কৃষ্ণগোলাপ পর্ব -১৬

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

১৬.
‘আপনার সাহস কি করে হলো এত রাতে আমার রুমে আসার?’

রাফসান বিস্মিত কন্ঠে জবাব দিল,

‘কি বলছেন এইসব ঐচ্ছি? আমি এত রাতে আপনার রুমে কেন যাবো?’

ঐচ্ছি বরাবরের মতোই রাগ দেখিয়ে বললো,

‘হুম, সেটাই তো আমার প্রশ্ন। মিথ্যে বলবেন না রাফসান, অদৃশ্য হয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার ক্ষমতা আপনার আছে। আর আমি আপনার উপস্থিতি টের পেয়েছি, আপনার শরীরের ঘ্রাণ পেয়েছি আর.. আর আমার ঠোঁটে..’

এইটুকু বলেই থেমে যায় ঐচ্ছি। কন্ঠস্বর তার কেঁপে উঠে। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে সে। রাফসান ক্ষীণ সুরে বলে উঠল,

‘আর ঠোঁটে কি ঐচ্ছি?’

ঐচ্ছি গলা ঝেরে বললো,

‘কিছু না। আপনি সত্যি করে বলুন রাফসান, আপনি আমার রুমে এসেছেন কিনা?’

অধর ছড়িয়ে হাসে রাফসান। ডান দিকের গালটায় ছোট্ট একটা গর্ত হয়। রাফসান পরিষ্কার কন্ঠে বললো,

‘আমি সত্যিই বলছি, আমি আপনার রুমে যাইনি। বরং এতক্ষণ আমি ঘুমাচ্ছিলাম। আপনার ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙল। আমাকে আপনার বিশ্বাস না হলে কিছু করার নেই ঐচ্ছি। তবে এইটুকু বুঝতে পারছি আপনি আজকাল আমাকে একটু বেশিই মিস করছেন। তাই হয়তো এত রাতে ঘুমের মাঝেও আমাকে ফিল করছেন।’

ঐচ্ছি দমে গেল। নিজের এমন উদ্ভট সব কাজে রাফসানের কাছে বারবার তাকে অপ্রস্তুত হতে হয়। তারই ভুল। দুশ্চিন্তা করতে করতে মাথা ঠিক নেই। তাই এমন উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা মাথায় আসছে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিঁইয়ে যাওয়া গলায় ঐচ্ছি বললো,

‘আমি দুঃখিত রাফসান। হয়তো ঘুমের মাঝে কোনো স্বপ্ন দেখেছি, তাই এমন হয়েছে। আমার জন্য আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেছে। সরি তার জন্য।(একটু থেমে) আচ্ছা এখন তাহলে রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।’

রাফসান বাঁকা হাসল। তৃপ্তি ভরা নিশ্বাস ফেলে ঘোর লাগা কন্ঠে ডেকে উঠল,

‘ঐচ্ছি!’

‘জ্বি!’

রাফসান থামল। বুক ভার হচ্ছে জমানো ভালোবাসার উত্তেজনার চাপে। কন্ঠস্বর ধারাল। এক অন্যরকম ঘোর লেগে আছে সেই সুরে। ঐচ্ছিও নিশ্চুপ। কিছু বলছে না। হয়তো সেও অপেক্ষা করছে কিছু শোনার। রাফসান উন্মুক্ত আকাশের পানে তাকাল। মৃদু হাসল। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে তীক্ষ্ণ সুরে বললো,

‘ভালোবাসি ঐচ্ছি।’

ঐচ্ছির অগোছালো মনে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। কর্ণকুহুরে নুপুরের রিনিঝিনি শব্দের মতো বাজতে লাগল সেই এক সুর। ‘ভালোবাসি’,’ভালোবাসি’,’ভালোবাসি’। ফট করে কলটা কেটে দিল ঐচ্ছি। বুকের বা পাশটা ভয়ানক ভাবে লাফাচ্ছে তার। এর আগেও রাফসান তাকে ভালোবাসার কথা বলেছে তবে এইভাবে না। আজ তার এই সুরে মাদকতা ছিল। যার নেশা ঐচ্ছিকে উন্মাদ করে তুলছে। সারা শরীর বয়ে চলছে মৃদু উত্তেজনা। ঐচ্ছি জোরে জোরে কয়েকবার নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে। অল্পতেই এত অস্থির হয়ে পড়লে চলবে না। আগে সে এই জ্বীনকে আচ্ছামতো নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে, তারপর এসব অস্থিরতা নিয়ে ভাবা যাবে। ঐচ্ছি নিজেকে শান্ত করলো। গায়ের ওড়নাটা বালিশের পাশে রেখে চুপচাপ শুয়ে পড়ল সে। কাল বাদে পরশু তার এংগেইজমেন্ট, কিছু একটা মাথায় চলছে তার। সময় আর সুযোগ পেলেই সেটাকে কাজে লাগানো যাবে।

সাদমান তপ্ত নিশ্বাস ফেলে তার ভাইয়ের পাশে বসল। বিস্ময়ের সুরে বললো,

‘ভাইয়া তুমিও মিথ্যে বলতে শিখে গিয়েছো?’

রাফসান অধর জোড়া বাকিয়ে চমৎকার এক হাসি দিয়ে বলে,

‘প্রেম আর ভালোবাসার মোহ মানুষকে অনেক কিছুই শেখায়। যেমন আমাকে মিথ্যে বলা শিখিয়েছে।’

সাদমান গোলগোল চোখে তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই ভালোবাসা মানুষকে কতটা বদলে দেয়।

..

সকাল ৯:৩০ মিনিট। ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছে সায়মা। হাত পা চারদিকে চারটা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে। বিক্ষুব্ধ নয়নে তার দিকে চেয়ে আছে ঐচ্ছি। বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘশ্বাস। মনে মনে ভাবে, এই মেয়ের জামাইয়ের বুঝি আর বিছানায় ঘুমানো হবে না। আর বসলো না ঐচ্ছি। দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।

‘বাব্বা আজকে সূর্য কোন দিকে উঠেছে বলতো? এত তাড়াতাড়ি দুপুরের পাখি ঘুম থেকে উঠে গেল কি করে?’

ঐচ্ছি চোখ বাকিয়ে তাহেরা বেগমের দিকে তাকায়। উনি মিটিমিটি হাসছেন আর রুটি মেকার দিয়ে রুটি বানাচ্ছেন। চুলাটা জ্বালিয়ে দিয়ে সেটাতে একটা কড়াই বসাল ঐচ্ছি। কড়াইয়ে তেল ঢালতে ঢালতে ফিচেল গলায় বললো,

‘এই মায়েদের না সবকিছুতেই সমস্যা। দেরিতে উঠলেও বকে আর তাড়াতাড়ি উঠলেও এমন ভাবে জেরা করে যেন আমি ঘুম থেকে উঠে না জেল থেকে পালিয়ে এসেছি। এনাদের মন বোঝা বড্ড দায়। উনারা যে কখন কি চায় এক আল্লাহই ভালো জানেন।’

ঐচ্ছি বানোয়াট দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের দিকে আড়চোখে তাকায়। মা তার দিকে তির্যক চোখে চেয়ে আছে। সে কি চাহনি। ফট করেই হেসে ফেলে ঐচ্ছি। তাতেই ভয়ানক রেগে যান তাহেরা বেগম। ঐচ্ছির ডান কানটা জোরে টেনে ধরে বলেন,

‘মাকে নিয়ে মজা হচ্ছে? এত পাঁজি হয়েছো তুমি? দাঁড়াও তোমার বাবাকে আজ বিচার দিতে হবে।’

ঐচ্ছির হাসি পেলেও হাসল না। হাসিটাকে কোনোরকমে দমিয়ে রেখে দুঃখি দুঃখি কন্ঠে বললো,

‘মা, প্লিজ ছাড়ো। লাগছে তো।’

তাহেরা বেগম তো ছাড়লেনই না উল্টো আরো শক্ত করে কান মলে দিলেন। ঐচ্ছি এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

‘ও আমার মা জননী, আমি সত্যিই ভীষণ ব্যাথা পাচ্ছি। দয়া করে আপনার এই নরম তুলতুলে হাতটা আমার কানের উপর থেকে সরিয়ে আমাকে বাধিত করুন। দয়া করুন মা জননী, আপনার এই নিরহ বাচ্চাটার উপর। পিলিজজ!’

তাহেরা বেগমও হেসে ফেললেন। তবে সেই প্রশান্তিময় হাসি ঐচ্ছির দৃষ্টির আড়ালেই রইল। কান ছেড়ে আবারো নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন তিনি। গলার স্বর খানিকটা চওড়া করে বললেন,

‘আর যদি শুনেছি এসব কথা, তবে পরেরবার একদম কান ছিঁড়েই দম নিব।’

ঐচ্ছি তখন হেয়ালির সুরে বললো,

‘আমার কান ছিঁড়লে বিয়ের জন্য যে কানের ঝুমকাগুলো বানাচ্ছো ঐগুলো কে পরবে শুনি?’

তাহেরা বেগম চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ঐচ্ছি দাঁত কেলিয়ে হাসল। ফ্রিজ থেকে ডিম নিয়ে রান্নাঘরে আসতেই তাহেরা বেগম জিগ্যেস করলেন,

‘ডিম দিয়ে কি হবে?’

ঐচ্ছি খুশি খুশি গলায় বললো,

‘সামুর জন্য অমলেট বানাবো। আমার হাতের অমলেট তো ওর বরাবরই প্রিয়। তাই ভাবলাম আজ সকালের নাস্তাটা ওর প্রিয় খাবার দিয়েই হোক।’

_______________________

রুম জুরে পায়চারি করে চলছে ঐচ্ছি। চোখ মুখ কুঁচকানো। হাত দুটো সমানে কচলে যাচ্ছে। ঘাড় অবধি খোলা চুলগুলো বারবার তাকে বিরক্ত করছে। এক পর্যায়ে ঐচ্ছির বিরক্তির মাত্রা অতিক্রম করতেই ঐচ্ছি বেন্ট দিয়ে সেগুলোকে বেধে ফেলে। ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে সায়মার পাশে বসে। ক্ষীণ সুরে সায়মা তখন বলে উঠে,

‘এগারোটা বাজে। ভার্সিটিতে যাবি না?’

ঐচ্ছি ঘাড় কাত করে সায়মার দিকে তাকায়। মোবাইল টিপাতে ব্যস্ত সে। ঐচ্ছি ছোঁ মেরে সায়মার মোবাইলটা নিয়ে নেয়। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,

‘মোবাইলে এত কি তোর? তোর চোখের সামনে যে তোর বান্ধবী টেনশন করতে করতে মরে যাচ্ছে সেদিকে তোর বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। কেমন বান্ধবী তুই,হু? তুই তো বান্ধবীর নামের কলঙ্ক।’

তেতিয়ে উঠে সায়মা। ঐচ্ছির চুলে টান দিয়ে বলে,

‘তোর মতো পাগলরে ছাগল মার্কা টেনশন করতে কে বলছে? হুদাই সব আজাইরা জিনিস নিয়া টেনশন করে। হু, উনি যেন মহারাণী, উনি টেনশন করলে পৃথিবীর আর কেউ শান্তিতে থাকতে পারবে না সবাইকে যেন উনার সাথে উনার টেনশনে সামিল হতে হবে। হুম, ঠেকা পড়ছে তো। যত সব ঢং।’

সায়মা মুখ বাঁকায়। ঐচ্ছি বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে সায়মার দিকে তাকিয়ে আছে। সায়মা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ঐচ্ছি দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘এক থাপ্পড়ে তোর সবগুলা দাঁত ফেলে দিব সমুচার বাচ্চা সমুচা। আমি এইদিকে টেনশনে মরে যাচ্ছি আর এটা তোর কাছে কিছু না। আমি আজাইরা টেনশন করি? আমার জায়গায় তুই থাকলে বুঝতি আমার কিসের এত টেনশন। জ্বীনের পাল্লায় আমি পড়ছি তুমি না। তাই তুমি জীবনেও বুঝবা না আমার টেনশনগুলা ঠিক কত প্রকারের। আর ঐ খবিশ জ্বীন, হনুমানটা খালি একটার পর একটা প্যাঁচ লাগিয়েই যায়। কি দরকার ছিল ঐ হনুমানের আরিফকে এইভাবে মারার। আরিফের এখন জ্ঞান নেই, জ্ঞান ফিরলেই তো ও সবাইকে সব বলে দিবে। আর তখন এই এলাকার সবাই জেনে যাবে রাফসান জ্বীন। আমার বিয়ে জ্বীনের সাথে হচ্ছে। তখন কত বড় ঝামেলা হবে বুঝতে পারছিস?’

চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে ঐচ্ছির। চোখ মুখ বিষন্ন হয়ে আসে। সায়মা আধসোয়া হয়ে বসে ছিল। এখন সোজা হয়ে বসে। গম্ভীর স্বরে বলে,

‘রাফসান ভাই খারাপ কি করেছে বলতো? ঐ আরিফ তো তোকে কম জ্বালায়নি। আর এখন তোর বিয়ে ভাঙতে রাফসান ভাইকে তোর নামে যা নই তাই বলেছে। রাফসান ভাই কেন সহ্য করবে? আমি হলেও সহ্য করতাম না। ভালো হয়েছে জ্বীনের হাতে কেলানি খেয়ে ঐ আরিফের উচিত শিক্ষা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, রাফসান ভাইও এখানে একটা ভুল করে ফেলেছে। আরিফকে মারার সময় উনার অমন ভয়ংকর রুপে চলে আসাটা ঠিক হয়নি। উনার ঐ রূপ দেখেই বেচারা আরিফ ফিট খেয়েছে। এখন জ্ঞান ফিরলে আরিফের কতটুকু কি মনে থাকে সেটাই হলো দেখার বিষয়।’

ঐচ্ছি চিন্তিত কন্ঠে বললো,

‘সাদমান বললো রাফসানের রাগ নাকি এখনো কমেনি। আর উনি যখন খুব রেগে যান তখনি নাকি অমন ভয়ানক দেখতে হয়ে যান। উনার এই রূপ দেখে তো আরিফ অজ্ঞান হয়েছে আর আমি তো সাথে সাথে অক্কা যাবো। কিন্তু এখানে আরেকটা কথা আছে, আরিফ রাফসানের নাম্বার কই থেকে পেল? আর হুট করেই আমার নামে এমন উল্টা পাল্টা কথা রাফসানকে বলতে গেল কেন? এখানে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির হাত নেই তো?’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here