গল্পটা_আমারই সূচনা পর্ব

0
814

গল্পটা_আমারই

সূচনা পর্ব
(সুরমা)

কাল আমার বিয়ে। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা আই এলটি ভবনের সামনে। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। ওরা কয়েকজন বন্ধু বান্ধব মিলে গরীব দুখিদের শীতবস্ত্র বিতরন করছিল। আমি রুমের বড় আপুর সাথে গিয়েছিলাম সেইখানে। ওও আর আমার রুমমেট আপু একি ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করতো। তারা দুজন খুব ভালো ফ্রেন্ড। আপুও সেই বস্ত্রবিতরনে অংশ নিতে গিয়েছিল। আমাকেও সাথে নিয়ে গেলো।

তন্বী আপুর কাজ গুলো আমার খুব ভালো লাগে। তাই আপুকে বলেছিলাম আমাকে যেন একদিন তার সাথে নেয়। আমার খুব আগ্রহ আপুর মতো হত দরিদ্র, পথশিশু, এতিম মিসকিনদের জন্য কিছু করবো। তাই আপু তখন আমাকে নিয়ে গেলো।

আমি ওদের বিপরীত পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। দাঁড়িয়ে থেকে তাদের কাজ দেখছিলাম। আমার খুবই ভালো লাগছিল। সেই লোকটা একাই সব সামাল দিচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছিল সেই গ্রুপের লিডার সে। সে দেখতে বেশ লম্বা, ফর্সা, মাথা ভর্তি কালো চুল। চুল গুলো একটু লম্বা। জোড়া ভ্রু, কাজল কালো দুটি চোখ। গালে চাপদাড়ি। দাড়ি গুলো একদম ছোট। লোকটাকে এতো সুন্দর লাগছিল। তার চেয়েও বেশি সুন্দর ছিল তার কথা। প্রথম দেখাতেই অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছিল মনে।

গিয়েছিলাম কাজ করতে। কিন্তু গ্রুপের তন্বী আপু ছাড়া একজনকেও আমি চিনতাম না। গ্রুপে বেশ কয়েকজন ছেলেও ছিল। যার ফলে আমি দূরে দূরে থাকতাম।ওদের সাথে মিশতে আমার কেমন জানি লাগছিল।

লম্বা টেবিলের উপর সব কাপড়চোপড় রেখে
সবাই টেবিলের ওপর পাশে দাঁড়ালো। এখন সবাইকে শীতবস্ত্র দেওয়া হবে। আমাকে রাস্তার ওপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তন্বী আপু আমাকে ডাক দিয়ে বললো,
-মীরা,তুই ওখানে কি করছিস? আয় আমার পাশে এসে দাঁড়া। তুই না বলছিলি কাজ করবি। কিন্তু আসার পর থেকেতো দূরে দাঁড়িয়ে আছিস। তন্বী আপুর ডাকে আমি এগিয়ে গেলাম। তন্বী আপুর পাশেই সেই লোকটা দাঁড়িয়েছিল। তন্বী আপু সেই লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো,,,
– অর্ণব এ হলো মীরা। আমার রুম মেট। আমার জুনিয়র। অনার্স ফাস্ট ইয়ার পড়ে। খুব ভালো মেয়ে। আমাকে প্রতিদিন বলে আমার সাথে কাজ করবে। তাই আজ নিয়ে আসলাম। তন্বী আপু পরিচয় করিয়ে দিলে সে আমার দিকে এক পলক তাকায়। আমি নম্র স্বরে বললাম,,
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম সালাম। পড়াশোনা কেমন চলছে?
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।
– গুড,নিজের ফ্যামিলি ছেড়ে এত দূরে আসলে। অযথা টাইম নষ্ট করো না। মন দিয়ে পড়াশোনা করো।
– জ্বি, আচ্ছা। লোকটা আর কিছু বললো না। নিজে আবার ব্যস্ত হয়ে গেলো। আমিও তাদের কাজ গুলো দেখতে লাগলাম। একজন মানুষের মন কতো বড় হলে নিজেকে মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে এই গ্রুপের লোকগুলোকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।

একজন লোক আসছে তার হাতে এই গ্রুপের একজন করে একটা বস্ত্র দিয়ে ছবি তুলছে। পর পর বস্ত্র বিতরণ করতে লাগলো। এবার অর্ণব একজন বৃদ্ধার হাতে বস্ত্র তুলে দিবে। গ্রুপের একজন সামনে দাঁড়িয়ে বললো,,,
-দোস,দাঁড়া একটা ছবি তুলি। কথাটা শুনে অর্ণব বললো,
-ছবি তুলতে হবে না।
-দাঁড়া এক মিনিটও লাগবে না। ফেইসবুকে দিবো। এই কথাটা শোনে অর্ণন অনেকটা রেগে গিয়ে বললো,,,,
-আমার ছবি ফেইসবুকে দেওয়ার দরকার নেই। তোদের গুলো দিস।
-তুই তো সব আয়োজন করলি। সবার আগে তো লোকের তোর ছবি দেখা উচিত। ছবি না দিলে লোকে বুঝবে কিভাবে তোর এতো বড় একটা মন আছে। তুই এতো ভালো কাজ করিস। এবার অর্ণব আরো রেগে গেলো। সে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,,,,,

-I don’t like showoffs. আজকাল কার লোকজনের কারো জন্য কিছু করার থেকে দেখানোর টেনডেনসিটা বেশি থাকে। কাউকে ভালোবাসি এটা লোককে বোঝানোর জন্য ফেইসবুকে সোঅপ বা সবার কাছে বলে বলে প্রচারণা করতে আমার ভালো লাগে না।আমি যেটুকু করি মন থেকে, অনুভূতি থেকে,ভালোবাসার জায়গা থেকে করি।সেই ভালোবাসাটা লোক দেখানো নয়।প্রকৃত ভালোবাসা।

এই পথচারী মিসকিনদের জন্য আমি মন থেকে করি।মহান আল্লাহ তাআলাকে খুশি করার জন্য। নিজের মনের তাড়না থেকে করি। লোক দেখানো বা ফেসবুকে দেওয়ার জন্য না। লোকে কি বললো তা আমার দেখার বিষয় না। আর আমি ভালো মানুষ এটা লোককে জানাতে হবে না। যে জানার সে এমনিতেই জানবে। আমি জানি আমার কাজটা পূন্যের কাজ। তবুও এক শ্রেণির লোক আমার এই কাজ নিয়ে সমালোচনা করবেই। আমি কারো থেকে প্রশংসা বা সমালোচনা শোনার জন্য কিছু করছি না। যা করছি নিজের থেকে।

অর্ণবের শেষের কথাগুলো আমার হৃদয় ছুঁয়েছিল। কেউ একজন এলো,মন কেড়ে নিয়ে চলে গেলো। আমি সহজে ছেলেদের উপর ক্রাশ খাইনা। কিন্তু সেদিন আমি শুধু ক্রাশ না,মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলাম। হুম,কেউ একজন এসে আমার হৃদয়টা আমার থেকে টেনে ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেলো। আর আমি নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুতেই বেসামাল মনকে মানাতে পারলাম না।

আজও হৃদয়ে দাগ টানে অর্ণবের সাথে আমার প্রথমদিন গুলোর কথা মনে হলে।

ভেবেছিলাম অর্ণবের সাথে আমার আর দেখা হবে না। আবার মনও মানছিল না। কেন জানি অর্ণবকে আরো একবার দেখার জন্য আমি উতলা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানি না অর্ণব কোথায় থাকে। আবার তন্বী আপুকেও বলতে পারছিলাম না লজ্জায়। তন্বী আপু কি মনে করে। কি ভাববে।

তাছাড়া দেখা হলেও বা কি? তাকে নিয়ে আমি যেমন চিন্তা ভাবনা করছি তা কখনই হয়ত বা সম্ভব হবে না। একটা মানুষের পড়াশোনা প্রায় শেষ। এখন কি সে সিঙ্গেল আছে? হয়তো গার্লফ্রেন্ড আছে। মনকে নানারকম অজুহাত দিতে লাগলাম। কিন্তু মনতো আরো বেহায়া। কিছুতেই সে আয়ত্তে থাকতে চায় না। উড়তে চায় স্বাধীন পাখির মতো। কল্পনার রাজ্যে হারাতে চায়। সেই মানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চায়। একটা রাজ্য তৈরি করে তাকে নিয়ে সেই রাজ্যে প্রেমের মহল গড়তে চায়।

প্রথমবারের মতো মা বাবা, নিজের পরিবারের সবাইকে ছেড়ে ঢাকা শহরে পা রেখেছিলাম। প্রথমে মনে হতো আমি ঢাকা শহরে থাকতে পারবো না। মা বাবার জন্য কাঁদবো। কিন্তু না। আমার ধারণা ভুল ছিল। ঢাকা শহরে আমি দিব্বি ভালো আছি।

একটা রুমে আমি আর তন্বী আপু থাকি। তন্বী আপু খুবই ভালো মানুষ। যতক্ষণ রুমে থাকি ততক্ষণ আমার সাথে কথা বলে। মানুষটা কারণে অকারণে অনেক কথা বলে। তবে আমার খারাপ লাগে না। খুবই ভালো লাগে। হয়তো তার এক একটা গুণের জন্য আমি আমার পরিবারকে কিছুটা সময় ভুলে থাকতে পারি। তন্বী আপু আমাকে পড়াশোনার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়।

তন্বী আপু নিজেও প্রচুর পড়াশোনা করে। কিছু প্রবলেম হলেই দেখি আপু অর্ণব নামের সেই লোকটাকে কল করে। যখন থেকে অর্ণবকে দেখেছি তখন থেকে তন্বী আপুর মুখে অর্ণবের নাম শুনলেই আমার বুকটা কেঁপে উঠে। হার্ডবিট ফুল স্পিডে চলতে থাকে। সেই সময়টা মনে হয় আমার দমটা হয়তো এখানেই থেমে যাবে। কখনও কখনও বুকের ভেতরে চিনচিন ব্যথা শুরু হয়ে যায়।

তন্বী আপুর সাথে কোনো কথা বলতে থাকলেই হুটহাট করে অর্ণবের কথা চলে আসে। অর্ণব এরকম। পড়াশোনায় এক্টিভ। অর্ণবের মতো ছেলে হয় না। তন্বী আপু অর্ণবের অনেক প্রশংসা করে। তন্বী আপু ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে যদি এতোবার অর্ণবের নাম নিতো নিঃসন্দেহে মেনে নিতাম তাদের মধ্যে রিলেশন আছে। কিন্তু তন্বী আপুকে এমনটা ভাবার কারণ নেই।

কজ, তন্বী আপুর বয়ফ্রেন্ড আছে। তহিদ ভাইয়ার সাথে তন্বী আপুর ৭বছরের রিলেশন। দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসে। তন্বী আপু কয়েকবার তহিদ ভাইয়ার সাথে আমার মিট করিয়েছে। তহিদ ভাইয়াও লোক ভালো। তাছাড়া তন্বী আপুর মাইন্ড ভালো। তহিদ ভাইয়া বিসনেস করে। বিসনেসের কারণে অনেক বিজি থাকে ভাইয়া। তাই তন্বী আপুর সাথে বেশি কথা বলতে পারে না। এমনও দিন যায় চার পাঁচদিন পর পর কথা হয়। কিন্তু তন্বী আপু কিছু মনে করে না। এমনকি রাগও করে না। তাদের বন্ডিং খুবই ভালো। তাদের ভালোবাসা দেখে আমারও ভালো লাগে। অনেক সময়তো মনে মনে বলি,আমিও আমার বফকে এত্তগুলো ভালোবাসা দিবো।

চলবে——

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here