খেলাঘরে তুমি আমি পর্ব -০৪

#খেলাঘরে_তুমি_আমি
পর্ব—০৪
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

—তোমার কথা সরাসরি বলেনি।তবে ও মনে করে ওর স্ত্রীর খু ন আর কেউ নয়,ওর কাছের লোকজনই করেছে।পারমিতা আমার ভয় হচ্ছে অর্ণব বুঝে যায়নি তো মিথিলার খু ন আর কেউ নয় তুমি করিয়েছো….

মায়ের কথা শুনে আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম।এগুলো কি শুনছি আমি নিজের কানে?

মা আগে থেকেই জানতো মিথিলার খু ন ওর বোন পারমিতা করিয়েছে..,তাহলে কি এসবের ভেতরে পারমিতার সাথে সাথে আমার মাও জড়িত….?

মা আর পারমিতার কথাগুলো শুনে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো আমার।এই পৃথিবীতে মায়ের পরে যদি আমি কাউকে সবথেকে বেশি ভালোবেসে থাকি সে শুধুই মিথিলা।আর এই কথাটা মায়ের থেকে আর কেউ ভালো জানতো না।তাহলে মা আর ভালোবাসাকে কিকরে শেষ হতে দিতে পারে?মিথিলার প্রতি কিসের এতো রাগ ছিলো তার,এটা আমাকে জানতেই হবে আর সেটা যেকোনো প্রকারে।ইচ্ছে করছে মাকে গিয়ে এক্ষুণি জিজ্ঞেস করি।

—মা,তুমি আমার ভালোবাসাকে কেনো এভাবে শে ষ হতে দিলে,আমার ছেলেটাকে কেনো মা হারা করলে?কী ক্ষতি করেছিলো তোমার মিথিলা,আমার ভালোবাসাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও মা।

যদি মায়ের সামনে গিয়ে কথাগুলো বলে বলে নিজের মাথাটা ঠুকতে পারতাম হয়তো একটু স্বস্তি পেতাম আমি।কিন্তু এক্ষুণি সেই উপায় নেই আমার।তবে তাই আমি আমি আমার মাকে কিছুতেই ক্ষমা করবো না।মিথিলার মৃত্যুর পেছনে ওর বোন পারমিতা ছাড়া যদি মায়ের সত্যিই বিন্দুমাত্র ভূমিকা থেকে থাকে তার শাস্তি মাকে পেতে হবে।কেউ নিজেদের কৃতকর্মের থেকে ছাড় পাবে না।

কথাগুলো ভেবে আমি নিজের ঘরের দিকে চলে গেলাম।কাঁধের ব্যাগটা খুলে রাখতেই রিসালাত ঘুম থেকে জেগে উঠলো।আমি ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম।আমায় কাছে পেয়ে রিসালাতের কান্না মূহুর্তেই থেমে গেলো।ওর মুখের দিকে তাকাতেই কান্নায় চোখদুটো ভেঙে আসতে লাগলো আমার।ছেলেদের কান্না মানায় না,কোথাও একটা শুনেছিলাম।কিন্তু এই মুহুর্তে আমার কাছে কথাগুলো অত্যন্ত নিরর্থক মনে হচ্ছে।একটা ছয় মাসের শিশু,যার কিনা ঘুম ভাঙার পরে সবার আগে নিজের মাকে পাওয়ার কথা আজ তাকে একলা অসহায়ের মতো কাঁদতে হচ্ছে।এতো বড়ো পাপের শাস্তি সৃষ্টিকর্তা আমার স্ত্রী আর মাকে কি দেবে জানি না কিন্তু আমি কি শাস্তি দেবো মনে মনে ঠিক করে নিয়েছি।আমার চোখের দুফোটা জল রিসালাতের গালের ওপরে গিয়ে পড়লো,অমনি ও নড়েচড়ে উঠলো।
যেদিন প্রথম বাবা হয়েছিলাম রিসালাতকে পেয়ে আমি অনুভব করতে পেরেছি আমার প্রানটা যেনো দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো।একটা ভাগ আমার ভেতরে বাকিটা রিসালাত!আমি নিজেও জানি না নিজের প্রানকে কোথায় লুকিয়ে রাখবো।আগে পারমিতার ভয় ছিলো,কিন্তু এখন তার সাথে আমার মাও যুক্ত হলো।মা আমার স্ত্রীকে খু ন হতে দিতে পারলে আমার ছেলের ক্ষতি করতে হয়তো দুবার ভাববে না।

রিসালাতকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছাদের ওপর গেলাম।আকাশটা চাঁদের রুপালী আলোয় ঝলমল করছে।রেলিংএর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালাম।আকাশের দিকে তাকাকেই ভেতর থেকে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।ছোবেলায় শুনেছিলাম মানুষ নাকি মরে গিয়ে আকাশের তারার হয়ে যায়।যদিও এই কথার কোনো ভিত্তি নেই,কিন্তু আজ মনটা অদ্ভুতভাবে সেই মিথ্যেটাকেই সত্যি হিসেবে মানতে চাইছে।মিথালা মারা যাবার পরে যদি আকাশের তারা হয়ে থাকে ও নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছে আমায়।শুধু আমায় না নিজের ছেলেকেও দেখতে পাচ্ছে।



পরেরদিন..
যখন রুমে বসে কিছু অফিসের কাজ করছি,আমার কাছে রিফাতের একটা ফোনকল আসলো।ফোনটা রিসিভ করতেই রিফাত ওপাশ থেকে বলে ওঠে।

—দোস্ত তোর কাজ হয়ে গিয়েছে,তোর নম্বরের ডিটেইলস কালেক্ট করে ফেলছি।

—কী বলিস দোস্ত,এতো তাড়াতাড়ি?থ্যাঙ্কস রে,

—আর ধন্যবাদ জানাতে হবে না।তোকে মেসেজ করে পাঠিয়েছি,দেখে নে এক্ষুণি।

কালবিলম্ব না করে রিফাতের মেসেজ চেক করতে লেগে পড়লাম।লোকটার নামটা দেখে কেমন জানি একটু খটকা লাগলো আমার।সাহিত্য চৌধুরী!এই নামটা তো আমার এক পরিচিতর,যার সাথে বহুদিন যাবত যোগাযোগ নেই আমার।তবে কি এই সে সাহিত্য…?নামটা দেখে আমার কৌতূহলের মাত্রা কয়েকগুন বেড়ে গেলো।যদিও বাদবাকি ডিটেইলস দেখে সেরকম কিছুই মনে করতে পারছি না।কিন্তু এই নামটা আমার বড্ড চেনা।মিথিলার সাহিত্য চৌধুরীর সাহায্য নিয়ে আমার স্ত্রীকে খু ন করেছে।সে হয়তো জানেই না যাকে খু ন করেছে সে আমার স্ত্রী,যদি এই ব্যক্তি আমার সেই পরিচিত হয়ে থাকে।একজন ডাক্তার হয়ে পেসেন্টের প্রান নেওয়া।এই মানুষকে কোনোকিছুর বিনিময়েই ক্ষমা করা যায় না।আমাকে সবার আগে এই লোকের অবধি পৌঁছতে হবে,তার মাধ্যমেই হয়তো মিথিলা হ ত্যা রহস্যের কুলকিনারা মিলবে।



বিকেলে বেলকনিতে বসে কিছু অফিসের কাজ করেছিলাম।মিথিলা আমার সামনে একটা চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হয়।আমি ওরদিকে একবার তাকিয়ে নিজের কাজে আবারও মনোনিবেশ করলাম।

—চা,টা নাও।তোমার বিকেল তো আবার চা ছাড়া চলে না।

—আগে চলতো না, কিন্তু এখন চলে।

—মানে,কি বলতে চাইছো তুমি!
আমার উত্তরে অবাক হয়ে পারমিতা প্রশ্ন করে।

—বলতে চাইছি আগে যখন মিথিলা বেঁচে ছিলো ওর হাতের চা বা কফি ছাড়া আমার বিকেল সত্যিই কাটতো না।সময়ের সাথে সাথে নিজেকে চা বা কফি ছাড়াই মানিয়ে নিয়েছি।

—কিন্তু এখন আমি তো আছি,আপু যা করতে তোমার জন্য আমি কি করতে পারি না?

—যেটা ছেড়ে দিয়েছি।সেটা আবার আবার নতুন করে অভ্যাস করতে চাই না।কে জানে,যদি কোনোদিন তুমি পাশে না থাকো আবারো মুশকিলে পড়ে যাবো আমি.!

—আমার সাথে এরকম রহস্য করে কেনো কথা বলছো,আমি তোমার পা‌শে কেনো থাকবো না।আপু একটা দূর্ঘটনায় আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছে,তোমার কি মনে হয় আমার সাথেও সেরকম কিছু হবে?

—এ বাবা,আমি আবার কখন বললাম সেটা।যদিও কার সাথে কখন কি ঘটে বলা তো যায় না।আজকাল যা হচ্ছে চারদিকে।স্বামী স্ত্রীকে খু ন করে দিচ্ছে,তো স্ত্রী স্বামীকে।আবার ভাই নিজের ভাইকে ছাড়ছে না,বোন বোনকে মে রে ফেলছে…

আমার কথা শুনে পারমিতা যেনো চমকে উঠলো,আমি চমকানোর জন্যেই কথাটা বলেছি ওকে।নিজের মায়ের পেটের বোনকে খু ন করে শান্তিতে ঘুমানো,এটা তো অন্যায়।পারমিতার মনে ধীরে ধীরে ভয়ের বীজ এমনভাবে বপন করে দেবো,যে ও চাইলেও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না।পারমিতা চায়ের কাপটা রেখে বাইরের দিকে পা বাড়ায়।আমি ওকে পেছন থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করি।

—রিসালাত কোথায়,ও কি ঘুমিয়েছে?

—না ঘুমায়নি,মায়ের কাছে আছে।

—আচ্ছা একটু পরে নিয়ে এসো এখানে।

পারমিতা হ্যাঁ বোধক উত্তর দিয়ে চলে গেলো।আমি আবারও কাজ করতে লাগলাম।সকাল থেকেই পায়ের ব্যথাটা আবারো বেড়েছে।প্রায় তিনবছর আগে যখন আমার বিয়ে হয়নি বাড়ির সিঁড়ি থেকে অসাবধানবশত পা ফসকে পড়ে গিয়েছিলাম।তখন পায়ে ভীষণ চোট পাই,এখন পর্যন্ত সেই ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছি।যখনই পায়ের ওপর একটু বেশী চাপ পড়ে ব্যথাটা আরো বেশী অনুভূত হয়।কাজ রেখে মাকে খোঁজার জন্য রান্নাঘরের দিকে গেলাম।সেখানেই সে রিসালাতের জন্য খাবার তৈরি করছিলো।

—কি রে বাবা,কিছু লাগবে?

মা আমায় দেখে বললো!

–মা পায়ের ব্যথাটা আবারো বেড়েছে,তোমার কাছে ওষুধ হবে?

—হ্যাঁ হবে, কিন্তু ওষুধ তো আমার ঘরে।যাই আমি এনে দিচ্ছি।

—না থাক,তুমি কাজ করো।আমি নিজে নিয়ে নিচ্ছি,তোমাকে যেতে হবে না এখন কষ্ট করে।

এই বলে আমি মায়ের ঘরের দিকে গেলাম।কেনো জানি না ব্যথাটা আজ একটু বেশিই বেড়েছে।সেদিন যে কোনো না দেখে তৈলাক্ত সিঁড়িতে পা দিতে গিয়েছিলাম,সেই ভুলের ফল এখনো পেতে হচ্ছে।

মায়ের ঘরে ঢুকে ওষুধ খুঁজতে লাগলাম কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না।ড্রয়ারের ভেতরে খুঁজলাম সেখানেও নেই।না,ওষুধটা তো নিতেই হবে আমায়।ভালো করে চারদিকটা খুঁজতে লাগলাম,যেসব জায়গায় ওষুধ থাকার প্রশ্নই ওঠে না সেসব জায়গা খুঁজতে শুরু করি।মায়ের ওয়্যারড্রপের একটা বক্সের ভেতরে যেখানে বহু পুরনো জিনিসপত্র ফেলে রাখা আছে,সেটাও খুঁজতে শুরু করি।হঠাৎ আমার চোখটা একটা জিনিসের ওপরে আটকে গেলো।জিনিসটাকে ওয়্যারড্রপের ভেতর থেকে বের করে আনলাম।

একটা পয়জনের শিশি!এতো সেই বিষের শিশি যা আজ থেকে বেশ কয়েকমাস আগে আমাকে দেওয়া হয়েছিলো।তবে কে দিয়েছে কেউ কিচ্ছু জানতে পারেনি।তখন বাড়িতে আমার বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিলো,এতো মানুষের ভেতরে আসল অপরাধীকে কেউ শনাক্ত করতে পারে নি।কিন্তু সেই পয়জনের শিশি মায়ের কাছে কেনো?

হঠাৎ কেনো জানি সবকিছুর হিসেব দুয়ে দুয়ে চার হয়ে মিলতে লাগলো আমার কাছে।সিঁড়িতে ইচ্ছাকৃত তেল ফেলে রাখা,আমার এক্সিডেন্ট।তখন তো বাড়িতে বাইরের কেউ ছিলো না,আর মাকে সন্দেহ করার চিন্তা কারোর স্বপ্নেও আসেনি।কিন্তু আজকের এই বিষ!
তার মানে এসব মায়েরই কাজ?মা শুধু মিথিলার খুনের সাথে জড়িত নয়,আমাকে খু ন করার পরিকল্পনা তারও আগে থেকেই!যা এখনও মা মনে পুষে রেখেছে!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here