গাঙচিল পর্ব ১৪+১৫

#গল্পের_নাম: ||গাঙচিল ||
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____১৪

২৩.
কক্সবাজারের ইনানী সি বিচে দাঁড়িয়ে আছে অহি।তার ডান হাত রোদ্দুরের হাতের ভাঁজে।দৃষ্টি সামনের বিস্তর নীল জলরাশিতে।ঘোর লাগা সে দৃষ্টিতে যেন দুনিয়ার খেয়াল নেই।যেন অন্য ভুবনে আছে সে।এলোমেলো বাতাসে তার কালো শাড়ির আঁচল উড়ছে।আধভেজা চুল বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ে যেতে চাইছে বহুদূরে।

চারিদিক এখনো ঝাপসা!ভোরের সূর্য উঠি উঠি করে উঠছে না।চারপাশে কোনো কোলাহল নেই।কেমন স্নিগ্ধতা আর কোমলতা বিরাজ করছে।বালুতীরে পা রাখলেও যেন মনে হচ্ছে বালি ব্যথা পাবে।

অহি রোদ্দুরের হাতের ভাঁজে রাখা নিজের হাতটা ছাড়াতে চাইলো।রোদ্দুর ছাড়লো না।অগত্যা সাবধানে পা সামনের দিকে এগোল!পায়ের পাতায় প্রথম শীতল পানিটুকু স্পর্শ করতেই তার সারা শরীর শিউরে উঠলো।রোদ্দুরের হাতের ভাঁজে থাকা হাতটাও কেঁপে উঠলো।রোদ্দুর আরো শক্ত করে তার হাত চেপে ধরলো।

অহি নিচু হয়ে বাম হাতে পানি ছুঁয়ে দিতে রোদ্দুর আলগোছে বলল,

—“অজান্তা!সাবধানে।”

তারপর দু পা এগিয়ে নুইয়ে পড়া অহির শাড়ির আঁচলটা দুই হাতে উঁচু করে ধরলো।অহির সেদিকে খেয়াল নেই।রোদ্দুরের থেকে নিজের হাত মুক্ত পেতেই দু হাতে পানি সামনের দিকে ছেটানো শুরু করলো।তার মন খুশিতে নেচে উঠছে বার বার।সৃষ্টি লগ্ন থেকে জলের প্রতি মানুষের আলাদা একটা টান!পানির সাথে মানুষের গভীরতা আজকের নয়।যেটা অহি আজ প্রথম টের পেলো।

এই সামনের আছড়ে পড়া প্রতিটি ঢেউ, ঢেউয়ের আঘাত স্পর্শ করা প্রতিটি পাথর আর বালুকণা,যতদূর চোখ যায় সামনের নীল নীল জলরাশি।সবকিছু অহির বড্ড আপন মনে হচ্ছে। নিজের মনে হচ্ছে।একান্ত নিজের।সে বহু বছর পর বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলো।

রোদ্দুর ধরে রাখা অহির শাড়ির আঁচলটা গভীর ভাবে স্পর্শ করে নাকে চেপে ধরলো।অহির গায়ের গন্ধ।সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ তার স্মেল নিল।তারপর চোখ খুলে অহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।

অহির সবকিছুতে সে মুগ্ধ!তার প্রতিটি কথা,কথা বলার ভঙ্গি,ক্ষণে ক্ষণে কপাল কুঁচকানো,হুট করে আবেগে ভেসে যাওয়া, হুট করে গম্ভীর হওয়া, কখনো বা রেগে যাওয়া।সব কিছুতে সে মুগ্ধ।তার শব্দহীন পা ফেলে এগিয়ে আসা,ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি,তার হুটহাট প্রতিটি স্পর্শ সবকিছুতে রোদ্দুর মুগ্ধতা খুঁজে পায়।এই যে এখন খিলখিল করে হাসা,পানি নিয়ে ছোটাছুটি করা বাচ্চা মনের মেয়েটির প্রতিও সে মুগ্ধ।

হঠাৎ অহি এক মুঠো পানি এনে রোদ্দুরের চোখে মুখে ছিটিয়ে দিল।ঠান্ডা পানির স্পর্শে যেন রোদ্দুরের ঘোর কাটে।সে অনুরোধের স্বরে বলল,

—“অজান্তা,পানি ছিটিয়ে দিবে না প্লিজ।এমনিতেই একটু আগে শাওয়ার নিয়ে আমার ঠান্ডা লেগে গেছে।এই দেখো।”

বলেই সে বড়সড় একটা হাঁচি দিল।অহি হুট করে থেমে গেল।প্রচুর অস্বস্তি হওয়া শুরু করেছে তার।কালরাতের কথা মনে পড়ায় এখনি লজ্জায় বালিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।সে ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে তাকালো।

একটুপর রোদ্দুরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল,

—“ওরকম মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকবেন না তো!বিরক্ত লাগে।তাছাড়া আশপাশে এখন বেশকিছু কাপল দেখা যাচ্ছে।”

রোদ্দুর অবাক হয়ে বলল,

—“চেয়েই তো রয়েছি। কিছু করছি না তো।ওই দেখো!দক্ষিণ দিকের দুটো প্রাণী জড়াজড়ি করছে।”

অহি এক পলক সেদিকে তাকিয়ে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল।মনে মনে বলল,

—“তুই তো চেয়েই থাকবি রে বুদ্ধু!ওদের মতো তোর এত সাহস আছে?রুমের ভেতর জড়িয়ে ধরতে তোর হাত পা কাঁপে আর তুই পাবলিক প্লেসে জড়িয়ে ধরবি?এখানে জড়িয়ে ধরলে তুই নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করবি।”

—“অজান্তা ও দিকে চলো।”

রোদ্দুরের কন্ঠে অহি মাথা নেড়ে তার দিকে তাকাল।কুচকুচে কালো শার্টে কি সুন্দর লাগছে মানুষটাকে।অগোছালো ভাবে বাতাসে কম্পমান চুলগুলো অহির ছুঁয়ে দিতে মন চাইলো।কিন্তু হাত বাড়াল না।একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে রইলো শুধু।এমন একটা ছেলে তাকে এতটা গভীরভাবে ভালোবাসে,এতটা কেয়ার করে,এতটা গোপন করে সবার থেকে আড়ালে রেখে ভালোবাসে তার প্রতি মুগ্ধতা তৈরি না হয়ে পারে?

সে রোদ্দুরের পাশে দাঁড়িয়ে রোদ্দুরের ডান হাতটা নিজের দুহাতে শক্ত করে ধরলো।তারপর মাথা নিচু করলো।তার দু চোখ ভরে উঠেছে।ইচ্ছে করছে সামনের মানুষটাকে সারাজীবনের জন্য জড়িয়ে ধরতে।কোনোদিন এক সেকেন্ডের জন্যও ছাড়বে না!এক্ষুনি জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।

রোদ্দুর বাম হাতটা অহির দুহাতের উপর রেখে নরম গলায় বললো,

—“অজান্তা!কি হয়েছে?ওদিকে যাবে না?”

অহি মাথা নিচু রেখেই বলল,

—“হোটেলে যাব।আজ সারাদিন আপনাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো।”

অহির হাতের উপর চেপে রাখা রোদ্দুরের বাম হাতটা খসে পড়লো।অস্পষ্ট ভাবে বলল,

—“ও মাই গড!”

তার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে পারদের গতিতে।এই মেয়ে মেরে ফেলবে তাকে।হার্ট অ্যাটাক ঘটিয়েই মেরে ফেলবে!

রোদ্দুর করুণ গলায় বললো,

—“অজান্তা,তুমি অসুস্থ?জ্বর এসেছে নির্ঘাত!”

বলেই সে অহির কপালে হাত ছোঁয়াল।তার হাতের স্পর্শ পেয়েই অহি চোখ তুলে তাকালো।রোদ্দুর সে চোখের দিকে এক পলক তাকিয়েই ব্যতিবস্ত হয়ে বলল,

—“অজান্তা,তোমার বাম চোখ এত লাল কেন?দেখি দেখি!”

অহির হাত থেকে নিজের ডান হাতটাও ছাড়িয়ে চিন্তিত মুখে গভীর মনোযোগে অহির চোখের পাতা টেনে সরালো।চোখটা বেশ লাল।সাদা অংশে এক জায়গা বেশি লাল হয়ে আছে।রোদ্দুর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

রোদ্দুরের কুঁচকানো ভ্রু যুগল,কপালে চিন্তার বলিরেখা, চোখে মুখে গভীর মায়া।সব মিলিয়ে অহি আরেকদফা মানুষটার প্রেমে পড়লো।তার দিকে রোদ্দুরের খেয়াল নেই।সমস্ত খেয়াল এখন তার চোখে।এমন ভাবে চোখ স্পর্শ করে যাচ্ছে যেন সামান্যতে ব্যথা পেয়ে যাবে।

অহি আর সময় নিল না।নিজের মনের কথা শুনে ফিসফিস করে বলল,

—“আমি আপনাকে ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি রোদ্দুর হিম।”

রোদ্দুর কুঁচকানো কপালেই অহির দিকে নজর দিল।যেন বোঝার চেষ্টা করছে অহি কি বলছে।কিছু বুঝে উঠার আগে অহি উঁচু হয়ে তার ঠোঁটের নিচে স্বশব্দে চুমু খেল।

এটাতে কাজ হলো।রোদ্দুরের টনক নড়লো।ঝড়ের গতিতে কয়েক পা সরে গিয়ে চারপাশে চোখ বুলালো।তার চোখে মুখের লজ্জার ছাপ কিছুটা কমলো চারপাশে কাছাকাছি কেউ নেই দেখে।বহুদূরে আবছা দু জোড়া কাপল দেখা যাচ্ছে শুধু।

সে সরাসরি অহির চোখের দিকে তাকালো না।আশপাশে তাকিয়ে চোখে মুখে জোরপূর্বক বিরক্তিভাব ফুটে তোলে বলল,

—“অজান্তা,এসব কি?”

অহি ভ্রু নাচিয়ে বলল,

—“কোনসব?”

রোদ্দুর নিভে গেল।বলল,

—“কিছু না!এবার বলো,চোখ লাল হলো কি করে?”

—“আপনি করে দিয়েছেন!”

—“কি!আমি?কখন?”

অহি শাড়ির আঁচল পিঠ দিয়ে সামনে এনে বলল,

—“ভোররাতে।ঘুমের মধ্যে চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।সারারাত আমার উপর লেপ্টে ছিলেন।সত্যিই আপনার ঘুম জঘন্য, জঘন্য এবং জঘন্য।”

রোদ্দুর অসহায় ভাবে এদিকে ওদিকে তাকালো।নিচু হয়ে কয়েকটা পাথর তুলে সমুদ্রে ঢিল ছুঁড়লো।তারপর ক্ষীণ গলায় বললো,

—“স্যরি অজান্তা!”

অহি নিজেও দুটো পাথর তুলে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলো।রোদ্দুরের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,

—“আমি এই জঘন্য ঘুমের মানুষটাকেই বুকে জড়িয়ে হাজার জনম কাটাতে চাই।”

রোদ্দুরের বুকের ভেতর খুশির বন্যা বয়ে গেল।সে সার্থক,তার ভালোবাসা সার্থক।তার পাশের মেয়েটিকে এক্ষুণি বুকে জড়িয়ে পিষে ফেলার ইচ্ছেটা সে দমন করলো।

হাতের শেষ পাথরটা সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে অহির পিছনে দাঁড়াল।ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করে হাতে নিল।অহির অজান্তে সেখান থেকে একটা লকেটসহ চেইন বের করে হাতের তালুতে রাখলো।

সাবধানে অহির চুলগুলো সরিয়ে তার গলায় লকেট পরিয়ে দিল।অহি অবাক হয়ে গলায় হাত রেখে বলল,

—“এটা কি?”

রোদ্দুর উত্তর দিল না।বক্সটা সমুদ্রে ঢিল দিয়ে অহির মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।চেইনটা সামনে ঠিক করে লকেটটা হাতের ভাঁজে নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো।তারপর অহির দিকে এক পলক তাকিয়ে সেটা খুললো।

লাভ শেপের লকেটের দু খন্ডের এক খন্ডে রোদ্দুর আরেক খন্ডে অজান্তা লেখা।দু খন্ড একত্রে করে তার উপরের পৃষ্ঠে গোলাপের ভেতর লেখা ‘রোজান্তা’!

রোদ্দুর চারপাশে তাকিয়ে দ্রুত লকেটে একটা চুমু দিয়ে সরে দাঁড়াল।এক সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে উল্টো ঘুরে হোটেলের দিকে হাঁটা ধরলো।অহি লকেটটা হাতে নিয়ে বিস্ফারিত নয়নে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।রোদ্দুরের গমনপথের দিকে চেয়ে তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।লকেটে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে রোদ্দুরের পিছু পিছু দৌঁড়ানো শুরু করলো।

২৪.

ধূসর রঙের একটা পাখি জলে ভেসে বেড়াচ্ছে।পা দিয়ে আরামসে সাঁতার কেটে যাচ্ছে।মাথা ও পাখায় কালো ছোপ ছোপ দাগ।চমৎকার এই পাখি থেকে থেকে ডুব দিয়ে আবার মাথা তুলছে বার বার।ঢেউয়ের তালে তালে কি সুনিপুণ ভাবে হেলেদুলে ভেসে বেড়াচ্ছে।অহি হাতের আঙুল উঁচিয়ে বলল,

—“ওই দেখনু না!গাঙচিল! ”

অহির আগ্রহভরা কন্ঠে রোদ্দুর সেদিকে তাকালো।তারা এখন বীচের পাথরের উপর বসে আছে।অহির পা জলে ভেজানো।রোদ্দুর নিজেও খালি পা দুটো পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলা জলের ধারার উপর রাখলো।তারপর অহির দিকে চেয়ে বলল,

—“হুঁ!গাঙচিল।”

অহি হাস্যোজ্জ্বল মুখে পাখিটির দিকে চেয়ে আছে।পাখিটা তাদের কাছাকাছি চলে এসেছে ভেসে।মাথা উঁচিয়ে এদিক ওদিক ঠাওর করার চেষ্টা করছে।অহি সাবধানে সেদিকে চেয়ে রোদ্দুরের হাত চেপে ধরলো।তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,

—“গাঙচিল কি সুন্দর,তাই না?”

রোদ্দুর অহির দিকে অপলক চেয়ে আছে।এতদিন পরেও বুঝতে পারছে সত্যিকার সমস্যা তার মধ্যেই।তার পাশে হাত চেপে বসে থাকা মেয়েটার দিকে সে সারাজীবন চেয়ে থাকলেও তৃষ্ণা মিটবে না।কখনো চোখ ভরবে না।সে অহির দিকে চেয়েই বলল,

—“হুঁ।ভীষণ সুন্দর।”

—“ওদের জীবন কত আনন্দের।সমুদ্রের নীল জলরাশিতে সাঁতার কাটছে মনের সুখে।আবার একটুপর আরেক নীল আকাশে উড়াল দিবে।সন্ধ্যাবেলা নিজের বাড়ি ফিরবে।সেই বাড়ি আবার পাথর দিয়ে তৈরি।পাথরের খাঁজে কি সুন্দর রাত কাটিয়ে দিবে।”

—“আমার গাঙচিলের জীবনও ভীষণ সুন্দর।সে যখন আমার কোলে উঠে হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করে,বাতাসে তার চুল উড়ে,শাড়ির আঁচল ডানা ঝাপটায় তখন তাকে আকাশে উড়ন্ত পাখির চেয়েও ভয়ংকর সুন্দর আর সুখী লাগে।সেও আমার বুকের নরম পাথরের খাঁজে ঘুমিয়ে পড়ে।”

অহি সন্দিহান চোখে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।রোদ্দুর সঙ্গে সঙ্গে এক লাফে উঠে সরে গেল।কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বলল,

—“এভাবে তাকাচ্ছো কেন?”

অহি সন্দিহান চোখে মুখে বলল,

—“আপনি কি আমায় নিয়ে বর্ণনা করলেন?কি সাংঘাতিক!আপনার সাহস তো দেখি দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে।বাহ!”

অহি লজ্জিত মুখে আবার পাখিটির দিকে তাকালো।রোদ্দুর আশপাশে তাকালো।তারা ফাঁকা জায়গা দেখেই বসেছে।এদিকে কাছাকাছি মানুষ নেই।সে ফের এগিয়ে এসে অহির পাশে বসে পড়লো।ক্ষীণ কন্ঠে বলল,

—“তোমার গাঙচিল পরিযায়ী।এরা সিজন ভেদে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায়।প্রতিকূল পরিবেশ বা বৈরি অবস্থা দেখলেই অন্য দেশে পলায়ন দিবে।হয়তো আজ দেখছো,দু মাস পর এসে আর এদের দেখা পাবে না।কিন্তু আমার গাঙচিল স্থায়ী।সে আমার বুকে শেকড় গেড়েছে।যে শেকড় ছেড়ে আর কোথাও যাবে না।যেকোনো পরিস্থিতিতে আমার বুকেই থাকবে।এবার বলো,তোমার গাঙচিল ভালো নাকি আমার গাঙচিল ভালো? ”

অহি মাথা নিচু করলো লজ্জায়।পাথরে নখ দিয়ে টোকা দিতে দিতে বলল,

—“আপনার বুকের খাঁজের পাথরের বাসাটা যেন কোনোদিন অন্য কারো দখলে না যায়।সারাজীবন যেন আপনার গাঙচিলের থাকে।”

—“থাকবে!”

তারপর আর কেউ কথা বলে না।দুজন নিরবে উঠে দাঁড়ায়।সমুদ্র তীরের বালিতে পা ভিজিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে।অহি রোদ্দুর আঙুলের ভাঁজে আঙুল রাখে।রোদ্দুর চট করে দুজনের হাতটা অহির শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে ফেলে।গভীর সমুদ্র ততক্ষণে সূর্যটাকে গিলে ফেলছে।বহু মানুষ এই সময়টাতে মুগ্ধতা নিয়ে লাল লাল সূর্যটা কিভাবে দিনশেষে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায় তা দেখছে।

হাতে হাত রেখে, আঙুলে আঙুল গুঁজে জীবনের শ্রেষ্ঠ সন্ধ্যা নামায় দুজন।

২৫.

তিনদিন পর কক্সবাজারের ট্রিপ থেকে ঢাকায় ফিরে অহি বাবার বাড়ি যায়।কলতা বাজারের ঘিঞ্জি গলি দিয়ে যখন পা ফেলে এগিয়ে যায় ততক্ষণে সে হাজারো নতুন অনুভূতির জলজ্যান্ত সাক্ষী।তার মিষ্টি-মধুর নতুন জীবন শুরু হয়েছে।সে আড়চোখে তার পাশের মানুষটার দিকে তাকালো।

রোদ্দুর আজ প্রথম শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে।প্রথম নয়,কিন্তু বিয়ের পর প্রথমবার!তার দু হাত ভর্তি কাঁচা বাজার।গেট খুলে বাড়িতে পা রাখতে রোদ্দুর চমকে বলল,

—“অজান্তা,মিষ্টি আনিনি।শিট!”

অহি হাতের লাগেজটা উঁচু করে ভেতরে ঢুকলো।রোদ্দুরের গোল গোল চোখের দিকে এক পলক চেয়ে বলল,

—“মিষ্টি আনেননি তাতে কি হয়েছে?তাছাড়া বাড়িতে তো বাচ্চা কেউ নেই যে মিষ্টির জন্য হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করবে।”

—“ইয়ে মানে চাচাজী স্যরি বাবার মিষ্টি খুব পছন্দের।সেদিন স্যান্ডেল বিক্রি করে ফেরার পথে আধ সেরের কাছাকাছি মিষ্টি খেয়ে ফেলেছিল।তাছাড়া আজ প্রখমবারের মতো শ্বশুর বাড়ি আসলাম।মিষ্টি নিয়ে আসতে হয়।ধুর!বড্ড ভুল হয়ে গেছে।”

অহি সামনে এগোতে এগোতে বলল,

—“এতবড় সাংঘাতিক ভুল করে ফেলেছেন যার কোনো ক্ষমা নেই।এখন গিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ুন।”

জলিল মোল্লা বাইরে বের হয়ে দুজনকে দেখে খুশিতে তার চোখ নেচে উঠলো।অহির মাথায় হাত বুলিয়ে রোদ্দুরকে বলল,

—“বাবা জীবন কেমন আছো গো?”

রোদ্দুর নিচু হয়ে কদমবুসি করে বলল,

—“ভীষণ ভালো আছি বাবা!সবাই কোথায়?মা কোথায়?”

—-“তোমার মা একটু ঘুমায়।বাদবাকি সবাই রান্নাঘরে।”

—“অহ।ভালো!বাবা,আপনার মাথায় তো চুল বের হয়ে গেছে।কেমন কুচকুচে হয়ে গেছে প্রায়!দেখো,অজান্তা।”

জলিল মোল্লা খুশিতে গদগদ হয়ে সজারুর কাঁটার মতো সূঁচালো খাড়া চুলগুলোতে হাত বুলাল।অহি সেদিকে এক নজর চেয়ে লাগেজটা বারান্দায় রাখলো।রোদ্দুরের হাত থেকে ব্যাগ গুলো নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।শফিককে কোথাও দেখা যাচ্ছে না!সবাই হয়তো রান্নাঘরে।

অহি চলে যেতে রোদ্দুর বলল,

—“বাবা!মোড়ের দোকানে মিষ্টি কিনে ভুলে রেখে এসেছি।টাকা দিয়েছি,কিন্তু মিষ্টি আনা হয়নি।বড়ই দুঃখীত।”

জলিল মোল্লা রোদ্দুরের থেকে দ্বিগুন দুঃখ নিয়ে বলল,

—“কি কান্ড!চলো, চলো।দুজন একত্রে গিয়ে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসি।কিনে ফেলেছো যখন তখন আনতেই হবে।এতগুলো টাকা!তাছাড়া মোড়ের দোকান তো বেশিদূর নয়।চলো!”

রোদ্দুর অসহায় দৃষ্টিতে রান্নাঘরের দিকে তাকালো।সত্যিই তার মিথ্যে খাপছাড়া।কেন যে বলতে যায়!গলা উঁচিয়ে একবার বলল,

—“আমি একটু বাজারে যাচ্ছি।”

তারপর জলিলের পেছন পেছন হেঁটে গেট দিয়ে বের হয়ে গেল।

(চলবে)#গল্পের_নাম: ||গাঙচিল ||
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব______১৫

—“অজান্তা,চলো আমাদের ফ্ল্যাটে ফিরে যাই।না কোরো না প্লিজ!”

অহি বিছানার চাদর টান টান করে রোদ্দুরের দিকে এক পলক গভীর চাহনি দিল।তারপর টেবিলের উপর থেকে মলিন কাভারের বালিশ দুটো বিছানার মাঝামাঝি রেখে বলল,

—“এত রাতে ফ্ল্যাটে যাব কেন?”

রোদ্দুর এগিয়ে এসে অহির মুখ সোজা বিছানায় বসে পড়লো।চট করে একটা হাত ধরে বলল,

—“এত কেন কেন করবে না তো।চলো না!”

—“মা তো যাবে না রাতের বেলা।বিয়ের দিন রাত হয়ে গেছিল বলে এ বাড়িতে থেকে গেল।আপনার মনে নেই?আজও তো রাত দশটার কাছাকাছি।”

রোদ্দুরের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হলো।সত্যিই তো!এদিকটা সে ভেবে দেখেনি।ভেবেছিল মাকে আর অহিকে সাথে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরবে আজ রাতেই।যদিও ফ্ল্যাট বেশিদূর নয়,কিন্তু মা তো এতরাতে যেতে রাজি হবে না।

পরক্ষণে রোদ্দুরের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠলো।অহির হাত টেনে আরো একটু কাছে নিয়ে বলল,

—“মা তাহলে আজও এই বাড়িতে থাকুক।তাছাড়া মাকে দেখে বড্ড খুশি মনে হচ্ছে।এখানে সবার সাথে কথাবার্তা বলছে,ইচ্ছে মতো সব করছে।এর আগে তো সবসময় ঘরবন্দী থাকতো।নাজমা খালা আর আমি ছাড়া আর কারো সাথে পরিচয় ছিল না তেমন।প্রেমের বিয়ে বলে আমার নানার বংশের সাথেও তার সম্পর্ক নেই।বলি কি?আজ রাতটা মা তাহলে এখানে থাকুক।কাল সকালে শফিক গিয়ে রেখে আসবে বা আমি এসেই নিয়ে যাব।আজ বরং আমরা রাতের ঢাকার শহরে হাঁটি।”

অহি চিন্তিত মুখে বলল,

—“কিন্তু সবাই রাজি হবে?এত রাতে ছাড়বে আমাদের?আজই তো মাত্র এ বাড়িতে এলাম।”

—“আরে ছাড়বে ছাড়বে!অজান্তা,তুমি দ্রুত নীল রঙের শাড়িটা পড়ে ফেলো তো।”

বলে রোদ্দুর উঠে দাঁড়ালো।দরজার দিকে এগিয়ে যেতে অহি পথ আগলে দাঁড়াল।ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,

—“বাইরে যাচ্ছেন কেন?”

রোদ্দুর অবাক হয়ে বলল,

—“কেন যাচ্ছি বুঝতে পারছো না?শাড়ি পড়বে তো তুমি।রেডি হও!”

—“আজ আপনি আমায় শাড়ি পড়িয়ে দিন।”

অহির আবদারে রোদ্দুরের গলা শুকিয়ে গেল।দু পা পিছিয়ে বড়সড় ঢোক গিলল।গায়ের টিশার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে বলল,

—“অজান্তা,আমি শাড়ি পড়াতে পারি না।”

অহি নাক ফুলিয়ে বলল,

—“সেটা পারবেন কেন?পারেন তো শুধু কাঁপা-কাঁপি করতে।শাড়ি খুলতেই আপনার দফারফা হয়ে যায়। আর শাড়ি পড়াবেন!”

রোদ্দুর আঙুল উঁচিয়ে বলল,

—“আ-আমি আজ সারা রাত ইউটিউব ঘেঁটে শাড়ি পড়া শিখবো।বুঝতে পেরেছো তুমি?না শিখলে আমার নাম রোদ্দুর হিম নয়।বলে রাখলাম।”

রোদ্দুর চলে যেতে অহি ফিক করে হেসে ফেলল।সে এগিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো।

রোদ্দুর বাইরে বের হয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিল।এই মেয়ের আশপাশে থাকলে কেমন যে অনুভূতি হয়!প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে সে শফিকের রুমে ঢুকলো।

শফিক কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল।রোদ্দুরকে দেখে কল কেটে কান থেকে ফোন নামাল।শফিকের হাতে নতুন অ্যান্ড্রয়েড।টিউশনির টাকা জমিয়ে সে কিনেছে।রোদ্দুর একটা ফোন তাকে গিফট করেছিল।কিন্তু সে কিছুতেই নিতে রাজি হয়নি।অগত্যা সেটা এখন অহির হাতে।

—“হেই ব্রো!”

রোদ্দুর টেবিলের চেয়ার টেনে বসতে শফিক তার সামনাসামনি বিছানায় বসে পড়লো।তাকে একটু ক্লান্ত লাগছে।এতগুলো মানুষ বাড়িতে।এটা ওটা আনা নেওয়া করতে করতে আর বাজারে যেতে যেতে সে কিছুটা টায়ার্ড।

—“ফোনের ওপাশে কে ছিল?স্পেশাল কেউ?”

রোদ্দুরের অতিশয় স্বাভাবিক কন্ঠে শফিক ঘাবড়ে গেল।ডান হাত কপালে বার কয়েক চালান করে অহেতুক হাসার চেষ্টা করলো।রোদ্দুরের দিকে এক পলক চেয়ে বলল,

—“ফ্রেন্ড।জাস্ট ফ্রেন্ড!”

—“জাস্ট ফ্রেন্ড!বাহ!আমি হলাম গিয়ে ইনভেস্টিগেশন অফিসার।কেউ হাঁ করলেই তার ভেতরের সব পড়তে পারি।”

—“একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না রোদ্দুর ভাইয়া?হাঁ করলেই সব বুঝে যান?কই, বুবুকেই তো বুঝতে পারেননি।”

—“হে হে হে।হাসালে শফিক।তোমার বুবুকে বুঝতে পারিনি কে বলেছে?তোমার বুবুকে জিজ্ঞেস করিও।এখন সারাক্ষণ আমার কথায় উঠ-বস করে।আমার ভয়ে তার কাঁপা-কাঁপি অবস্থা।সামান্য হাত ধরলেই কেঁদে টেদে গঙ্গা বানিয়ে ফেলে।এমন ভয় পায় আমাকে।কিন্তু আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসি বলে তার সবকিছু ভালো লাগে।এখন শোনো,তোমার জাস্ট ফ্রেন্ডের ব্যাপারে আমি মোটামুটি জানি।কতদিন হলো অ্যাফেয়ার?”

শফিক শুকনো ঢোক গিলে বলল,

—“বেশি না।চার মাসের মতো।ও আমার ক্লাসমেট।খুবই লক্ষী মেয়ে।”

—“নাম কি?”

—“ইয়ে মানে,ভাইয়া ওর নামটা….একটু কেমন জানি।আসলে ওর জন্মের সময় আলট্রাসনোগ্রাফিতে এসেছিল ছেলে হবে।সেজন্য বাসার সবাই রনি নাম ঠিক করে রেখেছিল।কিন্তু জন্মের পর দেখা গেল মেয়ে।তো কি করা!বাসার সবাই রনি বলেই ডাকে।ভার্সিটিতে ওর নাম দেয়া রনিয়া।রনির সাথে আ যুক্ত করা।আমি ওকে একটা বিশেষ নামে ডাকি।আমাদের মধ্যে তুই তুকারি সম্পর্ক।ও আমার পরিবার সম্পর্কে সবই জানে।আমাদের দারিদ্র্যতাকে সে আমার মতই আপন করে নিয়েছে।”

রোদ্দুরের ভেতর ভালো লাগা কাজ করলো।যাক,এই ছন্নছাড়া ছেলেটার জীবন গুছিয়ে দেয়ার জন্য একটা মেয়েলি হাত খুবই প্রয়োজন ছিল।সে হেসে বলল,

—“তোমার ঠেলাগাড়ি ঠেলার জন্য তো হেল্পার পেয়েই গেলে।এখন যত্ন করে তাকে আগলে রেখো।মেয়েদের হাতে জাদু আছে।বুঝেছ?তার এক ধাক্কাতেই তুমি সোজা বিসিএস ক্যাডার হয়ে যাবে।”

শফিক লাজুক হাসলো।রোদ্দুর বলল,

—“বাবার ব্যবসা কেমন চলে শফিক?”

জলিল মোল্লা স্যান্ডেলের দোকান খুলেছে সেদিনের পর থেকে।এই বয়সে কেউ চাকরি বাকরি দিচ্ছিল না।সেজন্য স্যান্ডেলের ব্যবসাতে ঢুকেছে।পাইকারি দরে জুতা এনে প্রতিদিন লক্ষীবাজার ফুটপাতে বসে।ভালোই আয় হয়।বলতে গেলে রমরমা ব্যবসা।এর জন্য তিনি অহিকে আর চাকরি করতে দেননি।এমনকি শফিকের তিনটে টিউশনির একটা বাদ দিয়ে দিয়েছে।শফিক হাসিমুখে বলল,

—“অনেক ভালো চলছে।বাবা প্রফেশনাল হয়ে গেছে একদম।”

রোদ্দুর আর দেরি করলো না।হাতঘড়ির দিকে এক নজর চেয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

—“শফিক, আমরা এখন গুলিস্তান যাব।তোমার বুবু কান্নাকাটি করছে ফ্ল্যাটে ফেরার জন্য।ওখানে নাকি খুবই মূল্যবান কিছু ফেলে রেখে এসেছে।কত করে বললাম, চলো সকালে যাই।কিন্তু কিছুতেই শুনছে না।আমি রাজি না দেখে রুম থেকে বের করে দিয়ে দরজা আটকে বসে আছে।কি আর করা!এখন আমরা দুজন রওনা দিবো।তুমি একটু মা -বাবাসহ সবাইকে বুঝিয়ে বলো।”

শফিক কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,

—“ঠিক আছে।সমস্যা নেই।আমি সবাইকে বুঝিয়ে বলছি।তাছাড়া বেশি রাত হয়নি।ঢাকাতে রাত দশটা,এগোরাটা ব্যাপার নাহ!”

রোদ্দুরের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো।

২৬.

রাতের ঢাকা শহর আলোতে ঝলমল করছে।চারপাশে হলুদ আর সাদা আলোর সংমিশ্রণে অদ্ভুত এক পরিবেশ বিরাজ করছে।অহি মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছে পরিবেশটা।

রাতের ঢাকা শহরে পা ফেলে হাঁটা হয়নি তার।আজ প্রথমবারের মতো মনে হলো প্রতিটি মেয়ের একবার হলেও রাতের শহরে হাঁটা উচিত।এত এত চমৎকার একটা মুহূর্ত, অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতির সাক্ষী প্রতিটি মানুষের হওয়া উচিত।

অহি যেন কেমন ঘোরের মধ্যে চলছে।চারপাশের পরিচিত পরিবেশ কেমন অপরিচিত মনে হচ্ছে।সে রোদ্দুরের ধরে রাখা হাতটা চেপে দাঁড়িয়ে পড়লো ফুটপাতে।মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকাল।ঘন কৃষ্ণ আকাশে ফিনিক তারার মেলা বসেছে।কালো চাদরে যেন উজ্জ্বল আলোর ছিটেফোঁটা।কি সুন্দর লাগছে।

হিমেল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে চারিদিকে।ইট,সিমেন্টের ভিড়ে দু একটা কদাচিৎ গাছের সবুজ পাতা ফিনফিনে হাওয়ায় দুলছে।সেসব পাতায় আবার রাস্তার আলো পড়ে অদ্ভুত সব নকশা তৈরি হচ্ছে।কয়েক সেকেন্ড পর পর সাই করে গাড়ি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।সব মিলিয়ে কেমন অন্য রকম পরিবেশ।

অহি রোদ্দুরের হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

—“জীবন এত সুন্দর কেন?”

রোদ্দুর হেসে ফেলল।এই মেয়েটা এত অল্পতে তুষ্ট কেন?এর চাওয়ার পরিধি এত ছোট্ট কেন?একটু বেশি চাইলে ক্ষতি কি!আর দশটা মানুষের মতো এত চাহিদা কেন নেই তার?এখানেই যে তার গাঙচিল সবার থেকে আলাদ।সবার থেকে বেস্ট।অনন্য!

সে অহির হাত ধরে কিছুটা এগিয়ে গেল।এখানে রাস্তা বেশি চওড়া।বহু মানুষ জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে।ফ্ল্যাটের কাছাকাছি এসে গেছে প্রায়।তাই তাড়াহুড়ো নেই।বাস থেকে নেমে আধঘন্টার মতো হলো তারা হাঁটছে।অহির হাত চেপে সে ফুটপাতে বসে পড়লো।

পাশের জায়গাটুকু ফু দিয়ে ধুলোমুক্ত করলো।তাতেই ক্ষান্ত হলো না রোদ্দুর।প্যান্টের পকেট থেকে টিস্যুর গোছা বের করে বিছিয়ে দিল।ইশারায় অহিকে পাশে বসতে বলল।

অহি বসে পড়লো পরম আনন্দে।ফের রোদ্দুরের হাত ঝাঁকিয়ে বলল,

—“বলুন না জীবন এত সুন্দর কেন?জানেন আমার এতদিনও বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না।জীবন আমার কাছে ঋণের মতো মনে হতো।যা না চাইলেও টেনে নিয়ে যেতে হবে।একমাত্র মৃত্যুতে সে ঋণের বোঝা কাঁধে থেকে নামবে।একটা দিনও আমি বেঁচে থাকার কোনো মানে খুঁজে পাইনি।আমার গভীর রাতের দীর্ঘশ্বাসগুলো জানে কতটা কষ্টে আমার সকাল হতো।কতটা বেদনা নিয়ে রোজ আমার পৃথিবীর অন্ধকার কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটতো।

কিন্তু এই দেখুন,আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে কেমন যেন সব পরিবর্তন হতে শুরু করলো।এখন আমার ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটলেই মনে হয় আমার বেঁচে থাকা সার্থক।অন্তত এই ঘটনার জন্য আমার বেঁচে থাকতে হতো।বেঁচে না থাকলে এত সুন্দর একটা মুহূর্তের আমি চিরসাক্ষী হতে পারতাম না।

আপনি মানুষটা সত্যিই ম্যাজিক জানেন।কেমন হুট করে আমার জীবনে এসে সব পরিবর্তন করে দিলেন।সব অশুভ থেকে অ শব্দটাই ভ্যানিশ করে দিলেন।আমার আমিকে আপনি প্রখর রৌদ্রে তপ্ত করে আবার নিজেই হিম হয়ে নামলেন।আপনার এই পাগলামিগুলোর অংশ হতেও আমি এখন হাজার জনম বাঁচতে চাই।শত কোটি জনম শুধু আপনাকেই চাই।”

শেষের কথাগুলো অহি ক্ষীণ কন্ঠে বলল।কিন্তু রোদ্দুরের কানে ঠিক পৌঁছাল।রোদ্দুর খালি হাতটা বুকে চেপে আছে।কোনোরকমে বলল,

—“অজান্তা!তোমার এই রোমান্টিক কথা শুনে আমার বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে।সুখের ব্যথা।প্রেমের ব্যথা!”

অহি যেন সংবিৎ ফিরে পেল।কাঠ কাঠ গলায় বললো,

—“রোমান্টিক কথা কখন বললাম আবার?”

রোদ্দুর কিছু বলল না।এই মেয়েটার তার প্রতি ভালোবাসার ধরণ অন্যরকম।অন্য রকম হবে না কেন?এই মেয়েটাই যে অন্য রকম।সবার থেকে আলাদা।

দুজন চুপচাপ বসে রইলো কিছুক্ষণ।হঠাৎ মনে পড়ায় অহি বলল,

—“আপনার বাবার সাথে কথা হয়নি আর?”

রোদ্দুর অন্যমনষ্ক হয়ে গেল।রাস্তায় চলমান রিকশা গুলোর দিকে চেয়ে বলল,

—“হয়নি অজান্তা।জানো,ছোটবেলায় আমি বাবার বাধক ছিলাম।বাবার সবকিছুতে আমি মুগ্ধ।সবসময় তাকে ফলো করতাম।তিনি যা করবেন আমারও তাই করা চাই।তিনিও আমি বলতে পাগল।সবকিছু দিয়ে আগলে রাখতেন।কিন্তু তার দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকে তিনি আস্তে আস্তে আমাদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে।হঠাৎ করে তার পরিবর্তন আমি ধরতে পারি। কিন্তু আড়ালে চেপে যাই।তারপর তার বিয়ের কথা ফাঁস হওয়ার পর কেমন যেন অপছন্দ হতে থাকেন তিনি।কিছুটা পছন্দ করলেও মায়ের অসুস্থতার পর সবটা মুছে গেছে।একটা সময় যেই আমি বাবা নামক মানুষটার জন্য পাগল ছিলাম,সেই আমি আজ তার নামটাও শুনতে পছন্দ করি না।তার কথা মনে পড়লেই জীবনের সেই মুহূর্ত গুলো মনে পড়ে,যখন আমার মা নিজের গায়ে নিজে আঁচড় কাটতো।কামড়ে,খুবলে ফেলতো নিজের শরীর।নিজের সন্তানকে দা নিয়ে ধাওয়া করতো।নিজে……..”

অহি আর বলতে দেয় না।রোদ্দুরকে সে পুরনো কষ্ট গুলো, পুরনো ক্ষত গুলো মনে করতে দেবে না।তার মাকে,তাকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখবে।তার মনে একটা প্রশ্ন আসে।রোদ্দুরের বাবার দ্বিতীয় পক্ষে কোনো সন্তান আছে কি না।কিন্তু করে না।রোদ্দুরকে এসব বিষয়ে বলে মন খারাপ করিয়ে দিতে চায় না।

কিছুটা সময় কেটে যায় নিঃশব্দে।দুজন নিঃস্তব্ধতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কাব্যগাঁথা শুনে যায় যেন কান পেতে।হাতঘড়ির দিকে চোখ পড়তে ঘোর কাটে রোদ্দুরের।বারোটা বাজে।এত রাতে বাইরে থাকা নিরাপদ নয়।এমনিতেই প্রচুর রাত হয়ে গেছে।

ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় সে।অহির হাত টান দিয়ে বলে,

—“অজান্তা,অনেক রাত হয়ে গেছে।চলো তাড়াতাড়ি।”

—“হুঁ!”

—“কাল সকাল থেকে আমার অফিস কিন্তু।”

অহির মন খারাপ হলেও মাথা নেড়ে হুঁ বুঝাল।তারপর দুজন হাতে হাত রেখে রাস্তা পার হয়।সাত-আট মিনিট পরেই নিজেদের ফ্ল্যাটে পৌঁছায়।ক্লান্ত শরীরটা ড্রয়িং রুমের সোফায় মেলে দিয়ে রোদ্দুর বলে,

—“অজান্তা,এক গ্লাস পানি।”

তার বলার আগেই অহি গ্লাসটা বাড়িয়ে দেয়।এক হাতে গ্লাস নিয়ে রোদ্দুর খপ করে আরেক হাতে অহির হাত চেপে ধরে।অহি চোখ দিয়ে ইশারা করে হাত ধরেছে কেন!রোদ্দুর হাত ছেড়ে দেয়।এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলল,

—“অজান্তা,কত বার তোমার হাত ধরলাম।তারপরও যতবার হাত ধরি সেই প্রথম হাত ছোঁয়ার অনুভূতি হয়।বুকের ভেতর ধুকপুক করে।গলা শুকিয়ে যায়।অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।মনে হয় এই প্রথম হাত ধরছি।এমন কেন?”

বলে সে এক চুমুকে সম্পূর্ণ গ্লাস খালি করে।হাতের গ্লাসটা পাশে নামিয়ে রাখতেই অহি নিচু হয়ে চোখের পলকে এগিয়ে এসে রোদ্দুরের ঠোঁটে চুমু খেল।

২৭.

রোদ্দুর নিজের কেবিনে বসে ফাইলের পাতা উল্টাচ্ছে।এবারের কেসটা বেশ জটিল মনে হচ্ছে।তার চেয়ে বড় জটিলতা তার মনে চেপে রেখেছে।তার সিঙ্গাপুর মিশনে যাওয়ার সব কাগজপত্র ঠিক হয়ে গেছে।পাসপোর্ট,ভিসা সব রেডি।ইভেন যাওয়ার ডেট ফাইনাল হয়ে গেছে।অথচ সে খবরটা কাউকে দেয়নি।কাউকে জানাতে পারছে না।সবটা সবার অগোচরে করা।কিন্তু এখন তো জানানো দরকার।মাকে নিয়ে চিন্তা নেই তার।অহি তাকে সামলে রাখবে।কিন্তু এতবড় ঘটনাটা অহিকে জানানো দরকার।অথচ সে অহিকে বলতে পারছে না।

কাল রাত থেকে আজ সকাল অবধি হাজার বার সে অহিকে বলার চেষ্টা করেছে।কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছে না।সবেমাত্র বিয়ে করেছে।এর মধ্যে এক বছরের বিচ্ছেদ।রোদ্দুরের চিন্তায় যাচ্ছে তাই অবস্থা।

দরজায় টোকা পড়ায় রোদ্দুর বলল,

—“কাম ইন!’

বিদ্যুৎ ভেতরে ঢুকে স্যালুট করে বলল,

—“স্যার,আপনার বাবা এসেছে দেখা করতে।”

(চলবে)

গল্পটি শেষের দিকে।🤎

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here