গল্পটা পুরনো।
লেখা – মুনিরা জলী।
পর্ব – ১।
🍁 🍁 🍁
বর এসেছে , বর এসেছে…..
বাইরে থেকে শোরগোল শোনা গেল। বরযাত্রী বরনের জন্য সবার মধ্যে তোরজোড় শুরু হয়ে গেছে।
বর এসেছে বলে বাইরে থেকে যখনই হৈচৈ শোনা গেল কনের রুমে বসে থাকা তরুণী মহল লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চ্ঞ্চল পায়ে সবাই একেএকে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল রূম ছেড়ে বর দেখতে। রুমে এখন আছে কনে রুহী আর ওর ফুপাতো বোন তোয়া। সবাই বর দেখতে গেলেও তোয়া যায়নি। ওকে বসে থাকতে দেখে রুহী বলল, “কি ব্যাপার আপু তুমি ওদের সাথে গেলেনা? গেট ধরার সময় তুমি থাকবে না?”
” হুহ্ ” তোয়া দড়জার দিকে তাকিয়ে ছিল । রুহীর কথা শুনে ওর দিকে ঘুরে তাকায়। হেসে বলল, “এত ভীরের মধ্যে আমি যাই নাকি? আমার এসব ভালো লাগেনা সেটা তুই জানিস না? ”
‘ভীর?’ অবাক স্বরে বললো রুহী।
” ভীড় না? কত মানুষ ! বেশিরভাগ ছেলে মানুষ। ছেলেদের ভীড়ে ঠেলাঠেলি আমার খুব বিরক্ত লাগে।”
” আপু এটা যে বিয়ে বাড়ি সেটা কি ভুলে গেছ? “হেসে উঠে বললো রুহী। ” বিয়ে বাড়িতে মানুষের ভীড় থাকাই তো স্বাভাবিক। যত বেশি আত্মীয় স্বজন বন্ধু, বান্ধব অতিথি হয়ে আসবে তত বেশি আনন্দও হয় তাইনা আপু বল?”
” হুম আমি জানি, কিন্তু আমি এখানেই ঠিক আছিগো । আর বিয়ের আগে কনেকে রুমে একা রেখে যাওয়া ঠিকনা। সো আই এম হেয়ার ফর ইউ। ” বলে হাসল তোয়া।
ওর কথা শুনে হেসে ফেলে রুহী। ” তুমি সত্যিই অদ্ভূত আপু ! শান্ত, চুপচাপ, কিন্তু লক্ষ্মী। ”
তোয়া উঠে এসে রুহীর সামনে দাঁড়িয়ে ওকে খুটিয়ে দেখতে দেখতে বলল, ” জানিসইত আমি এমনই। ”
” এভাবে কি দেখছ? মেকআপ ঠিক আছে তো? কোন প্রব্লেম? ” চিন্তিত চেহারায় জানতে চাইল রুহী।
“মেকআপ ঠিকআছে। টিকলিটা বাঁকা হয়ে আছে আর ওড়নাও আটকানো হয়নি।দেখি ঠিক করে দেই।”
তোয়া টিকলিটা সোজা করে ক্লিপ দিয়ে ভালো করে আটকে দিল।ওড়নাটা আরও সামনে টেনে কপাল বরাবর ভালো করে পিন দিয়ে আটকে দিল।আয়নার দিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণের করে বলল,
” ভালো করে দেখে নে সব ঠিক আছে কিনা। পাত্রপক্ষের লোক কিন্তু যেকোনো সময় হাজির হবে।”
তোয়ার কথা শুনে হাসতে হাসতে আয়নার দিকে তাকিয়ে ভালো করে মাথা ডানে বামে ঘুরিয়ে দেখল রুহী। সন্তুষ্টির চোখে তোয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। একদম ঠিক আছে । পারফেক্ট। ”
রুহীর কথা শেষ হতে না হতেই তরুণী মহল আবার কলকল করতে করতে রুমে এসে ঢোকে। মেয়েরা সবাই রুহীর কাজিন ও বান্ধবী। ওদের একজন উচ্ছলিত হয়ে বলে উঠল, “ওয়াও রুহী তোর বর সাহেবতো দেখতে দারুন হ্যান্ডসাম রে। ”
রুহী চোখ পাকিয়ে তাকায়, “এই খবরদার আমার বরকে নজর লাগাবিনা কিন্তু। ”
রুহীর কথা শুনে আরেকজন বললো, ” ওরে বাবা এখনো বিয়ে হয়নি, তাতেই কি টান! ”
এই কথায় সবাই সমস্বরে হাসতে লাগলো। আর কিছু বলবে সেই সুযোগ পেলনা কেউ। তার আগেই হুরমুর করে বরপক্ষের মহিলারা রুমে ঢুকে পরে । ওদেরকে দেখে রুহী একটু ঘাবড়ে গেল । পাশে বসা তোয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে সে। তাই দেখে তোয়া ওর কানের কাছাকাছি মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ” কি ভয় করছে?”
” একটু একটু।”
” ভয় কি? ফাহিম ভাইয়ার পাশে যাওয়ার পর দেখবি সব ভয় কই ভ্যানিশ হয়ে গেছে। ”
কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানোর কাজ সম্পন্ন করলেন। বরকনে অফিসিয়ালী এখন স্বামী -স্ত্রীতে রুপান্তরিত হলো। অতিথিবৃন্দের খাওয়া দাওয়ার পালা শুরু হয়েছে । আর এদিকে বর কনেকে ষ্টেজে এনে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। এখন চলছে ব্রাইডাল ফটোসুট। তোয়া ষ্টেজের সামনে সারি সারি সাজিয়ে রাখা চেয়ারগুলোর একটি খালি চেয়ারে বসে ছবি তোলা দেখতে ব্যাস্ত। এমন সময় হঠাৎ তোয়ার চোখ পড়ল বহু আকাক্ষিত একজোড়া চোখের উপর।ওর দুনিয়া যেন ওখানেই স্থির হয়ে গেল। কতদিন দেখেনি এই মুখ, এই গভীর কালো মায়াময় চোখ দুটো। দেখার সুযোগও ছিলোনা। কিন্তু আজ এতদিন পর এখানে তার দেখা পাবে ভাবেনি সে।স্থান কাল সব ভুলে সে হা করে তাকিয়ে রইল।
সেই চোখ জোড়াও তোয়ার দিকে অবাক বিস্ময় নিয়েই তাকিয়ে আছে। রাদীবও যেন ভুলে গেছে চারপাশের শোরগোল, কোলাহল। কতদিন পর দেখছে সেই অতি আকাক্ষিত স্নিগ্ধ, সুন্দর মুখখানা।চোখ ফেরাতেই পারছেনা সে। সবার অগোচরে এতোগুলো বছর যেই মুখখানা পরম যত্নে বুকের গভীরে লালন করে রেখেছে তাকে চোখের সামনে বাস্তবেই বসে থাকতে দেখে আজ তার চোখজোড়া মন ভরে দেখতে চাইছে তাকে, দুচোখের তৃঞ্চা যেন এই এক পলকেই মিটিয়ে নেবে। একে অপরকে দেখায় দুজনেই এত বিভোর ছিল পাশে কারও ধাক্কায় সদ্বিত ফিরে পাশে তাকিয়ে দেখে রাদীব। ওকে খেতে ডাকছে। রাদীব একপলক তোয়াকে দেখে আবার ঘুরে তাকায়, বলে,
” হ্যাঁ এইতো যাচ্ছি । ” বলে পা বাড়ায় খাবার টেবিলের দিকে।
রাদীবের সাথে তোয়ারও খেয়াল হয়, বর কনেকে খাবার টেবিলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তোয়া উঠে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে চেনা কাউকে খুজে। দেখে ওর মামী মিসেস শাহানা ওর দিকেই হেঁটে আসছে। কাছে আসতে আসতেই একটু উচু স্বরেই বললেন,
” কিরে তোকেও কি ডেকে বসাতে হবে?”
” না মামী, ডাকতে হবে কেন? এইতো যাচ্ছিলাম। ”
মিসেস শাহানা হেসে বললেন, ” আচ্ছা বুঝলাম। এবার যা তাড়াতাড়ি। একদম রুহীর পাশে বসবি। ঠিকআছে?”
তোয়া হেসে ফেলল, ” জ্বী মামী একদম পাশেই বসব এবার চলেন। ” ওর পাশে হাটতে হাটতে মিসেস শাহানা বললেন,
“তোর মা এলে কত ভালো হত বলত? বিয়ে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন যত বেশি হবে তত ভরা মনে হয়, মনের জোরও বাড়ে। মেয়ের বিয়ে দিতে যে কত কষ্ট হয়। আপনজন কাছে থাকলে মনে একটু সাহস বাড়ে। ” বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
তোয়া মামীর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। মেয়ে চিরদিনের জন্য শশুর বাড়ি চলে যাচ্ছে, এরপর চাইলেও আগের মতো যখন তখন মেয়েকে কাছে পাবেন না । ভাবতেই তোয়ার বুকের মাঝে কেমন ব্যাথাময় ভারবোধ হচ্ছে। মামীর কাধের উপর দিয়ে একহাত পেচিয়ে ধরে বলল সে,
” আম্মু সুস্থ থাকলে অবশ্যই আসত। হঠাৎ শরীরটা এতো খারাপ হয়ে গেল, জানেন তো আম্মুর ডায়াবেটিস আছে। আমি আর আব্বুতো এসেছি। আবার ঐদিকে ভাইয়াও আসছে। তাও সাথে নাকি আবার গেস্ট নিয়ে আসছে। এজন্য বাড়িতেও অনেক কাজ। বুঝতেই পারছো আম্মুর অবস্থা। ”
মিসেস শাহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হ্যাঁরে সবই বুঝি,বয়স হলে শরীর আর বশে থাকেনা। নাশীদ তো বিয়ে করতে আসছে। তাই না?”
” জ্বি মামি এবার ঢাকায় যাওয়ার জন্য রেডি হন। ”
ওরা ততক্ষণে খাবারের জায়গায় পৌঁছে গেছে। বর কনেকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। বাকিরা সবাই যারযার মতো বসছে।তোয়া রুহীর পাশে বসতেই রুহী ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “আমাকে একা রেখে তুমি এতক্ষন দুরে বসেছিলে কেন আপু? ”
তোয়া চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বলল, ” কিসের একা? তোর বর আছেনা সাথে? আর তোর ফ্রেন্ডরাও আছে কাজিনরা আছে। ”
রাদীবও একই টেবিলেই বসেছে। তাও আবার তোয়ার মুখোমুখি। খাবার সময় বারবার দুজনের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছিল। না চাইতেও নিজেদের অজান্তেই একে অপরের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল। তোয়ার বেশ লজ্জাও করছে। বর কনের সঙ্গে খাবার সময় যারা একসাথে খেতে বসে তাদের মধ্যে বেশ মজাদার, আনন্দময় পরিবেশ থাকে। সবাই মিলে হৈচৈ করে বেশ উপভোগ করছে। কিন্তু তোয়া রাদীব দুজনের কেউই এসব কিছুই উপভোগ করতে পারছেনা।বারবার তাদের মনোযোগ একই জায়গায় এসে আটকে যাচ্ছে। অবশেষে মনে প্রবল অস্বস্তি নিয়ে দুজনেই প্রায় নিরবেই খাওয়া শেষ করল।
খাওয়ার পালা শেষ হতেই বর কনেকে আবারও ষ্টেজে এনে বসানো হয়েছে। এখন বর কনের সাথে দুই পরিবার ও আত্মীয় স্বজনরা ছবি তোলায় ব্যাস্ত।তোয়ার এসব দল বেধে ছবি তুলতে একদম ভালো লাগেনা। তাই ষ্টেজের সামনে রাখা চেয়ারগুলোর একটাতে বসে অন্যান্য অতিথিদের সাথে দর্শক হয়ে দুর থেকেই ছবি তোলা দেখছে।
” কেমন আছ? ”
এতোই মগ্ন ছিল, এই প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে পাশে তাকায় তোয়া। কিন্তু প্রশ্নকারীকে দেখে এবার রিতিমত ঘাবড়ে যায় সে। এখন সে আর সেই সতেরো বছরের সদ্য যুবতি মেয়ে নয়। অথচ এই মানুষটার সামনে এলে এখনো একই অনুভুতি হচ্ছে দেখে নিজের কাছেই অবাক লাগছে? বুকের ভিতরে ধুকপুকানি বেরে গেছে। হাত পা যেন জমে গেছে। একমুহুর্ত চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার রাদীবের দিকে চাইল সে। কোন রকমে বলল,
” আপনি? ”
রাদীব তখন নিষ্পলক চোখে দেখছিল তোয়াকে। হেসে বলল সে,
” হ্যাঁ আমি, কেমন আছ বললেনা? ”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? ”
” আমিও আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। ”
” খালাম্মা, উর্বি ওরা সবাই কেমন আছে? ওরা আসেনি? ”
” আম্মা কালকের আসবে। আসলে আদিবের একটা এক্সাম ছিল । আর এদিকে ইমারজেন্সি বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে। তাই কি আর করা। আর উর্বি ঢাকায়, ওর শশুর বাড়িতে। ওর বেবী হয়েছে একমাসও হয়নি। তাই আসতে পারেনি। তো তুমি এসেছ কবে? ”
” আমি গতকাল এসেছি। তো আপনি দেশে এসেছেন কবে? ”
” এইতো তিনদিন হলো এসেছি । আমি আর ফাহিম একসাথে এসেছি। হঠাৎ চাচুর জরুরি তলবে তড়িঘড়ি করে হাজির হতে হয়েছে। ” বলে হেসে উঠল রাদীব।
তোয়া হালকা হেসে বললো, ” ও আচ্ছা। ”
একটু ইতস্ততঃ করে রাদীব বলল, ” তো তুমি এখন কোথায় আছ? ঢাকায়? ”
” হ্যাঁ ঢাকাতেই আছি। একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে মাত্র জয়েন করেছি। আার পিএইচডির জন্য এপ্লাই করেছি। ”
” বাহ বেশ ভালো। ”
এরপর যেন কথারা হারিয়ে গেল। দুজনেই চুপ।
রাদীব পলকহীন চোখে ওকে দেখতে ব্যস্ত। আর তোয়ার অস্থির মনের সাথে চোখ জোড়াও অস্থির ভাবে এদিক ওদিক ঘুরছে। রাদীব যেভাবে ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে, তাতে তোয়ার পক্ষে রাদীবের দিকে তাকিয়ে দেখতে অস্বস্তি লাগছিল খুব। ‘কি অদ্ভুত যখন চেয়েছিল মানুষটা ওর দিকে চেয়ে দেখুক তখন সে যেন বড়ই উদাসীন ছিল। কখনও কি তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল এভাবে।’ নিজের মনেই ভাবে তোয়া।
আর রাদীবও তোয়াকে দেখছে আর ভাবছে, সেদিনের সেই বাচ্চা মেয়েটা আজ কতটা পরিনত।সেদিনের কাচা সৌন্দর্য আজ পরিপক্ব সৌন্দর্যের রুপে প্রষ্ফুটিত হয়ে উঠেছে। ঘিয়ে রংয়ের জমিনে ম্যাজেন্ডা পাড়ের কাতান শাড়ি পড়েছে তোয়া। ওর ফর্সা মুখে কাজল আর হালকা গোলাপী লিপস্টিক ছাড়া আর তেমন কোনো প্রশাধন নেই। মাথায় ম্যাচিংঅফ হোয়াইট হিজাব পড়া। একটা স্নিগ্ধ সৌন্দর্য তোয়ার সর্বাঙ্গে আলতো ভাবে জড়িয়ে আছে। দুজনের কথা যখন ফুরিয়ে গেল , তখন দুজনেই ভাবনার সাগরে ডুবে গেল যেন। হয়তো ফিরে গেল অন্য কোনো ভুবনে অন্য কোনো সময়ে, যে সময়ে গল্পটা শুরু হয়েছিল। রাদীব আর তোয়ার গল্পটা যে অনেক পুরোনো।
চলবে……..