কোনো এক পূর্ণিমায় পর্ব -০১

~পাত্রপক্ষ বিয়ের আসর ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাও আবার আমার কারণে! আপুর বিয়েটা ভেঙ্গে তারা সবাই স্থান ত্যাগ করছে। পাত্রপক্ষের এভাবে চলে যাওয়ার কারণ আমি তবে কি করেছি সেটা এখনো বুঝে উঠতে পারছি না। চোখের সামনে খালি সবটা ঘটে যেতে দেখছি। বাড়ির সবাই ছেলে পক্ষকে থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তারা থামতে নারাজ। ছোট নানি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। ঋতু আপু কনের আসনে বসে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে।

পাত্রপক্ষ বিয়ের আসর ত্যাগ করলে ছোট নানি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তেড়ে আসলেন। আমার দুই বাহু ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

–“এ কি স’র্ব’না’শ করলি তুই? সব শেষ করে দিলি রে। আমার নাতনির জীবন শুরু হওয়ার আগেই ন’ষ্ট হয়ে গেল রে। আল্লাহ! আল্লাহ! একি হয়ে গেল?”

–“কিন্তু আমি কি করেছি? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

কথাটা বলা মাত্রই থা’স করে একটা থা’প্প’র পড়লো আমার গালে। ততক্ষণাৎ গালে হাত দিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি ঋতু আপু দাঁড়িয়ে রয়েছে। চড়টা কি তবে আপু মারলো?

–“কেন করলি এ কাজ? আমার জীবনটা শুরু পর্যন্ত করতে পারলাম না তার আগেই ধ্বংস করে দিলি?”

–“আপু আমি কি করেছি তোমরা বলছো না কেন?

দু ফোঁটা পানি মুখশ্রীতে গড়িয়ে পড়লো। এই আচরণ যে মেনে নিতে পারছি না। দোষটা পর্যন্ত জানতে পারলাম না তার আগেই এতো কিছু হয়ে যাচ্ছে আমার সাথে।

–“মেয়েটা আমার নাতনির কপাল পুড়াইতেই এই কাজ করছে। ওকে ঘাড় ধরে বের কর এখনি!”

–“ঠিকই বলছো নানি। এত কিছু যদি আগে বুঝতাম তাহলে তো হতোই।”

অতঃপর ঋতু আপু আমার এক বাহু ধরে এগোতে লাগলো গেটের দিকে। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি খালি। গেটের সামনে এসে আমাকে দাঁড় করিয়ে নিজের দিকে ঘুরালো আপু।

–“এমনটা না করলেও পারতি অনু।”

আমাকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দিবে ঠিক তখনই…..

ঘুমটা ভেঙ্গে গেল, প্রচন্ড পরিমানে হাঁপাচ্ছি। একটু আগে এসব কি দেখলাম আমি? গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চক্ষুদ্বয় পানির সন্ধান করছে, হঠাৎ কেউ সামনে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই খপ করে তা নিয়ে ঢোক ঢোক করে পুরোটা খেয়ে ফেললাম। এইবার তৃপ্তি লাগছে বেশ।

–“কিরে কি হয়েছে তোর?”

কন্ঠস্বরে সামনে তাকিয়ে দেখি ঋতু আপু দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে রয়েছে। আপুকে দেখে ঢোক গিললাম, আমার দিকে জিজ্ঞাসু নয়নে চেয়ে আছে আপু।

–“এই অনু বলছিস না কেন? এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন?”

–“আসলে একটা স্বপ্ন দেখে একটু ভয় পেয়েছি।”

–“এত্ত বড় মেয়ে সে না কি স্বপ্নে ভয় পেয়েছে যাহ।”

এই বলে হালকা হাসতে হাসতে আমার পাশে বসলো আপু। এদিকে কি জিনিস দেখেছি তা আমিই জানি। আমার চিন্তিত মুখশ্রী দেখে আবারও প্রশ্ন ছুঁড়ল।

–“এই যে আপনার ব্যাপারটা কি বলুন তো আমায়।”

–“কিছু না।”

–“কি দেখেছিস সেটা বল।”

–“না মানে। আমার জন্য তোমার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে এটা।”

–“কি? এইটা দেখে তুই ভয় পেয়েছিস?”

আপু হো হো করে হাসতে আরম্ভ করলো। আমি চোখ পিটপিট করতে করতে চেয়ে রইলাম।

–“আরো কিছু দেখেছি।”

–“আবার কি?

–“তুমি আমাকে চড় মেরেছো। তারপর আমাকে ধা’ক্কা
দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছিলে।”

–“একটা মারবো কিন্তু, কি সব বলছিস তুই হ্যা? আমি এমন করবো?”

বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো আপু। দেখেই বুঝা যাচ্ছে রেগে গেছে অনেক। আমি তো ইচ্ছা করে সেই স্বপ্ন দেখিনি তাই না? আপু কিছুটা শান্ত হয়ে আবার বসে পড়ল।

–“হয় তো বিকালের ঘটনার কারণে এসব দেখেছিস। এগুলো ভাবা বাদ দে।”

অতঃপর বিকালের ঘটনা স্মরণে আসতেই চেহারায় অন্ধকার নেমে এলো। কিছুটা এমনই ঘটেছে বিকালে তবে পার্থক্য হচ্ছে তখন বিয়ে ছিল না শুধু ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে এসেছিল।

••••••••••••••••••

ঋতু আপুকে দেখতে আসছে তাই ছোট নানি বার কয়েক আদেশ করেছেন। ভুলেও যেন ওদের সামনে না যাই। যদি আমাকে দেখে তাদের পছন্দ হয়ে যায়? তবে তো সমস্যা হয়ে যাবে।

ভদ্র মেয়ের মতো ঘরে চুপটি করে বসে ছিলাম তখনি খালামনির প্রবেশ ঘটে রুমে আমাকে একা বসে থাকতে দেখে বলে,

–“তুই এভাবে একা বসে আছিস কেন? আয় একটু হেল্প করে যা। নাস্তাটা ড্রয়িং রুমে দিয়ে আয়।”

–“নাআআআআআ একদম নাআআ!”

আমার কথায় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল খালামনি। আমতা আমতা করে বললাম,

–“ছোট নানি মানা করেছে।”

–“মায়ের কথায় কান দিতে হবে না তোর। তুই আয় চুপচাপ।”

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্রস্থান নিলো খালামনি। আর কি আমিও তার কথা মতো কর্ম সিদ্ধি করে এলাম। এরপরেই শুরু হলো যতো ঝামেলা! পাত্রের আমাকে পছন্দ হয়েছে। সেই ছেলে না কি আমাকেই বিয়ে করবে। ছোট নানির তেলে বেগুনে অবস্থা, শেষমেষ শুন্য হাতে ফিরে গেল তারা। যত কথা বসে বসে হজম করেছি আমি।

–“রুপ যেন বাহিয়া বাহিয়া পরে এক্কেবারে! তোর মা আমার মেয়ের কতগুলো বিয়ের প্রস্তাব ডুবালো এককালে আর এখন তুই ওই পথে হাঁটা দিচ্ছিস?”

–“স্বেচ্ছায় তো কিছু করিনি। আমি তো আসতেও চাইনি খালামনিই তো………

–“হইছে এখন আমার মেয়ের উপর দোষ দিচ্ছে বাহ্। তুই আর তোর মা তো একই রাস্তায় হেঁটে আমাদের সব শেষ করার তালে আছিস। নিজে চলে গিয়ে তোরে রেখে গেছে বাকি ক্ষতি করতে।”

কথাগুলো শুনে সেখান থেকে ঘরে এসে অশ্রু ঝরিয়েছি কতক্ষণ। সহ্য করতে পারে না মানলাম তাই বলে যে আর নেই তাকে নিয়ে এখন কথাবার্তা? কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছি সেই কখন খেয়াল নেই আমার।

••••••••••••••••

মৃদু ঝাঁকুনিতে বর্তমান ফিরে এলাম আবার। ঋতু আপু তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কমল কন্ঠে বলতে লাগল,

–“রাতের খাবারটা খেয়ে নেয় তারপর নাহয় আবার ঘুমাবি।

–“আমি কালকেই চলে যাবো। আব্বুকে বলে দিব সকালে এসে আমাকে নিয়ে যেতে।”

–“তোকে কেউ যাওয়ার পারমিশন দিয়েছে?”

–“আমি যদি আগে জানতাম তোমার জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে তার উপর ছোট নানি এই বাসায় তাহলে সত্যি বলছি আমি আসতামই না।”

–“চুপ কর তো। কেউ কোথাও যাচ্ছে না। খেতে আয় চুপচাপ।”

কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই আপু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি কালকেই চলে যাবো ভেবে নিয়েছি। আজকের ঘটনার পর থাকার ইচ্ছেটাই ম’রে গেছে। আপন খালামনি না থাকায় মায়ের চাচাতো বোনকে ছোটবেলা থেকে খালামনি ডেকে বড় হয়েছি। চাচাতো বোন হওয়া সত্ত্বেও আপন বোনের মতো চলতো তারা। শুনেছি খালামনির জন্য যখন ছেলে দেখা হচ্ছিল সেসময়ে না কি ছেলেপক্ষ আম্মুকে পছন্দ করে যেতো। এমন কাহিনী কয়েকবার হওয়ায় ছোট নানি আম্মুকে আর সহ্যই করতে পারে না।

কি যেন চিন্তা করছিলাম হঠাৎ ড্রয়িংরুম থেকে আওয়াজ আসায় তাড়াহুড়ো করে সেদিক পা বাড়ালাম।

ঋতু আপু এককোণে দাঁড়িয়ে, খালামনি আর খালু সোফায় বসে আর ছোট নানি? সে দেখি নাচি নাচি ভাব। হচ্ছে কি এখানে? আপুকে আবার ঘরে নিয়ে গেলাম। কি হয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর পেলাম না। ঠাই দাঁড়িয়ে আছে, মাথা উঠিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

–“১ ঘন্টার মধ্যে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে।”

–“কি!!”

বিস্ময়ের চরম শিখরে পৌঁছে গেলাম। রাত ১০টা বাজে, এখন মেয়ে দেখতে আসবে? পাগল না কি?

–“অনু…

–“হ্যা বলো।”

–“ওরা বিয়েতে রাজি অলরেডি আজকে মেইনলি বিয়ে ঠিক করতে আসছে।”

আরেক দফা অবাক হলাম। মেয়ে না দেখেই রাজি হয়ে গেল এ আবার কি।

••••••••••••••••••

হাজার না বলার পরেও ঋতু আপুকে রেডি করা হয়েছে ছোট নানির কড়া আদেশে। আমি শুধু দাঁড়িয়ে থেকে সব দেখে গেছি। রেডি হয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো আপু আমিও তার পাশে গিয়ে বসলাম। চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে তার চেহারায়, শান্তনা দেয়াটাও যে বৃথা কারণ প্রস্তাবটা এসেছে চৌধুরীদের থেকে। এই বিয়ে ছোট নানি দিয়েই ছাড়বে!

কলিং বেল বাজতেই নড়েচড়ে উঠলাম দুজনেই। দুমিনিট পর খালামনি আমাদের দুজনকেই যেতে বললেন। আমি মানা করলেও ঋতু আপুর অবস্থা দেখে বাধ্য হলাম যেতে। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম সবার সামনে। সোফায় দুইজন বসে আছেন, দেখে বুঝা যাচ্ছে পাত্রের মা বাবা হবেন।

কিন্তু ছেলে কোথায়? এই যাহ ছেলেই তো নেই। সামনে বসা একজন আমাদের বসতে বললেন। আপুকে বসিয়ে আমি পাশেই দাঁড়িয়ে রইলাম। খালু একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,

–“পাত্রকে দেখছি না যে? সে আসেনি?”

–“এসেছে তো। তবে আমাদের ছেলে আপনাদের মেয়ের সাথে এইখানে দেখা করবে না।”

বাক্যটা শুনে চক্ষু সংকুচিত হয়ে গেল। এখানে দেখা করবে না তো কোথায় দেখা করবে? আর যদি এসেই থাকে তবে কোথায় সে?

চলবে………………?^_^

#কোনো_এক_পূর্ণিমায় (সূচনা পর্ব)

#লেখনীতে_ওয়াসেকা_তাবাসসুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here