কোনো এক পূর্ণিমায় পর্ব -১৬+১৭

#কোনো_এক_পূর্ণিমায় (১৬তম পর্ব)

#লেখনীতে_ওয়াসেকা_তাবাসসুম

~মান সম্মান বাঁচানোর তাগিদে উপরে দৌড়াতে লাগলাম। এখন রুমে যেতে হবে যে কোনো মতে। দৌড়াতে দৌড়াতে সেই শক্ত কোনোকিছুর সাথে ধাক্কা খেলাম। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাবো ঠিক তখনই কেউ দুই বাহু ধরে নিল। আচমকা ঘটনায় চোখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেছে। এখনো যে পড়ে যাই নি বুঝে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালাম। অভ্র আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাড়াতাড়ি করে আমার বাহু ছেড়ে দিয়ে নিজের পকেটে এক হাত গুজে দাঁড়ালেন।

–“চোখে কি অন্ধকার দেখছো না কি সব? পড়ে গেলে কি হতো?”

–“পড়িনি তো? তাহলে এতো চিন্তার কি আছে?”

–“আমার জন্য পড়নি। তার জন্য আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।”

–“হ্যা হ্যা ধন্যবাদ।”

–“ধন্যবাদটা অন্তত ভালো মতো দিতে পারতে? কপাল ভালো কোলে এসে পড়নি তাহলে মান সম্মান সব যেতো আমার।”

ওনার কথায় আরেক দফা অবাকের উচ্চ পর্যায়ে উপনীত হলাম। এই লোকটা তখন থেকে কি শুরু করেছে!? কথায় কথায় একই কথা উঠায় কেন? চক্ষুদ্বয় সরু করে তাকালাম কিছুক্ষণ।

–“আপনার মুখে কিছুই আটকায় না তাই না? তখন এমন কথা বলে নিজে পালিয়ে এলেন। বাকি কথাগুলো যে আমি শুনলাম তার কি হবে?”

–“ইস রে সরি। আসলে ওইটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। না হলে ইচ্ছা করে কেউ ওসব বলে তুমিই বলো?”

–“তাহলে বলে পালিয়ে গেলেন কেনো? বাকি কথা যে আমি হজম করলাম?”

–“হবু স্বামীর জন্য এইটুকু হজম করাই যায়।”

–“কি বললেন আপনি? কি হবু স্বামী কি?”

–“আরেহ কিছু বলিনি।”

ভ্রু কুঁচকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। এর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝিনা কেন? কখন কি বলে নিজেও জানে না কি সন্দেহ!

–“আমি ঘরে গেলাম। আপনি যেখানে যাচ্ছিলেন যেতে পারেন।”

সোজা হাঁটা ধরলাম সাথে সাথে। পিছন থেকে আবারো অভ্রর গলা শোনা গেল।

–“বিয়েতে রাজি হওয়ার কারণটা কিন্তু জানতে চাই অনামিকা। কবে জানাবে?”

পিছন না ঘুরি দাঁড়িয়ে রইলাম। সেই অবস্থায় ওনার কথার উত্তর দিলাম,

–“না জানলেও চলবে। এমনিতেও আপনাকে বিয়ে করার শখ নেই আমার।”

এরপর আর অভ্রর রিয়েকশন দেখা হয়নি। কারণ দৌড়ে রুমে চলে এসেছিলাম। রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বসলাম। সত্যি সত্যি বিয়েটা হবে তাহলে? অভ্রকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলাম ভেবেও অদ্ভুত লাগছে বেশ।

আন্টির কথা মতো আর দুইদিন সময় আছে হাতে। তাহলে কালকে বাসায় চলে গেলে কেমন হয়? অনেকদিন হয়ে গেল এখানে আছি। এরমধ্যে খালামনির সাথেও দেখা হয়নি। যদিও এরমধ্যে সম্ভব না একে বারে বিয়ের দিন দেখা হবে। কিন্তু নিজের বাসায় তো যাওয়া দরকার। আর কবে সুযোগ পাবো কে জানে।

আন্টিকে বিষয়টা জানাবো ভাবলাম কিন্তু এতো রাতে যাওয়াটা ঠিক হবে? ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ৯টা বেজে ২৭ মিনিট। তারমানে বেশি দেরি হয়নি যাওয়াই যায়।
দরজা খুলে একবার চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে নিলাম। না কেউ নেই তাহলে যাওয়াই যায়। চুপচাপ নিচে নেমে আন্টির রুমের সামনে গিয়ে নক করলাম। কিছুক্ষণ বাদে আন্টি এলেন।

–“কিছু বলবি মা?”

–“হ্যা আন্টি আসলে তোমার কাছ থেকে পারমিশন নেওয়ার আছে একটা।”

–“কিসের পারমিশন? বল।”

–“আমি ভাবছিলাম কালকে একটু বাসায় যাবো। তুমি যদি হ্যা বলো তাহলেই যাবো।”

–“ধুর পাগলি! আবার আমার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার কি আছে? কিন্তু ভালো করেছিস এসে। ভিতরে আয় তোর জরুরি কথা আছে।”

আন্টি আমার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে এলেন। তারপর আমাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও চেয়ার টেনে বসলেন।

–“আংকেল নেই যে?”

–“তোর আংকেল বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাইরে গেছেন হাঁটাহাঁটি করতে।”

–“ওহ্ আচ্ছা।”

–“তোকে আগে আসল কথা বলি শোন ভালো করে। দুদিন পরে বিয়ে ভেবে আজকে সবাইকে ফোন দিলাম আসার জন্য। তো অভ্রর দাদু বাড়িতে খবর দিতেই ওর দাদি একটু রাগারাগী করলেন। তারপর বললেন তারা সবাই কাল সকাল সকাল আসবেন। কয়েকদিন বোধহয় এই বাড়িতেই থাকবেন।”

–“সে তো ভালো কথা।”

–“ভালো কথা? আমার শাশুড়ি মাকে চিনিস তুই? আর অভ্রর দাদু বাড়ি সম্পর্কেও তো কিছু জানিস না।”

–“আসলেই কিছু জানি না। তাহলে তুমি বলো না আমায়?”

–“অভ্রর বাবারা ছয় ভাই বোন। চার ভাই আর দুই বোন। অভ্রর বাবা হচ্ছেন মেজো। ওর বড় ভাই আছেন তার আবার এক ছেলে এবং একমাত্র সন্তান। সেজো ভাইয়ের দুই ছেলে আর এক মেয়ে। ছোট জনের দুই মেয়ে। আমার বড় জা এর বিয়ে হয়েছে গেছে ওর ছোট্ট
দুইটা ছেলে আর মেয়ে। ছোট জা এর এখনো বিয়ে হয়নি। অভ্রর দাদা কয়েক বছর আগেই চলে গেছেন। ওর দাদি অর্থাৎ আমার শাশুড়ি থাকেন সবার সাথে।”

–“এতো গুলো মানুষ এক বাড়িতে থাকে?”

–“হ্যা। সবাই এক বাড়িতেই থাকেন। সবাই কালকে আসবে বলেছেন।”

–“সবাই যখন একসাথে থাকে তাহলে তোমরা আলাদা থাকো কেন?”

–“আসলে অনু তোর আংকেল বরাবর নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছেন। পারিবারিক বিজনেসে ওর যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। প্রথম থেকেই নিজের থেকে কিছু করতে চেয়েছিল। এই নিয়ে শাশুড়ি মায়ের সাথে তর্ক পর্যন্ত হয়েছে। বাকিরাও বলেছিল যে পারিবারিক বিজনেস থাকতে নিজের আলাদা কি প্রয়োজন? কিন্তু সে শুনেনি। বলতে পারিস এক পর্যায় রাগ করে বেরিয়ে আসে ওই বাড়ি থেকে। তারপর থেকে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়েই গিয়েছিল তবে পরে ওনারাই ফোন দিয়ে কথা বলে সমস্যা মিটিয়ে নেন।”

–“এতো গুলো বছরে তোমরা ওই বাড়িতে যাওনি?”

–“গিয়েছি তবে অতিথি হিসেবে। তোর আংকেলের প্রচুর জেদ জানিস তো। শাশুড়ি মায়ের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়াটা মেনে নিতে পারেনি। যদিও উনি ভালোর জন্যই বলেছিলেন তবে হয় তো ভাবেননি ছেলে রাগ করে বাড়ি ছাড়বে। তাহলে মনে হয় এগুলোও বলতেন না। তারপর অভ্রর বিয়ের কথা বলায় রেগে গেছেন হয় তো।

–“ওমা রাগ করার কি আছে এখানে?”

–“অভ্রর বড় চাচার ছেলে রাহিল।সে বাড়ির বড় সন্তান, রাহিল আর অনিক খুব কম বয়সের ছোট বড়। অনিকের বিয়েতে সবাই খুশি থাকলেও অভ্রর বিয়েতে রাগ করছেন। কারণ রাহিলের এখনো বিয়ে হয়নি। ওনার কথা যেখানে বাড়ির বড় সন্তান এখনো বিয়ে করেনি সেখানে ছোটরা আগে বিয়ে করলে বিষয়টা কেমন দেখায়!”

–“তাহলে বিয়ে দিয়ে দিতে বলো।”

–“ওসব অনেক কাহিনী বাদ দে এগুলো। এখন ওনারা বিয়েতে না করতে পারবে না আমি জানি। তোর আংকেলের এমনিতেই শাশুড়ি মায়ের উপর অভিমান এখন ওনারা বিয়েতে আপত্তি জানালে আরো সমস্যা হতে পারে।”

আন্টি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর এক হাত আমার মাথায় রেখে বলতে লাগলেন,

–“মা রে তুই যে বিয়েতে রাজি হয়েছিস। আমি অনেক খুশি রে। আচ্ছা এখন তুই যদি কালকে যেতে চাস সকাল সকাল যাবি। না হলে ওনারা চলে আসলে দেখা করে যাস ঠিক আছে?”

–“আচ্ছা আন্টি।”

–“আর কয় দিন আন্টি ডাকবি? মা ডাকার অভ্যাস কর।”

–“মা?”

–“হ্যা মা ডাকবি। যেমন অভ্রর মা তেমনি বিয়ের পর তোরও মা।”

–“ঠিক আছে ডাকবো।”

–“যাহ ঘুমিয়ে পর।”

মৃদু হেসে চলে এলাম ঘর থেকে। এখন কাজ ঘরে গিয়ে একটা ঘুম দেওয়া যাতে সকালে উঠে বাসায় যেতে পারি।

••••••••••••••••••

সকালবেলা উঠে বেশ তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলাম। ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে নয়টার একটু বেশি বাজে। তাহলে এখন বেড়িয়ে পরা যায়, নিচে নেমে গেলাম জলদি করে। নিচে গিয়ে দেখলাম সবাই অলরেডি ব্রেকফাস্ট করতে বসে গেছে। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই আন্টি এগিয়ে এলেন আমার দিকে।

–“আয় খেয়ে নে।”

–“নাহ আন্টি এখন না। আমি এখন বাসায় যাই।”

–“না খেয়ে যাবি? খেয়ে যা।”

–“না গো। আজকে আব্বুর ছুটি আছে, আমি বলেছি সকালবেলা যাবো তারমানে না খেয়ে বসে থাকবে।”

আংকেল এর মধ্যেই আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,

–“ওহ্ অনামিকা যাচ্ছো তুমি? একা একা যাবে না কি?”

–“হ্যা আংকেল।”

–“সে কি! চৌধুরী বাড়ির হবু বউ এভাবে যাবে? এই অভ্র যা নিজের বউকে দিয়ে আয়।”

শেষের কথাটা অভ্রকে তাড়া দিয়ে বললেন আংকেল। উনি কফিতে চুমুক দিচ্ছিলেন, হঠাৎ এমন কথায় গলায় আটকে গেল কফি। সাথে সাথে কাশতে শুরু করলেন অভ্র। অনিক ভাইয়া পাশেই বসে ছিলেন,উনি পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই অভ্র পুরোটা শেষ করলো। বাকি সবাই এতক্ষণে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। কোনো রকমে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অভ্র কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

–“এখনো বিয়ে হয়েছে না কি যে বউ বউ করছো?”

আংকেল চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই উত্তর দিলেন,

–“এই তো কাল পরশুর মধ্যে হয়ে যাবে। হবেই তো তাহলে বলতে ক্ষতি কি? যা মেয়েটাকে দিয়ে আয়।”

–“যাবো না। অফিসে কাজ আছে আমার।”

অনেকটা রেগে কথাটা বলায় ভ্রু কুঁচকে গেল আমার। আচ্ছা মানুষ তো! এমনিতেও আমি শখ করে যাবো না কি ওনার সাথে? এতো সময় নেই আমার কাছে। আমি কৃত্রিম হেসে বললাম,

–“আমি চলে যেতে পারবো।”

–“তা বললে হয়? বাড়ির হবু বউ তুমি আর একদিন দেরিতে গেলে ওর কাজ কেউ খেয়ে ফেলবে না।”

আবিদ আবার কিছুটা উৎসুক ভঙ্গিতে বলল,

–“আমি যাই? আমি যদি অনামিকাকে নিয়ে যাই চলবে?”

অভ্র ততক্ষণাৎ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন,

–“ভার্সিটিতে ক্লাস নেই? পড়াশোনা চাঁদে পাঠানো ধান্দা তোর? ভার্সিটিতে যা। ওর সাথে আমি যাচ্ছি।”

–“সেই তো যাবেই তাহলে এতো কাহিনী করার কি আছে?”

অভ্র আবিদের কথায় মুখ নামিয়ে কফি খেতে লাগল। বেচারা বারবার নিজের কথায় নিজেই ফেঁ’সে যায়। উনি তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠতেই আমরা বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলাম।

আমি আর অভ্র বের হওয়ার উদ্দেশ্যে দরজার দিকে যেতেই হঠাৎ বেল বেজে উঠলো। অর্থি চেয়ার ছেড়ে উঠলো তাড়াতাড়ি।

–“আমার মনে হয় দাদু বাড়ির সবাই এসে গেছে। আমি দরজা খুলবো কেউ হাত দিবে না দরজায়।”

অর্থি গিয়ে দরজা খুলে দিল। তবে ওর আশায় পানির ঢেলে দিয়ে দরজার অপাশ থেকে একটি ছেলে এগিয়ে এলো। ছেলেটা ধীর পায়ে এগিয়ে আসছিল, আমাকে দেখেই দৌড়ে এলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে দুই বাহু ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলো,

–“তুমি এখানে অনামিকা? তোমাকে যে পাগলের মতো খুঁজে বেরাচ্ছি আমি! তুমি বিয়ে করছো? কাকে? আর কেন অনামিকা? আমাকে ঠকিয়ে এভাবে অন্য আরেকজনকে নিজের জীবনে জায়গা দিবে তুমি?”
#কোনো_এক_পূর্ণিমায় (১৭তম পর্ব)

#লেখনীতে_ওয়াসেকা_তাবাসসুম

~অবাক চোখে তাকিয়ে আছি সামনে থাকা ছেলেটার দিকে। কিছু বলবো তার আগেই ছেলেটা আরেক দফা দুই বাহু ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

–“বলো কেন করলেন এমন? এইভাবে বেঈমানি করতে পারলে আমার সাথে?”

অভ্র তেড়ে এসে ছেলেটাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিল। এতক্ষণে সবাই ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়ে গেছে। আমি নিস্তেজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অভ্র গিয়ে ছেলেটার কলার চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,

–“তোর সাহস তো কম না! ওইদিন মা’ই’র ভুলে গেছিস তুই? কোন সাহসে আবার অনামিকাকে ডিস্টার্ব করছিস তুই?”

ছেলেটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে অভ্রর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। নিজের ড্রেস ঠিক করতে করতে বললো,

–“আমার ভালোবাসা মানুষকে নিয়ে যেতে এসেছি আমি। আমার সাহস একটু বেশি দেখেই এসেছি বুঝেছেন?”

–“ওইদিনের পরও শিক্ষা হয়নি তোর বুঝেছি। আজকে তোকে একদম শিক্ষা দিয়ে পাঠাবো।”

–“আমাকে শিক্ষা দিবেন নাকি দিবেন না সেটা পরের হিসাব। আমাকে আগে নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে যেতে দিন।”

এতক্ষণে যেন হুশ ফিরল আমার। সামনে তাকিয়ে দেখি ছেলেটা আমার দিকেই আসছে। সাথে সাথে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম,

–“চলে যাও এখান থেকে। চলে যাও রাফি! চলে যাও বলছি।”

–“যাবো তো অবশ্যই তোমাকে নিয়ে যাবো সাথে করে।”

–“যাবো না আমি। তোমার সাথে কেন যাবো আমি!?”

–“কারণ তুমি আমার প্রেমিকা। আর তোমাকে এমন অচেনা জায়গায় একা রেখে যাবো না আমি।”

–“”কি হচ্ছে কি এখানে?””

হঠাৎ কারো কঠোর আওয়াজে সবাই দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। দরজার সামনে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে গোনা পাঁচজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। যার আওয়াজ কিছুক্ষণ আগে পেলাম উনি পাঁচজনের মধ্যে বয়স্ক আর আমার যতদূর মনে হচ্ছে উনি অভ্রর দাদি। অভ্রর দাদিসহ বাকি চারজন বাড়িতে প্রবেশ করলো। ওনার কর্কশ স্বরে পুরো বাড়ি যেন কেঁপে উঠলো মূহুর্তের জন্য!

–“এইসব কি হচ্ছে এই বাড়িতে? আর কিছুক্ষণ আগে এই যে এই ছেলেটা কি বললো? কি প্রেমিক প্রেমিকা? এসব কি হ্যা?”

আন্টি এগিয়ে এসে দাদিকে বলতে লাগলেন,

–“মা আপনি ভিতরে এসে বসুন না। এতদূর থেকে এসেছেন হাঁপিয়ে গেছেন নিশ্চয়ই।”

–“আমার চিন্তা বাদ দাও তো। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও আগে! কে এই ছেলে? আর এই মেয়েটাও বা কে? ওই যে অনামিকা? যার সাথে আমার অভ্র দাদুভাই এর বিয়ে ঠিক করেছো ওই মেয়ে?”

–“হ্যা মা ওর নামই অনামিকা।”

–“এই ছেলেটা কি ওকেই বলছিল না? কি প্রেমিকা? ছিঃ ছিঃ এই মেয়ের ওর সাথে সম্পর্ক আছে?”

–“না না মা ওসব কিছু না।”

রাফি দাদির দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে নাটকীয় ভাব নিয়ে বলতে শুরু করলো,

–“আপনি ঠিকই ধরেছেন দাদি। অনামিকা আর আমার রিলেশন চলছে অনেকদিন হয়ে গেল।”

এবার যেন অভ্রর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। রাফির দিকে এগিয়ে গিয়ে আবার ওর কলার চেপে ধরলো।

–“একদম মিথ্যা কথা বলবি না। তুইও জানিস আর অনামিকা, আমিও জানি তোদের কোনো রিলেশন নেই। এইখানে এসে ঝামেলা করতে চাস তুই? এখনি তোকে বাড়ির বাইরে বের করছি দাঁড়া।”

অভ্র রাফিকে ধরে বাড়ির বাইরে বের করে দেওয়ার জন্য দরজার দিকে অগ্রসর হতেই রাফি চেঁচিয়ে উঠলো।

–“আমার কাছে প্রমাণ আছে!”

কথাটা কানে আসতেই দাদি অভ্রকে থামিয়ে দিলেন। আমি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছি। কি করবো আমি? আর কি বলবো? রাফি কিসের প্রমাণ দেখাবো? আমার আর ওর কোনোদিন রিলেশন ছিলোই না! তাহলে?

দাদি এক প্রকার আদেশের সুরে রাফিকে প্রমাণ দেখাতে বললেন। রাফি অভ্রর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে এনে পকেট থেকে ফোন বের করলো। তারপর কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে কিছু একটা বের করে দাদির সামনে ধরলো। দাদি চোখের চশমাটা একটু ঠিক করে ফোনের স্ক্রিনে তাকালেন। সাথে সাথে ওনার কপাল কুঁচকে গেল উনি অভ্রর দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলা শুরু করলেন,

–“এসব কি দাদুভাই? ছিঃ এ কেমন মেয়ে পছন্দ করেছিস তোরা? এই মেয়ে আরেক ছেলের সাথে সম্পর্ক গোপন করে তোকে বিয়ে করতে এসেছে!”

–“নাহ দাদি। এই ছেলে মিথ্যা বলছে, আমি ওকে চিনি। এই ছেলে অনামিকাকে অনেক জ্বালায়। ওইদিনও তো……..

–“বেশ! নে তুই দেখে নে তোর হবু বউয়ের কাজ।”

এই বলে রাফির ফোনটা নিয়ে অভ্রর দিকে এগিয়ে দিলেন দাদি। অভ্র সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো সেদিকে। তারপর শান্ত দৃষ্টিতে রাফির দিকে তাকালো।

–“এই তোর প্রমাণ? বাড়ির বাকি মানুষকে এইটা দিয়ে বুঝালেও আমাকে বুঝাতে পারবি? জীবনেও না!”

–“কি বলছিস দাদুভাই তুই? দেখতে পাচ্ছিস না ছবিতে? ছেলেটা কিভাবে ওকে জড়িয়ে ধরে আছে। ছিঃ ছিঃ এগুলো দেখেও কেমন লাগছে।”

–“দাদি ওইদিন ঘটনাস্থলে আমিও উপস্থিত ছিলাম। আমি সবটাই দেখেছি আর তোমার কাছে যেটাকে স্বাভাবিক লাগছে, ওইটা আসলে জোরাজুরি ছিল। এই ছেলে ওকে জোর করে আটকে রেখেছিল। ওইদিন আমিই তো অনামিকাকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসলাম।”

এবার বাকি চারজনের মধ্যে থেকে একজন পুরুষ এগিয়ে এলেন। তারপর আংকেলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–“এসব কি হচ্ছে? তোর বাড়িতে এসে এগুলো দেখতে হচ্ছে কেন বল তো?”

–“দেখো বড় ভাইয়া আমি নিজেও কিছু জানি না। এই বিষয়ে অনামিকা আর অভ্রই ভালো বলতে পারবে।”

বড় ভাইয়া? তাহলে উনি অভ্রর বড় চাচা? সাথে বড় চাচি? আর বাকি দুজন? ওনারা সেজো না কি ছোট?

–“অনামিকা… অনামিকা?”

নিজের নাম শুনে ধ্যান ভাঙল। অভ্রর চিন্তিত মুখশ্রী চোখে পড়লো। এই চিন্তা কি আমার জন্য? কিন্তু কেন? হাজারো চিন্তার মাঝে টুপ করে এক ফোঁটা পানি মুখশ্রী হতে গড়িয়ে পড়লো। অভ্র এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

–“কিছু বলো প্লিজ। তুমি না বললে সবাই এই ছেলেটার কথা বিশ্বাস করবে।”

–“আমি কিছু বলার পরেও যে করবে না। তার গ্যারান্টি দিতে পারবেন আপনি? এখানে উপস্থিত অর্ধেক মানুষ তো অলরেডি বিশ্বাস করে নিয়েছে আমার যা মনে হয়।”

–“কেউ কিছু বিশ্বাস করেনি! আমি বলছি করেনি! আর আমি তো সত্যিটা জানি, দেখেছি আমি।”

–“বাকিরা জানেও না, দেখেওনি। তাই কথায় কেউ বিশ্বাস করবে বলে আমার মনে হয় না।”

–“আমি তো বিশ্বাস করি।”

এক বাক্যে যেন চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এই একটা বাক্য যেন ভরসার হাত হয়ে উঠলো। কিন্তু উনি জানেন তাই হয় তো বলছেন। বাকি মানুষগুলো যে আমাকে অবিশ্বাস করছে?

রাফি ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে লাগলো। ওর চেহারার হাব ভাব অন্যরকম। মনে হচ্ছে ওর মনের মধ্যে বিজয়ের আনন্দ!

–“চলো এবার।”

–“তোমার সাথে কেন যাবো আমি? বললাম না যাবো না। যদি যেতেই হয় একা যাবো আর নিজের বাসায় চলে যাবো কিন্তু তুমি ভুলেও এদিকে আসবে না।”

–“বুঝতে পারছি রেগে আছো। তাই বলে নিজের ভালোবাসার মানুষের উপর এভাবে রাগ করতে হয় না অনামিকা।”

আন্টি মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে। বাকিরা সবাই নিরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে। দাদিকে দেখে বুঝা যাচ্ছে ঘটনায় উনি বেশ বিরক্ত। অভ্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন। রাফি আমার দিকে হাত বাড়াতে যাবে তখনই অভ্রর রাগান্বিত কন্ঠ কানে এলো,

–“তোমরা সবাই দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে সবটা দেখছো কেন হ্যা? বাকিদের কথা না হয় বুঝলাম বাট আম্মু?তুমি তো অনামিকাকে কিছুটা হলেও চিনো? অন্তত পক্ষে তোমার তো কিছু একটা বলা উচিত তাই না? এই ছেলে যেই ছবিটা তোমাদের দেখাচ্ছে সেইটা সুযোগ বুঝে তুলে নেওয়া ছবি। আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম আমি জানি সবটা। আর দাদি এই একটা ছবি দিয়ে অনামিকাকে বিচার করো না। তোমাদের এসব কথায় ওর মনের উপর দিয়ে কি যাচ্ছে সেটা একটু ভেবে দেখো।”

দাদি নিজের চশমা আবার ঠিক করে অভ্রর দিকে তাকালেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা শুরু করলেন,

–“আমার দাদুভাইয়ের উপর বিশ্বাস রয়েছে। তবে এখানে যেটা ঘটে গেল সেটাকে উপেক্ষা করি কিভাবে? এই ছেলে যদি মিথ্যা বলে থাকে কেন বললো? অনামিকা আর ওর সম্পর্কও বা কি?”

–“কোনো সম্পর্ক নেই। ভার্সিটি থেকেই অনামিকাকে বিরক্ত করে এই ছেলে। ওর ব্যাপারে সব খবর আছে আমার কাছে। আগের বার ওয়ার্নিং দিয়ে পাঠিয়েছি তবে সেটা মনে হচ্ছে কাজে দেয়নি।”

আমার আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে মন চাইছে না। ছুটে পালিয়ে যেতে পারলে হয় তো শান্তি লাগতো। কেন এমন হলো! শরীরটাও মনে হচ্ছে শক্তি হারিয়ে ফেলছে।

–“চলে যাবো আমি।”

–“তুমি কেন যাবে হ্যা? গেলে এ ছেলেকে বের করবো আমি। তুমি কোথাও যাবে না।”

বলা মাত্রই রাফিকে নিয়ে দরজার দিকে অগ্রসর হলো অভ্র। রাফি বারবার নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, চেঁচামেচি করছে তবে কোনো লাভ হচ্ছে না তাতে। অভ্র এক ধাক্কায় ওকে বাড়ির বাইরে বের করে দিল।

–“তোর ব্যবস্থা এবার করতেই হবে। আর কখনো যদি অনামিকার আশে পাশে দেখি, তোকে কি করে ফেলবো আমিও জানি না!”

সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সবাই অভ্রর দিকে দৃষ্টি তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে চাইছে বারবার। আবার যেন নিজেকে থামিয়ে দিচ্ছে। এগুলো তো না হলেও পারতো?

•••••••••••••••••••••••

ঋতু আপু,অর্থি আর আন্টি সহ রুমে বসে আছি। সবাই আমাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টায় আছে। তবে তা খুব একটা কাজে দিচ্ছে না। নিজেও বুঝতে পারছি যেটা হয়ে গেছে তার দাগ মেটানো তো সম্ভব না। আন্টি এদিক ওদিক পায়চারি করছে বারবার। কিছুক্ষণ বাদেই অভ্রর রুমের বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

–“তোমরা একটু বাইরে যাবে? আমি একটু কথা বলতাম আর কি।”

তিনজনে এক এক করে রুমের বাইরে বেড়িয়ে গেল। অভ্র রুমে প্রবেশ করলেন। তারপর আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিয়ৎক্ষণ।

–“দরজাটা বন্ধ করি? আসলে আমি চাইনা কথাবার্তা বাইরে যাক। তোমার সমস্যা থাকলে বন্ধ করবো না, এমনিই বলবো।”

চোখ তুলে ওনার দিক চেয়ে সম্মতি জানালাম। উনি তারপর দরজা লক করে, একটা চেয়ার টেনে বসলেন।
গলা ঝেড়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলা শুরু করলেন,

–“দেখো যা হয়েছে সেটা অতীত মনে করে ভুল যাও। বাকিদের আমি বুঝিয়ে দিয়েছি। আম্মুরাও বিষয়টা বুঝতে পেরেছে, দাদিকে নিয়ে একটু প্রবলেম হতে পারে কিন্তু আমি ম্যানেজ করে নিব। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না একদম।”

–“আমি বিয়েটা করবো না।”

–“কিহ!?”

চলবে………………..
চলবে………………….^_^

[আজকে কিন্তু বড় পর্ব দিয়েছি। হালকা পাতলা মন্তব্য করে যাবেন। হ্যাপি রিডিং♡]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here