গল্পটা পুরনো।
লেখা- মুনিরা জলী।
পর্ব – ৩
” না – নু – উ – উ -!”
তোয়া নানীর রুমের দড়জা থেকেই প্রায় চিল্লায়ে ডাক দিল নানীকে। ওর নানী বিছানার একপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। চোখ দুটো বন্ধ, হাতে তজবী। তোয়া ডেকেই ভিতরে ঢুকে পরল। নানী চোখ খুলে ওর দিকে চেয়ে বললেন,
” আয় বুবু, সেই একবারের জন্য একটুখানি দেখা দিয়ে গেলিগা। আর এতক্ষনে আমার কাছে আসার সময় হলো তোর? ”
তোয়া নানীর পাশে বসল। একহাত নানীর পিছনে কাধের উপর দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
” আমি আসছিলাম তোমার কাছে, তুমি তখন নাক ডেকে ঘুমুচ্ছিলে।তাই তোমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে ডিসটার্ব করিনি,বুঝলে? তারপর খেয়েদেয়ে একটু গড়াগড়ি দিলাম। এখন উঠেই সবার আগে তোমার সাথে গল্প করতে চলে এলাম। শরীরের কি অবস্থা বল? ”
” এই বয়সে আর থাকা ! আল্লাহর ইবাদত করে দিন কোনোরকমে কেটে যাচ্ছে। ” বলেই তোয়ার দিকে একটু ঘুরে বসলেন তিনি। তোয়ার একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন। তোয়ার দিকে তার ভজে ঘেরা ক্ষীন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন খানিকটা ক্ষন। বললেন,
” কতদিন পর আইলিরে বুবু? তা এবার কিছুদিন থাকবিত? ”
” জ্বী নানু থাকব। এবার প্রায় নয়, দশদিন থাকা হবে ইনশাআল্লাহ্। ”
” তোরে একা কেনে পাঠাইছে নাহিদা? তোর বাপ মায়ের এত কিসের ব্যস্ততা যে এতটুকুন মেয়েরে একা পাঠায় দিছে? “বেশ ঝাঝালো কণ্ঠ নানীর, একটু হাপিয়ে গেছেন। হাপানো কণ্ঠে আবারও বললেন তিনি, ” আর মাকেও কি দেখতে ইচ্ছা করেনা তোর মায়ের?
তোয়া একটু আরষ্ট ভঙ্গিতে হেসে বলল, ” আসলে নানু তুমি জানতো আম্মুর স্কুল আছে, তাই সময় পায়না। কিন্তু তোমার কথা খুব মনে করে আম্মু। আসতে পারেনা বলে আক্ষেপও করে। বিশ্বাস কর। ”
নানীকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল সে, ” ছুটি পেলে হয়ত আমাকে নিতে আসতে পারে আম্মু। কিন্তু তুমি কাউকে বলবানা ওকে? কনফার্ম না, ছুটি পাওয়ার উপর নির্ভর করছে। তুমি একটু বেশি বেশি করে দোয়া কর যেন ছুটি পায়। ”
নানী খুশি হয়ে তাকালেন। ” সত্যি বলছিস? দোয়া করি যেন ছুটি পায়। জানিসতো বয়স হইছে আজ আছি কাল নাই, এইজন্য খুব অস্থির লাগে ছেলে মেয়েদের দেখার জন্য। ”
তোয়া চোখ পাকিয়ে তাকায় নানীর দিকে। ” একদম এমন কথা বলবানা, বুচ্ছ? তোমার বয়সের সেঞ্চুরি পালন করব আমরা। এত সহজে তোমার ছুটি নাই। ”
হেসে ফেললেন তিনি তোয়ার কথায়, ” পাগলি বুবুর কথা শোন। সময় হইলে সবাইকেই যাইতে হবে বুবু।
তোয়া গাল ফুলিয়ে মন খারাপ গলায় বলল, ” সে তখন দেখা যাবে। কিন্তু তুমি বারবার এমন কথা একদম বলবানা। এসব শুনতে ভালো লাগেনা। ”
নানি ফোকলা দাঁতে হেসে ওঠে বলেন, ” আমার পাগলি বুবুর কথা শোন। আচ্ছা যা আর বলবো না। ”
নানির সাথে গল্প করতে বসে সময়টা বেশ কাটলো তোয়ার। আসরের আজান দিতে নানি বললেন,
” ঐযে আজান দেয়। নামাজটা পড়ে নেই । ”
“তো-য়া-পু-উ-উ-। ”
তখনি রুহীর ডাক শোনা গেল, ডাকতে ডাকতেই এগিয়ে এলো সে। এবার দড়জায় উকি দিতে দেখা গেল তাকে। তোয়াকে দেখে উজ্জ্বল দেখালো রুহীর মুখ।
” আপু, তুমি এখানে? আর আমি তোমাকে সারা বাড়ি খুজে এলাম। ”
” কেন? নানু তখন ঘুমাচ্ছিল, তাই এখন কথা বলতে এলাম। ”
” কথা হয়েছে, বাকি গল্প রাতের বেলায় করবা, এখন উঠ। জানোই তো ছোট দিন। একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তাই আগে ছাদ থেকে ঘুরে আসি। চল। ”
তোয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ” আসর নামাজটা পড়ে নেই আগে। তারপর ছাদে যাই। ঠিক আছে? ”
রুহী ওর দাদীর দিকে ফিরে বলল, ” কি দাদী ছাদে যাবা? চলনা আমাদের সাথে। ”
” তোরা যা, আমি এখন সিড়ি বাইতে পারবনা। হাটুর ব্যাথাটা আবার শুরু হইছে। ”
তোয়া বলল, “আচ্ছা, তুমি তাহলে রেস্ট নাও নানু। ”
▪️▪️▪️▪️▪️
আসরের নামাজ সেরে ছাদে গেল দুজনে । ছাদে ঢুকে তোয়া চারপাশে দেখে একেবারে অভিভূত হয়ে গেল। মুখ দিয়ে আপনা আপনিই বেরুল, ” ও-য়া-ও-ও ! কি অপূর্ব ! ”
তোয়ার কথা শুনে রুহী হেসে ফেলে। কিন্তু কিছু বলেনা। তোয়া মুগ্ধ নয়নে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। নানারকম ফুলের গাছ, ফলের গাছ লাগানো আছে ছাদ জুড়ে। বড় বড় টবে আম গাছ, পেয়ারা গাছ, লেবু, পেঁপে, বড়ই আরও বেশ কিছু ফলের গাছ আছে। এছাড়া ছোট বড় নানারকম সাইজের টবে নানারকম মৌসুমী ফুল ও অন্যান্য ফুলের গাছও লাগানো অাছে। চারিদিকে এত গাছ আর এত ফুল।
তোয়ার নানার তৈরি এই বাড়িটা অনেক পুরোনো। দোতলা বাড়ি। চারপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে বাড়িটা। তোয়ার নানারও গাছপালার প্রতি প্রচণ্ড টান ছিল। তাই বাড়ির চারপাশে নানারকম ফলের গাছ লাগিয়ে ছিলেন তিনি। তিনি আজ বেচে নেই। কিন্তু তার হাতের লাগানো গাছগুলো আজও তার স্মৃতির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস শাহানাও গাছপালা নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন।তাই গাছগুলোর যত্ন তিনি নিজের হাতেই করেন। আর ছাদের গাছগুলো সব উনার নিজের হাতে লাগানো। তোয়ার মামা রাকিব সাহেবও সময় পেলেই স্ত্রীকে সাহায্য করেন বৈকি।
যেহেতু এখন হেমন্ত কালের কার্তিক মাস। শীত ধীর পায়ে প্রকৃতির উপর একটু একটু করে জেকে বসছে। রাজশাহী শহরটা সেসময় প্রচুর গাছপালা আর পুকুরে ছেয়ে ছিল।তাই ঠান্ডাটাও পরত অনেক বেশি। বিকেলটা চোখের নিমিষেই পেরিয়ে যায়, আর ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে একরাশ হিম হিম শিরশিরে বাতাসের ছোঁয়া নিয়ে । ভারি মিষ্টি লাগে এই হিম হিম হালকা শীতল পরশ।
তোয়ার বেশ লাগছিল নানারঙের ফুলের সৌরভ মাখানো এই হিমেল বাতাসের ছোঁয়া। ও গায়ের ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে নেয়। রুহীর উদ্দেশ্যে বললো সে ,
” এখানে অনেক ঠান্ডা পরে তাইনারে? ঢাকায় এখনো একটুও ঠান্ডা পরেনি। ”
” এখনোত তেমন ঠাণ্ডা পরেনি, শীতকালে হাড় কাপানো ঠান্ডা পরে। এবার থাকো কিছুদিন, তাহলে আসল ঠান্ডা দেখতে পারবা। ”
তোয়া হাসি মুখে তাকিয়ে রইল। ” তাই? “ওড়নাটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বলল, “এখন কি কম নাকি, আরও ঠান্ডা পরলে কিভাবে থাকিস বলতো তোরা? ”
” তুমি শাল নিয়ে আসনি আপু? ”
” হ্যাঁ এনেছি। ”
” তোমার বোধহয় ঠাণ্ডা লাগছে, তাই শাল যখন আনস শালটা পরে আসলেই পারতে । ”
তোয়া হেসে বললো, ” ধুর এতো ঠান্ডাও লাগছেনা যে শাল পরতে হবে। ”
দুজনে হাটতে হাটতে ছাদের কিনারায় এসে দাঁড়ায়। বাড়ির গা ঘেঁষে বিশাল একটা কৃষ্ণচুড়া গাছ। ঝিরিঝিরি পাতা সহ বড় একটা ডাল ছাদের উপর হেলে পরেছে। তোয়া ডাল সহ পাতা ছিড়ে হাতে নিয়ে আবার হেঁটে আরেক পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। এখানে দাঁড়িয়ে পুকুর দেখা যায়।পুকুরের পাশ ঘেঁষে সারি সারি নারকেল গাছ।তোয়া আনমনা হয়ে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে ছিল। হঠাৎ পাশের ছাদ থেকে দুজন ছেলের কণ্ঠ কানে এল। ওদের একজন উচ্চকন্ঠে হাসছিল। ওদিকে তাকায় তোয়া। ছেলে দুটি ভিতরের দিকে পা ঝুলিয়ে ছাদের দেয়ালের উপর বসে ছিল। রুহীদের ছাদের দিকে পাশ ফিরে ছিল। হঠাৎ রাদীব মাথা ঘুরিয়ে সরাসরি এদিকেই তাকায়। তাই দেখে তোয়া থতমত খেয়ে যায়। চোখ সরিয়ে নেয়ার আগেই চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের। এক মুহূর্তের জন্য হত বিহবল হয়ে পরে তোয়া। কেমন যেন অস্থিরতায় বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করতে থাকে। এমন কেন লাগলো বুঝতে পারেনা সে। তাই তাৎক্ষণিকভাবে ওদিক থেকে সরে আসে।
এত দ্রুত এভাবে তোয়াকে চলে যেতে দেখে রাদীব ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে। ‘ কি হল? মেয়েটা এভাবে পালাল কেন? ‘ অবাক হয়ে ভাবে সে।
এদিকে তোয়াকে এভাবে দ্রুত সিড়ি ঘরের দিকে যেতে দেখে রুহীও ওর পিছু পিছু চলে আসে।
” কি হলো আপু এখনই নিচে যাবে? ”
” হ্যাঁ চল যাই। এখুনি আজানও দিবে। ”
আর দাঁড়িয়ে না থেকে ওরা নিচে নেমে যায়। ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল রাদীবের বন্ধু সায়েম। রাদীবের দিকে ফিরে বলল সে,
” মেয়েটা কেরে? নতুন দেখছি। সো কিউট ! ”
রাদীব বিরক্ত গলায় বলল, ” সুন্দর মেয়ে দেখলেই তার সাথে ফ্লার্ট করতেই হবে তোর তাইনা? ”
” আমি ফ্লাট করতে চাই কেন মনে হলো তোর? ”
” তোর স্বভাব তো আমার অজানা নয়। কিন্তু সবার সাথে সেই চেষ্টা করিসনা। ”
” কেন? মেয়েটাকে তোরও ভালো লেগেছে বল? ” সায়েমের চোখে মুখে দুষ্টুমি মাখা হাসি ঝুলে আছে দেখে রাদীব এবার একটু রেগে গেল। রাগী কণ্ঠে বলল সে,
” দেখ সব কিছু নিয়ে ফাজলামি ভালো লাগেনা, তুই ভালো করে জানিস আমার প্রেম ট্রেমের ব্যপারে কোনো ইণ্টারেস্ট নাই। এসব ছাড়াও আমার অনেক ইম্পর্টেণ্ট কাজ আছে। ”
রাদীবকে এমন সিরিয়াস হতে দেখে বেশ মজা পেয়েছে এমন ভাবে হাসতে হাসতে বলল সায়েম,
” এই বয়সে তুই সবকিছু এত সিরিয়াসলি নিস কেন? তোর জীবনের অভিধানে মজা, ফান এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই নাকি ডিলিট করে দিয়েছিস? হ্যাঁ? ”
রাদীব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ” সে তুই বুঝবিনা। তোরা তিন ভাই এক বোন। আর তুই সবার ছোট। তোদের আর্থিক অবস্থাও যথেষ্ট ভালো। দায়িত্ব কাকে বলে সেটা তুই জানিস? না চাইতেই তুই সবকিছু পেয়ে গেছিস, অভাব কি কখনও দেখেছিস? তাহলে তুই আমার অবস্থান বুঝবি কেমন করে? ”
” মাানছি আমাদের পারিবারিক ও আর্থিক পরিবেশ দুটোই আলাদা। কিন্তু চোখ কান তো আমার বন্ধ নাই। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষকে তোর মতো পরিবেশেই বড় হতে হচ্ছে। সেসব কী আমি দেখিনাই? সুতরাং এইটুকু বোধ আমার আছে। ”
” তাহলে আমাকে বুঝতে পারিসনা কেন? ”
” আমি তোকে খুব ভালো করে বুঝি। এজন্যই তোকে একটু রিল্যাক্স করার জন্য ফান করি। তুইতো এমন ছিলিনা। সেই ছোট্ট বেলা থেকে তোকে চিনি, জানি।আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তুই আমোদ প্রিয় ছিলি। মনে আছে? ”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাদীব কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই দুর থেকে সমধুর আজানের ধ্বনি বাতাসে ভেসে ভেসে চারিদিকে অপার্থিব আবেশ ছড়িয়ে দিল। রাদীব বসা থেকে উঠে বাইরের দিকে মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সামনে পুকুরের পারে সারি সারি নারকেল গাছের মাথার উপর একটু আগেই উজ্জ্বল আলোকিত আবীর মাখা লালীমার রংমশাল ছড়িয়ে দিয়ে সূর্য্যিমামা ডুব দিয়েছে। রাদীব মুগ্ধতায় বিভোর হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। সেই সাথে ভাবনায় বুঁদ হয়ে গেল সে।
তার জীবনটা আর সবার মত সহজ নয়। বাবা যখন মারা যায় তখন সবে সে মাধ্যমিক পাশ করেছিল। এত অল্প বয়সে মাথার উপর থেকে পরম নির্ভরতায় মাখানো হাতটা যখনই উঠে গেল ও যেন অথৈ সাগরের ঢেউয়ের মধ্যে হাবুডুবু খেতে শুরু করল। ওর সৌভাগ্য যে এমন একজন মা আছেন তাদের । হ্যাঁ তিনি ভেঙ্গে না পরে তিন ছেলে মেয়েকে শক্ত হাতে আকড়ে ধরেছিলেন। তাদের বাবা তাদের জন্যে একটা মাথা গোঁজার ঠাই রেখে গিয়েছিলেন। আর মাকেও স্বাবলম্বী হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন তিনি নিজেই । হয়তো অদুর ভবিষ্যতে বাবা হয়তো এমন সম্ভাবনার কথা ভেবেই তার স্ত্রীর জন্য কলেজের লেকচারের চাকরির ব্যাবস্থা করেছিলেন। কিন্তু আদীব আর উর্বি এখন বড় হয়েছে, উচু ক্লাশে উঠেছে, খরচও বাড়ছে। তাই রাদীব চেষ্টা করে টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ অন্তত নিজেই জোগাড় করতে। তাছাড়া বড় ছেলে এবং বড় ভাই হিসেবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ সচেতন। তাই সে তার জীবনে কোনোরকমের বিলাসিতাকে ঠাই দেয়না। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল যখন খেয়াল হল আকাশের কোল ঘেষে আবীরের লালীমা টুকুর শেষ রেখা ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। দ্রুতবেগে ঘুরে দাঁড়ায় সে। সায়েমকে তাড়া দিয়ে বলে,
” নামাজের সময় চলে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি নীচে চল, নামাজ পড়ে নেই। ” বলেই দ্রুত পায়ে সিড়ির দিকে এগিয়ে যায় সে।
” হ্যাঁ চল। ” বলে সায়েমও রাদীবের পিছু পিছু যায়।
দুজনে দ্রুতবেগে নিচে নেমে গেল। পেছনে ঝুলে রইল হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা একরাশ আবছায়া আঁধার।
#গল্পটা_পুরনো।
মুনিরা জলী।
পর্ব – ৪।
মাগরিবের নামাজ আদায় করে সবাই ডাইনিং টেবিলে সান্ধার নাস্তা খেতে বসেছে। তোয়া, রুহী, রাকিবুল, শাহীল বসে নাস্তা করছে আর গল্প গুজব চলছে সাথে। শাহানা চায়ের কাপ সহ ট্রে হাতে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলেন। ট্রেটা টেবিলের মাঝখানে নামিয়ে রেখে একটা কাপ তুলে নিয়ে তোয়ার সামনে রাখলেন। আরেকটি কাপ তুলে নিয়ে বললেন,
” তোমরা নাও আমি চাটা আম্মার ঘরে দিয়ে আসি। ”
” তোমারে আর কষ্ট করতে হবেনা। ” দড়জায় দাঁড়িয়ে কথাটা বলে উঠলেন তোয়ার নানী।
” আপনি আবার এই শরীরে উঠে এলেন কেন? আমি চাটা দিতেই যাচ্ছিলাম। ” বলেই নিজের হাতের দিকে ইশারা করলেন শাহানা। তোয়া ততক্ষণে উঠে গিয়ে নানীকে ধরে এগিয়ে আনছিল। হেঁটে আসতে আসতেই বলেন তিনি ,
” আজকে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে বউ। তাই ভাবলাম তোমাগো সঙ্গে একসাথে বসে চাটা খাই। কতদিন পর তোয়া বুবু আসছে বলত। ”
ততক্ষণে সবাই যারযার চায়ের কাপ তুলে নিয়েছে। শাহানা একটা চেয়ার টেনে দিলেন। তোয়া নানীকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে চায়ের কাপটা তুলে নেয়। শাহানা হাতে ধরে রাখা কাপটা শাশুড়ির সামনে রেখে দিয়ে নিজেও আরেকটি কাপ নিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।
” তোর পরীক্ষা যেন কবে? ” চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন রাকিব।
” এই রবিবার, ২২ তারিখে। ” বলল তোয়া।
রাকিব একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, ” আজ মঙ্গলবার, এখনো চারদিন আছে । এই কটাদিন ভালো মতো পড়াশুনা কর, একদম সময় নষ্ট করবিনা। কেমন? ”
তোয়ার নানী বললেন, ” তোরা না এই হপ্তায় বউয়ের ভাগ্নের বিয়ে খাইতে যাবি? কবে যাবি? ”
শাহীল চট করে বলল,” পরশুদিন যাব দাদী, পরশু রাতে।”
তোয়া বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করল। শাহানা উঠে দাঁড়িয়ে তোয়ার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
” কি হলো তোর? হঠাৎ এমন বিষম খেলি কেন? ” রুহীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ” আরে হা করে দেখছিস কি,পানিটা এগিয়ে দেনা ওর কাছে ।”
রুহী একটা গ্লাসে দ্রুত পানি ঢেলে তোয়ার হাতে দিতেই সে এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু পান করে লম্বা করে একটা শ্বাস নেয়।
তারপর মাথা তুলে দেখে সবাই ওর দিকেই উদ্বিগ্ন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন ভিষন লজ্জায় পরে তোয়া। অস্বস্তি নিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নেয় সে। ওকে সামলে নিতে দেখে সবাই স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। শাহানা বলেন,
” ঠিক আছিস এখন? ”
তোয়া লজ্জিত কণ্ঠে বলে তোয়া, ” জী মামি আমি ঠিক আছি? ”
রাকিব এতক্ষন চুপচাপ দেখছিল। কাপে শেষ চুমুক দিয়ে খালি কাপ নামিয়ে রাখেন টেবিলে। তোয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন, ” বুঝতে পারছি তুই ভয় পেয়েছিস।”
তোয়া সাথে সাথেই বলে ফেলল, ” মামা আমি একা কিভাবে পরীক্ষা দিতে যাব? তুমি ভালো করেই জানো আমি এখানকার রাস্তা ঘাট কিছুই চিনিনা। ”
” হ্যাঁ জানি, আর এজন্য আমি সব ব্যাবস্থা করেই যাব। তোকে এনিয়ে চিন্তিত হতে হবেনা, বুঝতে পেরেছিস? ”
নানী বললেন, ” কিরে আমার সাথে থাকতে পারবিনা? ”
” হ্যাঁ নানী, তুমি আছ আর কি চাই? ” বলেই নানীকে একহাতে জড়িয়ে ধরে সে। মুখে হাসি তার।
” ব্যাস,সমস্যা সমাধান হয়েছে। ” বললেন শাহানা। ” রুহী, শাহীল তোদের হলো? ” তাড়া দিয়ে বললেন তিনি।
” এইতো হয়ে গেছে। ” বলেই কাপটা ট্রেতে রাখল শাহীল। রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, ” আচ্ছা আব্বু ,আমরা কয়দিন থাকব ওখানে? ”
রাকিবুল বললেন, ” সোমবার ফিরে আসব ইনশাআল্লাহ্।”
শাহানা এটো কাপ প্লেট সব ট্রেতে তুলে নিতে নিতে বললেন,
” শাহীল তোর হলে পড়তে বসার প্রস্তুতি নে। রাদীব কিন্তু এখুনি চলে আসবে।”
তোয়া বলল, ” রাদীব কে? ”
রুহী চট করে জবাব দিল, ” রাদীব ভাইয়া এই পাজী ছেলেটার টিচার। ” বলেই ফিক করে হেসে দিল সে।
শাহীল কটমটে চোখে তাকালো। তোয়াও হাসতে শুরু করল।
শাহানা ট্রে হাতে কিচেনে যেতে যেতে বললেন, “এখন আবার কোনো রকম বাদরামো শুরু করিসনা যেন। ” বলেই কিচেনে ঢুকে গেলেন তিনি।
” আমি যাই পড়তে বসি।কাল একটা ক্লাশ টেস্ট আছে। ” রুহী একথা বলে উঠে ওর রুমে চলে গেল। তখনি কলিং বেজে উঠে। রাকিব শাহীলকে তাড়া দিয়ে বললেন,
” ঐযে রাদীব বোধহয় চলে এসেছে। যা তাড়াতাড়ি দড়জাটা খোল। আর হ্যাঁ ওকে আগে এখানে পাঠিয়ে দিস। কথা আছে ওর সাথে। ”
” আচ্ছা আব্বু পাঠিয়ে দিচ্ছি। ” শাহীল রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই তোয়াও উঠে দাঁড়ায়। ওকে উঠতে দেখে বললেন,
” তুই বোস। তোর সাথেও কথা আছে। ”
সংকোচ নিয়ে আবার বসে তোয়া। মনে মনে বিরক্ত লাগছিল তার। অচেনা একটা ছেলের সামনে তাকে বসতে বলার কারণ কি ভেবে পায়না সে। রাদীব তখন দড়জায় এসে দাঁড়িয়েছে।
” আসসালামুয়ালাইকুম। ” বলেই ভিতরে এসে দাঁড়ালো সে।
রাকিবুল বলেন,” ওয়ালাইকুম আসসালাম। এসো রাদীব, এখানে বসো।”
তোয়া আড় চোখে তাকিয়ে দেখে চমকে মাথা নিচু করে ফেলে। এই ছেলেটাই রাদীব? আজকেই এসেছে সে। এসে অবধি এর সাথে কতবার দেখা হলো। কি আজব? ভেবে অবাক হয় তোয়া। রাদীবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাকিব আবারও বললেন,
” দাঁড়িয়ে কেন বসনা। তোমার সাথে একটু কথা বলব। তোমার তাড়া নেইতো? ”
” না কাকু, সময় আছে , আপনি বলেননা কি বলবেন। ” বলে টেবিলের দিকে চেয়ে দেখে রাদীব। টেবিলের অপর পাশে প্রথমে তোয়ার নানী আর তার পাশেই তোয়া বসে আছে মাথা নিচু করে। টেবিলের এপাশের খালি চেয়ারটায় বসে সে। সামনে তাকিয়ে হেসে বলল, ” কি দাদী খবর কি তোমার? ”
” আমার আর কি খবররে ভাই। কোনো রকম চলছে। আল্লাহ কে ডেকেই কেটে যায় দিন। ”
রাকিবুল গলা উচিয়ে শাহানার উদ্দেশ্যে বলেন, ” শাহানা রাদীবের জন্য একটু চা কর তো। ”
শাহানাও গলা উচিয়ে জবাব দিলেন,” হ্যাঁ বসিয়েছি।”
রাদীব সংকোচের সাথে বলে, ” না না কাকু আমি এক্ষুণি চা নাস্তা করেই বেরিয়েছি। আর কিছু খাবনা এখন। ”
“তা বললে কি হয়?শোন যেজন্য তোমাকে ডেকেছি ” বলেই তোয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” এই হলো আমার বড় আপার মেয়ে তোয়া। ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছে। ” আবার রাদীবকে দেখিয়ে তোয়ার উদ্দেশ্যে বললেন, ” আর ও হচ্ছে রাদীব, আমাদের পাশেই ওদের বাসা আর শাহীলের টিচার। ”
রাদীব তোয়ার দিকে তাকায়।তোয়াও ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। আবারও চোখে চোখ পরে যায়।কেউ পরিচয় করিয়ে দিলে কিছু বলতে হয়।এটাই ভদ্রতা। কিন্তু দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে ভেবেই পায়না কি বলা উচিৎ। দুজনই মনের ভিতরে কথা খুজে বেড়ায়। শেষে রাদীব সামান্য মাথা ঝুকিয়ে হাসি ফুটিয়ে তোলে তার মুখে। তাই দেখে তোয়াও লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নেয়। রাদীব এবার মুখ খোলে, বলে,
” কোন ইউনিট এ পরীক্ষা দিবে? ”
” জী? ” তোয়ার চোখে প্রশ্ন। বুঝতে পারেনি কথাটি ওকে নাকি মামাকে জিঙ্গাসা করা হয়েছে।
রাদীব আবার বলল একটু উচু গলায়, ” কোন ইউনিট? ”
” ওহ ” এবার বুঝতে পেরে বলে, ” ই ইউনিট। ”
” আচ্ছা। ফাস্ট প্রেফার কোন সাবজেক্ট? ”
” ইকোনমিকস, সোস্যাল সাইন্সও পছন্দের। ”
” গুড। দুটোই ভালো সাবজেক্ট। ”
এসময় শাহানা কিচেন থেকে ট্রে হাতে বেরিয়ে এলেন। ট্রেটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বললেন, ” কেমন আছ? ”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি কাকি। ” লাজুক হেসে বলল রাদীব।” কিন্তু এসবের কি দরকার ছিল?”
” তোমাকেতো রোজ নাস্তা দেইনা। আজ তোয়া এসেছে বলে সামান্য আয়োজন করা হয়েছে। নাও তুমি শুরু কর। ”
শাহানা নাস্তা গুলো রাদীবের সামনে এগিয়ে দিয়ে আবার কিচেনে চলে গেলেন। রাদীব পুডিংটা নিয়ে খেতে শুরু করে।
রাকিবুল এবার কথা শুরু করলেন, ” আসল কথাটা এবার বলি। একটা দায়িত্ব দেব তোমাকে। ” এটুকু বলে থামলেন তিনি। রাদীব অবাক হয়ে তাকায়। মনে মনে ভাবে, কি দায়িত্ব দেবেন কাকু? তারপর বলে,
” জ্বী কাকু, বলেন কি করতে হবে? ”
রাকিবুল একটু ইতস্তত করে বলেন, ” তোমার কাকির ভাগ্নের বিয়ে উপলক্ষে আমরা কদিনের জন্য খুলনায় যাব। এর মধ্যে তোয়ার পরীক্ষা। ওতো এখানে কিছু চেনে না। তাই ওর পক্ষে একা কোথাও যাওয়াও সম্ভব নয়। তাই পরীক্ষার দিন তোমাকে একটু কষ্ট করে ওকে নিয়ে যেতে হবে। তোমার কি কোন অসুবিধা হবে? ”
তোয়া একথা শুনে চমকে উঠে। কি বলে মামা একটা অচেনা ছেলের সাথে কিভাবে যাবে? এটা ভেবেই দুশ্চিন্তায় আরও কুকড়ে যায় সে। অস্বস্থি ভরা দৃষ্টি নিয়ে রাদীবের দিকে তাকায় । রাদীবও এক নজর তাকিয়ে ভাবে,’ মেয়েটা ভিষন লাজুক। কিজানি একে কিভাবে নিয়ে যাবে সে? আর তাছাড়া এই মেয়েটাকে যতবার দেখছে ততবার কেন জানিনা অন্য রকম একটা অস্বস্থি ঘিরে ধরছে তাকে। ভার্সিটিতে পরে সে। কত মেয়ে ক্লাশমেট আছে তার। কৈ তাদের সঙ্গে এমনটা কখনই অনুভব করেনি তো সে?
রাদীব তোয়ার দিয়ে তাকিয়েই এসব ভাবনায় ডুবে ছিল। তোয়াই অনেকটা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়।
রাদীবকে কোন জবাব দিতে না দেখে রাকিবুল আবার বলেন, ” তোমার অসুবিধা থাকলে……… ”
রাকিবুলকে থামিয়ে বলে উঠে রাদীব, ” আরে না না কাকু, এতে অসুবিধার কি আছে? আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। আমি সময় মতই পরীক্ষার দিন ওকে নিয়ে যাব। ” তোয়ার দিকে চেয়ে আবার বলে সে, ” পরীক্ষা রবিবারে তো তাইনা? ”
” জী, রবিবারে। ” মৃদুস্বরে বললো তোয়া।
” আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আছি কাকু, আপনারা নিশ্চিতে ঘুরে আসতে পারেন। ”
রাকিবুল স্বস্তির নিঃশাষ ফেলে বললেন, ” তুমি আমার অনেক বড় একটা দুশ্চিন্তা দুর করে দিলে। ”
রাদীব চা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আচ্ছা, তাহলে আমি এখন শাহীলকে পড়াতে যাই? ”
” হ্যাঁ হ্যাঁ , তুমি এখন যেতে পার। ”
যাওয়ার আগে দাদীর দিকে তাকিয়ে বলল, ” তো দাদী পরে দেখা হবে, ভালো থেকো। ”
” তুমি তো শুনি রোজই আস। তোমার সময় কৈ আমার সঙ্গে দেখা করার? ”
” আসলেই দাদী একদম সময় থাকেনা, এখান থেকে বেরিয়ে আবার আরেকজনকে পড়াতে যাই। তারপর বাসায় গিয়ে নিজের পড়াশুনা থাকে। বলতে পার দৌড়ের উপর থাকি। ”
” হ্যাঁরে ভাই সবারই খালি ব্যস্ততা,কারও একটু সময় নাই। আর আমারে দেখ খালি অবসর, শুয়ে বসে থাকতে থাকতে হাতে পায়ে খিল ধরে যাচ্ছে। ”
রাদীব হেসে বলে, ” বাইরে গিয়ে একটু হাটাহাটি করতে পারনা? ভোরবেলায় হাটতে বের হবে, দেখবা শরীর মন একদম ঝরঝরে হয়ে গেছে। ”
” পায়ের ব্যথা নিয়ে বাইরে যাইতে সাহস হয়না। আচ্ছা তুমি যাওগা, দেরি হইতেছে তোমার। ”
“আচ্ছা আসি ” রাকিবুলেরর দিকে ঘুরে বলল, ” আসি কাকু আসসালামুয়ালাইকুম। ”
রাকিবুল সালামের জবাব দিয়ে বললেন,”ওকে যাও।”
তোয়ার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত অস্বস্তিতে চুপচাপ রইল সে, তোয়ার দিকে তাকাতেই তোয়ার শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে গেল । রাদীব ভেবে পায়না সদ্য পরিচিত মেয়েটাকে বিদায় জানানো উচিৎ কিনা। মেয়েটাকে সহজ করতে কথা বলাও দরকার। তানাহলে ওকে ভার্সিটিতে সাথে নিয়ে যাবে কিভাবে? কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মুখে কোন কথা জুগালো না। মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে হালকা মাথা নেড়ে বলে সে,
” আসি। ” বলেই আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালনা সে। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। তোয়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।
রুহী, শাহীল পড়তে বসেছে। মামি টিভি দেখতে বসেছেন। সাথে মামাও সোফায় বসে অফিসের কাজ করছেন বোধহয়। নানি এশার নামাজের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। তোয়া কিছুক্ষণের জন্য টিভি দেখে। তারপরে উঠে গিয়ে পড়তে বসল। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে কেন জানেনা। কিছুই ভালো লাগছে না। পড়াতে মনোযোগ দিতে না পেরে একটু পরেই উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় তোয়া।
পাড়ার রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট বেশি না থাকায় বাইরে আবছায়া আলো আধার ভেদ করে পুকুরের কালো টলটলে পানি দেখা যাচ্ছে। যেখানে পানির উপরে লাইটের আলো পরেছে সেই জায়গার পানি বাতাসের তোড়ে হালকা ঢেউ তুলে চিকচিক করছে। তোয়া সেইদিকে একমনে দেখছে।
তোয়ার মনে পরে, ছোট বেলায় নানাবাড়িতে এলে পুকুরে গোসল করতে যাওয়া হত। পুকুর পারে শান বাধানো ঘাট আছে। পারের উপরে দুপাশে পাকা করা চেয়ারের মতো তৈরি করা হয়েছে। সেখান থেকে শুরু হয়েছে সিড়ি, যা নেমে গিয়েছে অনেক গভীর পর্যন্ত। তোয়ারা ছোট বেলায় দলবেঁধে সেই সিড়িতে দাঁড়িয়ে গোসল করত। যেহেতু সে সাতার কাটতে পারেনা, তাই বুক অবধি পানিতে নেমে খুব সাবধানে ইট গাঁথা সিড়িতে পা দুটো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে টুপ করে একটা ডুব দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াত। একটু এদিক ওদিক হলেই ডুবে যাওয়ার সমুহ সম্ভাবনা ছিল। তাও পুকুরে নামার লোভ সামলাতে পারতোনা।
হঠাৎ গেট খোলার শব্দে চমকে ওঠে তোয়া। গেটের সামনের রাস্তায় চোখ রাখে সে। শাহীলকে পড়িয়ে চলে যাচ্ছে রাদীব। বেরিয়ে সোজা পাশে নিজেদের বাসায় ঢুকলো। পাশে হলেও রাদীবের বাসার গেটটা পাশাপাশি নয়। বরং কোনাকোনি ভাবে আড়াআড়ি রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে রুপালি ও নীলের কম্বিনেশনে তৈরি গেটটা। গেটের সামনে দোতালায় বারান্দার বাইরে লাইট জ্বলছে। সেই আলোতে রাস্তাটা আলোকিত হয়ে আছে। তোয়ার বারান্দায়ও এসে পরেছে কিছুটা আলো।
তখনই আবারও গেট খুলে রাদীব বাইরে এলো। আর কেন যেন হঠাৎ মাথা তুলে তাকায় বারান্দার দিকে। তোয়া গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত পরে চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনের রাস্তা ধরে হেটে চলে যায় রাদীব। তোয়ার মাঝে আবারও সেই অস্থিরতা ফিরে আসে। এবার তোয়া বুঝতে পারে কেন ওর মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। আসলে যখন থেকে শুনেছে রাদীবের সাথে একা ভার্সিটি যেতে হবে তখন থেকেই ওর নার্ভাস লাগছে। সংকোচ হচ্ছে। এই জন্য কিছু ভালো লাগছিল না।
‘ধুর! যা হবে দেখা যাবে। আগে থেকে ভেবে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। ‘ এই ভেবে নিজেকে শান্ত করে ঘরের ভিতর ঢুকে গেল সে।
চলবে ইনশাআল্লাহ।