কৃষ্ণবেণী পর্ব -২৩

#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_২৩(১)
#নন্দিনী_নীলা

আয়ান একটু সুস্থ হয়েই বাড়ি থেকে গায়েব হয়ে গেছে। এমন অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় গেছে কেউ বুঝতে পারছে না। এদিকে জায়ানের এসবে কোন মাথা ব্যথা নাই। নিজের মতো থাকছে। এজন্য সবার সন্দেহ হচ্ছে জায়ান কে। আয়ান হঠাৎ গায়েব হ‌ওয়ার পিছনে জায়ানের হাত আছে নাকি?
জেসমিন বেগম ছেলের রুমের সামনে এসে পায়চারি করছে। ছেলের কাছে আয়ানের খবর কিভাবে জিজ্ঞেস করবে ভাবছে!
তিনি পায়চারি করছিল তখনি জায়ান দরজা খোলে বাইরে আসে। চমকে উঠে সটান দাড়িয়ে পরে‌ জেসমিন বেগম। জায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকায় জেসমিন বেগমের দিকে।
জেসমিন বেগম ঢোক গিলে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,” তুমি কি জানো আয়ান কোথায়? এই শরীর নিয়ে ছেলেটা কোথায় গেল। ফোন ও লাগছে না।”
” আপনার ছেলে কোথায় আমি কি করে জানবো?”
” এভাবে বলছো কেন ও তো তোমার ভাই। হঠাৎ উধাও হয়ে গেল তুমি একটু খোঁজ নিবে না?”
” সরি এতো বাড়তি সময় আমার কাছে নাই।”
জেসমিন বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,” আমার মনে হচ্ছে আয়ান উধাও হ‌ওয়ার পেছনে তোমার হাত আছে।”
জায়ান তাকালো জেসমিন বেগমের দিকে। তারপর রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলো। হেলেদুলে হেঁটে চলে গেল। জেসমিন বেগম জায়ানের মুখের ভঙ্গিমা দেখে শিউর হ‌লো আয়ানের নিরুদ্দেশ এর পেছনে জায়ানের হাত আছে।
___________________________

তৃষ্ণা অনেক দিন পরে কলে বাড়িতে কথা বলেছে। তখন জানতে পেরেছে সুজনের ব‌উ মারা গেছে। মেয়েটাকে না চিনলেও শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আহারে বিয়ে কয়দিন হলো এতেই মরে গেল। কি এমন হয়েছিল যে আত্মহত্যা করলো। বকুল তো বলার সময় কান্না করে দিয়েছিল। বকুলের সাথে যে ভালোই সম্পর্ক ছিল তা আসার পর ও বুঝেছে। অনেক কথাই বলেছিল বকুল তার হয়ে। তৃষ্ণা উদাস হয়ে বসে র‌ইলো। লাস্ট বার তো সুজন ভাই ওর সাথে খারাপ আচরণ করেছিল আচ্ছা তিনি কি ব‌উয়ের সাথেও খারাপ আচরণ করতো?
সেই কষ্টে কি আত্মহত্যা করলো?
আর সুজন ভাই ব‌উয়ের মৃত্যুতে পালিয়ে কেন গেল?
তৃষ্ণা আনমনে নানান কথাই ভাবছিল তখন বাইরে থেকে জায়ান আর জেসমিন বেগমের কথা শুনে ও দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনতে পায়।
তৃষ্ণা বেরিয়ে আসে রুম থেকে জেসমিন বেগম তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে হনহনিয়ে চলে যায়। তৃষ্ণা ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকিয়ে উষসীর রুমের দিকে যায়। উষসী রুমেই ছিল ও উঁকি মেরে চলে আসতে যাবে পেছনে ঘুরে তখন উষসী ওকে ডেকে উঠে। চমকে লজ্জা মুখে দাঁড়িয়ে যায়।
” আরে বাইরে থেকে চলে যাচ্ছ কেন? ভেতরে আসো।”
” না না ভেতরে যাব না।”
” আরে আসো তো।”
জোর করেই ভেতরে নিয়ে গেল উষসী তৃষ্ণা কে। তৃষ্ণা আয়ান আর উষসীর অনেক ছবি দেয়ালে টাঙানো দেখল। জরোসরো হয়ে সোফায় বসলো। উষসী নিজে থেকেই অনেক কথা বলে ভাব জমাতে চাইছে। তৃষ্ণা ও বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারল না। আড্ডায় মেতে উঠলো।
দুই জা এর মধ্যে এভাবে একটা বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে লাগল।
_________________________

আয়ান নিখোঁজ হয়েছে আজ এক সপ্তাহ হলো। বাড়ির সবাই সেই নিয়ে টেনশনে আছে কিন্তু জায়ানের নির্লিপ্ত ভঙ্গি দেখে সবাই ওকে সন্দেহ করে নিয়েছে কিন্তু এখনো মুখে স্বীকার করাতে পারেনি। এদিকে আয়ান নিখোঁজ এর কোন প্রভাব পরেনি উষসীর উপর। পার্টি আড্ডা মাস্তি নিজে মতো করেই যাচ্ছে।
এদিকে উর্মির পেছনে আঠার মতো লেগেছে আরিফ। ওদের দুজনের সম্পর্ক ঠিক করতে অনেক বার ঘুরতে বা লং ড্রাইভে যাওয়ার অফার দিয়েছে আরিফ কিন্তু উর্মি প্রথম বারের পর আর কখনোই দেখা করতে রাজী হয়নি। এমনকি আর জায়ান কে বলেও কাজ হয়নি জায়ান বলেছে,
” সব সময় বড় ভাই ধমক দিয়ে কি বোন কে প্রেম করতে পাঠাবে? তোমার নিজের উচিত ওকে মানিয়ে কোথাও নিয়ে যাওয়া।”
লজ্জা আর আরিফ কিছু বলার সাহস করেনি।
এদিকে জায়ান হঠাৎ একটা ফ্যামিলি ট্যুরের আয়োজন করলো। ট্যুরের কথা শুনে সবাই অবাক। আয়ান এখনো বাড়ির বাইরে। এর মধ্যে জায়ান ট্যুরের আয়োজন করলো। জেসমিন বেগম আজ স্বামীকে নিয়ে খাবার টেবিলে কথা তুললো। কিন্তু জায়ান উত্তর না দিয়ে খাওয়া শেষ করল।
উঠে দাঁড়ালো চলে যাবার জন্য তখন জায়ানের বাবা বলল,” হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলে কেন?”
” অনেকদিন কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। সবার মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। ঠিক করা দরকার সামনে বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে এই মেজাজ নিয়ে বিয়ে আয়োজনে কেউ মনোযোগ দিতে পারবে না।”
“কিন্তু আয়ান!”
” সময় মতো চলে আসবে।”
__________________________

আয়ানের দেখা মিলল ট্যুরে যাওয়ার দিন। আগের থেকে সুস্থ হাঁটতে পারে। শরীরে আঘাত না থাকলেও রোগা ও কালো হয়েছে আগের থেকে। যেন অনাহারে অযত্নে ছিল।
আয়ান নিজের রুমে এসে দেখল উষসী মিটিমিটি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু উষসীর দৃষ্টি ফোনে নিবন্ধ।
আয়ান উষসীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে উষসী আড়চোখে তাকিয়ে অবাক হ‌ওয়ার ভঙ্গিতে বলল,” এতো তাড়াতাড়ি বাসুরের দেওয়া শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে গেলে? আমিতো ভেবেছিলাম এইমাস তোমার দেখা পাবো না। সত্যি গো তোমার বিরহে খুব‌ই কাতর হয়ে গেছি দেখো চোখের পাড় কালো হয়ে গেছে। তোমার চিন্তায় আমার ঘুম উবে গেছিলো।”
” মশকরা করো আমার সাথে? আমি ছিলাম না এতে সব চেয়ে আনন্দিত হয়েছিলে তুমি তা কি আমি জানি না ভেবেছ!”
” জানলে তো জানোই আবার জিজ্ঞেস করছো কেন?”
” তুমি জানতে আমি বিপদে ছিলাম আর কোথায় কে রেখেছিল। সব তুমি জানতে তবুও হাত পা গুটিয়ে বসে ছিলে? ব‌উ হয়ে স্বামীর প্রতি কি এতটুকু ও টান নেই?”
উষসী বিছানায় থেকে উঠে দাঁড়ালো। আয়ানের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। আয়ানের গালে আঙুল স্পর্শ করে বলল,” ভালোই শাস্তি পেয়েছো তাই না? অন্য মেয়েদের দিকে বাজে নজর দেওয়ার চিন্তা ভাবনা এবার অন্তত বাদ দিও। আর টানের কথা বললে? তা পাওয়ার তুমি কিছু করেছো? উল্টো দিনের পর দিন ওয়াইফ রেখে ভাবি, বাইরের অন্যান্য মেয়েদের দিকে কু নজর দিয়েছো। এরপর তোমার প্রতি আমার কোন টান থাকবে?”
আয়ান থেমে গেল ভেতরে ভেতরে ও আক্রোশে ফুঁসছে। উষসী ওর ভাইয়ের সাথে হাত মিলিয়ে ওর সাথে এসব করছে। ভাইকে এর জন্য ভুগতেই হবে। কিন্তু তার আগে নিজের ঘর শত্রু উষসীর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আমাকে বিপদে ফেলে নিজে শান্তিতে ঘুমাবো তাই না।
” কি ওমন চোখে তাকিয়ে আছো কেন? আবার কোন শয়তানি বুদ্ধি আঁকছ?”
আয়ান হঠাৎ রাগী ভাব কাটিয়ে নরম সুরে বলল,” আমি এই কষ্টের মুহূর্তে বুঝতে পেরেছি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি। বাকিদের প্রতি আমার কোন ভালোবাসা নাই শুধু দৈহিক সৌন্দর্য দেখে আমি আটকে যেতাম কিন্তু মন থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
বলতে বলতে উষসীর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিলো। উষসী থতমত খেয়ে গেলো হঠাৎ আয়ানের পাল্টে যাওয়া সুর দেখে।
উষসী বুঝতে পারছে আয়ান ওকে পটানোর চেষ্টা করছে। উষসী ছাড়াতে হাত পা ছুঁড়ছে। আয়ান না ছেড়ে উষসী জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার বাক্য ছাড়তে লাগে। উষসী অস্বস্তিতে ঘাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এদিকে আয়ান শয়তানি হাসি দিচ্ছে আড়ালে। ওর মনে আবার কোন শয়তানি বুদ্ধি এলো সে শুধু আয়ান ই ভালো জানে।
________________________

তৃষ্ণা জায়ানের ভেজা চুল মুছে দিচ্ছে। জায়ান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তৃষ্ণা পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হাত নামিয়ে বলে,” আপনি এতো লম্বা কেন? তালগাছের মতো মাথা মুছতে গিয়ে আমার পায়ের পাতা ব্যথা হয়ে যায়।”
জায়ান ভ্রু কুটি করে বলল,” আমি তালগাছের মতো লম্বা?”
” হ্যা।” বলেই জিভ এ কামড় দেয়। আর সাথে সাথে বলে,” না মানে আপনি নিজেই যদি চুল মুছে নিতেন‌।”
” একদম স্বামী সেবা করায় গাফিলতি করবার চিন্তা ভাবনা করবে না।”
“আমি ওমন ব‌উ‌ই না আমি খুব লক্ষ্মী ব‌উ।”
” ওরে আমার লক্ষ্মী ব‌উ গো। পেছনে ঘুরে দাঁড়াও তোমার চুল আমি মুছে দেই। এখন থেকে আমার চুল তুমি মুছে দিবে। আর তোমার চুল আমি মুছে দেবো।”
তৃষ্ণা জায়ানের দিকে পিঠ করে দাঁড়ালো। জায়ান খুব সুন্দর করে চুল মুছে দিলো। ওভাবেই তৃষ্ণা কে ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিয়ে বসালো।
হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে তৃষ্ণার চুল শুকিয়ে দিলো। তৃষ্ণা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে। এটা আবার কেমন জিনিস। এখানে আসার পর জায়ান কে ব্যবহার করতে দেখেছে নিজে করেনি। আজ ওকেও ব্যবহার করাচ্ছে।
এখন জিজ্ঞেস না করেই তৃষ্ণা দেখেই বুঝতে পারলো এটা চুল শুকানোর যন্ত্র।
” চুল শুকাতে ও মেশিন যন্ত্র লাগে আল্লাহ। কিছুক্ষণ খোলা রেখে ফ্যানে বা রোদে বসলেই তো শুকিয়ে যায়।”
” তাড়াতাড়ির সময় কিছুক্ষণ ও ওয়েট করার উপায় থাকে না।” থেমে আবার বলল,
” যাও প্যাকিং করো একটু পর বের হবো আমরা।”
” আচ্ছা।”
তৃষ্ণা আলমারির খোলে সব পোশাক বের করতে লাগলো।
” আপনার কোন গুলো নেব?”
” তোমার পছন্দ মতো নিয়ে নাও। আমি বাইরে যাচ্ছি।”
জায়ান বাইরে চলে গেল। তৃষ্ণা নিজের শাড়ি ব্যাগে ভরে নিচ্ছে। জায়ানের গুলো নিতে গিয়ে দুটানায় ভুগছে যদি আবার বকে। এটা পছন্দ না হয়। অনেক সময় নিয়ে একটাও নিলো না জায়ানের সব শার্ট প্যান্ট বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলো।

এদিকে আয়ান এই ট্যুরকে নিজের একমাত্র অস্ত্র বানিয়ে নিয়েছে। বড় কিছু অঘটন না ঘটিয়ে বাসায় ফিরবে না বলেই প্রতিজ্ঞা করে নিলো। ওর উপর হ‌ওয়া সব অন্যারের প্রতিশোধ ও নিবেই।
#চলবে??#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_২৩(২)
#নন্দিনী_নীলা

” হাই মিস কি করছেন?”
দরজার পাশে থেকে অচেনা পুরুষ কন্ঠস্বর শোনে চমকে উঠে উর্মি। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছিল ট্যুরে যাওয়ার জন্য। তখনি কেউ দরজায় হেলান দিয়ে কথা বলে উঠে। ও চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে দেখে আরিফ হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আরিফের হাসি দেখেই ওর রাগে গা জ্বলে উঠে। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে,’ বেয়াদব’

আরিফ কপাল কুঁচকে বলেন,” আমাকে গালি দিলেন?”

উর্মি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে,” আপনি এখানে কি করছেন এই অসময়ে?”

” হবু শশুর বাড়ি আসতে আবার সময় অসময় লাগে বুঝি? যখন আসবো তখনি পারফেক্ট টাইম।”

উর্মি জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলে,” রং জায়গায় এসেছেন।এটা আপনার হবু শশুর বাড়ি নয়। বিদায় হোন। এখন আমরা সবাই ফ্যামিলি ট্যুরে যাব।”

” সরি হবু ব‌উ। আমি আপনাদের সাথে যাচ্ছি ট্যুর দিতে।”

উর্মি চেঁচিয়ে বলল,” হোয়াট? আপনি কেন যাবেন? আপনি কি আমাদের ফ্যামিলির কেউ? পরিবারের সবার মধ্যে বাইরের মানুষ নট এলাও।”

“বাইরের কেউ এলাও না জানি। আর আমি কোন বাইরের কেউ নয়। আমি এই বাড়ির হবু জামাই। সো আমার যাওয়া হচ্ছে।”

” হ–বু জামাই। কথার মধ্যে হবু আছে তাই আপনি এখনো পরিবারের কেউ হোন নাই। বিদায় হোন।”

আরিফ কথাটা শুনেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একদম উর্মির কাছে চলে এলো কিন্তু কোন স্পর্শ করল না। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,” চলেন এখনি কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে হবু শব্দটা বাদ করে দেই।”

” এতো বিয়ে করার শখ তো এখানে আসছেন কেন? অন্য জায়গায় যান। আপনাকে আমি ভালো ভাবছিলাম।‌ আপনি তো দেখছি একটা ছ্যাচড়া।”

” অবুঝ ভেবে ক্ষমা করে দিলাম যান।”

উর্মি রাগে বলল,” আপনি যাবেন এখানে থেকে।”

” এখনো আপনার রুমে থাকার মতো অনুমতি পাই নি। যেতে তো হবেই। আচ্ছা আসেন। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।”

আরিফ বেরিয়ে এলো। উর্মি ব্যাগ থেকে সব পোশাক বের করে ফেলল। যাবেই না ও।
” ভাইয়া ওই ছ্যাচড়া লোকটাকে ও নিয়ে যাচ্ছে। ধুর আমিই যাব না।”

বাড়ির সবাই আয়ান কে জিজ্ঞেস করেছে কোথায় ছিল এতো দিন। আয়ান কোন উত্তর দেয় নি শুধু রাগী চোখে তাকাচ্ছিলো জায়ানের দিকে। সবাই গাড়িতে উঠে বসেছে। বাকি শুধু উর্মি। তৃষ্ণা উর্মি কে নিতে এসে দেখল সব কিছু খোলে বসে আছে। যাবে না। সে কারণে জিজ্ঞেস করলেও বলছে না। তৃষ্ণা তোষামোদ করে ব্যর্থ হয়ে জায়ান কে বলল সব। জায়ান উর্মির না যাওয়ার কারণ ধরে ফেলল নিমিষেই।

” উর্মি এসব কি রেডি হ‌ও নি কেন যাবে না?” জায়ান রাগী গলায় বলল।

” ভাইয়া আমি যাব না।”

” প্রবলেম কি?”

” কোন সমস্যা নাই। তোমরা চলে যাও আমাকে জোর করো না।”

” তুমি কিন্তু এখন বেশি বাড়াবাড়ি করছো। কার জন্য এমন নাটক করছো বুঝতে পারছি না ভাবছো। কান খুলে শুনে রাখো তোমার বিয়ে আরিফের সাথেই হবে আর সেটা ট্যুরে থেকে ফিরেই। তাই ওর সাথে কোন রকম খারাপ বিহেভ না করে ভালো আচরণ করো। ওকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করো। দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নিচে আসবে। এক সেকেন্ড লেট যেন না হয়।”
বলেই জায়ান হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
________________________

গোমড়া মুখে উর্মি বাইরে আসতেই গাড়ি ছেড়ে দিলো।
সবাই নিজেদের গাড়িতে উঠে বসেছে। উর্মি এসে নিজের গাড়িতে আরিফ কে দেখে রাগে দুঃখে কান্না করতে চায়। কিন্তু পারে না। সামনে জোভান বসেছে ও পেছনে গিয়েই বসলো।
আরিফ দূরত্ব রেখেই বসে আছে। ওর দিকে তাকায় নি। ফোন টিপছে আর এক দুইবার সামনে তাকিয়েছে। এদিকে উর্মি রাগী চোখে কয়েকবার তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ করে বসে র‌ইল।

তৃষ্ণা শাড়ির আঁচলে আঙুল পেছাচ্ছে আবার খুলছে। কিছু জিজ্ঞেস করতে উশখুশ করছে খুব। কিন্তু জায়ানের শক্ত চোখ মুখ দেখে সাহস পাচ্ছে না। একবার নিজের আঙুলের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার জায়ানের দিকে তাকাচ্ছে।

” কি বলতে চাও বলো। ”

তৃষ্ণা চোখ কপালে তুলে তাকালো জায়ানের দিকে। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল,” আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি কিছু বলতে চাইচ্ছি?”

জায়ান তৃষ্ণার গাল টেনে দিয়ে বলে,” ম্যাজিক।”

” আমিও এই ম্যাজিক শিখতে চাই!” অবুঝ গলায় বলল তৃষ্ণা।

জায়ান বললেন,” এটা শিখতে হলে ভালোবাসার রোগে আক্রান্ত হতে হবে।”

তৃষ্ণা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে। জায়ান তৃষ্ণার হাত ধরে কাছে টেনে হাতের উল্টো পিঠে চুমু দিয়ে বললেন,” বলো।”

” আমার মনে হয় উর্মি আপু আরিফ ভাইয়া কে পছন্দ করে না। উনি তো মিহির ভাইকে পছন্দ করতো তাই বলছিলাম কি যদি…..

বলতে বলতে তৃষ্ণা থেমে গেল জায়ানের চোখ মুখ লাল হয়ে আসছে দেখে ভয়ে। তৃষ্ণা আবার কথা চেঞ্জ করে বলল,” আপনি যা করছেন আপুর ভালোর জন্য। আমি একটু বেশিই কথা বলি। আমি আর কোন বাড়তি কথা বলব না আপনি রাগ করবেন না প্লিজ।”

জায়ান তৃষ্ণার কথা শুনে আচমকাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে তৃষ্ণা কে ছেড়ে দিয়েছে।
তৃষ্ণা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে হাসলে কত সিগ্ধ লাগে। তৃষ্ণা গালে হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। জায়ান হাসি থামিয়ে সিটে হেলান দিয়ে আছে। হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে গেছে।

ওভাবেই তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলল,” এতো ভয় পাও?”

ঘোর থেকে বেড়িয়ে এসে বলল,
” আপনি মানুষটা খুব রাগী‌। রেগে গেলে ভয়ংকর হয়ে যান। আমার খুব ভয় লাগে তখন।”

” আমার রাগ তুমি বুঝতে পারো?” অবাক গলায় বলল।

” হুম পারি তো। রাগলেই আপনার মুখটা ভয়ংকর হয়ে যায়।”

“ভালোবাসা হচ্ছে তাহলে!” বিরবির করে বলল।

তৃষ্ণা শুনতে কাছে এগিয়ে এসে বলল,” কি বললেন শুনতে পাইনি।”

জায়ান তৃষ্ণার বাহু ধরে টেনে নিজের বুকের উপর তৃষ্ণার মাথা চেপে ধরে বলল,” হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে গেছি। একটু রেস্ট করি আসো।”

” আপনাকে হাসলে অনেক সুন্দর লাগে।”
লজ্জা মাখা গলায় বলল তৃষ্ণা। তৃষ্ণার কথা শুনে জায়ানের ঠোঁটের কোনে আবার ও হাসি ফুটলো।
____________________________

এদিকে আয়ান খুব ভালো বিহেভ করছে উষসীর সাথে। উষসী এই শয়তান টার এতো ভালো আচরণ হজম করতে পারছে না। কিছু তো শয়তানি বুদ্ধি আঁকছেই কিন্তু ধরতে পারছে না ও। গায়ে গা লাগিয়ে বসতে চাইছে। উষসী দূরত্ব করলেও সে যেন কাছেই থাকতে চাচ্ছে।

” তোমার মনে কি শয়তানি প্লান ঘুরছে বলো তো? আমার সাথে কেন ভালোবাসার অভিনয় করছো?”

আয়ান নরম সুরে বলল,” বিলিভ কর‌। আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি। আমি শুধরে গেছি।”

” তোমার মতো মানুষ কে বিলিভ করবো তাও আমি কখনোই না।”

” দেখ কত অত্যাচার করেছে জায়ান আমাকে। না খাইয়ে রেখেছে। পানির তৃষ্ণায় আমি ছটফট করেছি আর ও আমাকে এক ফোঁটা পানিও দেয় নি। যে তোমার স্বামীকে এতো ভয়ঙ্কর শাস্তি দিয়েছে তার জন্য তুমি আমাকে অবহেলা করবে?”

” তুমি নিজের পাপের শাস্তি পাইছো। এখানে আমি কি করব। আমি যে এখনো তোমার সাথে আছি এটাই তোমার ভাগ্য। একদম আমার সাথে ভালোবাসা বাসি দেখাতে আসবে না। তুমি যে এক নারীতে সন্তুষ্ট নয় সেটা আমার থেকে কেউ ভালো জানে না। শত নারীর দিকে খারাপ দৃষ্টি দেওয়া তোমার জন্মগত দোষ।”

আয়ান চোখ মুখ শক্ত করে উষসীর কথা হজম করছে। মন তো চাচ্ছে এখানেই এইটা কে কিছু করে দিতে। কিন্তু এখন ওর সব কিছুই সহ্য করতে হবে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করে আবার কিছু বলতে লাগলো। উষসী অবাক হয়ে গেছে এতো কথা বলল ও তাও আয়ান ওকে কিছু বলল না। উল্টো হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে।

ওর অবাক করা মুখের দিকে তাকিয়ে আয়ান বলল,” আমি এসব শোনার যোগ্য। তুমি বলে নিজের মনকে শান্ত করো।”

উষসীর মাথার ঘুরে উঠবে এমন লাগছে। এতো ভালো আয়ান হতেই পারে না। এতো ভালো অভিনয় করছে কি করে?
_________________________

দীর্ঘ জার্নির পর সবাই গন্তব্যে এসে পৌঁছেছে। সাইরু হিল রিসোর্ট বান্দরবান। অপরুপ সৌন্দর্যের মধ্যে অন্যতম একটি রিসোর্ট। জায়ান এই রিসোর্ট ঠিক করেছে সবার জন্য। ক্লান্ত শরীর নিয়েই সবাই রিসোর্ট এ প্রবেশ করল। এতো জার্নি তৃষ্ণা খুব কম‌ই করেছে। এজন্য ক্লান্তে নেতিয়ে গেছে।
জায়ান তৃষ্ণাকে এক হাতে নিজের সাথে মিশিয়ে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করল।
আরিফ সারা রাস্তায় একটা কথাও বলেনি উর্মি কে এমনকি তাকায় ও নি উর্মির দিকে।
উর্মি আরিফ এর বিহেভিয়ার এ হতভম্ব হয়ে গেছে। এখনো গাড়ি থেকে নেমেই হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেল। জোভান আর আরিফ এর জন্য এক রুম ঠিক করা হয়েছে। আরিফ সেই রুমেই চলে গেছে। পেছনে থেকে উর্মি আরিফের ভাব দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেছে।

ও আনমনেই বলে উঠলো,” নির্লজ্জ লোকটার হঠাৎ এতো ভাব কোথা থেকে উদয় হলো!!”

জোভান পেছনে থেকে উর্মি কে ধাক্কা দিয়ে বলল,” কি হয়েছে?”

” আরিফ লোকটা ছ্যাচড়ামি ছেড়ে ভাব দেখাচ্ছে!”

” তোর কি তাতে? তুই তো তাকে পছন্দ করিস না। তাকে নিয়ে এতো কিসের ভাবনা?”

” ভাবছি না অবাক হচ্ছি। যাইহোক ভালোই হয়েছে তার জন্য আসতে চাইছিলাম না। তিনি আমার পেছনে না থাকলে আমি শান্তিতে একটু আনন্দ করতে পারবো।”

” শোন তোর সাথে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার আছে। রেস্ট করে নে তারপর বলব। সাথে একটা সারপ্রাইজ পাবি।”

উর্মি অবাক স্বরে বলল,” তুই আমাকে সারপ্রাইজ দিবি? স্বপ্ন দেখছি না তো?”

” এখন রুমে যা ফ্রেশ হ। সময়মতো পেয়ে যাবি।”
_________________________

ডিনারের পর জোভান উর্মি কে নিয়ে রিসোর্ট এর বাইরে আসলো। উর্মি জোভানের পকেট ও এদিক ওদিকে তাকিয়ে বলল,” আমার সারপ্রাইজ ক‌ই? এই তুই মিথ্যে বলেছিলে?”

জোভান উত্তর না দিয়ে ফোনে কারো নাম্বার উঠিয়ে কল দিলো।
উর্মির রাগ বাড়ছে কথার উত্তর দিচ্ছে না আবার কাউকে কল করছে। রাগে ও ফোন ছিনিয়ে নিয়ে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু ফোন নিতে পারল না। জোভান সরিয়ে কল দিয়ে ফেলল।

” এ্যাই তুই কাকে ফোন দিচ্ছিস?”

” মিহির কে ”

চঞ্চল উর্মি থমকে দাঁড়িয়ে পরলো। অবিশ্বাস্য চোখে বলল,” মিথ্যা বলছিস?”

” নো সত্যি মিহির কে কল দিছি।”

” তুই তার নাম্বার কোথায় পেলি?”

” যোগাড় করেছি!”

” কেন?”

” তোর খুশির জন্য?”

” এসব ভাইয়া জানলে কি হবে ভাবতে পারছিস?”

” নিজের চিন্তা কর। কি হবে না ভেবে।”
ফোন রিসিভ হতেই জোভান ফোন এগিয়ে দিলো উর্মি কে,” নে কথা বল।”

উর্মি ফোন নিলো কিন্তু কথা বলল না কল কেটে দিলো।
” এটা কি করলি?”

” মিহির আমাকে পছন্দ করে না। তার সাথে আমি কথা বলে আর তাকে ডিস্টার্ব করতে চাই না। আমার জন্য তাকে আর কখনো কল করবি না।”

” তাহলে কি ভাইয়ার পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করতে রাজি তুই?”

” আমি কোন কিছু তেই রাজি নয়। কিছুতেই না।”

বলেই কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। মিহির ওকে ভালোবাসলে ওর এই কষ্ট ভোগ করতে হতো না কেন ওই পাষাণ হৃদয়ের মানুষটাকে ভালোবেসেছিল!!

#চলবে?
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here