঁ”সে যায়। তাছাড়া অপরাধ প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত আমিই সকলের চোখে অপরাধী। ”

” আমি কাউকে তেমন কিছু বলতে শুনিনি। তুমি একটু বাড়িয়ে বলছো। ”

” আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। চোখ কান খোলা রাখলে তুমিও দেখতে পেতে। ”

” কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করি? কাজ না থাকলে আমাকে একটু এগিয়ে দিতে পারবে?”

” সময় নেই, থা’নায় যেতে হবে। ওসি সাহেব কল দিয়েছিল। তুমি বরং একাই চলে যাও”

” আচ্ছা ঠিক আছে। আমার চাবিটা নিয়ে যাচ্ছি, কোথাও গেলে দরজা লাগিয়ে দিও। ”

সোহাগ কিছু বললো না। রাস্তায় একটা রিকশাও নেই। আজ আকাশে সূয্যিমামার আধিপত্য নেই। মেঘের আড়ালে ঢেকে গেছে, হয়তো বৃষ্টি নামবে। রিকশার অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করলাম।

” আপা কই যাইবেন? ”

” এইতো সামনের বাসস্ট্যান্ডে। ”

” রিকশায় যাবেন?’

” হ্যাঁ। ভাড়া কত টাকা?”

” দিয়েন আপনি। ”

‘ ভাড়া ঠিক করে নেওয়া ভালো। ”

“যা ভাড়া তাই দিয়েন। ”

রিকশায় উঠে বসলাম। ভাগ্যিস রিকশাওয়ালা পিছন দিয়ে ডাকলো। চৈতীর খু’নের ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক। যদি সোহাগ চৈতী অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে থাকতো তাহলে আমার খু”ন হওয়া উচিত। ওঁরা আমাকে নিজেদের মাঝখান থেকে সরাতে চাইবে। কিন্তু চৈতীর মা”রা যাওয়া সবকিছু পাল্টে দিলো। চৈতীর স্বামী কিছু করেনি তো, এই খু’নে তারও হাত থাকতে পারে। কিন্তু লোকটা দেশের বাইরে, সে কি করে একাজ করবে? হয়তো কোন কারণ ছিল। তাছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে হ”ত্যা করছে কিনা কে বলতে পারে। আজ-কাল মানুষ টাকার জন্য সবকিছু করতে পারে।

এতো সময়ে খেয়াল হলো আমি ভুল রাস্তায় যাচ্ছি। বাসস্ট্যান্ডের রাস্তা এদিকে না। চারদিক কেমন শুনশান নীরবতা। খোলা মাঠের পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। এতো সময় কেন খেয়াল করলাম না! কবিদের মতো চোখ বন্ধ করে ভাবতে গিয়ে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।

” এ কোন পথে যাচ্ছেন আপনি? এইটা তো বাসস্ট্যান্ডের রাস্তা না। ”

” এ পথ দিয়ে গেলে শর্টকাট হয়। আপা মনে হয় অনেকদিন যাওয়া-আসা করেন না। ”

” হ্যাঁ, তা হবে হয়তো। ”

রিকশাওয়ালার উপর বিশ্বাস করতে চাইলাম। এই মুহুর্তে উত্তেজিত হওয়া চলবে না। তাছাড়া কেউ আমার ক্ষতি করতে চাইবে কেন? আমি তো কারো সাথে অন্যায় করিনি। তবুও মন কু ডাকছে।

” আপা পানি খাবেন? ”

” না, পিপাসা লাগেনি। আপনি তাড়াতাড়ি চলেন। বিকেলের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। ”

” আপনার মনে হয় একটু বেশিই তাড়া। যাইহোক পানিটুকু খেয়ে নিতে পারতেন। না জানি এখন কত সময় ধরে পানির অভাবে ভুগবেন। ”

” কি বলতে চাইছেন আপনি?”

রিকশাওয়ালা পিছন ফিরে বি”শ্রিভাবে হাসলো। কয়েক মুহূর্তের ভিতর পাশের ঝোপঝাড় থেকে চারজন লোক বেরিয়ে এলো। সকলে ক্ষুদার্থ হা’য়ে’না’র মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে, কেমন বিপদে পড়লাম আমি। কে কি’ড’ন্যা’প করাতে পারে? নাকি মে”রে ফেলবে? আমার যাওয়ার ব্যাপারে শুধু সোহাগ জানতো। তাহলে কি ও এমন করলো?

না না সোহাগ এমন করতে যাবে কেন! ও তো চাইলেই ঘুমের ভিতর আমাকে মে’রে ফেলতে পারতো। কিন্তু তা না করে লোকজন দিয়ে এসব করাবে কেন?

” বেশি ঝুঁকি নিয়ে লাভ নাই, এই মাইয়া তিড়িংবিড়িং করতে পারতে। অজ্ঞান করে দিবি নাকি?”

” তোমরা আমার সাথে এমন করছো কেন? কে করতে বলেছে তোমাদের? ”

” তোর না’গ’র। হেই পোলা মা বাপের পছন্দ করা মাইয়া বিয়া করবো। তাই তোরে রাস্তা দিয়া সবারার কইছে। কেমন না’গ’রের লগে পিরিত করছ হ্যাঁ?”

সোহাগ বাবা-মায়ের পছন্দ করা মেয়ে বিয়ে করবে? তাহলে দু’বছর আগের সবকিছু আবেগ ছিল?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here