খেলাঘরে তুমি আমি পর্ব -০৫

#খেলাঘরে_তুমি_আমি
পর্ব—০৫
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

হঠাৎ কেনো জানি সবকিছুর হিসেব দুয়ে দুয়ে চার হয়ে মিলতে লাগলো আমার কাছে।সিঁড়িতে ইচ্ছাকৃত তেল ফেলে রাখা,আমার এক্সিডেন্ট।তখন তো বাড়িতে বাইরের কেউ ছিলো না,আর মাকে সন্দেহ করার চিন্তা কারোর স্বপ্নেও আসেনি।কিন্তু আজকের এই বিষ!
তার মানে এসব মায়েরই কাজ?মা শুধু মিথিলার খুনের সাথে জড়িত নয়,আমাকে খু ন করার পরিকল্পনা তারও আগে থেকেই!যা এখনও মা মনে পুষে রেখেছে!

—কি খুঁজে পেলি ওষুধ,কি করছিস এতোক্ষণ?
মা আমাকে নিচ থেকে জিজ্ঞেস করে।

—না পায়নি,তবে খুঁজছি।

—আর খুঁজতে হবে না,ওষুধ নেই।থাকলে এতোক্ষণে ঠিক পেয়ে যেতি,এবার নিচে চলে আয়।

আমি বিষের শিশিটা আবারও জায়গামতো রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম।মা আমাকে দেখে ডেকে বলতে লাগলেন।

—এতোক্ষণ কি করেছিস আমার ঘরে,একটা ওষুধ খুঁজতে এতো সময় লাগে নাকি?

—কি করবো বলো,খুঁজে পাচ্ছিলাম না যে কিছুতেই।আচ্ছা আমি তাহলে বাইরে গিয়ে নিয়ে আসছি।

—এই অবস্থায় যেতে পারবি,তুই না পারলে বল, কেয়ার টেকারকে পাঠাবো।

—না,ঠিক আছে আমি পারবো।এতো টেনশন করো না তো আমায় নিয়ে।

এরপর আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম ওষুধ কেনার জন্য।তখন সন্ধ্যা সাতটা।চারদিকটা অন্ধকার হয়ে আসছে ধীরে ধীরে,সাথে ঠান্ডা বাতাস।শীতের ভেতরেও বৃষ্টি নামবে নাকি,কে জানে?এমনিতেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় নাকি সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে,নিউজে দেখেছিলাম।আমাদের এদিকেও তাই হবে মনে হচ্ছে।
আমাদের গলির ফার্মেসিটা কোনো কারণে বন্ধ তাই বাইরের দিকে আসতে হলো বাধ্য হয়ে।একটুপরে আমার ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করে আকাশ থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলো,এতো বৃষ্টি আমি শীতকালে কখনো দেখিনি।দৌঁড়ে গিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালাম।কিন্তু বৃষ্টি তো আর বাঁধ মানে না।সে তার আপন গতিতে ঝরে চলছে।আমার অর্ধেক শরীর ভিজে একাকার,ঠান্ডায় পুরো শরীর জমে যাবার উপক্রম। ঠিক তখন একটা জিপের ফ্ল্যাশলাইট এসে পড়লো আমার ওপর।গাড়িটা এসে আমার সামনেই দাঁড়ায়।তারপর আমায় ইশিরা করে কেউ ভেতরের দিকে ডাকতে লাগলো।বৃষ্টির কারনে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট তবে এইটুকু বুঝতে পেরেছি সে আমাকে ইশারা করে ডাকছে।আমি দৌঁড়ে গিয়ে তার গাড়িতে উঠলাম।সিটের ওপরে বসতেই সে একটা টাওয়াল এগিয়ে দিলো আমার দিকে,আমি হাত বাড়িয়ে নিলাম।

—আপনি ভিজে গেছেন,টাওয়ালটা দিয়ে নিজের ভেজা শরীর মুছে নিন।নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে,

আমি আমার ভেজা শরীর টাওয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে বললাম।

—থ্যাংকস ম্যাডাম।কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না,না কখনো আগে দেখেছি এই এলাকায়,কোথায় থাকেন আপনি?

—আমি একটা মেয়ে,আর আপাতত এই দেশেই আছি।

—আপনি কোনো পুরুষলোক নন সে আপনাকে দেখেই যেকেউ বুঝতে পারবে আর আপনি যে এ দেশেই থাকেন সেটা তো আমি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি।

—ওহ,তার মানে আমার নাম-ধাম জিজ্ঞেস করছেন।বেশ বলছি তাহলে আমার নাম দোয়া রহমান জান্নাত।আপনি আমায় দোয়া বা জান্নাত যেকোনো একটা নামে ডাকতে পারেন। তবে আমি জান্নাত নামে ডাকলে বেশী খুশি হবো,কারণ এই নামটা আমার নিজের দেওয়া। দোয়া নামটা কেমন জানি সেকেলে সেকেলে লাগে।কি করবো বলুন,দাদার দেয়া নাম একেবারে ফেলেও তো দিতে পারি না।

মেয়েটার কথা শুনে পুরো অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি।একটা সাধারণ প্রশ্নের উত্তরে কেউ এতো কথা বলে কিকরে!

—প্লিজ প্লিজ এবার থামুন,এতো কিছু জানতে চেয়েছি আমি আপনার কাছে।অদ্ভুত তো?আর আপনি নিজের নাম জান্নাত কেনো জাহান্নাম রাখুন গিয়ে তাতে আমার কি?

—ওয়েট আমি কথার ভেতরে আগ বাড়িয়ে ঢুকে পড়া একদম পছন্দ করি না।

—তার মানে এখনো শেষ হয়নি আপনার বলা?

—কিকরে হবে,আপনি আমাকে দুটো প্রশ্ন করেছেন।আমার নাম আর ধাম।নামটা তো বললাম ধামটা মানে আমি কোথায় থাকি সেটা কে বলবে?

—থাক আমি শুনতে চাই না।বলতে হবে না আমায়,

—বলতে হবে না বললেই হলো।যখন জানতে চেয়েছেন আমি যে উত্তর রেডি করে রেখেছি পেটের ভেতরে।এখন সেগুলো না বলতে পারলে বদহজম হয়ে যাবে যে আমার।

—আচ্ছা বলুন,শুনছি।

—আমি এই শহরেই থাকি।আগে উত্তরা থাকতাম এখন এই ধানমন্ডি।আমার একটা পার্লারের বিজনেস ছিলো জানেন তো,উত্তরাতে চলছিলো না খুব একটা পরে ধানমন্ডি চলে আসলাম একটা ফ্রেন্ডের সাজেশনে।এখানে এসে আমার ব্যবসায় পুরো লালবাতি!বাধ্য হয়ে অফ করে দিতে হয়েছে পার্লারটা।প্রথম প্রথম খুব ডিপ্রেশনে ছিলাম এসব নিয়ে,পরে ভেবে দেখলাম লাইফে তো আপস এন্ড ডাউন থাকবেই।সো চিল… এতো চাপ নেওয়ার কিচ্ছু নেই।

—কথার জ্বালায় তো মুখে পোকা বসা দায়,মানুষ তো দূরের কথা..?কিভাবে চলবে বিজনেস…
ইচ্ছে করছিলো মুখের ওপরে কথাটা বলে দেই।কিন্তু যাই হোক না কেনো সে আমাকে এরকম একটা বিপদের মূহুর্তে হেল্প করেছে তাই মনের কথা মনেই চেপে রাখলাম।

—ও আচ্ছা…তা কি করা হচ্ছে এখন?

—পড়াশুনা শেষ,চাকরি বাকরি করি না কিছুই,করিনা বলতে পায়নি।ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম চার পাঁচ জায়গায়,কাজ হলো না।দেখুন আমি চাইলে কিন্তু বলতেই পারতাম যে আমি ইচ্ছে করে জব নিচ্ছি না,বা আরোও অনেক কিছু।সেটা বলিনি কারণ আমি বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা একদম পছন্দ করি না।

মেয়েটার কথা যতোই শুনছি ততোই অবাক হচ্ছি।একটা মানুষ এতো কথা কিভাবে বলতে পারে।এরপর থেকে ভেবেচিন্তে কথা বলতে হবে এর সাথে।খেয়াল করলাম আমাদের গাড়িটা বেশ খানিকটা দূরে এগিয়ে গিয়েছে।আমি তাকে পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম।

—আমরা কিন্তু অনেকটা দূর চলে এসেছি।আমাকে বাসায় ফিরতে হবে আবার..

—এই বৃষ্টির ভেতরে বাসায় কিকরে ফিরবেন, আর যদি আপনার একান্ত এই রাতের ভেতরে ভিজতে ইচ্ছে করে তাহলে নেমে যেতে পারেন।

—তাহলে আপনিই বলুন,এখন কি করা উচিত আমার?

—আমার বাসায় যেতে আপনার কোনো আপত্তি আছে?

—সেটা কিকরে হয় দোয়া ম্যাডাম,আমি আপনাকে চিনি না জানি না এভাবে হুট করে আপনার বাড়িতে চলে যাবো?

—এই যে মিস্টার আমি আপনাকে একটা কথা বলেছিলাম যে আমাকে জান্নাত নামে ডাকলে বেশী খুশি হবো!

—শুনুন আপনাকে খুশি রাখার দায়ভার আমি নিয়ে রাখিনি,আর আমি আপনাকে দোয়া নামেই ডাকবো।ঠিক আছে?

—আচ্ছা সেটা আপনার ইচ্ছে।কিন্তু আপনি আমার বাড়িতে যেতে ভয় কেনো পাচ্ছেন,কি মনে হচ্ছে আমি আপনার কোনো ক্ষতি করে দেবো?

—সব ব্যপারে একটু বেশি না বুঝলে হয় না, কখন বললাম আমি যে আপনি আমার ক্ষতি করে দেবেন?আপনি আমায় নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবেন ভালো কথা,বাকি লোকজনদের হ্যান্ডেল করবেন কিকরে?

—আমার বাড়িতে আমি ছাড়া বর্তমানে কেউ নেই?আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন।আমার মনে হয় না এটা ছাড়া আর কোনো অপশন আছে আপনার কাছে।

—দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেই!

কিছুক্ষণ পরে গাড়িটা এসে দোয়ার বাড়ির সামনে থেকে থামলো।আমরা দু’জন গাড়ি থেকে নেমে দৌঁড়ে ভেতরে ঢুকলাম।দোয়া আমায় ড্রয়িংরুমে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলো।একটু পরে ও হাতে দুটো চায়ের কাপ নিয়ে ফিরে আসে।

—আপনি কিন্তু চাইলে চেঞ্জ করতে পারেন,আমার বাসায় পোশাক আছে।

—এই যে বললেন আপনি ছাড়া কেউ থাকে না এখানে,পুরুষ মানুষদের পোশাক পেলেন কোথা থেকে?

—এখন থাকে না বলেছি,আগে থাকতো না বলিনি।পোশাকগুলো আমার ভাইএর।ও একটা কাজে শহরের বাইরে আছে।

—তাই বলুন।কিন্তু আমি ঠিক আছি।যেটুকু ভিজেছিলো পথে আসতে আসতে শুকিয়ে গিয়েছে।

—যাক ভালো।চা টা খেয়ে নিন,বেশী করে আদা দিয়ে নিয়ে এসেছি।

এই একটা কাজ খুব ভালো করেছে দোয়া।আমি এমনিতেই আদা দেওয়া চা খুব পছন্দ করি।ও নিজের মনের অজান্তেই আমার ভালো লাগাটা বুঝে গেলো।দোয়ার চা নিয়ে আমার বিপরীত দিকের সোফাটায় বসে পড়েছে।

—আপনি এরকম কেনো,এতো কষ্ট করে চা বানিয়ে আনলাম আপনার জন্য একটা কমপ্লিমেন্ট তো দিবেন।

হায় আল্লাহ,এ কেমন মানুষ।নিজে কাজ করে আবার নিজেই সেধে কমপ্লিমেন্ট চাইছে।

—হুমম,খুব ভালো হয়েছে।

—হয়েছে এখন এটা না বললেও চলবে।কথাটা আগে বললে বেশী খুশি হতাম।আপনি তো আবার আমাকে খুশি রাখার দায়িত্ব নিয়ে বসে নেই,কেনোই বা ভাববেন আমার কথা।আমিই ভুলে গিয়েছিলাম কথাটা,

কথা শুনে ইচ্ছে করছে চা সুদ্ধ কাপটা মুখের ওপর ছুড়ে মারি,এমন বিরক্তিকর মানুষ আমি আমার গোটা জীবনে দেখিনি।কোনমতে কাপটা শেষ করে বললাম।

—আমার কিন্তু বড্ড দেরী হয়ে গেছে।বৃষ্টি থামলেই বেরোতে হবে আমায়,

—দেরী হচ্ছে নাকি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?অবশ্য আপনি যে একটা ভীতুর ডিম চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছি আমি।

—না,সেরকম কোনো ব্যপার নয়।আমার বাড়িতে ফেরাটা সত্যিই ভীষণ জরুরী!সেখানে আমার….

—ছেলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে তাই তো,খুব চিন্তা হচ্ছে বুঝি নিজের ছেলের জন্য?

দোয়া আমার মুখ থেকে কথাটা টেনে নিজে থেকে বলে উঠলো।আমি হতবাক হয়ে গেলাম তার কথা শুনে।আমার যে ছেলে আছে,আর আমি তার জন্যেই টেনশন করছি সে জানলো কিকরে সেটা,এটা জানা তো দোয়ার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here