খেলাঘরে তুমি আমি পর্ব -১০

#খেলাঘরে_তুমি_আমি
পর্ব—১০
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

—সাহিত্যকে সেদিন গুন্ডা দিয়ে আমি খু ন করিয়েছিলাম!আর কেউ নয়…আমি নিজে আমার ভাইকে মে রে ছি।আমার পথের কাঁটা দূর করেছি।

আদিত্যর কথা শুনে আমি আর দোয়া দুজনেই চমকে উঠলাম।

—তুই তোর ভাইকে মে রে ছিস,কিন্তু কেনো?সে কি ক্ষতি করছিলো তোর?

—ও আমার সাথে কোনো অন্যায় করেনি।অন্যায় করেছিলো আবার বাবা মা।আপনারাই বলুন পৃথিবীতে কখনো এমন বাবা মা দেখেছেন বা শুনেছেন যারা কিনা দুই সন্তানকে দু চোখে দেখে।

—কি হয়েছিলো আমাদের বুঝিয়ে বল…

—ছোটোবেলা থেকেই আমি একটু দূরন্ত স্বভাবের ছিলাম।আমার বড়ো ভাই সাহিত্য ও সবসময়ের জন্যই পড়ালেখায় আমার থেকে এগিয়ে থাকতো।আমি ছিলাম ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চার আর ও ফার্স্ট বয়।ক্লাসে ওর জায়গা হতো সবার সামনে,আর আমাকে পেছনে বসতে হতো।তবে এই বৈষম্য শুধু ক্লাসরুমের ভেতরে সীমাবদ্ধ ছিলো না।বাড়িতে যখন ভালো রান্না বান্না হতো মাছের বড়ো মাথাটা মা সাহিত্যের থালায় তুলে দিতো,মাংসের বড়ো পিসটা ওকে খাওয়াতো।শুধু পড়ালেখায় ভালো ছিলাম না বলে ওরা আমার সাথে সবসময় দুর্ব্যবহার করতো,আর বড় ছেলেকে মাথায় তুলে রাখতো।সবসময় এটাই বলতো বড়ো ছেলে বড়ো হয়ে বড়ো চাকরি করবে,বড়ো বাড়ি গাড়ি কিনবে।আমাদের সুখী রাখবে।তাহলে ওকে কেনো বেসি ভালোবাসবো না,আদর যত্ন করবে না?
আমার বাবা মায়ের কাছে আমরা দু ভাই দুটো প্রোডাক্ট ছাড়া বেশী কিছু ছিলাম না।যার যতো ভালো সার্ভিস তার ততোই কদোর।

ভাইয়ের দেখাদেখি আমার মনের ভেতরেও ডাক্তার হওয়ার একটা তীব্র বাসনা চেপে বসে।শুনতাম বাবা মা ওকে বলতো ডাক্তার হলে নাকি অনেক টাকা উপার্জন করা যায়।ভালো থাকা যায়।একদিন বাবাকে গিয়ে বললাম আমিও ভাইয়ের সাথে ডাক্তারি পড়তে চাই,ওর মতো ডাক্তার হতে চাই।এখনও মনে আছে সেদিন বাবা আমার কথা শুনে টানা পাঁচ মিনিট হেসেছে।তবে বাবা বিদ্রুপ করলেও মা চেয়েছিলো যাতে ভাইয়ের সাথে আমিও ডাক্তারি পড়ি।আমার মনের ইচ্ছেটা আর কেউ না হলেও মা বুঝতে পারে।

এডমিশন টেস্টে আমি আর সাহিত্য দু’জনই কৃতকার্য হলাম।যদিও আমার সারি ছিলো সাহিত্যের অনেক পেছনে।পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা সুবিধের ছিলো না।বাবার পক্ষে দু’জন ছেলেকে ডাক্তারি পড়ানো অসম্ভব ছিলো।সে নিজেও দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায়।পরে সাহিত্যকে মেডিকেলে ভর্তি করানো হলো।বাবা বুঝে গিয়েছিলো সাহিত্য আমার থেকে অনেক ভালো ছাত্র।আমি না পারলেও ও অনেক ভালো ডাক্তার হতে পারবে।তাই ওকেই বেছে নেয়।আমাকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন চিরদিনের জন্য মাটিচাপা দিয়ে দিতে হলো।কিন্তু সাহিত্য চেয়েছিলো যেনো বাবা আমাকে ডাক্তারি পড়ানোর জন্য পাঠায়,ও বাবাকে অনেক বুঝায়।কিন্তু বাবাকে রাজি করতে পারেনি।

—আর তুই সেই ভাইকেই শেষ করে দিলি…, একবারের জন্যেও তোর বিবেক দংশন করলো না তোকে?

—তো আর কি করতাম আমি।ওর দয়া নিয়ে কি বেঁচে থাকতাম আমি..

—ওটা দয়া ছিলো না মূর্খ,ও তোকে মন থেকে ভালোবাসতো।তা না হলে কেউ এতো বড়ো ত্যাগ স্বীকার করার কথা ভাবতে পারে না।আর তোর যদি ওর ত্যাগকে দয়াই মনে হয় তুই নিজে মরে গেলি না কেনো,ওকে মা র লি কেনো?

–আমি যেকোনো প্রকারে ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম।আর তার জন্য এই পথটা বেছে নিতে হয়েছে আমাকে।কিন্ত বিশ্বাস করুন ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য আমি এখনও নিজেকে দোষী মনে করি না।দোষী তো আবার বাবা মা।তাদের ব্যবহার আমার মনে সাহিত্যের প্রতি তিলে তিলে ঈর্ষার পাহাড়ের জন্ম দেয়।আমি কখনো সহ্যই করতে পারতাম না ওকে।শুধু তাদের দ্বিমুখী আচরণের জন্য।

—তোর গল্পটা বেশ দুঃখজনক।তোর সাথে যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে।আমাদের এই দেশে অনেক বাবা মা আছে।যারা ছেলে মেয়েদের একটা প্রোডাক্ট মনে করে।একদম ঠিক বলেছিস তুই।তবে জানিস তো,তোর অপকর্ম তোকে হারিয়ে দিয়েছে।তোর সাথে যতোই অন্যায় হোক নিজের ভাইকে খু ন করে যে পাপ করেছিস তার কোনো ক্ষমা হয় না।
এবার বল আমার স্ত্রী কে কেনো মেরেছিস?

—একদিন পারমিতা এসে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায় আমার দিকে।এরপর ধীরে ধীরে আমাদের ভেতরে প্রেম হয়।পারমিতা ভাবত সাহিত্যের মৃত্যুর জন্য একমাত্র মিথিলাই দায়ি তাই ও আমাকে সাথে নিয়ে পরিকল্পনা করতে থাকে কিকরে মিথিলাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়া যায়।ওর প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি।বিশ্বাস করুন আমার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না আপনার স্ত্রীকে মারার।কিন্তু নিজের ভালোবাসাকে বাঁচাতে এটা করতেই হলো আমায়।

—এখনো পারমিতাকে ভালোবাসিস তুই?

—হ্যাঁ,বাসি।শুধু আমি নই।ও নিজেও ভালোবাসে আমায়।

—পারমিতা এরপর যখন জানবে সাহিত্যের মৃত্যুর জন্য ওর বোন কখনো দায়ী ছিলো না,তুই ছিলি।তখন তোদের এই লাভ স্টোরির কী হবে. . .?

—আমি জানি না,কিচ্ছু জানি না আমি।

—শয়তানিতে তোরা দুজন কারোর থেকে কম নস।আর তোদের এই শয়তানির জের ধরে একটা নিরপরাধ মেয়েকে প্রাণ হারাতে হলো।আমাকে স্ত্রী হারা আর আমার ছেলেকে মা হারা হতে হলো।কতোগুলো পাপ করেছিস ভেবে দেখেছিস?

—আমি জানি, আমি যে অন্যায় করেছি তার কোনো ক্ষমা হয়না।কিন্তু তোমরা আমায় কথা দিয়েছিলে সত্যিটা বললে আমাকে ছেড়ে দেবে।

—ছেড়ে তো দেবোই,তবে তার আগে যে একটা কাজ করতে হবে তোকে…

—কি কাজ করতে হবে?দেখুন আমাকে পুলিশি ঝামেলায় জড়াবেন না দয়া করে,বরবাদ হয়ে যাবো।

—এতোগুলো মানুষের জীবন বরবাদ করে নিজে ভালো থাকতে চাইছেন,লজ্জা নেই আপনার?
দোয়া আদিত্যকে উদ্দেশ্য করে বললো।

—এই আপনি একদম চুপ থাকুন,আমাকে জ্ঞান দিতে আসবেন না।আজ আপনার জন্য আমার এই পরিণতি।আপনাকে বিশ্বাস করাটাই ভুল হয়েছে আমার।

–যাক ভালো,একটা শিক্ষা তো অর্জন করা হলো।ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।

—অর্ণব সাহেব আপনার কি কাজ করে দিতে হবে সেটা তো বললেন না!
আদিত্য দোয়ার কথার কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে আমায় বললো।

—তোকে আমাদের সাথে যেতে হবে।তারপর পারমিতার সাথে সবটা স্বীকার করতে হবে যে সাহিত্যের খু ন মিথিলা নয় বরং তুই করিয়েছিস!

—এর থেকে বরং আপনি আমায় মেরে ফেলুন অর্ণব সাহেব।আমি কিছুতেই এই মুখ নিয়ে পারমিতার সামনে যেতে পারবো না।আর সত্যিটা জানতে পারলে ও আমার সাথে ঠিক একই কাজ করবে যেটা আপনারা করছেন।

—তার মানে তুই আমার কথা শুনবি না,তাই তো?

—দেখুন যা হবার তো হয়েই গেছে।আপনিই বলুন আমি সত্যিটা স্বীকার করলে কিছু কি পাল্টাবে?আপনার স্ত্রী তো ফিরে আসবে না তাই না?

—নিজের মুখে সবটা স্বীকার করতে দেখে ভেবেছিলাম কিছুটা হলেও অনুশোচনাবোধ এসেছে তোর ভেতরে।কিন্তু তুই আসলেও শুধরানোর পাত্রই নস।তোকে আইনের হাতে তুলে দেবো না সিধান্ত নিয়েছিলাম,কিন্তু এখন সেটাই করতে হবে।

—আমি ঠিক জানতাম আপনারা সত্যিটা জানার পরে এতো সহজে ছেড়ে দেবেন না আমায়।ঠিক আছে আমায় পুলিশের কাছেই নিয়ে চলুন,কিন্তু দয়া করে পারমিতার সামনে দাঁড়াতে বাধ্য করবেন না আমায়।

এরপর আমি আর দোয়া আদিত্যকে ঘর থেকে বের করে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।বাড়ির দরজার সামনে আসতেই দেখতে পাই পারমিতা এইদিকেই আসছে।ওকে এই মূহুর্তে এই জায়গাতে দেখার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না আমি।কিন্তু ওকে খবর টা দিলো কে…?এমনটা নয় তো আদিত্য এখানে আসার আগে পারমিতাকে ইনফর্ম করে দিয়েছিলো।

পারমিতা এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো।আদিত্য ওকে দেখে চিৎকার করে ওঠে।

—পারমিতা আমায় বাঁচাও।দেখো তোমার হাসবেন্ড কি অবস্থা করেছে আমার।

এরপর হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে দোয়া আদিত্যের হাতটা ছেড়ে দিয়ে আমার পাশ থেকে সরে যায়।তারপর পারমিতার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো!ওর এই অদ্ভুত আচরণ দেখে কিছুটা ভরকে গেলাম আমি।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here