কোনো এক পূর্ণিমায় পর্ব -১৯+২০ ও শেষ

#কোনো_এক_পূর্ণিমায় (১৯তম পর্ব)

#লেখনীতে_ওয়াসেকা_তাবাসসুম

~বাসায় এসে থেকেই মন মেজাজ বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। ইচ্ছা ছিল আজকে বাসায় যাবো কিন্তু হলো না। অভ্র গতকাল রাতে বলেছিলেন যে আন্টিকে না কি বিয়েটা একটু পিছানো কথা বলেছেন। তাহলে কালকে বাসা থেকে ঘুরে আসাই যায়। কালকে সকাল সকাল উঠে আন্টি বলবো তাহলে।

রাত হয়েছে অনেক ঘুমানো উচিত। তার আগে একটু ফ্রেশ হয়ে আসা উচিত ভেবে ওয়াশরুমে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে মুখ মুছতে মুছতে রুমে ঢুকলাম। রুমে এসে বারান্দার দিকে গেলাম। বারান্দার কাছে আসার সাথে সাথে কেউ হাত ধরে টান দিল। হঠাৎ টান দেওয়ায় কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। চোখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেছে। অনুভব করতে পারলাম কারো বুকের উপর এসে পড়েছি। পিটপিট করে চোখ খুলতেই অভ্রকে দেখতে পেলাম। চোখাচোখি হতেই মুচকি হাসলেন উনি।

–“কি করছেন আপনি? আর এতো রাতে আমার রুমে কোথা থেকে এলেন?”

–“আমি আমার বউয়ের রুমে এসেছি। তোমার কি তাতে?”

–“এই যে শুনুন এখনো বউ হয়নি। ”

–“হতে কতক্ষন? বউ তো বউই।”

–“কেউ এসে যদি দেখে কি ভাববে বলুন তো? ছাড়ুন আমাকে।”

অভ্র হাতের বাঁধন আরো শক্ত করলেন। ওনার সাথে দূরত্ব আরো কমে গেল। এই প্রথমবার অদ্ভুত এক অনুভূতির সাক্ষী হলাম।

–“কেউ আসবে না আর দেখবেও না। তোমার রুমের দরজা একদম লাগিয়ে এসেছি। সবাই ভাববে তুমি ঘুমিয়ে গেছো।”

–“যদি আপনার খোঁজ করে?”

–“করলে করুক তাতে আমার কি?”

–“মাথা নষ্ট হয়ে গেছে আপনার মহাশয়।”

–“তুমিই তো নষ্ট করে দিচ্ছো। এ কি করলে বলো তো? কেন মন ঘুরে ফিরে তোমাতেই এসে আটকে যায়?”

এই প্রথম ওনার কথায় গালে লাল আভা ছেয়ে গেল। অভ্রর এক দৃষ্টি আমাকে অবশ করে তুলছে একদম। এভাবে তাকিয়ে থাকলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো। নিজে ছাড়ানোর জন্য নড়াচড়া করা শুরু করলাম।

–“এই লাফাচ্ছো কেন?”

–“ছাড়ুন আমাকে।”

–“ইসস রে কেন হবু স্বামীর কাছে থাকতে ভালো লাগে না?”

–“কাছে রাখার কাগজ পত্র এখনো পান নাই আপনি।”

–“তাই তো? আম্মুকে বলে কালকেই কাবিন করাচ্ছি ওয়েট।”

–“হেহ পাগল আপনি? কালকে আমি একটু বাসায় যাবো।”

সাথে সাথে অভ্র আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমিও সামলে নিয়ে দাঁড়ালাম। উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,

–“কেন যাবে?”

–“অনেক দিন তো যাই না। হাজার হোক আমার বাসা ওইটা আর কত জিনিসপত্র আছে সেখানে।”

–“তো? পরেও আনা যাবে সেসব।”

–“আমি তবুও যাবো। আব্বুর সাথে দেখা করবো না?”

–“আংকেল তো এমনিতেই বিয়ের দিন আসবেন।”

–“আপনি কি চাচ্ছেন এই বাড়িতে বিয়ে হবে?”

–“হ্যা তো?”

–“এই আপনি কি আসলেই পাগল?”

–“তোমার মাথা। খালি যাই যাই করো কেন হ্যা?”

–“এমন ভাব করছেন যেন সারাক্ষণ যাই যাই করি। বিয়ের পর তো একেবারে এই বাড়িতেই আসবো তাই না?”

–“হ্যা তারপরে এইখানেই বিয়ে হলে সমস্যা কি?”

–“আপনি থামুন তো। বেশি বুঝেন আপনি।”

–“ঠিক আছে আসছি আমি।”

অভ্র যেতে নিলে খপ করে ওনার হাত ধরে নিলাম। লোকটা রেগে গেলো না তো? এমনিতেই হাসতে পারে না আবার রেগে থাকলে তো আরেক সমস্যা। ওনার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি তারপরে উনি একটাবারও আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছেন না।

–“শুনছেন?”

–“হুম”

–“রাগ করবেন না প্লিজ। কালকে যাবো আপনি পরশু দিন আমাকে নিয়ে আসবেন ঠিক আছে?”

–“হুম”

–“হুম হুম করছেন কেন?”

–“এমনি”

–“ভালো কথা মনে পড়েছে। আপনি কিন্তু এখনো আমাকে বলেন নি।”

–“কি বলবো?”

–“ওই যে ওইদিন?”

–“ওহ্ সেটা।”

–“বলবেন না?”

–“জানি না”

–“ঠিক আছে চলে যান।”

অভ্রর হাত ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ বাদে অভ্রও চলে এলেন। হেহ লাভ কি হলো রাগ করে? নিজেরই তো আসতে হলো। অভ্র আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে নিলেন। ওনার এহেন কান্ডে আমারও কপালে ভাঁজ পড়লো।

–“কি সমস্যা?”

–“তোমার কি সমস্যা? ফ্লোরে বসে আছো কেন? ভিতর থেকে চেয়ার এনে বসা যাচ্ছে না?”

–“নাহ এভাবে বসার মজা আছে। আপনি বুঝবেন না।”

কথাটা বলে হাত পা আরেকটু গুটিয়ে বসে পড়লাম। অভ্র একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন।

–“আপনিও বসলেন যে?”

–“তোমার কি তাতে? চুপ থাকো তো।”

–“কিছু বললেই দোষ হয়ে যায়! কথাই বলবো না।”

–“বলো না। বলতে বলেছে কে?”

–“আপনি আসলেই একটা খারাপ মানুষ।”

অভ্র হঠাৎ করেই হেসে উঠলেন। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি বজায় রেখে অক্ষিদ্বয় বন্ধ করে আকাশ পানে চাইলেন। এদিকে আমার চক্ষুদ্বয় ওনাতেই‌ স্থির হয়ে আছে। আচমকা অভ্রর হাত আমার হাতে পড়লো। সাথে সাথে হাত সরাতে নিলে উনি খপ করে ধরে ফেললেন।

–“ধুর খালি পালাই পালাই করে। বললাম না চুপচাপ বসে থাকো।”

–“কিন্তু হাত…

–“কি সমস্যা?”

–“না কিছু না।”

–“জানো অনামিকা?”

–“কি?”

–“তুমি ছোটবেলায় অনেক সুন্দর ছিলে।”

–“আপনি কিভাবে জানলেন?”

–“দেখেছিলাম তোমাকে কয়েকবার। তবে তোমার সাথে পরিচয় হয়নি কখনোই। আম্মু আমাকে বলতো একদিন না কি তোমার সাথে বিয়ে দিবে। একটা সময় পর্যন্ত আম্মুর কথা মজা হিসাবে নিলেও তারপরে কি জানো হলো। যেদিন আম্মু প্রথম ভাবিদের বাসায় গিয়েছিল। ফেরত এসেই বলেছিল তোমাকে অনেকটা অধরা আন্টির মতো দেখতে। ভাইয়ার বিয়ের আগে আরেকবার গেছিলো আর ওইদিন তোমার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে এসেছে একদম। আমাকে এসে কি বলেছে যেন? বলেছিল,”অভ্র রে তোর বউ পেয়ে গেছি।” কথাটা শুনে হাসবো না কাঁদবো সেটাই বুঝে উঠছিলাম না।”

ওনার কথা শেষে দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম। অভ্র আমার বলতে শুরু করলেন,

–“যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল সেদিনও ধাক্কা খেয়েছিলাম মনে আছে? তোমাকে দেখে কোথাও না কোথাও আমারও মনে হয়েছিল তোমাকে আমি চিনি। তারপর বিয়ের দিনও সেই ধাক্কাই খেলাম।”

–“আপনার সাথে পরিচয়টাই তো ধাক্কা দিয়ে।”

–“তা ঠিক। তবে আফসোস সিনেমার মতো ধাক্কা খেয়ে একবারো কোলে এসে পড়নি।”

–“কি বলতে চাচ্ছেন আপনি হ্যা?”

–“হেহ কিছু না।”

কিছুক্ষণ নিরবতা বজায় রেখে দুজনেই বসে রইলাম। এরপরে কি বলা উচিত আমিও জানি না। বেশ কিছুক্ষণ পার হওয়ার পর অভ্রই বলে উঠলেন,

–“বিয়ের পর “তুমি তুমি” করবা। এই আপনি আপনি ভালো লাগে না।”

–“সম্মান দিচ্ছি ভালো লাগছে না?”

–“স্বামীকে “তুমি” করে বলা মানে অপমান করা না ম্যাডাম।”

–“আর স্বামী, কি হবে স্বামী দিয়ে? একা এসেছি একা যেতে হবে।”

আবারো ভ্রু কুঁচকে তাকালেন অভ্র। আমি স্বাভাবিকভাবে হাসলাম। উনি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

–“শখ বেশি তাই না? বিয়ে করে তোমাকে আর এই বাড়িতেই আনবো না খুশি? একা থেকো একদম।”

–“এটা কোনো কথা? একা ফেলে রেখে আসবেন তাই বলে?”

–“এই যে এখন তো নিজেই আসতে চাইছো। তাও মুখ দিয়ে বের হয় না কথা।”

–“আপনিও তো “ভালোবাসি” মুখ দিয়ে বলেন না।”

এহেন কথায় যে অভ্র অবাক হয়েছেন ওনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন। আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। নিজের কথায় নিজেই জিভ কাটলাম। অভ্র উঠে দাঁড়ালেন তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

–“রাত হয়েছে ঘুমাও। কালকে কখন যাবে আমাকে বলো। আমি গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবো। আর ফ্লোর থেকে উঠো এরপর ঠাণ্ডা লাগলে সমস্যা”

কোনো উত্তর দিলাম না খালি হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। উনি মৃদু হেসে বারান্দা থেকে বের হলেন। তারপর দরজা খুলে চারপাশ চোখ বুলিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আমিও উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। কিছুক্ষণ বাদেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম।

•••••••••••••••••••••

আন্টিকে বলে অভ্র আর আমি বেরিয়ে পড়েছি বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। অভ্র মনোযোগ সহকারে গাড়ি ড্রাইভ করছেন। আমি কানে এয়ারফোন দিয়ে বসে আছি। আজকে অভ্র জানালার কাঁচ খোলা রাখায় শীতল হাওয়ায় কিছুটা শিউরে উঠলাম।

–“কাঁচ খুলে রেখেছেন কেন? ঠান্ডা লাগছে তো।”

–“তুমিই দেখি গাড়িতে উঠলে বলো কাঁচ খুলে রাখতে এখন কি হলো?”

–“না ঠান্ডা লাগছে বন্ধ করুন।”

–“এইটুকুতে কিছু হয় না।”

–“এই মজা নিবেন না একদম।”

–“আচ্ছা ঠিক আছে।”

অভ্র কাঁচ উঠিয়ে দিলে আবারো সিটে গা এলিয়ে বসলাম। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে আমার, আশপাশ চোখ বুলিয়ে বুঝলাম এখনো কিছুটা পথ বাকি। এই সুযোগে চোখ বন্ধ করে ঘুমানো চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ বাদে তলিয়ে গেলাম ঘুমের দেশে।

ঘুম ভাঙতেই হাই তুলতে তুলতে পিটপিট করে চোখ খুললাম। সাথে সাথেই কিছুটা চমকে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম!

চলবে……………^_^

[গল্পের শেষের দিকে চলে দিকে চলে এসেছি। গল্প নিয়ে মতামত দিয়ে যাবেন♡]#কোনো_এক_পূর্ণিমায় (২০তম পর্ব)

#লেখনীতে_ওয়াসেকা_তাবাসসুম

#সমাপ্তি_পর্ব

~পাশে অভ্রকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। এতক্ষণ ওনার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলাম? অভ্র ফোন চালাচ্ছেন পূর্ণ মনোযোগে।

–“আমি এখানে কেন? আমরা কোথায়?”

–“ঘুম থেকে উঠেই পাগল হয়ে গেছো। আমরা তোমারই বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি।”

–“ওহ্ তাই তো। দেখেছেন মাথা থেকে বেরিয়েই গেছিল পুরো।”

–“কবে আমিও না বেরিয়ে যাই।”

–“হেহ কিছু বললেন?”

–“কই না তো। যাও যাও দেরি হচ্ছে না?”

–“হ্যা আসছি তাহলে।”

গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। কিছুটা নিচু হয়ে কাঁচের এপার থেকে অভ্রকে বিদায় জানালাম। উনি খালি মৃদু হাসলেন। আমি বাসার দিকে হাঁটা দিলাম, গেটের সামনে আসতেই অভ্রর ডাক শুনলাম। পিছনে ঘুরে দেখলাম উনি গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছেন। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি ফুটে রয়েছে।

–“চলে যাচ্ছো?”

–“মাত্র একটা দিনই তো।”

–“আমার কি হবে?”

–“কিছু হবে না বুঝেছেন? এতদিন একা কিভাবে ছিলেন? ওভাবেই থাকবেন।”

–“এতদিন তো তুমি ছিলে না। এসেই তো একা থাকার অভ্যাসটা ভঙ্গ করে দিলে।”

–“একটা দিন দেখতে দেখতেই চলে যাবে। বাসায় গিয়ে কালকের প্রস্তুতি নিন অভ্র সাহেব। কালকে থেকে চিরকালের জন্য আপনার ঘাড়ে উঠে বসে থাকবো।”

–“আমার সমস্যা নেই তাতে। তবে একটা দিন যদি না যায়?”

–“উফফ এইবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে। কিছুই হবে না আপনি নিজেও জানেন। এক কাজ করুন তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে ঘুমান তাহলে আর আমার কথা মনে হবে না।”

–“বেশি বেশি না। যদি তুমি বুঝতে হয় তো বলতে না যাই হোক যাও তাহলে।”

কথাটায় কিছুটা খারাপ লাগলো। ওনার চেহারাও হাস্যজ্জ্বল থেকে মূহুর্তেই মলিন হয়ে গেল। আমার কথায় কি কষ্ট পেলেন উনি? অভ্র এখনো একইভাবে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছেন। ভ্রু উঠিয়ে আমাকে বললেন,

–“যাচ্ছো না কেন?”

–“আপনি যাবেন না?”

–“তুমি যাও আমিও যাচ্ছি।”

–“আসি তাহলে কালকে তো দেখা হচ্ছেই।”

–“হুম”

সোজা হাঁটা ধরলাম আবার থেমে গেলাম ঘুরে আরেক বার অভ্রকে দেখে নিলাম। কেমন জানো লাগছে মানুষটা থেকে দূরে যেতে। কিন্তু এটা তো কোনো ব্যাপার না। কিছুক্ষণ দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর মৃদু হেসে চলে এলাম।

উপরে এসে দরজায় বেল দিলে কিছুক্ষণ বাদেই দরজা খুলে যায়। সামনে খালামনিকে দেখে কিছুটা চমকে গেলাম। আবার গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম খালামনিকে। খালামনি আমাকে ভিতরে নিয়ে এলেন। ভিতরে এসে কতগুলো পরিচিত মুখ দেখে বেশ ভালো লাগলো। আব্বু,খালু তারপর আরো কয়েকটা পরিচিত মুখ। কালকে বিয়ে দেখে কয়েকজন কাজিন এসেছে বাসায়। আমি গিয়ে বড়দের সালাম দিলাম তারপর আব্বু ফ্রেশ হতে বললে নিজের রুমে গেলাম। ওয়াশরুমে গিয়ে ভালো মতো হাত মুখ ধুয়ে নিলাম।

সবার সাথে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। হেলতে দুলতে নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ অভ্রর কথা মনে হতেই ফোন হাতে নিলাম। তারপর ওনাকে মেসেজ দিলাম,”পৌঁছেছেন?” ততক্ষণাৎ উত্তর পেলাম না দেখে ফোনটা রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পর টুং করে আওয়াজ হতেই আবার হাতে নিলাম। অভ্র রিপ্লাই দিয়েছেন,”হ্যা অফিসে এসেছি। একটা মিটিং ছিল কেবল শেষ করে এলাম।”

আবারও মেসেজ দিলাম আমি,”দুপুরে খেয়েছেন? না খেয়ে থাকলে খেয়ে নিন।” সাথে সাথে উত্তর পেলাম,”খাইনি এখনো। একটু দেরি হবে কিন্তু খেয়ে নিবো।” আমিও রিপ্লাই দিলাম,”ঠিক আছে। সময় মতো বাসায় চলে যাবেন কিন্তু। এখন মন দিয়ে কাজ করুন, কথা শুরু হলে আর থামবে না কিন্তু।” অভ্র কিছুক্ষণ সময় নিয়ে উত্তর দিলেন আবার,”সাবধানে থেকো। কালকে দেখা হচ্ছে, আসি তাহলে কিছুক্ষণ পরে আরেকটা মিটিং আছে।” তারপর স্বাভাবিক ভাবে আচ্ছা বলে কথা শেষ করে দিলাম।

••••••••••••••••••••

আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। প্রথমেই বলে দিয়েছিলাম যেহেতু এখন বিয়ে নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান করবে না তাই আজকেও তেমন জাঁকজমকের কিছু না করতে। ঋতু আপুর মতোই ছাদে ছোটখাটো পরিসরে আয়োজন করা হয়েছে সব।

আমাকে সাজানোতে ব্যস্ত সবাই। এর মাঝেই কাজিন দের নানা কথার শিকার হতে হচ্ছে আমাকে। একটু পর পরই অভ্রকে নিয়ে কথা উঠাচ্ছে সবাই। পারছি না খালি পালাতে বসে বসে খালি শুনেই যাচ্ছি। হঠাৎ এক আপু উৎসাহিত কন্ঠে বলতে লাগল,

–“অনু তোর বরকে কিন্তু দেখেছি। ছবিতেই কি‌ সুন্দর দেখতে! তাহলে বাস্তবে দেখলে অজ্ঞান না হয়ে যাই আবার।”

আপুর কথায় সবাই খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আমি জোরপূর্বক হেসে এড়িয়ে গেলাম তবে আমার মোটেও হাসি পায়নি। অদ্ভুত তো! আমার বরকে দেখে অজ্ঞান হতে হলে আমি হবো। অন্য কেউ কেন হবে? আরেকজনের বরের দিকেই বা এরা নজর দেয় কেন বুঝি না!

বেশ কিছুক্ষণ আমাকে সাজিয়ে সবাই চলে গেল। কারণ বরপক্ষ না কি কাছাকাছি চলে এসেছে। আমি রুমে একা একা বসে জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিছুটা সময় অতিক্রম হওয়ার পর দেখলাম কতগুলো গাড়ি বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। এক এক করে অনেকেই নামলো। ঋতু আপু, অনিক ভাইয়া, অর্থি, আবিদ থেকে শুরু করে আন্টি, আংকেল তারপর বাকিরাও নামলো কিন্তু অভ্রর খবর নেই।

তারপরেই বাদামী রঙের হালকা কাজ করা পাঞ্জাবি পরিহিত একজন নামলো গাড়ি থেকে। নিচে নেমে পাঞ্জাবির হাতা ঠিক করতে করতে উপরে তাকালেন অভ্র। তড়িৎ গতিতে জানালা থেকে সরে গেলাম আমি। উনি আবার দেখে ফেললেন না তো আমাকে? কি জানি! যাচাই করতে আবারো উঁকি দিলাম। তবে দেখতে পেলাম না ওনাকে। হয় তো গেটে চলে গেছেন, আর কি আমিও বসে রইলাম চুপচাপ। কারণ এখন ওনাদের অ্যাপায়ন চলবে কতক্ষণ। তারপর আরো কত কাহিনী তারপর এসে আমাকে নিয়ে যাবে।

বিছানায় চুপচাপ বসে আছি। এককালের ইচ্ছা ছিল বিয়েতে লেহেঙ্গা পড়বো। এই একটা মাত্রই শখ ছিল বিয়ে নিয়ে কিন্তু তাও হলো না। হয় তো হবে কিন্তু তাতে তো দেরি আছে আরো। হালকা গোলাপি রঙের কাজ করা শাড়ি পড়েছি। তবে সেটাও খালামনির পছন্দ করে দেওয়া। আনমনা হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছি। এত সময় ধরে বসিয়ে রাখছে এবার তো খিদা লেগে যাবে! তখন আবার আরেক বিপদ হবে।

এর মধ্যেই দরজার খোলার আওয়াজ পেলাম তারমানে বাকিরা নিতে এসেছে? আগ্ৰহী চাহনিতে সেদিকে চেয়ে রইলাম। এক এক করে কয়েকটা কাজিন এলো। তারপর তাড়া দিয়ে বললো,

–“চলো চলো তোমাকে উপরে হস্তান্তর করার সময় এসে গেছে।”

এই বলে আমাকে নিয়ে উপরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো সবাই। দু এক মিনিট পরে উপরে পৌঁছে গেলাম। এবার কেমন যেন লাগছে! মনে হচ্ছে হার্ট এক একটা হার্টবিট কম নিচ্ছে। আমাকে নিয়ে যেতে লাগলো কাঙ্ক্ষিত জায়গায়। কিছুটা যাওয়ার পরেই দেখলাম সবাই বসে রয়েছে আর তার মাঝেই বসে আছেন অভ্র।
ওনাকে দেখে কিছুক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে রইলাম। আজকে উপলব্ধি হলো লোকটা আসলেই হ্যান্ডসাম! এতদিন উনি নিজে মজা করে বলতেন তবে এরপর থেকে অস্বীকার করা কঠিন হয়ে যাবে।

সামনে যেতেই অভ্রর চোখ পড়লো এদিকেই। ওনার সাথে দৃষ্টির মিল হতেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আপুরা আমাকে নিয়ে অভ্রর পাশে বসিয়ে দিলেন। চুপচাপ সেখানে বসে রইলাম। পাশে যে একটা মানুষ বসে আছে সেদিকে একটা বার তাকালাম না পর্যন্ত। অভ্র চেপে এদিকে এসে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলেন,

–“কি ব্যাপার কি? আমার দিকে তো ঘুরেও তাকাচ্ছো না।”

–“তাকিয়ে করবো কি? চুপচাপ বসে থাকুন তো।”

–“আহা লজ্জা পাচ্ছো না কি? সমস্যা কি আমিই তো। পর পুরুষ হলে একটা কথা ছিল তা তো না।”

কটমট চোখে তাকালাম অভ্রর দিকে। উনি মুখ টিপে হাসলেন। আবারো দৃষ্টি নত করলাম। সবাই চলে এলে বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।

সব কার্যক্রম শেষে বিয়ে সম্পন্ন হলো। অভ্রর সাথে একে একে করে বড়দের সালাম করলাম। তারপর সবাই মিলে বাসায় গেলাম। আর টুকটাক যারা গেস্ট এসেছিলেন সকলেই চলে গেলেন এর মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হবে সকলে।

মেয়েরা সবাই এক রুমে বসে আছি। আব্বু রুমে আসলে সবাই এক এক করে চলে গেল। আব্বু এসে আমার পাশে বসলো। স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

–“এত বড় হয়ে গেলি কবে রে? আজকে সারা জীবনের মতো চলে যাবি তুই। আমি যে একেবারে একা হয়ে যাবো এবার।”

–“এভাবে বলছো কেন তুমি? এভাবে বললে আমি যাচ্ছি না।”

–“হুস এসব বলে না। বিয়ে করে মেয়েদের চলে যেতে হয় এটা স্বাভাবিক। তোর মায়ের চলে যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেছিলো হাজার হোক তুই যেন ভালো থাকিস। কতটুকু পেরেছি জানি না তবে অভ্রর হাতে তোকে তুলে দিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হবো এবার। অভ্র তোকে ভালো রাখবে আমার বিশ্বাস। মায়েদের মতো উপদেশ তো দিতে পারবো না যে শশুরবাড়ি গিয়ে কিভাবে থাকতে হয়, খালি বলবো নিজের এবং বাকি সবার খেয়াল রাখিস।”

চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। আব্বুকে জড়িয়ে ধরেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম বসে বসে। আব্বু যে অনেক কষ্টে কান্নাটা আটকে রেখেছে তাও বুঝতে অসুবিধা হলো না। কিছু সময় অতিক্রম হলে খালামনি তাড়া দিল এখন সবাই বের হবে। সকলে একসাথে নিচে নেমে এলাম। এক এক করে সবাই গাড়িতে উঠতে আরম্ভ করলো। আমি আর অভ্র বাড়ির লোকজনের থেকে বিদায় নিয়ে একটা গাড়িতে উঠে পড়লাম। সারাটা পথ চুপচাপ বসে থাকলাম। অভ্র বুঝতে পারলেন মন খারাপের বিষয়টা উনিও পুরোটা সময় আমার হাত ধরে বসে ছিলেন।

সময় মতো সকলে বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। ধীরে ধীরে বড়রা সবাই যে যার ঘরে বিশ্রামের জন্য চলে গেলেন। তারপর সবাই ফ্রেশ হয়ে অভ্রর কাজিন মহল এসে বসলো আমাদের ঘরে। সকলে যে যার মতো আসন খুঁজে বসে পড়েছে। অভ্র সহ বিছানায় বসে আছি আর সবাই আমাদের ঘিরে বসে আছে। অভ্র মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। আবিদ উঠে দাঁড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো,

–“ওকে ওকে ফাইনালি আমাদের সকলের প্রিয় এবং আমার ভাইয়া অভ্র ভাইয়া উনি আমাদের অনামিকার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। তালি হবে!”

সাথে সাথে সবাই তালি বাজানো শুরু করলো। আমিও নিঃশব্দে হাসলাম শুধু। পাশে অভ্র এখনো কপালে হাত দিয়ে বসে আছেন। ওনাকে দেখে অনিক ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন,

–“এখনি মাথায় হাত পরে গেল তোর? সামনে আরো কত কি বাকি!”

ঋতু আপু আড়চোখে তাকালো ভাইয়ার দিকে। ভাইয়া অস্বস্তির হাসি হাসলেন শুধু।

–“আমার ক্লান্ত লাগছে প্রচুর। তোদের চোখে ঘুম নেই হ্যা? সবাই ঘুমাতে যাহ এখনি! যাহ পালা সব!”

–“আরেহ বুঝতে পারছি আমার সামনে বউয়ের সাথে কথা বলতে পারছিস না তাই বলে তাড়িয়ে দিবি রে?”

–“এই তোমরা যাবে? বের হও তো!”

সবাই সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন অভ্রর দিকে। তারপর এক এক করে উঠা শুরু করলেন। মাঝ দিয়ে অভ্রকে কথা শুনাতে শুনাতে এক এক করে সবাই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সবাই চলে যেতেই অভ্র দরজা বন্ধ করে দিলেন।
চুপচাপ এসে পাশে বসলেন। উনি কিছু বলবেন তার আগেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,

–“কয়টা বাজে?”

অভ্র ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে উত্তর দিলেন,

–“বেশি না। এখনো বেশি রাত হয়নি। আচ্ছা অনামিকা আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম….

–“ঘুমাই?”

–“অ্যা? ঘুমাবে?”

–“আপনিও তো বললেন আপনার ক্লান্ত লাগছে। আসলে আমি কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিলাম না কিন্তু আপনি যখন নিজে থেকে বললেন মনে হলো বলেই দেই। আসলে আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে বুঝলেন।”

–“হ্যা না মানে আচ্ছা। হ্যা ঘুমাও।”

–“আচ্ছা থ্যাংকিউ।”

বালিশ টেনে শুয়ে পড়লাম। অভ্র কম্বল এনে গায়ের উপর দিয়ে দিলেন। অভ্র পাশে হেলান দিয়ে বসে রইলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলাম আমিও।

•••••••••••••••••••••

অভ্রর ডাকে ঘুমের রাজ্য থেকে জেগে উঠলাম। পিটপিট করে চোখ মেলে অভ্রর হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী দেখতে পেলাম। ওনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে উঠে বসলাম। উনি আমাকে ধরে নিচে নামালেন।

–“কি করছেন?”

–“যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো তাড়াতাড়ি।”

–“কিন্তু কেন? কয়টা বাজে এখন?”

–“রাত ১টা বাজে এখন।”

–“হেহ? আপনি এখন আমাকে জাগালেন কেন?”

–“এতো ঘুম কিসের হ্যা? ওয়াশরুম থেকে আসো তারপর ছাদে যাবো।”

–“দাঁড়ান আসছি।”

চটজলদি ফ্রেশ হয়ে এলাম। তারপর একটা ওড়না জড়িয়ে অভ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি আমার হাত ধরে বললেন,

–“চুপ থাকবে কিন্তু গুটিগুটি পায়ে যাবো। এখন কেউই জেগে থাকার কথা না তাই সমস্যা হবে না।”

আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। তারপর ওনার হাত ধরে হাঁটা দিলাম ছাদের উদ্দেশ্যে। গুটিগুটি পায়ে ছাদে এসে পৌঁছালাম দুজনে। দুজনে গিয়ে ছাদের রেলিং ঘেসে দাঁড়ালাম। আকাশ পানে তাকিয়ে রইলাম উজ্জ্বল চাঁদটার দিকে। অভ্র এক হাত গালে দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার‌ দিকেই। যা বুঝতে পেরে মৃদু হাসলাম শুধু।

–“ভালোবাসলে বলে দিতে পারেন কিছু মনে করবো না অভ্র সাহেব।”

–“শুনবে না কি?”

–“কি শুনাবেন?”

–“ভালোবাসি। ভালোবাসি তোমায় অনু। শুনতে পেয়েছো?”

এক কথায় থমকে গেলাম সম্পূর্ণ। কথাটা যেন মনে এসে আঘাত করলো। অভ্র আমার দু বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরালেন। তারপর নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন। ওনার বুকে মাথা রেখে চুপ করে রইলাম।

–“কতদিন বাঁচবো জানি না। তবে যতদিন আছি তোমার সাথে থাকতে চাই। কোনো এক পূর্ণিমায় তোমাকে নিজের করে পাবো আসলেই ভাবিনি।”

এখনো চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কি বলা উচিত আমার? ওনার কথার কোনো উত্তরই তো নেই আমার কাছে। উনি আমায় চুপ থাকতে দেখে ওনার ওষ্ঠদ্বয় আমার কপালে ছোঁয়ালেন।

–“কিছু বলবে না?”

–“জানি না শুধু জানি আপনার মতো হয় তো বাসি না তবে একদিন আপনার থেকেও বেশি ভালোবেসে দেখাবো বলে দিলাম।”

এই বলেই ওনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড় দিলাম ছাদেই। উনিও আমার পিছনে দৌড়াতে লাগলেন। শেষমেষ হেরে গিয়ে ধরা দিলাম ওনার হাতে। স্নিগ্ধ চাঁদের আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে আছে। চাঁদের কিরণ দুইজনকেই ছুঁয়ে দিচ্ছে। সেই আলোয় আবারো আমায় জড়িয়ে ধরলেন অভ্র। শুভ হোক বাকি জীবন এই আশায় ওনার সাথেই নতুন জীবনের পথ চলা শুরু করলাম।

———-সমাপ্ত———-

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here