কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-🎈পর্ব ১০+১১

কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-১০.🎈
@হাফসা আলম
_____________________
সামনের রুমটা বড়রা দখল করে নিয়েছে।নিজেদের মত তারা গল্প করছে।রুচিকাকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে।সব তার পছন্দের কথা।তুতুলের এখনো মনে আছে।সেদিন ইয়াজের সাথে তার মা,বোন আর বাবা এসেছিলো।ইয়াজের এক বোন।সেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতো।কবে প্রথম দেখা হয়েছে??কিভাবে পরিচয় হয়েছে??ব্লা ব্লা।তুতুল কিছু বলতে পারে না।মেয়েটা হেসে উঠে সেদিন বলেছিলো,
“ আমি সব জানি,ইয়াজ জোড় করে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে।তুমি তো রাজিই হওনি।ইয়াজ অনেক পরিশ্রম করে তোমাকে নিজের করছে।তার খুশি দেখার মতো।কাল সারা রাত উল্লাস করেছে।সকালে তো সবার আগে উঠে বসেছিলো।সবাইকে তিন ঘন্টা আগে রেডি করিয়েছে।সে হুলুস্থূল কান্ড বুঝলে তুতুল!!”

তুতুল পুরানো কথা ভাবছেই।আজ বেশি মনে পড়ছে।বার বার মনে হচ্ছে কি দরকার ছিলো ইয়াজ নামক প্রানীর সাথে জড়িয়ে যাওয়ার।কোনো কি প্রয়োজন ছিলো??

“ কিছু গল্প অসম্পূর্ন থাকে।এদের অসম্পূর্ন থাকতে দেওয়াই ভালো।যত এগুলো নিয়ে ভাববে?তত এর গভীরে তলিয়ে যাবে।সেখান থেকে জন্ম নিবে বিষন্নতা,হতাশা,ব্যর্থতা।যা মানুষকে দুর্বল করে তুলে।জীবনের প্রতি তৈরি করে অনীহা।বাঁচার ইচ্ছে হ্রাস পায়।তখন তারাই ভুল থেকে বেড়িয়ে আসতে চেয়ে আবার ভুলের সাথে আলিঙ্গন করে।এটাই মানুষ জাতির ভুল।মানুষের উচিত ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া।ভুলের মাঝে আরো তলিয়ে যাওয়া না।যা হয়েছে ভাগ্য ভেবে ছেড়ে দেওয়া উচিত।নিশ্চুয়ই ভাগ্য সৃষ্টিকর্তার হাতেই বন্দী।”

তুতুল নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো।সামনে তাকিয়ে দেখে রিঝের জায়গাটা খালি।মানে তার পাশেই বসে আছে।তুতুল পাশ ফিরে তাকায়।রিঝ ফোনের দিকে থেকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবার ফোন দেখতে দেখতে বলল,
“ এটা মাত্র লেখলাম।কথাগুলো কেমন ছিলো??আসলে ফেইসবুকে দিয়েছি।সবার আগে তোমার মতামত জানতে চাই।জানি তারিফ তো জীবনে করবে না।উল্টা বাজে বলবে।”

রিঝের কথায় তুতুল হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল,
“ মোটেও বাজে হয় নাই ভাইয়া।ওয়াও একদম খাটারা টাইপের হয়েছে।আসলে আমার দোষ না তারিফ শব্দ আপনার সাথে যায় না।হু হা হি।”

রিঝ কিছু বলল না।চুপ করেই বসে থাকলো।রামিম এসে রিঝের পাশে বসে।তুতুলের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ চলো তুতুল আমরা সমুদ্র দেখতে যাই।”

রামিমের কথা মজার ছলে নিলো রিঝ।গায়ে মাখলো না তেমন।তুতুল খুশিতে ডগমগিয়ে উঠে বলল,
“ সত্যি!!!ওয়াও চলেন।”
“ এই মুহূর্তে তো যাওয়া যাবে না।”
“ যখন যাবেন বলিয়েন।আমি যাবো।”

রিঝ মৃদূ হেসে বলল,
“ পানিতে চুবিয়ে মেরে ফেললে কেউ টেরও পাবে না।ভালো হবে তাই না??”
“ আপনার জন্য তো ভালোই হবে।ফালতু কথা।ভাইয়ারে নিয়া যামু।দেখি কিভাবে খুন করেন।”

রিঝ সোজা হয়ে বসে।সামনের টেবিল থেকে জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে বলল,
“ সমুদ্র দেখার মতো কি আছে??আমাদের বাসার সামনে যে সুইমিংপুল আছে তা আরো ভালো দেখতে।সমুদ্রের নোংরা নোনা পানি ছিঃ।”
“ মোটেও না।সমুদ্র সুন্দর।আপনি বুঝবেন না।”
“ বুঝতেও চাই না।ফালতু জিনিস।”

রামিম রিঝের পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা দেয়।কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
“ দেখ দোস্ত মেয়েরা সব সময় চায় তাদের পছন্দকে ছেলেরা দাম দিক।আর প্রিয় হতে হলে প্রিয় মানুষের পছন্দের দাম দিতে হয়।তোরা এতো বিপরিত কেনো বলবি??”

রিঝ কড়া চোখে তাকায়।পাশে তুতুল আছে।রিঝ রামিমের পেটে ঘুঁষি মারে।রামিম আউ করে উঠে।তুতুল কিছুই বুঝে না।উঠে চলে যেতে নেয়।রামিম পা বাড়িয়ে ফেলে দিতে চায়।কিন্তু তুতুল পড়ে না।রুচিকার বোন আরোহি ঠুস করে রিঝের কোলে বসে পরে।রিঝ বিস্মিত হতবাক হয়ে সরে বসতে চায়।কিন্তু পারে না।আসমা দূর থেকে দেখে।রামিমকে গালি দেয়।রামিম জিভ কাটে।আরোহির প্রান প্রিয় মানুষ রিঝ।ক্রাশ।বয়স বেশি না।আঠারো মাত্র।এটাই প্রেমের বয়স।অল্প বয়সি মেয়েরা সুন্দর ছেলেদের প্রেমে পড়ে বেশি।সৌন্দর্যের মাঝে এরা ভালো লাগা আর ভালোবাসা গুলিয়ে ফেলে।কিন্তু এদের প্রেম হয় মারাত্নক।অনেক আগে থেকে রিঝ নাম অসুখে আক্রান্ত আরোহি।রিঝের কথা বলা,হাঁটা,চোখের চশমা উঠানোর ধরন,গম্ভীর মুখ,লেখালেখি ,রাগ সবই তার প্রচন্ড পছন্দ।পাগলের মতো রিঝকে দেখলেই পিছনে পিছনে ঘুরে।রিঝ স্বভাব সরূপ পাত্তা দেয় না।কথাও বলে না একটু।যেনো চিনেই না।
“ ওয়াও কেয়া ফিল্মি এন্ট্রি।”

তুতুল হেসে চোখ ছোট করে।রিঝ অস্বস্তি নিয়ে নড়াচড়া করছে।আরোহি ড্যাবড্যাব করে রিঝকে দেখছে।কে বলেছে ছেলেদের মাঝে সৌন্দর্য মেয়েদের চাইতে কম??এটা যে বলেছে সে বোকা।মহা বোকা।আরোহি রিঝের গলা জড়িয়ে কোলেই বসে আছে।রিঝের মুখ দেখার মতো।পারছে না থাপড়ে দাঁত সব ফেলে দিতে।রামিম উঠে দাড়ায়।আরোহিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ কে তুমি নন্দিনী যেই হও উঠে পরো।”

আরোহি মুগ্ধ চোখে দেখে।রিঝের ভ্রুর কাটা অংশটা আরোহির খুব পছন্দ।চোখ,নাক,ঠোঁট সবই সুন্দর।আরোহির ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করতে,” আপনি এতো সুন্দর কেনো??বলবেন?”

রিঝ অনেকক্ষণ থেকে তাকে উঠাতে চাচ্ছে।ঠেলছে।গলা থেকে হাত ছাড়াতে চাচ্ছে।বড়রা সবাই দেখবে ভেবে সে শব্দ করে কিছুই বলছে না।তুতুল দ্রুত ছবি তুলে।তার তো এদের জুটি দারুন লাগছে।রিঝ প্রচন্ড রাগ নিয়ে তুতুলের দিকে তাকালো।তুতুল ভয়ে সরে যায় সামনে থেকে।রিঝ আরোহির হাত শক্ত করে ধরে ঝিটকে ফেলে দেয়।আরোহি বেঁচারি একদম নিচে পরে।রিঝ উঠে যেতে যেতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ কানে কি শুনতে পাও না??ডিজগাষ্টিং।রামিম তুই দাড়া।”

রামিম দেয় এক দৌড়।রিঝও পিছনে ছুট লাগায়।রামিম এই বাসায় নতুন।রিঝ এসেছে কয়েকবার।তুতুলদের সাথে।আরো অনেক দিন আগের কথা।রামিম কিছু চিনে না।উল্টাপাল্টা দৌড়ায়।তুতুলও ফোন নিয়ে ছাদে চলে যায়।এরপর তার উপরে ঝড় আসবে।আরোহি ঠোঁট উল্টে মন খারাপ করে।ফেলেছে দেখে তার খারাপ লাগছে।আর রিঝের এতো কাছে যেতে পেরে খুবই খুশি লাগছে।নিচে বসেই সে হাসছে।তার হাসি দেখে আসমা বিস্মিত হয়ে বিড়বিড় করে,
“ হাসে কা??”

রিঝ রামিমকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে চলে যায়।তুতুল তখন উল্টাদিকে ফিরে পেয়ারা গুনছে।বাসার সামনের গাছে পেয়ারা ধরেছে অনেক।একদম টিয়া রঙ্গের।রিঝ আস্তে আস্তে পা ফেলে।একদম তুকুলের পিছনে এসে দাড়ায়।তুতুল সবে মাত্র দশটা গুনেছে।পিছনে কেউ আছে।তুতুল টের পায়।পিছনে ফেরে তাকিয়ে রিঝকে দেখে।চমকে উঠে উত্তেজিত হয়ে একদম পিছনের দিকে পড়ে যেতে নেয়।ছাদে রেলিং নেই।খোলা চারপাশ।পাঁচতলার উপর থেকে নিচে পড়লে একদম কবরে।তুতুল সাথে সাথে চোখ বুজে নেয়।চোখ মুখ খিঁচে চিৎকার করে বলে,
“ আল্লাহ্।”

রিঝ হাতটা শক্ত করে ধরে।তুতুলের পাগুলো পিছলে যেতে নেয়।রিঝ নিজের পা একদম তুতুলের পায়ের পিছনে রাখে।অনেকটাই ঝুঁকে গেছে সে।বুকের ভিতরে হাতুরি পিটা হচ্ছে।মৃত্যু মানুষের খুব কাছে চলে আসলে বুঝা যায় মানুষ কতটা ভয় পায় মৃত্যুকে।তুতুল হাতের উপরে আরটা ঠান্ডা হাতে স্পর্শ পেয়ে চট করে চোখ জোড়া মেলে তাকায়।রিঝকে দেখে স্বস্তির শ্বাস নেয়।মুখে হাসির রেখা টেনে বলে,
“ আল্লাহ্ বাঁচাইছে।”
“ আল্লাহ এখন আমার মাধ্যমে উপরেও পাঠাই দিতে পারে।”

তুতুল আঁতকে উঠে বলল,
“ মানে কি??”
“ খুব সহজ।তুমি না ছবি তুলেছো??কই দেখাও।কেমন লাগছে আমাকে দেখতে হবে তো।”

রিঝের হাতে বাম হাতটা।ফোন ডান হাতে।তুতুল দ্রুত হাত পিছনে নিয়ে যায়।বলে,
“ ছবি দেখে আপনি কি করবেন রিঝ ভাই??আমি বলছি বেষ্ট হয়েছে।”
“ তোমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না।দেও তো দেখি।”
“ না।”

রিঝ ঠোঁট কামড়ে হাসে।তুতুলকে পিছনে ঝুকিয়ে দিতেই সে চিৎকার করে বলে,
“ ফেলে দিয়েন না।মরে যাবো।”
“ বাঁচতে চাইলে ফোন দেও।”

তুতুল নাছড়বান্দা।সে নাকঁছ করে বলল,
“ কখনোই না।”
“ ওকে ফেলে দি।” রিঝ সত্যিই আরো ঝুঁকিয়ে দেয়।
তুতুল চিৎকার করে চোখ বুজে।রিঝ সামনে টেনে হাসে।তুতুল বলে,
“ আমাকে মেরে আপনার লাভ কি??”

“ লসও কিছু নেই।” রিঝের কন্ঠ স্বাভাবিক।তুতুল আরো ভয় পায়।সত্যি যদি ফেলে দেয়!!
“ লস অবশ্যই আছে।আমি মরলে জেলে বন্দী হতে হবে।”
“ তুমি বেঁচে থাকলেও আমি বন্দী।”

কৌতুহলি চোখে তাকালো তুতুল।রিঝের মুখ গম্ভীর।চোখের চশমাটা নেমেছে নাকের ডগায়।তুতুলের যে হাত রিঝের হাতে।সে হাতটা দিয়ে রিঝের হাত খামছে ধরে সে।পিটপিট করে তাকায়।ভয়ে শেষ।এই বুঝি ফেলে দিবে।রিঝ কঠিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“ ফোন কি দিবা??”

তুতুলের যেন জানের চাইতেও ছবি মূল্যবান।সে দিতেই চাইছে না।রিঝ এবার সত্যি ফেলে দেওয়ার মত ভাব করে।তুতুল আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে ফোন দিয়ে দেয়।কোমড় পেচিঁয়ে দাড় করিয়ে দেয় রিঝ।বেধারাম হাসি পাচ্ছে তার।তুতুল মুখ ফুলিয়ে নেয়।রেগে আগুন হয়ে হনহনিয়ে নিচের দিকে চলে যায়।মুখে বিড়বিড় করে, খারাপ লোক।নিজের সুবিধার জন্য,নিজের কাজের জন্য সবাইকে খুন করতে পারবে।যতসব।”

রিঝ উচ্চ শব্দ হাসে।রামিম ছাদেই লুকিয়ে ছিলো।রিঝের মুড ভালো দেখে বেরিয়ে আসে।হেসে হেসে বলে,
“ স্যরি দোস্ত।আমি তো তুতুলরে ফেলাইতে চাইছিলাম তোর কোলে।ওই চিপকালি কই থেকে যে আইছে আই ডোন্ট নো দোস্ত।”

রিঝ কথাই বলেনা।রাগে তার শরীর জ্বলছে।মনে হচ্ছে আরোহির শরীরের স্পর্শ এখনো তার গায়ে লেগে আছে।রামিম আবারও বলে,
“ স্যরি দোস্ত।আমরা তো ভাবছি,”

কথার মাঝ পথে থাময়ে দিয়ে রিঝ বলল,
“ দেখ ধাক্কা খেলে কোলে বসলেই ভালোবাসা তৈরি হয় না।তোরা নামেই প্রেম করছ।সত্যি করে বল মাইশাকে তুই ভালোবাসছ??”

রামিম মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ হয় তো বাসি।তাই তো আমাদের মাঝে সবই মিলে।”
“ ভুল কথা।ভালোবাসা থাকলে মিলের প্রয়োজন নেই।আর এসব ফিল্মি কাহিনী করলেও ভালোবাসা হয় না।আমি জানি তোরা এসব ফাউ কাজ করার জন্যই এখানে আইছস।কিন্তু এগুলোতে কিছুই হবে না।সো ফালতু জিনিস বাদ।

রিঝ চলে যেতে নেয়।রামিম থামিয়ে বলে,
“ তাহলে কি তুই সারা জীবন না বলেই কাটিয়ে দিবি??এভাবেই চলবে সব??”

ঠোঁট কিঞ্চিত মেলে হাসলো রিঝ।ফোনের ছবি দেখতে দেখতে বলল,
“ সবার ভালোবাসার ধরণ এক হয় না।ভালোবাসা নিজের মতো হয়।অন্য কেউ কি করেছে বা করবে ,করে এসছে এগুলো অনুকরণ করে লাভ কি।আমি নিজের মতো ভালোবাসবো।আমার দৃষ্টি কোণ থেকে বলে দিয়ে ভালোবাসা হয় না।বললে তো চাপিয়ে দিওয়ার মত হয়।আমি কিছুই চাপিয়ে দিতে চাই না।এমন কিছু করতে চাই যাতে হাজার ভাবে হাজার পরিস্থিতিও আমাকে না ভুলে।আর আমরা আমাদের মতই ভালো আছি।”

রামিম নাকটা একটু উঁচিয়ে নেয়।বিরক্তি গলায় বলে,
“ ভালো!!তোরা!!তোদের মতো!!ওরে বাপ তুতুল তো তোরে দেখতেও পারে না।তুই তো সারা দিন ঝগড়া করছ।আর তোদের মাঝে কত ভিন্নতা।বেচারি বাচ্চা মেয়ের সাথে এতোটা না লাগলেও পারছ।”
“ আমি লাগি??আশ্চর্য!!তুই আমার ফ্রেন্ড না কি ওর??আর বাচ্চা??ওরে তোর বাচ্চা মনে হয়??শয়তানের নানী একটা।ঝাল খাইয়ে কি অবস্থা করেছে দেখলি না।”
“ সেটা তো তুই ওরে এক পায়ে দাড় করিয়ে রাখছ তাই।”
“ সখে করি না।ও যে কি শুধু আমি জানি।”
“ কি??আমাদেরও বুঝা??”
“ ব্যক্তিগত জিনিস সবাইকে বুঝানো উঁচিতই না।ও তো আমার একান্ত ব্যক্তিগত নিজি মানুষ।”

রিঝ হেসে ফোন ঘুরাতে ঘুরাতে চলে গেলো।রামিম কিছু বুঝলো না।কিছুই না।এদের শেষ পরিনতি কি হবে!!!
________________________
প্রকৃতির সব কিছুই হয় নিয়ম মেনে।ধীরে ধীরে।দূর্ঘটনা আর মৃত্যুই হুট করে দরজায় এসে পরে।তা না হলে প্রকৃতি খুবই ধীর।ঋতু পরিবর্তন হয় ধীরে ধীরে।সকাল হয় ধীরে।রাতও নামে ধীরে।প্রতিদিনের মত আজও সূর্য ধীরেই উঠেছে।আজকাল ঘন কুয়াশায় ঢাকা শহরের অলিগলি ডুবে থাকে সকালে।ঘনকুশার সাদা চাদর সরিয়ে প্রকৃতি সূর্যের আলোতে রাঙা হয়।ঠিক তখনই সূর্যের তীক্ষ্ন রশ্নি এসে পরে তুতুলে সাদা পর্দার উপরে।সাদা পর্দা ভেদ করে মুহূর্তেই রুমটা আলো আলো হয়ে উঠে।সকালের একফালি মিষ্টি রোদ তুতুলের চুলে অর্ধ ঢাকা মুখের উপরে ভাগ বসিয়ে দিয়েছে।মিষ্টি রোদ মুখের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই তুতুল ব্যস্ত ভঙ্গীতে চোখমুখ কুঁচকে নেয়।আজকের সকাল এতো সুন্দর কেনো??পিটপিট করে চোখ খুলে তুতুল নিজের মাকে দেখতে পায়।ব্যস্ত হয়ে তিনি পর্দা সরিয়ে দিচ্ছেন।রুমের কোণায় কোণায় রাখা ফুলদানীতে ফুল রাখছেন।এটা তিনি সব সময়ই করেন।বাগানের ফুল দিয়ে মেয়ের রুম সাজান।মেয়ে যে ফুল পাগল।হঠাৎ কি মনে করে ফুলগুলো তুলে নিলেন।তুতুল ভারী অবাক হলো।প্রশ্ন করে মাকে,
“ আম্মু ফুল তুলে নিলা কেনো??”

আমিনা হুট করেই তুতুলের গায়ের চাদর টেনে নেয়।তুতুল আড়মোড় ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে উঠে বসে।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।আমিনা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ ফ্রেশ হয়ে নেও।রিঝ আর ওর বন্ধুরা কিসের যেনো কথা বলতে এসেছে।বলেছি দুপুরে আমাদের বাসায় লাঞ্চ করতে।”

তুতুল লাফিয়ে উঠে বলল,
“ বলো কি আম্মু??আজকে না আমার রান্নার দিন।”

আমিনা বিছানা ঠিক করতে করতে সহজ গলায় বলল,
“ হুম তো??”
“ তো মানে কি আম্মু??আমার রান্না উনারা কিভাবে খাবে??”
“ সেটা জানি না।উঠে নিজের কাজ নিজে করো।আর সবাই অপেক্ষা করছে।”
আমিনা বড় বড় পা ফেলে চলে গেলেন।তুতুল আহাম্মকের মত বসেই রইলো।সাপ্তাহে একদিন সে রান্না করে।এটা তার রুটিং একপ্রকার।অন্য দিকে পছন্দর।আর দিনটি হচ্ছে শুক্রবার।আজই সেই দিন।আর আজই উনারা এসেছে!!তুতুল জানে তার আম্মু আজ রান্না করবেই না।কারণ সেই একদিন বলেছে আজকের দিনে শুধু সেই রান্না করবে তার আম্মু রান্না করতে পারবে না।আমিনা ডাক দিলেন।তুতুল ভাবনার জগৎ ফেলে ফ্রেশ হতে গেলো।

সামনের রুমে বসে রিঝ বই পড়ছে।বাকিরা গল্প করছে।আলভীও সবার সাথে আছে।একসাথে পড়া না হলেও রামিম,আকাশ আলভীরও বন্ধু।সেই হিসেবে গল্প চলছে।তুতুল আসে একদম আসল সময়ে।রামিম তখন বলছিলো,
“ ভাবছিলাম আমরা ঘুরতে যাবো।আনাস ভাইয়া বিয়ের তো অনেক দেরি আছে।আর অনেক বছর হয়েছে একসাথে ঘুরতে যাইনা।রিঝ না হয় একা একাই ঘুরে।আমরা তো আর একা পারি না।ওর মতো নিরামিষ তো আমরা নই।তাই ভাবছি একটা ট্যুর প্ল্যানিং করি।কি বলছ আলভী??”

আলভী কিছু বলবে তার আগেই তুতুল লাফিয়ে বলল,
“ আমি যাবো আমি যাবো।চলো কক্সবাজার যাই।”

বইয়ের ভাজ থেকে মুখ তুলে রিঝ ধমকের সুরে বলল,
“ এক জায়গায় আর কত যাইতে ইচ্ছে করে তোমার??সব সময় তো একই জিনিস থাকে।পানি।আর পানি।”
“ তাতে কি।সমুদ্রই অনেক সুন্দর।”

রিঝ নাকঁছ করে বলল,
“ এবার পাহাড়া যাবো।”
“ না সমুদ্র।”
“ মোটেও না তুতুল।আমরা সবাই বান্দরবানেই যাবো।”

তুতুল নাক তুলে নেয় অনেক খানি।বলে,
“ বান্দরবানে কি এমন আছে??আর পাহাড় দেখার মতো কিছু না।খাম্বার মত মাটির স্তুপ।এছাড়া আর কি আছে??
আমার সমুদ্র দেখতে যাই রামিম ভাইয়া।”

রিঝ এবার রেগে গেলো।পাহাড় তার অতি প্রিয় জিনিস।এটার বিপরিতে কেউ কিছু বললেই তার মাথা গরম হয়।তার উপরে তুতুল তো অপমানই করে দিলো।রামিম তুতুলের তালে বলল,
“ ওকে ওকে আমরা কক্সবাজারই যাবো।”
“ মোটেও না।বান্দরবানে যাবো।তা না হলে ট্যুর বাদ।”

আসমা বিস্ময়ে মাথা এদিক সেদিক ঘুরায়।বাকিরাও একুই কাজ করছে।আকাশ বলল,
“ এমন করছ কা রিঝ??তুতুলেরও তো মন আছে তাই না।ওর যেতে ইচ্ছে করছে চল যাই।”
“ পানি দেখার ইচ্ছে নেই আমার।”

তুতুলও মুখ গোমড়া করে।রিঝ বইটা ঠাস করে টেবিলের উপরে রাখে।তুতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে রিঝের অন্যরকম লাগে তাই বলে,
“ ওকে পানিই দেখি।”

তুতুলও এবার উল্টে গেলো।বলল,
“ না খাম্বা মানে পাহাড়ই দেখমু।”
“ না পানি।”
“ না পাহাড়।”

সবাই বুঝলো।এদের সবই বিপরিত।তাই রামিম বলল,
“ চল কক্সবাজার এবং বান্দরবান দুই জায়গাই যাই।অনেক তো কাজ কাজ করলাম এবার একটু ঘুড়া ঘুড়ি দরকার।”

রামিমের কথা সবারই পছন্দ হলো।আলভী নীরব হয়ে বসেছিলো এতক্ষণ।এবার বলল,
“ স্যরি গাইস।আমি যেতে পারবো না।তার মানে তুতুলও না।”

সবাই হতবাক হয়ে বসে রইলো।যেনো আকাশ ভেঙে পড়েছে।এতোটা হতাশ তো বেকার থাকা কালিনও হয়নি কেউ।আকাশ রামিমের কানের কাছে এসে বলল,
“ শেষে তীরে এসে তরী ডুবলো??দোস্ত এটা মানা যায় না।কিছুতেই না।”
“ আরে থাম দেখি কি হয়।”

তুতুল বুঝাতে চাইলো নানা ভাবে।আলভীর ভিজিট আছে।সে সিলেট যাবে।তাই সবার সাথে যেতে পারবে না।তুতুলের মন একদম খারাপ হয়ে যায়।রিঝ আড়চোখে তুতুলকে দেখে।কিন্তু কিছু বলে না।তুতুল বুঝাতে ব্যর্থ।তার ভাই একা কিছুতেই তাকে যেতে দিবে না।এমন কি সব মেয়ে হলেও দিতো না।রিঝ অনেক সময় পরে বলল,
“ তাহলে আর কি তুতুলকে ছাড়াই যেতে হবে।”

তুতুলের খুব রাগ লাগছে।ঠিক আছে রিঝ ভাই তাকে পছন্দ করে না।দু’জনের সম্পর্ক টম এন্ড জেরি টাইপের।তবুও একটু তো সুপারিশ করতেই পারতো।রিঝের কথা তো সবাই শুনে।আল্লাহ এরে একটা মহান পাওয়ার দিয়েছে।সবার মন জয়করার।কিন্তু রিঝ একটা শয়তান!!
তুতুল সবার সাথে গল্প করে।তারপর উঠে যায়।রান্না করবে সে।ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো।কিন্তু ভাইয়া যখন বলেছে সে যাবে না মনে সেও যাবে না।মাঝে মাঝে কিছু ইচ্ছে বাদ দিতে হয়।তুতুলে যেতেই রিঝ আলভীর পাশে বসে।তারপর বলে,
“ দেখ আমি তো যাচ্ছি।ওকে যেতে দে।”

সবাই অবাক হয়ে রিঝকে দেখে।আলভীও অবাক।সে বলে,
“ তুই তো আমার বোনকে সামলাতেই পারছ না।তোর সাথে ওকে কেনো দিবো??সামান্য জগিং করতে নিলি হাত ছিড়ে এসেছে।”
“ আরে তখন তো শুধু তোর বোনের দায়িত্ব নিয়েছি।এবার তোর বানের সাথের শয়তান গুলোরও দায়িত্ব নিচ্ছি।যেতে দে।ওর মন খারাপ হয়েগেছে।এমনেতেও তোর বোনরে নেওয়ার ইচ্ছা নাই।তবে মনে কষ্ট পেয়ে যদি বদোয়া দেয় তখন তো আমার আর জীবিত আসতে পারবো না।তাই দিয়ে দে।এমনেও ওর পরিবেশ পরিবর্তেন প্রয়োজন আছে।”

আলভী রিঝের কথায় রেগে যায় অনেক।পরে আবার ভাবে,আসেই পরিবর্তন প্রয়োজন।তাই সে বলল,
“ ঠিক আছে।তবে আমার বোনের যাতে ক্ষতি না হয়।আমি কিন্তু তাহলে খুন করে দিবো তোকে।”

রিঝ বিড়বিড় করে বলে,
“ তোর বোনের কি আর ক্ষতি হবে যা হবে সব তো আমার।”
“ কিছু বললি??”
“ হুম দোয়া করিছ।তোর বোন তো সাধারন না।অসাধারন প্রতিভা তার।আল্লাহ্ জানে আমার কি অবস্থা হয়।”

আলভী কঠিন চোখে তাকায়।রামিম আসমা আকাশ রিঝকে জড়িয়ে ধরে।রিঝ ছিটকে সরিয়ে দেয়।
____________________
তুতুল চপিং বোর্ডে পেয়াঁজ কাটছে।চোখের পানিতে চোখ মুখ ভরে গেছে তার।চোখ লাল হয়ে আছে।পৃথিবীর সবচাইতে ভয়ঙ্কর জিনিস এই পেঁয়াজ।মানুষকে নিজের শক্তি দিয়েই কান্না করিয়ে ছাড়ে।রিঝ দরজার সাথে ঠেসে দাড়ায়।খোঁচা মেরে বলে,
“ আহারে যেতে পারবে না তাই কি কান্নাটাইনা করছে তুলাপাখি।”

তুতুল কড়া চোখে তাকায়।চোখ লাল।মুখ লাল।গালে পানি।তুতুলকে রিঝের মারাত্নক লাগছে।কাঁদলেও যেনো দারুন সুন্দর লাগে।তবে হাসির চাইতে না।রিঝ সামনে এগিয়ে এসে বলল,
“ এতো কান্না করে আর কি হবে??ফালতু সমুদ্র আর দেখা হবে না।তবে তুমি এক কাজ করো একটা মগ চোখের সামনে ধরে রাখো।নোনা পানি জমিয়ে জমিয়ে একদিন তুমি নিজেই সমুদ্র তৈরি করে নিতে পারবে।

তুতুল নাম মুখ ফুলিয়ে হাতের ছুরি রিঝের দিকে তাক করে। ছুরি গলার কাছে আসতেই রিঝ চমকায়।দ্রুত কয়েক পা পিছিয়ে যায় সে।চোখে মুখে ভয়ের একটা দারুন ছাপ নিয়ে বলে,
“ তুমি কি আমাকে খুন করবে না কি??আর তো শুধু এটাই বাকি আছে।”

বেশ সাবলিল ভঙ্গিতেই জবাব আসে,
“ হুম।খুন করে দিবো।দেখবেন রিঝ ভাই আপনার খুন আমার হাতেই হবে।”

চোখে একটা আবেগ আছে রিঝের।চশমার ফ্রেমের ভিতরে সেই চোখ ধরা পরে না তেমন।রিঝ চশমাটা নাকের ডগা থেকে ঠেলে ভালো করে পড়ে নেয়।চমৎকার একটা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলে,
“ খুন করবে??বেশ করো।বান্দা হাজির।”
“ সত্যি!!!কি দিয়ে করবো??এই ছুরি দিয়ে?? না কি হ্যান্ড স্যানিটাইজার খাইয়ে??”

রিঝ হাসে।তার কালো মোটা ভ্রুর একপাশে কাঁটা সাদা দাগ আছে।হাসার তালে সেই কাঁটা দাগে ভাজ পরে।চোখে চোখ রাখে।সেই চোখের ভাষা গভীর।এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে।সামনের ব্যক্তি ভড়কায়।বিচলিত হয়।বুকের পিনপিন শব্দে রিঝ আরো হাসে।তাক করা হাত খপ করে ধরে বসে।তুতুলের হাত বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আসে।রক্ত ঠান্ডা হয়।রিঝ হাতটা নিজের গলার কাছে নেয়।ছুরি গলায় লাগে।হয় তো ব্যথা পাচ্ছে।আর একটু কাছে এসে ঠান্ডা কন্ঠে বলে,
“ প্রেমিক মানুষকে খুন করতে হলে ছুরি,বোমা,গুলি বা পারমাণবিক বোমারও প্রয়োজন হয় না।শুধু একটু গভীর দৃষ্টি,আলতো ঠোঁটের হাসি,আর আর ঠোঁট ফুটে আবেগী কন্ঠে বলা ভালোবাসি শব্দেটাই যথেষ্ট।এতেই প্রেমিক সমাজ খুন হবে।মরন হবে অসংখ্য দীর্ঘশ্বাসের।”

রিঝ নিঃশ্বাস নিচ্ছে না।দম বন্ধ করে কথা বলছে।তুতুল তা বেশ টের পাচ্ছে।ধ্যান লাগার মত কন্ঠ।যেনো চুম্বুকের মতো টানছে এই দৃষ্টি।তুতুল নিজের বুকে হাত দেয়।পিনপিন একটা শব্দ।অদ্ভুত শব্দ!!ভয়ংকর ভাবে কানে বাজে সেই শব্দ।তুতুল চোখ ঝাকিঁয়ে উঠে।নিজেকে সামলে নিয়ে হাসার চেষ্টা করে।চোখ গোল গোল করে ঘুরিয়ে বলে,
“ ওহফফ্ আপনি তো মারাত্নক প্রেম বক্তা!!তাই তো বলি এতো এতো প্রেমিকা কেন আপনার।ভালো ভালো।”

তুতুল হাত নাচায়।রিঝ ছাড়ে না।তুতুল ভালো করে তাকিয়ে দেখে গলার কাছটায় ছুরির কোণা ঢুকে যাছে।লাল রক্ত দেখা যাচ্ছে।আতঙ্কিত হয়ে তাকায় তুতুল ।হাত আরো মচড়ায়।ফিসফিস করে বলে,
“ রিঝ ভাই আমি আপনার প্রেমিকা না।আমি তুতুল।হাতটা ছাড়েন।আপনার লাগছে।”

রিঝ শুনেনা কোনো কথা।নিঃশ্বাস বন্ধ মনে হয় এখনো।চোখ গভীর থেকেও গভীর হচ্ছে।দৃষ্টি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।আশ্চর্য্য সেই চাহনি!মারাত্নক তার ভাষা।উচ্চ শব্দে প্রেসার কুকার শিস বাজিয়ে উঠে।রিঝ চরম ভাবে চমকায়।হাত ছাড়ে দ্রুত।সরে আসে কয়েক পা।তুতুল হাসে।শব্দ করে।অনেক দিন পরের হাসি।এলোমেলো কোঁকড়া চুলগুলো দুলে।মুগ্ধ!!রিঝ চরম মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।এই চুল তার দুর্বলতা।এটা সে শিকার করতে বাধ্য।গলার কাছটায় যে হালকা কেঁটেছে সেটা এখনো সে টের পায়নি।পাবে বলে মনে হয় না।রিঝ হু হা করে হাসে।তুতুল এই হাসির অর্থ বুঝে না।রিঝ ছুরি হাতে নিয়ে চপিং বোর্ডে রাখা পেয়াজ হাতে নেয়।তুতুলের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ কথাগুলো আমার প্রেমিকার জন্য।সো তুমি ভড়কাচ্ছো কেনো??”

#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here