কুয়াশার মতো পর্ব -০৫

#কুয়াশার_মতো
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৫

ঝকঝকে সোনার গহনা সময়ে সাথে মলিন হয়ে যায়। তবু তার দাম কমে না, অযত্নে পড়ে থাকে না। সময়ের সাথে আমাদের সম্পর্কগুলো পুরনো হয়। কিছু সম্পর্ক সোনার মতো দামী, সেগুলো খুব যত্নে থাকে। আবার কতক সম্পর্ক সময়ের সাথে সাথে সস্তা হয়ে যায়।

সোহাগ বাবা-মায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় বিয়ে করেছিল। ভালোবাসা দিয়ে গড়া সম্পর্ক আজ মূল্যহীন। চৈতীর জায়গায় আমি থাকলে নেহাৎ মন্দ হতো না। এমন দিন দেখতে বেঁচে থাকার চেয়ে ম”রে যাওয়া ঢের ভালো।

” কি রে মাইয়া? না”গ”রের কথা শুনে অমন চুপসে গেলি কেন? ”

” আমাকে ছেড়ে দেবে? ”

” তোরে ছেড়ে দিলে আমাগো টাকা দিবে কে? তুই দিবি?”

” কত টাকা চাই তোমাদের?”

” পাঁচ লাখ। পারবি দিতে? তাহলে ছেড়ে দিমু। ”

” আমার কাছে এতো টাকা নেই। ”

লোকটা বোধহয় দলের সর্দার, সবাই ওস্তাদ বলে সম্মোধন করছে। ছিপছিপে গড়ন, শ্যামলা বর্ণের যুবক। বয়স বড়োজোর ৪৫ হবে। মুখে খোচাখোচা কাঁচা-পাকা দাড়ি, সব সময় চারদিকে নজর রাখছে। রিকশাওয়ালা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। লোকটা দৃষ্টিতে বাজে কিছুর ইঙ্গিত। চেয়ারের সাথে পিঠমোড়া করে আমার হাত বেঁধে রেখেছে। মুখে টেপ লাগানোর কথা ছিল কিন্তু সর্দার লোকটা নিষেধ করলো।

” কি রে মন্টু? মাইয়ার দিকে অমন কু’কু’রের লাহান চাইয়া আছিস কেন? জীবনে কি মাইয়া দেখিস নাই? ”

” ওস্তাদ বহু মাইয়া দেখছি, এমন মায়াবতী খুব কম নজরে পড়ছে। পোলাডা ভুল করতেছে, ওর উচিত আছিলো এই মাইয়াকে বিয়া করা। ”

‘ বেশি কথা বলবি না। আমাদের এতোকিছু চিন্তা করার দরকার নাই। টাকার বিনিময়ে কাম করি জ্ঞান দিতে লেগে চটবে। ”

‘ আচ্ছা, আর কমু না। ‘

‘ পোলা ডা এখনও খোঁজ নিচ্ছে না কেন? ওদের কারো লগে টাকার ব্যাপারে কথা হইছে নাকি?””

” কেমনে কমু কি করে। আমাগো লগে তো কথা হয়নি। ”

” দাঁড়া একটা কল লাগাই। বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। কেউ আইসা পড়লে বিপদে পড়বো।”

ওস্তাদ তড়িঘড়ি করে মোবাইল বের করলো, তারপর বাইরে চলে গেল। রিকশাওয়ালা আবারও আমার দিকে তাকিয়ে আছে, জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজচ্ছে। লোকটা যদিও রিকশাওয়ালা না, ভান ধরেছিল কিন্তু আপাতত নাম জানি না। বুঝতে পারলেই হলো।

আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে, চারদিকে অন্ধকারে ঢেকে গেছে। কি করবো বুঝতে পারছি না। পা’লা’নোর উপায় নেই, চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবে না। আশেপাশে লোকজন থাকলে ওরা মুখ খোলা রাখতো না। চৈতীর মৃ”ত্যু, সোহাগের বেইমানি সবকিছু অদ্ভুত রহস্যে ঘেরা। সোহাগ চৈতীর সাথে পরকীয়ায় জড়ালে ওকে কেন খু’ন করবে? এখন আবার নতুন কাউকে বিয়ে করছে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে, এখান থেকে বেরতে না পারলে কোন কিছুর সমাধান হবে না। যে করে হোক পালাতে হবে।

এমনও তো হতে পারে, চৈতীর সাথে সোহাগের সম্পর্ক ছিল। নতুন করে বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করবে বলে আমাদের দু’জনকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। চৈতীকে খু’ন করে আমাকে চৈতীর খু’নী হিসাবে প্রমাণ করবে। এমনভাবে গল্প সাজাবে যেন ওদের পরকীয়া সহ্য করতে না পেরে চৈতীকে হ’ত্যা করেছি। তারপর শাস্তি থেকে বাঁচতে পালিয়ে গিয়েছি।
এখানে বন্দী হয়ে থাকলে সোহাগ জিতে যাবে। যে-ভাবে হোক এখন থেকে পালাতে হবে।

” হ্যাঁ রে মন্টু, তুই কারে তুইলা আনছো?”

” কেন ওস্তাদ? তুমি যেমন বর্ণনা দিলে তেমনই। কালো বোরকা, হিজাব বাঁধা, একা একা হাঁটবে। বর্ণনা অনুযায়ী ধরে নিয়ে এসেছি। ”

” পোলা বেজায় খেপেছে। সে-ই মাইয়া নাকি তার বাড়ি গিয়ে বিশাল কান্ড করছে। ”

” আমাগো টাকা দিবে না?”

” রাখ তোর টাকা, গা’লা’গা’লি দিচ্ছে। বলছে আমাকে দেখে নিবে। ”

” ওস্তাদ এখন কি করমু?”

ওস্তাদ লোকটা কিছু না বলে কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লো। ওদের কথপোকথন শুনে মনে হচ্ছে ওরা ভুল লোককে ধরে নিয়ে এসেছে। অনেক্ক্ষণ বাদে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। সোহাগ এমন কিছু করেনি। তবুও সন্দেহ হচ্ছে, এটা তো নাটক সিনেমা না।

” ওস্তাদ কি করবা এখন? কাম-কাজ ফেলে বসে থাকলে তো না খেয়ে ম’র’তে হবে। ”

” ভাবতে দে, হাসপাতাল দিয়ে কল আসলো বলে। ”

বিমর্ষ গলায় দু’জনে কথা বলছে, অন্যজন গোমড়া মুখে বসে আছে। বাকি দু’জন ওদিকে পাহারায় আছে। আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ” তোমার কি কোন সমস্যা হয়েছে?”

” তোরে বলে কি হবে?”

” বলেই দেখো, হয়তো সাহায্যে করতে পারি। ”

” বললে বিশ্বাস করবি না, মনে হবে গল্প বানাচ্ছি। ফাও শুনে লাভ নেই। ”

” জীবন গল্পের থেকে অনেক বেশি ভ”য়ং’ক”র। বলো, বিশ্বাস করবো। ”

” আমার মাইয়া অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি, মেলা টাকা লাগবে। তাই এই কাম ধরছিলাম। কিন্তু লাভ হলো না। ”

” আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমাকে টাকা দেবো। ”

” সত্যি দিবি? এই মন্টু ওর বাঁধন খুলে দে। না তুই থাক আমিই দিচ্ছি। ”

হাত ব্যাথা হয়ে গেছে। এরা প্রফেশনাল লোক না। বিপদে পড়ে এই পথে নেমেছে। এদের দিয়ে সস্তায় কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। প্রফেশনাল লোকদের ডিমান্ড অনেক। এদের কথা বিশ্বাস হয়নি। কাজ হবে না জেনেও টোপ ফেলেছিলাম। কিন্তু ওরা ফাঁ”দে পড়েছে, তারমানে ওদের কথা সত্যি হলেও হতে পারে।

” ওস্তাদ আগে তোমার মেয়েকে দেখতে যাব, তারপর টাকা দেবো।”

লোকটার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। রাস্তার দু’পাশে খোলা মাঠ, অটোরিকশা নিয়ে তিনজন রওনা দিয়েছি। ওরা হাসপাতালের সামনে থামলো। ইশারায় নামতে বলছে।
সত্যি সত্যি একটা মেয়ে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে, পাশে মধ্যবয়সী মহিলা বসে আছে। চিন্তায় তাঁর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। আমাদের দেখে বলে উঠলো, ” টাকা আনতে পারছেন? ”

” না পারি নাই, রিকশাডা বেচে দিলাম তা-ও তো কিছু হলো না। ”

” আল্লাহ মোর মাইয়াডারে ভালো করে দেও। আপনি দেখেন কি করতে পারেন। বসে থাকলে কি হবে!’

” আচ্ছা দেখছি। ”

ওদের কথা বলার সুযোগ নিয়ে পাশ গলে বেরিয়ে আসলাম। তড়িঘড়ি করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম। বাড়ি ফিরতে হবে। রিকশা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
এতকিছু কাকতালীয় হতে পারে না, নিশ্চয়ই কেউ প্লান করে এমন করিয়েছে। সিনেমার গল্প বিশ্বাস করার বয়স বেশ আগে পার হয়ে গিয়েছে।

বাড়ির সামনে লোকজনের ভীড়। কোলাহলের ভিতর দিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। ভীড় কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। কম বয়সী এক যুবক সাদা কাপড়ে ঢাকা লা”শের উপর শুয়ে কাঁদছে। পাগলের মতো কিসব বলে চলেছে, সোহাগ পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো।

” কল ধরছিলে না কেন? রাতুল এসেছে। আসার পর থেকে এমন অবস্থা। ছেলেটা বোধহয় পা’গ’ল হয়ে যাবে। ”

” দা’ফ’ন হবে কখন? ‘

” এইতো এখন লা’শ নিয়ে যাবে। ”

” পুলিশ কিছু বলেছে? ”

” ওসি সাহেবের জরুরি কাজ পড়ে গেছে, রাতে আসবে। সবাইকে থাকতে বলেছে। ”

” আমি ফ্রেশ হবো, ঘরে যাচ্ছি। ”

সোহাগ ভালো মন্দ কিছু বললো না। ঘরে এসে লম্বা সময় ধরে গোসল করলাম। শরীরটা ভালো লাগছে না। নানান চিন্তায় মাথা ভারী হয়ে আসছে। কি”ড”ন্যা”প করা লোকদের কাছে মোবাইলটা রয়ে গেছে, ফেরত নেওয়া সময় পাইনি। ওদের কিছু না কিছু সাহায্য করা উচিত। যদিও ব্যাপারটা সাজানো মনে হচ্ছে। ফ্যানের নিচে বসে চুল শুকচ্ছি, সোহাগ ঘরে এসেছে।

” পিয়াসী দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করেছো?”

” না, তুমি খেয়েছো?”

” হ্যাঁ, বাইরে খেয়ে নিয়েছি। মা-বাবা কি বললো?”

” তেমন কিছু বলেনি, স্বাভাবিক আচরণ করছিলো। ”

” সোহিনী ঠিক বলেছিল, উনারা সবকিছু মেনে নিবেন। ”

” সোহিনী কখন কি বললো তোমাকে?”

” এই আইডিটা সোহিনীর দেওয়া ছিল। ও-ই তো বললো ভাবীকে উনার মা-বাবার কাছে গিয়ে মাফ চাইতে বল, তুইও একদিন বাড়িতে আয়। ”

” কখন বলেছে এসব? ‘

” এগিয়ে দিতে গেছিলাম তখনই কথা হয়েছিল। তোমাকে দেখে ক্লান্ত লাগছে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেও। আমি রাতুলের সাথে আছি। ”

” আমার কিছু জিনিস কেনার ছিল, একটু বের হবো। ”

” আচ্ছা। সন্ধ্যার আগে ফিরে আসবে। ”

” ঠিক আছে। ”

” টাকা লাগলে নিয়ে যেও। ”

” আচ্ছা। ”

সোহাগ বেরিয়ে গেল। আলমারিতে জমিয়ে রাখা বিশ হাজার টাকা, সোনার বালা জোড়া নিয়ে বেরিয়ে এলাম। হাসপাতালে গিয়ে যদি ওদের পাই তবে এসব দিয়ে আসবো। এছাড়া কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে হবে, মোবাইল ফেরত আনতে হবে। জানতে হবে কে ওদের কি’ড’ন্যা’প করার জন্য সুপারি দিয়েছিলো।

পুলিশ নিজের মতো তদন্ত করুক, আমিও জানার চেষ্টা করি। পিচঢালা পথে রিকশা চলছে, বাতাসের ঝাপটা চোখে মুখে লাগছে। দারুণ অনুভূতি। হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম ওস্তাদ লোকটা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে ছুটে এলো।

” ভেবেছিলাম আপনি আসবেন না। আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেননি। ”

” চলেন আপনার মেয়েকে দেখে আসি। ”

বাচ্চা মেয়েটা নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে, অথচ এই মেয়ের দুরন্তপনার সকলে অস্থির হয়ে যেত। লোকটার চোখে পানি টলমল করছে, দ্রুত হাসপাতালের পাট চুকিয়ে ফিরে এলাম। বালা জোড়া দাদির দেওয়া, কিন্তু ওই ছাড়া দেওয়ার মতো কিছু ছিল না। এমনিতে গহনা তেমন পরা হয় না। এতো উদারতা দেখানো উচিত হয়নি বোধহয়। তবে এখন আফসোস করে কি লাভ!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here