কুসুমিত কামিনী পর্ব -০১

শেষরাতের দিকে ছাদ থেকে নেমে ঢুলু ঢুলু চোখে রুমে ঢুকল মাহতিম। বিছানায় তাকিয়েই চোখ কপালে তুলল। দেখল নাক অবধি ঘোমটা টেনে নববধুরূপে জান্নাত এখনো বসে আছে।

জান্নাত বিছানা থেকে নেমেই পা ছুঁয়ে সালাম দিতে গেল তাকে।মুহুর্তেই

ড্যামিট! এসব কি বলেই একটানে পা দুটো সরিয়ে নিল মাহতিম।

মেয়েটি মাহতিমের দিকে চেয়েই তব্দা খেল।
আরেহ ভাইয়া আপনি আমার বর? বিস্মিত চোখে জিজ্ঞেস করলো জান্নাত।

নো। আমি কারো বর নই। আনকালচার! ডিজগাস্টিং! তুমি আমাকে আগে থেকেই চিনতে নাকি?

আপনি আমাকে কয়েকমাস আগেই দুজন বখাটে ছেলেদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।

তাহলে আমি চিনলামনা কেন তোমাকে?

আমার তো বোরকা পরা ছিল। মুখ নেকাব দিয়ে ঢাকা ছিল।

একটু থেমে বলল মাহতিম। হুম মনে পড়েছে। এজন্যই বুঝি আমার গলায় ঝুলে পড়ে গেলে? যখন বুঝলে আমি ভালো ছেলে? কিঞ্চিৎ টলতে টলতে বলল মাহতিম।

আজব! আপনি এভাবে আচরণ করছেন কেন? মনে হচ্ছে আপনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই বিয়ে হয়েছে? আমিতো জানতামইনা কার সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে। এইমাত্র আপনাকে দেখলাম। আপনি যে কতটা ভালো তা এই বাসর রাতেই আমার বোঝা হয়ে গিয়েছে। বউকে সারারাত জাগিয়ে রেখে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছেন? আপনি একটা আস্ত খবিশ! টনটনে আদ্র কন্ঠে বলল জান্নাত।

হোয়াট! বলে মাহতিম জান্নাতকে হ্যাঁচকা টেনে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করাল। গলা টিপে ধরার চেষ্টা করল। বলল তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। আর একটি শব্দ উচ্চারণ করলে তোর কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলব আমি।

উহুম! আপনি ম’দ খেয়েছেন মনে হচ্ছে। মুখ থেকে সেটার কেমন গন্ধ পাচ্ছি। আপনিতো দেখি পুরাই নষ্ট। বাদ মা’ল বলা যায়। দাঁড়ান এক্ষুনি আপনার মাকে সব জানাচ্ছি। আমার সাথে দুই নাম্বারি করল।

জান্নাত পরনের মোটা শাড়িটির কুচি উঠিয়ে ধরল। দরজার দিকে পা রাখতেই মাহতিম জান্নাতের হাত টেনে ধরল। জান্নাত সজোরে কামড় বসিয়ে দিল মাহতিমের হাতের উপরে। মাহতিম ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল। রক্তবর্ণ চক্ষুদ্বয় আরো রক্তিম হয়ে উঠল। এবং হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো।

দরজার বাইরে গিয়ে একটু দাঁড়াল জান্নাত। চিন্তা করল এখন সবাই ঘুমিয়ে আছে। থাক সকাল হলেই বলব। নিরুপায় হয়ে রুমে প্রবেশ করলো জান্নাত। দেখল মাহতিম বিছানার মাঝ বরাবর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। অঘোরে নাক ডাকছে। ভ্রুকুটি করে সেদিকে একপলক চাইল জান্নাত। মনে মনে বলল এভাবে কেউ নাক ডাকে এই প্রথম দেখলাম। এটা নাক ডাকা না বাঁশ কাটা।

জান্নাত বিয়ের লাগেজটা খুলে একসেট জামাকাপড় হাতে নিল। দলা পাকিয়ে আসা নীল কষ্টগুলো গলা অবদি এসে আটকে আছে। ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে ঝর্ণা ছেড়ে দিল। যেন কান্নার আওয়াজ চারদেয়াল অতিক্রম করতে না পারে। ঝর্ণার অবিরাম ঝরে পড়া পানির সাথে তার অশ্রুকণাগুলোও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।

পরনের সবকিছু বদলে নিল জান্নাত। রুমে এসে মেঝেতে একপাশ করে বিছানা করে নিল। মনে মনে ছোটখালাকে আচ্ছামত ঝেড়ে নিল। এই বিয়ের প্রস্তাব তার খালাই এনেছে। এরপর তার মা সব খোঁজ খবর নিয়েই রাজী হলো বিয়েতে।

ছোটবেলায় খুব বিয়ে পাগলী ছিল জান্নাত। মাকে সারাক্ষণ বিয়ে দাও বিয়ে দাও বলে জ্বালিয়ে মারত। বড় হওয়ার পর চাইতো তার বিয়ে যেন হয় মধুমাসেই। ফলফলাদি তার ভীষণ প্রিয়। নানানরকম ফল খেতে খেতে বরের সাথে দুষ্টমিষ্ট সময় কাটাবে। তার এই অদ্ভুত ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটল। জৈষ্ঠ্যমাস মধুমাস। এ মধুমাসেই তার বিয়ে হলো ঠিকই। কিন্তু বাসরঘরই হলনা তার। ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত শরীরে রাজ্যের ঘুম নেমে এল জান্নাতের।

প্রভাতের স্নিগ্ধ হাওয়া বইতে লাগল চারদিকে। চড়ুই পাখির চঞ্চল কলরব শুরু হলো। জানালা গলিয়ে ভোরের আলো ঠিকরে এলো রুমের ভিতরে। তবুও তার ঘুম ভাঙ্গলনা। মেঝেতে দিঘলকালো চুলগুলো অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জান্নাত উঠে দরজা খুলে দিল।

গুড়মর্নিং সুইট ভাবি।

আপনাকেও গুড়মর্নিং বলে পিটপিট চোখে চেয়ে বলল জান্নাত।

আমাকে চিনতে পারনি এইতো? আমি তোমার খালাত ননদ লুবনা।
একটি টকটকে লাল গোলাপ এগিয়ে ধরে বলল লুবনা।

থ্যাংকস বলে আলতো হাতে গোলাপটি নিল জান্নাত।

আর আমি তোমার নিজের ননদ ঝুনঝুনি? হিঃহিঃহিঃ।
ধরো বলে সে কিছু কামিনী ফুল জান্নাতের হাতের তালুতে গুঁজে দিল।

মুহুর্তেই জান্নাতের মন অনেকখানি ফুরফুরে হয়ে গেল। কামিনী ফুল তার সবচেয়ে প্রিয় ফুল। এ ফুলের সৌরভে সে মাতোয়ারা হয়ে যায় সবসময়।

ঝুনঝুনি? স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করল জান্নাত।

আরেহ ঝুনঝুনি মানে নুপুর। বলেই কাঁচভাঙা হাসিতে লুটোপুটি খেল নুপুর ও লুবনা।

তোমরা ভিতরে আস। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?

ভিতরে যাওয়ার সময় ঢের পড়ে আছে। তোমার জামাইকে ডাক। আম্মু বলছে নাস্তা খেতে যাওয়ার জন্য। তাই তাড়া দিতে আসলাম।

যাব। আপনার আম্মুকে একটু ডেকে দিবেন। জরুরী দরকার ছিল একটু।

আম্মুতো কাজে ব্যস্ত। একটু লেট হবে।

আচ্ছা তখন আসলেও চলবে।

জান্নাত ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
এই..এই.. শুনছেন বলেও মাহতিমকে জাগাতে ব্যর্থ হলো। উপায়ন্তর না দেখে বেসিন থেকে পানি নিল। কয়েক ফোঁটা পানি মাহতিমের মুখের উপর ছিটিয়ে মারল খাটের সামনে দাঁড়িয়ে।

মাহতিমের ঘুম ছুটে গেল। দেখল সামনে দাঁড়িয়ে জান্নাত। তড়াক করে শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসল। আমার মুখে পানির ছিটা কে দিল?

ধমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো মাহতিম।

আমি দিয়েছি। আপনার মা আপনাকে জাগানোর দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে। হালকা ভয়ার্ত ও বিরক্তি স্বরে বলল জান্নাত।

মাহতিম ফণা তোলা সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে ওয়াশরুমে চলে গেল।

মাহতিমের মা মেহনাজ খান তাদের রুমের চাপানো দরজায় টোকা দিল। জান্নাত দরজা খুলেই শ্বাশুড়ির পা ছুঁয়ে বিনম্রভাবে সালাম দিল। তিনি ভিতরে গিয়ে চেয়ারে বসলেন।

কোন অসুবিধা হচ্ছে মা?

আন্টি আপনার ছেলে কি এই বিয়েতে অমত ছিল?

নাতো? কেন এটা বলছ? উদ্বিঘ্ন স্বরে বললেন মেহনাজ।

কিন্তু উনিতো আমার সাথে রাতে বাজে আচরণ করেছে। আমার গলা টিপে ধরেছে। রুমেও ছিলনা। আমি আলাদা ঘুমিয়েছি। বলল উনি আমার স্বামী নয়। সালাম ও নিলনা। আবার আমি নাকি ক্ষ্যাত।

আপনাকে আমি এসব বলতামনা। কিন্তু আপনিই বলেছেন যেকোন সমস্যা হলেই যেন আপনাকে বলি। দ্বিতীয় কাউকে নয়।

মেহনাজ খান অপ্রতিভ হয়ে গেলেন ছেলের সম্পর্কে এসব শুনে। স্নেহময় আদুরে কন্ঠে জান্নাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন খুউব ভালো করেছ আমার কাছে নালিশ করে। আমি দেখছি বিষয়টা। আর আন্টি নয় মা বলবে আজ থেকে আমাকে। কেমন?

আচ্ছা আন্টি। না। আচ্ছা শাশুড়ী মা। আগে যে আন্টি বলছি তাই ওটাই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসছে।

মাহতিম ওয়াশরুমের দরজা খুলেই মাকে দেখে বিব্রতকর হয়ে গেল।
কিরে মাহতিম কি শুনলাম এসব? রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।

মা এই বিচ্ছুকে কোথা হতে ধরে আনলে? মুখের লাগাম নেই বললেই চলে। যা মুখে আসে তাই পট করে বলে বসে। কার সাথে কিভাবে চলতে হয় কিছুই জানেনা। ও ওদের বাসায় চলে যাক। যেদিন থেকে আমার মতো করে চলতে পারবে। সেদিনই কেবল এই বাসায় তার পা রাখতে পারবে।

মাহতিম তোর বাবার কান অবধি এই বিষয়টা যাক। সেটা আমি চাইনা। তরল গলায় কথাটা বলেই রুম থেকে চলে গেলেন মেহনাজ খান।

জান্নাত নিবুনিবু সরল চাহনিতে মাহতিমের দিকে আড়চোখে তাকাল।

মাহতিম চোয়াল শক্ত করে কড়মড়িয়ে বলল,
তোমার অবস্থা আমি দফারফা করে ফেলব। বেয়াদব কোথাকার। স্বামী স্ত্রীর বিষয় যারা অন্যকে জানায়। তাদের মত গর্দভ আর বেকুব নিয়ে সংসার করা অসম্ভব। কুকুর কোথাকার! আমার হাত কামড়ে কি করেছ?এটা যদি মাকে দেখতাম?

কেউ মানা করেনি। গিয়ে প্রদশর্নী করে আসুন বাসার সব অতিথিকে।

কখন যাবে তোমাদের বাসায়?আমি এটা শুনতে চাই এখন?
কাঠ কাঠ গলায় জানতে চাইলো মাহতিম।

কখন গেলে আপনার সুবিধা হয় মিস্টার মাহতিম?

#কুসুমিত_কামিনী ( ১)
#রেহানা_পুতুল
(আসসালামু আলাইকুম। নতুন গল্প সম্পর্কে ভালোমন্দ মন্তব্য করে প্রেরণা দিবেন আশারাখি।❤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here