#কুসুমিত_কামিনী ( ২)
#রেহানা_পুতুল
কখন যাবে তোমাদের বাসায়? আমি এটা শুনতে চাই এখন?
কাঠ কাঠ গলায় জানতে চাইলো মাহতিম।
কখন গেলে আপনার সুবিধা হয় মিস্টার মাহতিম?
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। মাহতিম দরজা খুলে দিল। জান্নাতের প্রশ্নের জবাব দেওয়া হলনা তার।
মাহতিমের ছোট বোন নুপুর ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়া তোমাদের দুজনের নাস্তা। আম্মু পাঠিয়ে দিয়েছে।
টেবিলে কি প্রবলেম?
সবাইর খাওয়া শেষ। তোমরা দুজন এলেনা। তাই জননী নিয়ে আসতে হুকুম করল।
আচ্ছা। রাখ তাহলে।
নুপুর আপু আমাদের সাথে খাও নাস্তা।
নাগো কিউটি ভাবি। আমি খেয়েছি। আমাকে আপু বলতে হবেনা। আমি তোমার জুনিয়র হব মে বি। ভাইয়া তাইনা?
তা আমি কি জানি?
ওমা! এমন ত্যাড়া আনসার কেন? মনে হয় কেউ তোমাকে এখন ফাঁসীতে ঝুলাবে।
ঝুলাবে কি? ঝুলেইতো গেলাম। এখন বাঁচার চেষ্টা করছি।
ফাজলামো করছ। নাহ? নাস্তা খাও দুজনে সুন্দরভাবে। শাসনের সুরে বলেই চলে গেল মাহতিমের একমাত্র ছোট বোন নুপুর।
মাহতিম পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিচ্ছে কলিজা ভুনা দিয়ে। সাথে কচি শসা ও পেয়াজ খাচ্ছে কামড় দিয়ে। জান্নাত তাদের বাসায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাহতিমের আয়েসী ভঙ্গিতে খাওয়া দেখে তার ক্ষুধা কয়েকগুণে বেড়ে গিয়েছে। রাতেও খায়নি জান্নাত। এখন তবুও খেতে বসছেনা। বেহায়ার মতো কেউ না সাধলে খেতে বসা যায়না। জান্নাত আঁকুপাঁকু করছে খাওয়ার জন্য।
” ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় /পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। ”
সুকান্ত ভট্টাচার্যর অমর চরণদুটি এক ঝলকেই মনে পড়ে গেল তার। লজ্জায় খেতেও পারছেনা।
মাহতিম উঠে গেল নাস্তা খেয়ে। বেসিনে হাত ধুয়ে নিতে নিতে বলল,আমি খাওয়ার সময় সাধাসাধি করার মানুষ নই। যার যার ভাগের খাবার সে নিজ দায়িত্বে খাবে। নিজ অধিকারে খাবে।
ক্ষুধা নিবারণের উদ্দেশ্যে জান্নাত নাস্তা খেয়ে নিতে বাধ্য হলো। খেয়েই শশুর শাশুড়ির রুমে চলে গেল। মাহতিমের বাবা রবিউল খান পত্রিকার শিরোনামে চোখ বুলাচ্ছেন। পুত্রবধূকে দেখেই আন্তরিককন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
কিছু বলবে মা?
বাবা আমাদের বাসায় যেতে চাই।
এখন কিভাবে যাবে। বাসা ভরা মেহমান। কাল বিকেলে যেও মাহতিমসহ। এটাইতো সিস্টেম। নুপুর ও যাবে।
আচ্ছা বাবা। তাই হবে।
পাশ থেকে মেহনাজ আদেশ দিয়ে বললেন,
জামা চেঞ্জ করে শাড়ি পরে রেডি হয়ে নাও। নতুন বউকে শাড়িতেই বেশি মানানসই লাগে দেখতে।
আচ্ছা মা বলে নত মস্তকে রুম থেকে বেরিয়ে এলো জান্নাত। নুপুরকে দেখতে পেয়ে ডাক দিল জান্নাত।
কি ভাবি?
তোমার ভাইয়ার সমস্যাটা কি বলতো। উনার আচরণে মনে হচ্ছে এই বিয়েতে উনার মত ছিলনা?
ভাইয়াটা না। উফফস! বিড়বিড় করে বলল নুপুর।
বল নুপুর প্লিজ। সত্যিটা জানলে আমাদের দুজনের জন্যই সুবিধা হবে।
তুমি, তোমার পরিবার বা কাউকে বলবানাতো? প্রমিজ কর।
প্রমিজ বলবনা।
নুপুর জান্নাতের হাত ধরে বাসার পিছনের বারান্দায় নিয়ে গেল। এদিক এদিক অনুসন্ধিৎসু চোখে চাইলো। দেখল আশে পাশে কেউই নেই।
তবুও নারী জাতির সহজাত অভ্যাসমতে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল,
শোন ভাইয়ার জারা নামের একটি মেয়ের সাথে প্রেম ছিল। তারা সেইম এইজ ও ক্লাসমেট ছিল। মেয়েটা ছিল অতি আধুনিক। মর্ডান বলতে যা বোঝায়। ভাইয়া তাকে বিয়েও করতে চেয়েছে। কিন্তু তখন ভাইয়া বেকার ছিল। তাই মেয়েটাকে তার পরিবার অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেয়। ভাইয়া কিন্তু তাকে দুইবছর অপেক্ষা করতে বলেছে। সে চাইলেই অপেক্ষা করতে পারতো। কিন্তু সেও ছিল অর্থলোভী মেয়ে।
তারপর হতেই ভাইয়া মেয়েদেরকে কম বিশ্বাস করে। ছলনাময়ী ভাবে। ভাইয়া রাতদিন নেশার ঘোরে ডুবে থাকে। বিয়েও করতে চায়নি আর কোনদিন। আবার ভাইয়া তোমার মত বোরকা পরা, মুখ ঢাকা অর্থাৎ ধর্মীয় মাইন্ডের মেয়েদের একদম পছন্দ করেনা। গেঁয়ো, আনস্মার্ট ভাবে।
অপরদিকে আব্বু আম্মু চেয়েছে ঠিক তোমার মতই একটি মেয়ে। বস্রের আবরণে যে নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখবে। যার চলাফেরা হবে শালীন। মাধুর্যময়। তবে আকর্ষণীয়! যে কিনা ধীরে ধীরে স্বামীকে স্বাভাবিক জীবন যাপনে নিয়ে আসবে। সেই মেয়েকে ভুলিয়ে দিবে। এই হলো মূল বিষয়। কি পারবেনা তোমার ছন্নছাড়া স্বামীকে আদরে সোহাগে ডুবিয়ে রাখতে? মন্দ জিনিসগুলো থেকে ফিরিয়ে আনতে?
মন্দ জিনিস বলতে?
এই ধরো যেমন,মদ গেলা,একের পর এক সিগারেট ফুঁকা ইত্যাদি।
ইনশাআল্লাহ পারব। তোমাদের সবার সাপোর্ট পেলে। আমাদের সাপোর্ট তোমার সাথে প্রতিটিমুহুর্তেই থাকবে ভাবি।
আমিন।
এবার ক্লিয়ার হলেতো। যাও এবার। যুবক স্বামীকে যুবতী বধুর যৌবনতরঙ্গিত শয্যায় বিশ্রাম নিতে প্রশ্রয় আশ্রয় দাও।
তুমিও এনগেজড নাকি নুপুর?বিপন্ন মুখে হাসির প্রলেপ এঁকে জানতে চাইলো জান্নাত।
হঠাৎ? ভ্রঁকুচকে নেত্রপল্লব উল্টিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো জান্নাত।
তোমার কথা শুনলে যে কেউই এটা ধারণা করবে।
তোমার কথার ফুলচন্দন ফুটুক।
তারমানে তুমি একলা রমনী। সঙ্গী এখনো জোটেনি।
বলেই নুপুরের গাল টিপে দিল অষ্টাদশী নবোঢ়া বধু জান্নাত। রিনরিনিয়ে চাপা হাসির গুঞ্জন তুলে দুলে দুলে চলে গেল।
রুমে প্রবেশ করেই কাচের বড় গ্লাসটি ভরে পানি ঢেলে নিল ওয়াটার পট থেকে। গলা তুলে ঢকঢক করে খেয়ে নিল পুরো এক গ্লাস পানি। যেন বহুদিনের পিপাসিত চাতক পাখি।
সে অন্যদিকে দৃষ্টি রেখে মাহতিমকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
আমি এক্ষুনি চলে যেতে চেয়েছি। কিন্তু মা বাবা মানা করল যেতে। বলল কাল আপনি নাকি নিয়ে যাবেন আমাকে।
তুমিতো এটাই চেয়েছ। পাজীর পাজি কোথাকার।
আপনার যা ইচ্ছে বলতে পারেন। তাতে আমার কিছুই যায় আসেনা। আমি বড়দের মান্য করতে জানি। আপনার মতো অভদ্র নই আমি।
সো বিরক্তিকর! তোমার সাথে কথা বলার রুচিবোধ ও আমার নেই।
জান্নাত মাহতিমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে একটু বাজিয়ে দেখতে চায় জান্নাত। ভাইবোনের কথার মিল থাকে কিনা তা দেখা প্রয়োজন তারজন্য। ভারকন্ঠে জান্নাত জিজ্ঞেস করলো,
আপনার পরিবারের সবাই বলল আপনার মত নিয়েই এই বিয়ে হয়েছে। এটা সত্যি?
হুম সত্যিই।
আপনি নাকি বলছেন পাত্রী দেখতে হবেনা। আপনার পরিবার দেখলেই হবে?
হুম বলছি।
যদি তাই হয়। তাহলে বিয়ের রাত অর্থাৎ গতরাত থেকেই আপনি আমার সাথে এত জঘন্য আচরণ কেন করছেন? তা শুনতে চাই আমি।
বউ তুমি না হয়ে যে কেউ হলে কোন সমস্যাই ছিলনা। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কিড়মিড় করে উত্তর দিল মাহতিম।
অপমানে থমথমে হয়ে গেল জান্নাত। সারামুখ পাংশুটে আকার ধারণ করেছে।
দূর্বল স্বরে জিজ্ঞেস করলো, মানে?
মানেটা তুমি নিজেকে প্রশ্ন করেই জেনে নাও।
আমিতো জানিনা। বুঝতেছিওনা কিছুই।
আমি সময় হলেই বলব।
নাহ আমি এক্ষুনি শুনতে চাই। মজবুত কন্ঠে বলল জান্নাত।
আগে প্রতি সপ্তাহে কোথায় যেতে তুমি? বোরকার আড়ালে তোমার কুৎসিত রূপ আমার কাছে সেদিনই উন্মোচিত হয়েছে। যেদিন তোমাকে উদ্ধার করেছি বখাটে নামধারী দুটো ছেলের হাত থেকে। বিয়েরদিন কবুল বলার পরই দেখলাম রাস্তার সেই সস্তা তুমিই আমার স্ত্রী হয়ে গেলে।
বজ্রকন্ঠে কথাগুলো বলেই বারান্দায় চলে গেল মাহতিম। মাটির কসমস ফুলের টবটি হাতে নিল। উপরে তুলে সজোরে আছড়ে ফেলল নিচে।
উপস্থিত ঘটনার আকস্মিকতায় জান্নাত হতবাক। নির্বিকার! বাকরুদ্ধ! মাহতিমের বলা কথাগুলো বুলেট গতিতে তার মাথার উপর দিয়ে গেল। মগজে কিছুই গাঁথলনা।
মাহতিমের ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। কোন কৌতুহল ছাড়াই ফোনটি হাতে নিল জান্নাত। দেখল স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম। জারা। রিংটোন বাজতে বাজতে অফ হয়ে গেল। আলুলায়িত বেশে বারান্দায় গিয়ে মাহতিমের পিছনে দাঁড়াল জান্নাত।
চমৎকার! চমৎকার! বলে হাততালি দিয়ে উঠল জান্নাত। আপনার জুড়ি মেলা ভার। নিজের অপকর্ম ঢাকতে অন্যকে কিভাবে ঘায়েল করতে হয় তা আপনার থেকে শেখা যাবে।
কিহহ! বলে মাহতিম মাথা ঘুরিয়ে আগ্রাসী চোখে চাইলো জান্নাতের দিকে। জান্নাত মোবাইলটি মাহতিমের নাক বরাবর ধরল। মাহতিম দেখল জারা কল দিয়েছে। মনে মনে জারাকে বিশ্রী ভাষায় গালি দিল মাহতিম।
চিলের মত ছোঁ মেরে জান্নাতের হাত থেকে কেড়ে নিল নিজের মোবাইলটি। ঘৃনাভরা কন্ঠে বলল,
সো হোয়াট! তোর মত প’তি’তার চেয়ে জারা ঢের ভালো মেয়ে।
চলবে ঃ ২