কৃষ্ণময়ীর অলংকার পর্ব -২১+২২

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২১

আকাশে পূর্ণ চন্দ্র। তাকে কে ঘিরে রয়েছে অগণিত তারকারাজি। জোছনার আলোয় প্রকৃতি নিজেকে করে তুলেছে মোহময়ী । মায়াবী রাত বুঝি একেই বলে। একেই হয়তো বলে চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙা আলো। চাঁদের আলোয় সাদা গোলাপ গুলোকে মনে হচ্ছে আরও বেশি স্বচ্ছ। আরও বেশি পবিত্র। মোহময়, আবেদনময়ী।
তপা পলকের দিকে তাকাল। এক চাঁদের উপর পড়েছে অন্য চাঁদের বাঁধ ভাঙা আলো। হলুদ ফর্সা রঙটা চাঁদের আলোয় আরও আকর্ষণীয় লাগছে।
পলক মোলায়েম গলায় বলল,
“কি দেখছো?”
তপা বিনা দ্বিধায় বলল,
“আপনাকে আকাশের ওই পূর্ণ চাঁদের মতো লাগছে।”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“আমার কাছে তুমিও আমার আকাশের চাঁদ।”
তপা একটু হাসল। বলল,
“হ্যা, অর্ধ চাঁদ।”
পলক তপার চোখের দিকে তাকাল। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তপা তার দিকেই তাকিয়ে আছে এখনো।
গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“তুমি কি জানো, পূর্ণ চাঁদের চেয়ে অর্ধ চাঁদ আরও বেশি মায়াবী।”
তপা হাসল। প্রাণ খোলা হাসি। পরক্ষণেই পলকের চাহনিতে লজ্জা রাঙা হয়ে গেল। ওষ্ঠকোণে ধরা পড়ল লাজুক হাসি।

” তখন গোধূলি লগ্ন। প্রতিদিনের মত সেদিনও আমি ছাদে এসেছিলাম। দেখছিলাম নীল আকাশের নতুন বধূর ন্যায় লাজে রাঙা রূপ। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার জন্য এর থেকেও হাজার গুণ বেশি রূপ নিয়ে যে কেউ ছাদেই অপেক্ষা করছিল আমি ঘূনাক্ষরেও টের পাইনি। অবশ্য অপেক্ষা করছিল বলা যায় না। বরং সেদিনের পর আমিই প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করে গেছি তার জন্য।”

তপা কৌতুহলী নজরে তাকিয়ে আছে পলকের দিকে। পলক তা দেখে মুচকি হাসল। পুনরায় বলল,
“এক এলোকেশী রমনী তার সদ্য ভেজা চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে এসেছিল এইখানটায়। ভেজা জামাকাপড়গুলো কোনো রকম মেলে দিয়েই চলে গিয়েছিল অন্দরমহলে। সাথে নিয়ে গিয়েছিল আমার মনটা। রেখে গিয়েছিল আমার ভগ্নহৃদয়টা। সেদিন তার এলোকেশ হতে টপটপ করে পরা জলকণা গুলো কেবল জলকণা ছিল না। বরং সেগুলো ছিল আমার জন্য একেকটা কালো যাদুর মন্ত্রোচ্চারণ। যা প্রতিনিয়ত বশীভূত করে রেখেছে আমাকে। সেদিনই প্রথম এ হৃদয়ে বসন্ত এসেছিল। আটাশ বছরের জীবনে সাতাশটা বসন্ত কেবল পাতা ঝড়া বসন্ত হলেও সেদিনই প্রথম ফুল ফুটেছিল এই হৃদয় বাগিচায়। যা আজ বিশালাকার বাগানে রূপান্তরিত হয়েছে। আমার হৃদয় বাগিচার ফোঁটা সুদৃশ্য ফুলটা আজ আমার বউ। আমার অর্ধাঙ্গিনী।”

তপা চোখ পিটপিট করে তাকাল। মনে পড়ে গেল এই বাসায় আসার পরের কিছুদিনের কথা। মনে হতো কেউ আছে। কেউ দেখছে তাকে। ভয় হতো। অস্বস্তি হতো। কিন্তু নিজেকে সাহস দিতো। নিজের মন কে ভাবাতো ওটা ভালো মানুষ। সত্যি সত্যিই যে ভালো মানুষ ছিল সেটা আজ বুঝতে পারল।
এই লোকটা তাকে এতটা ভালবাসে কি করে তা বুঝতে পারে না তপা। কি করে এতটা ভালবাসা যায়? এরকম নিঃস্বার্থ ভালবাসা সইবে তো তার পোড়া কপালে? তার চার আঙুল কপালে যে সুখ সয় না।

“আমায় আমার অধিকার দেবে বউ?”
পলকের এহেন কথা শুনে তপার দম বন্ধ হয়ে আসল। এতক্ষণ ভুলে গেলেও আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল বাসর রাতের কথা। গায়ের লোমকূপ শিরশির করে উঠল।
তপাকে ভড়কে যেতে দেখে পলক মৃদু হেসে বলল,
“ভয় পেলে?”
তপা মুখ তুলে চাইল।
ছাদের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে পাশাপাশি বসা সদ্য বিবাহিত দম্পতি। আকাশে পূর্ণিমা চাঁদ। চাঁদের আলোয় সাধারণ প্রকৃতিও অন্য রূপে সেজেছে।

কোমর চেপে কাছে টেনে গায়ের সাথে গা মিলিয়ে বসল পলক। তপা সরে যেতে চেয়েও পারল না। একটা হাত তখনও শক্ত করে ধরে আছে কোমরের একপাশ। তপা মোচড়ামুচড়ি করছে দেখে পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“সাপের মত মোচাড়ামুচড়ি করছো কেন?”
তপা ফোস করে শ্বাস ফেলল। কিছু বলার আগেই পলক পুনরায় বলল,
“আবার সাপের মতো ফোস ফোস করে নিশ্বাস নিচ্ছো। ব্যাপার কি তোমার? তুমি কি আমাকে ভয় দেখিয়ে আমার বাসর ভন্ডুল করতে চাইছো?”
তপা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। বলল,
“আপনি আসলেই একটা ইতর প্রজাতির প্রাণী।”
পলক শব্দ করে হাসল। ঠোঁটে হাসির পরশ রেখেই বলল,
“জানি তো। এর আগেও বলেছো। আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি তোমাকে বাচ্চা বলেছিলাম সেজন্য রেগে গিয়ে বলেছিলে।”
তপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“আপনি সেদিন বাচ্চা বলাতে রেগে গিয়েছিলাম। কেন জানেন?”
পলক একহাতে তপা কে জড়িয়ে বুকের একপাশে এনে বলল,
“সেদিন না জানলেও এখন জানি। ছোটবেলায় কাউকে কিছু বলতে চাইলে সবাই বাচ্চা মনে করে কথার গুরুত্ব দিতো না সেজন্য তাই না?”
তপা মাথা দুলিয়ে সায় জানালো।
পলক মৃদু স্বরে বলল,
“আসলে সমস্যা তোমার বাচ্চা বয়সের জন্য নয়। সমস্যাটা তোমার অসহায়তার ছিল। তোমার নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত থাকলে তোমার ওই বয়সের কথারও গুরুত্ব দিতো সবাই । তোমার ভিতটাই যে নড়বড়ে ছিল। তবে আর নয়। এখন তোমার জন্য শক্তপোক্ত খুঁটি আছে। স্বয়ং পলক তাজওয়ার। তোমার দিকে আঙুল তুলে দাঁড়ানোর সাহসও কেউ করবে না। যদি তুলেও তবে আঙুল কাঁটার দায়িত্ব আমার। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।”
তপা বুক থেকে মাথা তুলে পলকের মুখের দিকে তাকাল। আবছা আলোয় অস্পষ্ট মুখটা দেখার বৃথা চেষ্টা করে বলল,
“মিস্টার তাজওয়ার।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমি তোমার অফিসের বস?”
তপা কিছু বুঝতে না পেরে বলল,
“মানে?”
পলক তপার থেকে একটু সরে বসার চেষ্টা করে বলল,
“এইযে মিস্টার তাজওয়ার বলো সব সময়। এটা তো বস কেই বলে তাই না? স্বামী কে কেউ এভাবে বলে? স্বামী কে ভালবেসে ডাকতে হয়। ভালবেসে ডাকো।”
তপা ঠোঁট টিপে হাসল। মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি কিলবিলিয়ে উঠছে তার। আদুরে কণ্ঠে বলল,
“ওগো শুনছো।”
পলক আকষ্মিক ডাকে খুকখুক করে কেশে উঠল। তপা পলকের অপ্রস্তুত হওয়া দেখে খিলখিল করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। শেষে নিজেকে সামলে নিতে পলকের বুকেই লেপ্টে গেল।
পলক তপার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরল। ভাল লাগছে তার এভাবে তার কৃষ্ণময়ীকে দেখতে। হাসি আনন্দ দুঃখ সব কিছুতেই তো তার কৃষ্ণময়ীকে বুকে আগলে রাখতে চায়। ভাল বাসতে চায়। অতি যত্নের সাথে হৃদয়ের মণিকোঠায় লুকিয়ে রাখতে চায়।

“কৃষ্ণময়ী।”
“হুম।”
“আমায় অধিকার দেবে? তোমার ওই এলোকেশের উপর একচ্ছত্র অধিকার। যাতে ইচ্ছে করলেই ছুঁয়ে দিতে পারি এই দুটো হাত দিয়ে, চুমু একে দিতে পারি এই ঠোঁট দিয়ে। চাইলে যখন তখন দেখতে পারি এ দু নয়ন দিয়ে। দেবে?”
তপা একহাতে পলকের পেটের কাছের শার্ট আঁকড়ে ধরে বলল,
“আমার পুরোটাই আপনার। আপনি চাইলে আমি বাঁধা দিতে পারি না।”
“আমি তোমাকে চাইব। পুরোটাই চাইব। তবে সময় হলে। আজ নয়। তাই একটু পর পর ভয়ে শিউরে না উঠে সহজ হও। কেমন?”
তপা লজ্জা পেয়ে একটুখানি হাসল। পলক পুনরায় বলল,
“কি হলো দেবে অধিকার?”
তপা একহাতে হাত খোঁপা খুলে কেশরাশি পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে দিয়ে বলল,
“লিখে দিলাম আজ থেকে আপনার নামে।”
পলক কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে নাক ডুবালো নিকষ কৃষ্ণ আধারের ন্যায় কেশরাশিতে। কেটে গেল কিছু মূহুর্ত। দম বন্ধ করা কিছু অনূভুতি প্রবণ সময়।

“আমি কিছু বলতে চাই।”
পলক তপার চুলের নেশা থেকে বেরিয়ে এলো । ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
“বলো কৃষ্ণময়ী।”
“আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই মিস্টার তাজওয়ার।”
পলক মৃদু স্বরে বলল,
“বাঁধা দিচ্ছে কে?”
“আপনি।”
পলক অবাক হলো। চোখ ছোট ছোট করে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমি? কখন? কিভাবে?”
তপা আলতো হাতে পলকের ভ্রুকুটি স্পর্শ করে বলল,
“এই যে এখন। এভাবে বিয়ে করে।”
“বিয়ে করে তোমার নিজের পায়ে দাঁড়াতে বাঁধা দিচ্ছি আমি?”
“ঠিক তা নয়। তবে… ”
পলক তপাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গালে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে বলল,
“তবে কি কৃষ্ণময়ী? আমাকে বুঝিয়ে বলো। না বললে তো আমি বুঝতে পারব না।”
তপা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি জানি আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু আমি চাই আগে আমি নিজের পায়ে দাঁড়াই। তারপর আপনি বাড়িতে জানান আমাদের বিয়ের কথা। আগে আমি নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে চাই মিস্টার তাজওয়ার।”
পলক মুচকি হাসল।
“তুমি এটা বলতে এত হেজিটেড করছিলে? তুমি যা চাইছো সেটাই হবে। তবে আমার বাবা মা খুব কঠোর শ্বশুর শ্বাশুড়ি হবে না। তারা তোমাকে সাদরেই গ্রহণ করবে। আর তুমি যদি লেখাপড়া শেষ করতে নাও চাও আমার মা তোমাকে জোর করেই পড়াবে। দেখলে বুঝতে পারবে। তোমার অতীতটা আমি বদলাতে পারব না। কিন্তু আল্লাহ চাইলে ভবিষ্যতটা রঙিন করার দায়িত্ব আমি নিতে পারি। ভরিয়ে দিতে পারি তোমার জীবন ছোট ছোট খুশিতে, আনন্দে, আহ্লাদে।”

বিবাহ পরবর্তী দিনের ঊষালগ্ন। পূব আকাশ রক্তরাঙা আলোয় আলোকিত। পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ কমলা আভায় ছেয়ে গেছে। খোলা আকাশটাকে মনে হচ্ছে সুবিশাল মাঠ। যার কিঞ্চিৎ দুরত্বেই অবস্থান করছে জলন্ত আগ্নেয়গিরি। পূব আকাশের লার্ভা থেকে অগ্নি বলয় ছড়িয়ে পড়ছে পুরো অন্তরিক্ষ জুড়ে।
খোলা আকাশের নিচে ছাদের মেঝেতে মাদুর পেতে রেলিংএ হেলান দিয়ে শুয়ে আছে পলক। তার বুকেই আস্টেপিস্টে জড়িয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন তপা।
মুখের উপর আলোর আভাস পেতেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল পলক। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে নিজের অবস্থান বুঝতে পারতেই বক্ষস্থলে বয়ে গেল মাতাল সমীরণ।
তপার মাথায় ঠোঁট ঠেকিয়ে আরও একটু গভীরতা তৈরির জন্য হাতের বাঁধন দৃঢ় করতেই তপা নড়েচড়ে উঠল। হাই তুলে নিজেকে কারো শক্ত বন্ধনে আবিষ্কার করতেই চট করে উঠে বসল।
পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
তপা পলকের চাহনি দেখে মাথা নিচু করে বলল,
“আসলে আমি ভুলে গিয়েছিলাম বিয়ের কথা।”
পলক চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“এখন মনে পড়েছে?”
তপা মাথা নাড়াল।
“তাহলে দূরে কেন? এসো আমার সকাল টা মিষ্টি করে দাও।”
তপা চোখ ছোট ছোট করে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
পলক তা দেখে নিজেও ভ্রুকুটি করে বলল,
“তুমি আবার আমাকে কুঁচকানো ভ্রু দেখাচ্ছো। দাঁড়াও হচ্ছে তোমার আজকে।”
তপা সরে গিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে বলল,
“নতুন জীবনের প্রথম সকালের শুভেচ্ছা মিস্টার তাজওয়ার।”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“শুভেচ্ছা আপনাকেও মিসেস তাজওয়ার।”
তপা মুচকি হাসল। উল্টো ঘুরে এলোচুলগুলো গুছিয়ে হাত খোঁপা করতে করতে পা চালিয়ে ঢুকে পড়ল অন্দরমহলে।
পুরোটা ভেতরে ঢুকে আবার একটুখানি মাথা বের করে বলল,
“আমি নাশতা রেডি করছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

পলক মাথা চুলকে হাসল। নিজেকে বিবাহিত বিবাহিত মনে হচ্ছে তার। কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে বসে রইল। চোখ তুলে নিজের শারীরিক কসরতের জিনিসপত্রের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
“নাহ, অনেক অনিয়ম হয়ে গেছে। এবার নিজের ফর্মে ফিরতে হবে মিস্টার তাজওয়ার। নিজের ফিটনেস ধরে রাখার জন্য হলেও ব্যায়ামাগারের দিকে নজর দিতে হবে। নইলে বউ পাত্তা দিবে না। গেট রেডি মিস্টার তাজওয়ার।”

সপ্তাহ খানেক পর। তপা ক্লাস শেষে ইউনিভার্সিটি গেইটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল পলকের। দেরি দেখে বারবার বা হাতে পরে থাকা ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর ব্যাগ হাতড়ে ফোন বের করল। কিন্তু পলকের নাম্বার ডায়াল করার আগেই চোখ আঁটকে গেল সামনে দাঁড়ানো মানুষটার ওপর।
অস্ফুট স্বরে কণ্ঠ নৃঃসৃত হলো একটি শব্দ।
“বাবা।”
মূহুর্তেই আঁখি পল্লব ভিজে উঠল নোনাজলে। নিজেকে সামলাতে বার কয়েক অক্ষিপল্লব ঝাপটে খিঁচে বন্ধ করে ফেলল নেত্রযুগল।

মনকে কঠোরতায় মুড়ে দিয়ে বিরবির করে বলল,
” আমি এই লোকটাকে চিনি না। চিনি না। বাবা বলে আমার কখনো কেউ ছিল না। আজও নেই। হবেও না কখনো।”
#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২২

রাস্তার উল্টো পাশে রিকশা দাঁড়ানো দেখে তপা সামনের মানুষটিকে উপেক্ষা করেই এগিয়ে যেতে চাইল রিকশার কাছে। পলক তখনও আসে নি। তপা ব্যস্ত হয়ে কয়েক কদম ফেলতেই পেছন থেকে তার বাবা আজমল হোসেন ডেকে উঠলেন।
“তপা দাঁড়া মা।”
তপা দাঁড়ালো। একজন মানুষ এভাবে ডাকলে উপেক্ষা করা যায় না। যতই হোক সে অপছন্দের মানুষ বা দূরের মানুষ। এ তো স্বয়ং জন্মদাতা। দাঁড়ালেও পেছনে ফিরল না তপা। উল্টো হয়েই রইল।
আজমল হোসেন এগিয়ে এসে তপার সামনে দাঁড়ালো। বলল,
“ভাল আছিস মা?”
তপা তাচ্ছিল্য হেসে বিরবির করে বলল, “মা! হাস্যকর। বড়ই হাস্যকর।”
পরক্ষণেই কঠিন গলায় বলল,
“খারাপ থাকার কথা ছিল কি?”
আজমল হোসেন এ ব্যাপারে কিছু বললেন না আর। কথা ঘুরিয়ে বললেন,
“তোর মা অসুস্থ। ”
তপা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“মৃত মানুষ অসুস্থ হয় কি করে?”
“তোর নতুন মা।”
তপা খানিকটা উঁচু স্বরে বলল,
“খবরদার। ওই মহিলাকে মোটেই আমার মা বলে সম্মোধন করবেন না। সে কেবল আপনার স্ত্রী। আমার মা বহু আগেই আমাকে ছেড়ে, এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে।”
আজমল হোসেন চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
তপা পুনরায় বলল,
“আপনার স্ত্রী অসুস্থ তা শোনাতে আপনি নিশ্চয়ই এখানে আসেন নি। কেন এসেছেন সেটা বলে আমার রাস্তা ছাড়ুন।”
আজমল হোসেন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“এ কি ভাষায় কথা বলছিস তুই আমার সাথে? আমি তোর বাবা।”
তপা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“ভাগ্যিস মনে করালেন। আমার তো মনেই ছিল না।”
আজমল হোসেন রেগে গেলেও মুখ দেখে তা বোঝা গেল না। মৃদু আওয়াজে বললেন,
“বাড়ি চল। অনেক বাইরে বাইরে থাকা হয়েছে। আমার তো একটা কর্তব্য আছে। মেয়ে বড় হয়েছে। বিয়ে দিতে হবে। আমি তোর বিয়ে ঠিক করেছি।”
তপা যেন আকাশ থেকে পড়ল। কিঞ্চিৎ সময় পরেই শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠল।
মুখে হাসি নিয়েই বলল,
“আপনার কেন মনে হলো আপনি বলবেন আর আমি সুরসুর করে আপনার সাথে চলে যাব?”
আজমল হোসেন দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“কারণ আমি তোর বাবা।”
তপা শক্ত গলায় বলল,
“সেটাই সবচেয়ে বড় দূর্ভাগ্য আমার। আমার ক্ষমতা থাকলে আপনার দেওয়া জীবন আমি বের করে দিতাম। আপনার যতটুকু রক্ত আমার শরীরে বইছে সবটুকু গুনে গুনে ফোটায় ফোটায় হিসেব করে বের করে দিতাম। কিন্তু আফসোস সেটা করতে গেলে আমার মায়ের অস্তিত্ব টুকুও বিলীন হয়ে যাবে। আমার ঘেন্না করে নিজের শরীরের রক্তের উপর। শুধুমাত্র তা আপনার থেকে পাওয়া বলে। তারপরও মনে হচ্ছে আপনার সাথে যাব আমি?”

তপার বলা কথাগুলো না শুনতে পেলেও পলক এসে তপার রাগান্বিত মুখশ্রী দেখতে পেল। অতিরিক্ত রাগের দরুন তপা কেঁপে কেঁপে উঠছে। পলক দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তপার দুবাহু ধরে আগলে নিল। মুখ ঘুরিয়ে গালে হাত রেখে বলল,
“কি হয়েছে? শান্ত হও।”
তপা কিছু বলতে চাইলেও কথা জড়িয়ে গেল। মূলত পলক কে দেখে রাগের সাথে সাথে অদ্ভুত একটা অনূভুতি হচ্ছে তার। চাইতেও স্পষ্ট কিছু বলতে পারল না।
পলক মৃদু স্বরে বলল,
“আগে শান্ত হও। পরে শুনছি।”
পলক তপাকে রেখে পাশের দোকান থেকে পানি এনে দিল। তপা একটুখানি গলাধঃকরণ করে নিজেকে শান্ত করল।
পলক তপার গালে হাত রেখে বলল,
“এখন বলো কি হয়েছে?”
এতক্ষণ নীরবে সবটা পর্যবেক্ষণ করলেও এখন হুংকার ছাড়ল আজমল হোসেন। তপার কথাগুলো হজম করতে কিছুটা সময় লাগলো তার। তার আগেই কোত্থেকে পলক এসে ঝড়ের গতিতে এতকিছু করে ফেলল যে তিনি কথাই বলতে পারলেন না।
আজমল হোসেন শক্ত গলায় বললেন,
“আমার মেয়েকে ছোঁয়ার সাহস কি করে পাচ্ছো তুমি ছেলে?”
পলক চমকাল। মূহুর্তেই বুঝে গেল ইনি তপার বাবা। তার শ্বশুরমশাই। পলক কিছু বলার আগেই তপা মুচকি হাসল। পলক তপার দিকে তাকাল। তপা কে হাসতে দেখে আর কিছু বলল না। যা বলার সেই বলুক এটা ভেবে চুপ রইল।
তপা পলকের হাতে নিজের হাত রেখে বলল,
“আমার মা মারা যায় তখন আমার কত বছর আপনি জানেন?”
আজমল হোসেন কিছু বললেন না। তিনি হিসেব করতে ব্যস্ত। তপা তাচ্ছিল্য হাসল।
মলিন কণ্ঠে বলল,
” নয় বা দশ। মামার কাছে চলে গেছি সেই বয়সেই। কিন্তু সেদিনের পর আপনি খোঁজ নিয়েছিলেন আমার একবারও? মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে বের হয়ে যাওয়ার পর আদৌ আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি তার খেয়াল ছিল আপনার? ছিল না। আপনি তখন আপনার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে ব্যস্ত। ব্যস্ত নতুন সংসারে। কই আমি তো অভিযোগ করি নি কখনো। আপনার সংসারের এক কোণে আমি থাকতে চেয়েছিলাম। কারণ সেখানে আমার মায়ের ছোঁয়া ছিল। আমার মায়ের সাজানো সংসারে অন্য এক মহিলাকে দিব্যি জায়গা দিয়ে দিলেন। অথচ আমার জায়গা রান্নাঘরের কোণায়ও হলো না। মামার সাথে চলে যাওয়ার পরও আপনি একবার গিয়ে বলেন নি আপনার সাথে ফিরে আসতে। বলবেন কেন? আপনার নতুন সংসারে আমি ছিলাম উটকো ঝামেলা মাত্র। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমি ভয়ে সিটিয়ে থেকেছি।খারাপ ছোঁয়া সইতে না পেরে হাজার বার বাবা বাবা বলে চেঁচিয়েছি, কেঁদেছি । তখন কোথায় ছিলেন আপনি? কোথায় ছিল আপনার কর্তব্য? যখন ছোট্ট শরীরটা একটা নিরাপদ জায়গার অভাবে প্রতিরাতে ধুঁকে ধুঁকে মরছিল, তখন কোথায় ছিল আপনার কর্তব্য? বড় হয়েও যখন হায়েনার দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারিনি। গুমরে গুমরে কেঁদেছি তখন কোথায় ছিলেন আপনি? কোথায় ছিল আপনার দায়িত্ব? আপনার স্ত্রীর আঁচলের তলায়? এখন আপনি কর্তব্য দেখাতে এসেছেন? বিয়ে দিতে এসেছেন? আমার স্বামীর ছোঁয়া নিয়ে আপনি প্রশ্ন তুলছেন? লজ্জা করছে না একবারও? আয়নায় নিজেকে দেখে ঘেন্না লাগে না আপনার? আমার ইচ্ছে করে জায়নামাজে বসে দু’হাত তুলে আল্লাহ কে বলি আপনার মত মানুষ কে যেন তিনি বাবা হওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত করে। কিন্তু করতে পারি না। কারণ কি জানেন? আমার শরীরে আপনার পঁচা রক্তের সাথে আমার মায়ের শুদ্ধতম রক্তও বইছে। আপনি যাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। যার ছোঁয়ার সাহস নিয়ে কথা বলছেন সে আমার স্বামী। আমার জীবনের একচ্ছত্র অধিকারী। বুঝতে পেরেছেন? নাকি আরও বুঝিয়ে বলতে হবে?”
আজমল হোসেন কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন।
পলক অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার কৃষ্ণময়ী এভাবে কথা বলতে পারে জানা ছিল না তার।

“অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে হয় না তপা।” গম্ভীর গলায় এহেন কথা শুনে তপা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,
“কে অভিভাবক? আপনি? লজ্জা করছে না বলতে? যে সত্যিকারের অভিভাবক সে অনুমতি দিয়েছে। তার নামে আমার মা ডাকটা দুইবার উচ্চারিত হয়। সে আমার মামা। মামা ডাকতে যে দুইবার মা উচ্চারণ করতে হয় সেটা ঐ লোকটার কাছেই বুঝতে পেরেছি আমি। তাই অভিভাবক হওয়ার অধিকার একমাত্র তার। আপনি জন্মদাতা হয়েও যা পারেন নি তা তিনি মামা হয়েই করেছেন। তাই অভিভাবক হওয়াটা তারই সাজে।”

আজমল হোসেন কিছুক্ষণ নীরবে ভাবলেন। নরম গলায় বললেন,
“তুই একে ডিভোর্স দিয়ে দে। আমি যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছি তাকে বিয়ে কর। সারাজীবন আমার কাছে থাকতে পারবি।”
পলক রক্তচক্ষু করে তাকাল।
তপা চেঁচিয়ে উঠলো। বলল,
“খবরদার মিস্টার আজমল হোসেন। যা উচ্চারণ করেছেন তা শব্দ পর্যন্তই থাক। চাওয়াগুলো নিজের ভেতরেই কবর দিয়ে দিন।”
আজমল হোসেন পলকের দিকে একনজর তাকাল। পরক্ষণেই তপার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই ছেলেটা তোকে ভাল রাখতে পারবে না।”
তপা হাসল। তাচ্ছিল্যের হাসি। হাসতে হাসতেই বলল,
“তো কে রাখতে পারবে? আপনার পছন্দ করা ছেলে? তা কে সে?”
আজমল হোসেন যেন একটু সাহস পেলেন। দ্রুত বললেন,
“তোর নতুন মায়ের ভাইয়ের ছেলে। আমাদের সাথেই থাকে।”
“বাহ! নিজের ঔরসজাত সন্তানের আশ্রয় হতে পারলেন না। অন্যের সন্তানের দায়িত্ব ঠিকই নিতে পারছেন। আপনাকে তো বাঁধিয়ে রাখার মত পিতা মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে বাঁধিয়ে রাখতে। আফসোস আমার সেই ক্ষমতা নেই।”
আজমল হোসেন তাড়া দিয়ে বললেন,
“করবি বিয়ে? দিবি একে ডিভোর্স?”
তপা পলকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
” আপনার বউয়ের বিয়ের সম্মন্ধ এসছে। আপনি কিছু বলুন মিস্টার তাজওয়ার।”
পলক নীরবে হাসল। কিছু বলল না। কেবল দেখতে থাকল একের পর এক ঘটনা। শ্রবণ করতে থাকল বিষাক্ত উক্তিগুলো।

“তা কোন স্বার্থ লুকিয়ে আছে এই বিয়ে ঠিক করার পেছনে? আর কে বলেছে আমি আপনার কাছে থাকতে চাই? আমি তো আপনার মুখও দর্শন করতে চাই না। নিজের উপর ঘেন্না হয় আমার। পিতার জায়গায় আপনার নামটা বসাতে আমার চরম লজ্জা হয়। মন চায় খাতা ছিড়েখুঁড়ে, কলম ভেঙেচুরে চলে যাই। যেখানে কেউ জানতে চাইবে না কোন বিশ্বাসঘাতকের রক্ত বইছে আমার শরীরে।”
আজমল হোসেন অবাক চোখে তাকাল। একক্ষণ শান্ত কণ্ঠে কথা বললেও এখন দ্রুত তপার কণ্ঠের স্বর পরিবর্তন হচ্ছে। তীব্র হচ্ছে কণ্ঠনালীর ঝাঁঝ।
পলক বাবা মেয়ের মাঝে কথা বলতে চাইছে না। কিন্তু এখন আর উপায় না পেয়ে তপার দুবাহুতে হাত রেখে বলল,
“অনেক কথা হয়ে গেছে। আর নয়। চলো বাসায় যাবে।”

আজমল হোসেনের দিকে ফিরে মৃদু হেসে ঠান্ডা গলায় বলল,
“শ্বশুর মশাই চাইলে সুস্থ সবল মন নিয়ে একদিন মেয়ের সামনে আসবেন। প্রয়োজনে আমি নিয়ে আসব আমার বাড়িতে। মন ভরে দোয়া করে যাবেন। কিন্তু ভুলেও ডিভোর্স নিয়ে আর মাথা খাটাবেন না। আমি কিন্তু মোটেও ভালো মানুষ নই। বিশ্বাস না হলে মেয়েকে জিজ্ঞেস করে নিবেন। আসছি। ভালো থাকুন।”

পলক যেতে চাইলেও তপা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আজমল হোসেন তখনো অবাক চোখে পলকের দিকে তাকিয়ে। শান্ত গলায় কি সুন্দর শাসিয়ে গেল ছেলেটা। হজম করতে সময় লাগছে।
পলকের দিকে তাকিয়ে তপা মৃদু স্বরে বলল,
“আপনি বাইকের কাছে যান আমি দু’মিনিটে আসছি।”
পলক মাথা নেড়ে চলে গেল।
তপা শান্ত কণ্ঠে বলল,
“আমি জানিনা আমার মা কি করে মারা গেল। এত দুঃখের মাঝেও যে মানুষটা প্রাণ খুলে হাসতে পারতো সে কখনো হার্ট অ্যাটাকে এত দ্রুত মারা যেতে পারে না। আমি জানিনা আপনিই দায়ী কিনা আমার মা হারানোর জন্য। সরাসরি দায়ী না হলেও আপনিই দায়ী আমার কাছে। আপনার জন্যই আজ আমি এতিম। আমি চাইব আপনি আর কখনো আমার সামনে না আসুন। আমি কখনো জানতে চাইনি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান, আপনার ঔরসজাত সন্তান আমার থেকে বয়সে বড় কি করে হলো। কখনো জানতে চাইনি দিনের পর দিন কি নিয়ে আপনার আমার মায়ের সাথে ঝগড়া হতো। কখনো জানতে চাইনি কেন কারণে অকারণে আমার মায়ের গায়ে হাত তুলতেন আপনি। এটাও জানতে চাইনি কেন আমার মা তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী কে সহ্য করতে পারতো না। সে কি আগেই বুঝতে পেরেছিল তার মৃত্যুর মাস যেতে না যেতেই আপনি তার বান্ধবীকে বিয়ে করে নিয়ে আসবেন। দিয়ে দিবেন তার সাজানো সংসার। নাকি বিয়ের পাঠটা আগেই চুকিয়ে নিয়ে ছিলেন মিস্টার আজমল হোসেন? না আমি কোনো কৈফিয়ত চাই না। চাওয়ার দরকারও নেই। আর না আছে এসব শোনার চাহিদা। শুধু এতটুকু জেনে রাখুন। আমার মায়ের সাথে সাথে আমার বাবাটাও মরে গেছে। আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে একজন বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক। সে আমার বাবা নয়, হতে পারে না। তাই দয়া করে আমার সামনে এসে ভাল মানুষ সাজার নাটকটা করবেন না। বাবা হওয়ারও চেষ্টা করবেন না। আজ থেকে আমি মনে প্রাণে চাইব আপনার মত মানুষ কে যেন আল্লাহ বাবা হওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত করেন। সারাজীবন হাহাকার করায় একটা বার বাবা ডাক শোনার জন্য।”

তাজমহল পেরিয়ে উপরে যাওয়ার সিঁড়িতে পা বাড়াতেই পলক মৃদু স্বরে ডাকল,
“তিয়াশা।”
তপা পেছন ফিরল। পলকের সামনে গিয়ে বলল,
“বলুন।”
পলক আমতা আমতা করল। কিঞ্চিৎ সময় পর নিচু গলায় বলল,
“আজ এখানে থেকে যাবে?”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“তাজমহলে?”
পলক মাথা নাড়াল।
“ফ্রেশ হয়ে আসি?”
পলক আবার মাথা নাড়াল। তবে এবার সম্মতি জানাতে নয়। বরং অসম্মতি জানিয়েছে সে।
তপা হাসল। বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। জামা কাপড় নিয়ে আসি? তাছাড়া আরও প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আনতে হবে। আপনার মেইল কসমেটিকস তো আমি ব্যবহার করতে পারব না। যাব?”
পলক সম্মতি সূচক চাহনিতে তাকা। তপাও গটগট করে হেঁটে চলে গেল চিলেকোঠায়।

মিনিট পাঁচেক পর তপা হাতে দুটো শপিং ব্যাগ নিয়ে তাজমহলে প্রবেশ করল। ভাঙা পা নিয়ে যে রুমে থেকেছিল সে রুমের বিছানার উপর ব্যাগগুলো রেখে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল টেবিলে দুকাপ রঙচা। তপা মুচকি হাসল। ফুপিয়ে কান্নার দরুন মাথাটা ভার ভার লাগছে তার। চা টা ভীষণ দরকার ছিল। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চুমুক দিল চায়ের কাপে। ভাললাগায় চোখ বন্ধ করে ফেলল।
পলক এসে কাপ নিয়ে বিছানায় বসে বলল,
“তিয়াশা ঠিক আছ?”
তপা মৃদুস্বরে বলল,
“ঠিক না থাকার কথা ছিল?”
পলক কিছু বলল না। পরপর চুমুক দিল কাপে।
তপা পুনরায় বলল,
“এসব আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। আর ভেঙে পড়ি না।”
পলক মৃদু স্বরে বলল,
“তবে কেঁদেছো কেন?”
তপা চোখের কোণে জল নিয়ে বলল,
“চোখ যে বাঁধা মানে না। কথা শোনে না। শুধু শুধু জল গড়িয়ে পরে। মিস্টার তাজওয়ার একটা কথা দেবেন আমায়?”
পলক ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল,
“কি?”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“আপনি ভাল বাবা হবেন। পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল বাবা। আমি মরে গেলেও।”
পলক করুণ গলায় বলল,
“আমি পাগল হয়ে যাব।”

তপা রান্নাঘরে টুংটাং আওয়াজ তুলে রান্না করতে ব্যস্ত। পেছন থেকে পলক একটা কাগজ এগিয়ে দিল। তপা আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
“কি?”
“নিজেই খুলে দেখো।”
তপা কাগজটা হাতে নিল। ভাজ খুলে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল।
পলক আওয়াজ তুলে বলল,
“ক্যান আই কিস ইউ?”
তপার মনে পড়ে গেল প্রথম দিনের কিছু কথা। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল দুষ্টু হাসি। পলকের দিকে ফিরে দুষ্টু হেসে বলল,
“কোন ইয়ার?”
পলক মাথা চুলকে হাসল। বলল,
“ফার্স্ট ইয়ার। সবে এক সপ্তাহ আগে বিয়ে করেছি।”
তপা শব্দ করে হাসতে চেয়েও গিলে ফেলল হাসিটুকু। গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“কোথায় কিস করতে চান? গালে? নাকি ঠোঁটে?” বলেই ঠোঁট পাউট করে দেখাল।
পলক ঠোঁট কামড়ে হাসল। তপার হৃদয় কাঁপিয়ে দিতে নিচু হয়ে কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আপাদমস্তক।”

তপা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। কাঁপতে লাগল সর্বাঙ্গ। দ্রুত পেছন ফিরে রান্নায় মনোযোগী হতে চেষ্টা করল। কাঁপা হাতে খুন্তি নাড়িয়ে যাচ্ছে অনবরত। পলক সেদিকে তাকিয়ে নীরবে হাসল। মেয়েটা এতটাই লজ্জা পেয়েছে যে বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। খালি কড়াইয়ে খুন্তি নাড়ছে।
তপা কে আরও একটু অপ্রস্তুত করতে পলক এগিয়ে গেল। গা ছুঁই ছুঁই করে দাঁড়াল। কানের কাছে ফু দিল। তপার গোটা শরীর কেঁপে উঠল। হাতদুটো মুঠো করে ধরল। পলক আরও একটু এগিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল কানের লতিতে। তপা বোধহয় ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। সরলো না পলক। পরপর ছুঁয়ে দিল কয়েকবার।
তপা অস্ফুটে কিছু বলতে চাইল। সেদিকে নজর দেওয়ার আগেই চোখ আঁটকে গেল তপার কানের খানিকটা নিচে। শ্যামবরণ ঘাড়ের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে খুচরো চুল। ফু দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিল। তপা আরও শক্ত হয়ে দাঁড়াল। কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল বারবার। পলকের হয়তো মাথায় নেশা চড়ে গেছে। মুখ এগিয়ে নিয়ে ছোট ছোট করে চুমু একে দিল। পেটের উপর নিজের পুরুষালী শক্ত হাত চেপে টেনে মিশিয়ে নিল নিজের সাথে। তপা পলকের হাতের উপর হাত রেখে চেপে ধরল। পলক পুনরায় ঠোঁট ছোঁয়াতেই দৃঢ় করল হাতের বাঁধন। নখ বসে গেল ফর্সা হাতে। পলকের সেদিকে খেয়াল নেই। সে ব্যস্ত নিজের কর্মে। ছোট ছোট চুমু কিছুক্ষণেই পরিবর্তন হলো গভীর মাদকতায়। স্পর্শ গভীর থেকে গভীরতম হতেই তপা পেছন ফিরে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল মানুষটাকে। মুখ লুকিয়ে ফেলল তার চওড়া বুকের গভীরে । আচমকা এমন হওয়ায় পলকের নেশা ছুটে গেল। ঘোর থেকে টেনে বের করে আনল নিজেকে। পরক্ষণেই তপার পিঠের উপর দৃঢ় করল নিজের দু’হাতের বাঁধন।

চলবে….
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here