গাঙচিল পর্ব ১২+১৩

#গল্পের_নাম: ||গাঙচিল ||
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____১২

—“কি হলো আপনি শুনতে পাচ্ছেন না?কোথায় ঘুমাব আমি?”

অজান্তার দ্বিতীয় প্রশ্নে রোদ্দুর আরো ঘাবড়ে গেল।ধুর!গাধার মতো একটা কাজ হয়েছে।মাকে সাথে করে নিয়ে আসলেই হতো।একটু সাহস অন্তত বাড়তো!পাঞ্জাবির পকেটে ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। রোদ্দুর কপালের ঘাম মুছে ফোনটা হাতে নিল।বিদ্যুৎ ফোন করেছে।

—“হ্যালো, বিদ্যুৎ!”

—“জ্বি স্যার!আসসালামু আলাইকুম।স্যার আমি বাড়ি পৌঁছে গেছি।সেটা জানানোর জন্য ফোন দিয়েছিলাম।”

—“ভালো।খুবই ভালো।”

বিদ্যুৎ ফোন কেটে দিতে নিতে রোদ্দুর ঝটপট বলল,

—“বিদ্যুৎ ফোন কাটবে না।কথা আছে!”

—“কি কথা স্যার?”

রোদ্দুর কি বলবে বুঝতে পারছে না।কিছু একটা তো বলতে হবে।সে যে ভয় পাচ্ছে সেটা বলবে?কিন্তু এটা তো লজ্জার বিষয়!একটুপর বিদ্যুৎ নিজে থেকে অবাক হয়ে বলল,

—“স্যার!আপনি কি কোনো ভাবে নার্ভাস ফিল করছেন?”

রোদ্দুর পাঞ্জাবির হাতায় কপালের ঘাম মুছে বলল,

—“অফকোর্স নট!আসলে হাত থেকে গ্লাস পড়ে ভেঙে গেছে।সেজন্য একটু চিন্তিত।নতুন গ্লাস।গতকাল মাত্র কিনেছি। ছ’টা গ্লাস কিনতে টাকা লেগেছে চারশো ষাট!টাকার জন্য মায়া হচ্ছে।পার পিস গ্লাস কত টাকা করে পরেছে বিদ্যুৎ হিসাব করো তো?”

—“স্যার!শুধু গ্লাস কেন,মাথার উপর ছাদ ভেঙে গেলেও টেনশিত হবেন না।একবার টেনশন জেঁকে ধরলে কিন্তু তা সময়ের সাথে সমানুপাতিক হারে বেড়ে যাবে।একদম টেনশন ফ্রি থাকুন।বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে যান।আমি রাখছি!”

রোদ্দুর মনে মনে তিনবার দোয়া ইউনূস পড়ে বুকে ফু দিল।কপালে হাত দিয়ে বুঝতে পারলো কপাল ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।এমন ভয় পেলে তো চলবে না।ঘর্মাক্ত কপালও অহিকে দেখানো যাবে না।সে পাঞ্জাবির পকেট থেকে সাদা রুমালটা বের করে কোণাকুণি ভাঁজ করলো।কপালের চুলগুলো উঁচু করে রুমালটা কপালে বেঁধে ফেলল।

চুলগুলো পরিপাটি করে, পাঞ্জাবির হাতা টেনেটুনে চেহারায় একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব আনলো।নতুন একটা গ্লাসে পানি ঢেলে হাতে নিল।ঠোঁটের কোণে জোরপূর্বক হাসি ঝুলিয়ে সে রান্নাঘরের কাচ মাড়িয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলো।

অহির দিকে তাকালো না।চুপচাপ তার পাশে বসে হাতের গ্লাসটা অহির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলল,

—“পানিটা খাও অজান্তা!”

অহি মাথাটা সোফায় এলিয়ে বসে ছিল এতক্ষণ।রোদ্দুরের প্রশ্নে মাথা সোজা করলো।বাড়িয়ে রাখা গ্লাসের দিকে এক নজর চেয়ে বলল,

—“পানি কেন খাব?”

রোদ্দুর ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়েই বলল,

—“তোমাকে অনেক নার্ভাস লাগছে অজান্তা।পানিটুকু খাও।সাহস পাবে।সূরা ইখলাস পড়ে তিনবার ফু দিয়েছি!”

—“অ্যা?আমি নার্ভাস?”

—“কেন তুমি নার্ভাস না?”

অহি কুঁচকানো কপালের খাদ গভীর করে বলল,

—“নার্ভাস হবো কেন?”

—“হে হে। সত্যি তো!নার্ভাস হওয়ার কোনো প্রোপার কজ নেই।তাহলে ঠিক আছে।তোমাকে পানি খেতে হবে না।এত কষ্ট করে আনলাম যখন তখন আমিই খেয়ে ফেলি।কি বলো?”

রোদ্দুর অহির উত্তরের অপেক্ষা করলো না। চোখ বন্ধ করে ঢকঢক করে, এক নিঃশ্বাসে সম্পূর্ণ গ্লাস খালি করলো।তৃপ্তির একটা শব্দ তুলে গ্লাসটা নিচে নামিয়ে রাখলো।

অহি রোদ্দুরের দিকে গভীর পর্যবেক্ষণ করছে।ক্রমাগত পা নাড়িয়ে যাচ্ছে রোদ্দুর।পায়ের বৃদ্ধ আঙুল কাঁপছে।হাতের আঙুল গুলো নাড়াচাড়া করছে।সর্বোপরি অস্থিরতা তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে।হঠাৎ করে তার চোখ পড়লো কপালের শুভ্র রঙের রুমালের উপর।অহি ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলো,

—“কপালে কাপড় বেঁধেছেন কেন এসআই?কেটে গেছে?”

রোদ্দুর অহির দিকে তাকালো।অহির পরণে আজ টকটকে লাল রঙের শাড়ি।চুলগুলো খোঁপা করা।কানের দু পাশে কিছু চুল এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে।এক পাশে টোল খাওয়া সুন্দর মুখোশ্রী,সাজবিহীন মায়াবী মুখ!দু চোখে রাজ্যের চিন্তা!গভীর থেকে গভীরতর চাহনি!সে ঢোক গিলে চোখ সরিয়ে নিল।স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

—“কপালে রুমাল বাঁধা এখন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে অজান্তা।ও সব তুমি বুঝবে না।টিভিতে দেখোনি?বিভিন্ন সিনেমায় নায়ক অধিক স্টাইল করতে গিয়ে কপালে কাপড় বাঁধে!আমি সেটাই করেছি।কেমন লাগছে আমাকে?”

রোদ্দুর নিজের ঘন চুলে একবার আঙুল চালিয়ে হাসিমুখে অহির দিকে তাকালো।অহি এক পলক তাকিয়ে লম্বা করে হাই তুলল।

একটুপর চোখ সরিয়ে বলল,

—“ঘুমাব কোথায়?”

—“যেখানে ইচ্ছে ঘুমাতে পারো।যেকোনো রুমে,সোফায়, ফ্লোরে ইভেন আমার কোলেও ঘুমাতে পারো।”

অহি আরেক বার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।রোদ্দুর ঘন ঘন চোখের পলক ফেলছে।আশপাশে তাকিয়ে কথা বলছে।অহির চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে চাইছে না।অথচ তাকে রেখে অহি যখন অন্য কিছুকে প্রায়োরিটি দেয়,বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকে, দু বার চিন্তা না করে সেটা ভেঙে ফেলে রোদ্দুর।সেবার কেবিনের তাজমহলের দিকে বার বার তাকাচ্ছিল বলে এক ঢিলে ভেঙে ফেলল সেটা!অথচ নিজে যে আশপাশে তাকিয়ে কথা বলছে তার বেলা?অহির ইচ্ছে করছে আশপাশের সবকিছু ভেঙে ফেলতে!

অহি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,

—“আমি আসছি!”

রোদ্দুর এক ঝটকায় তার হাত চেপে ধরলো।অসহায় দৃষ্টিতে অহির চোখের দিকে তাকালো।সে চোখে গভীর আকুতি।ভয়মিশ্রিত লজ্জা!অহি না বসে বলল,

—“কিছু বলবেন?”

রোদ্দুর নিজের সাথে একপ্রকার ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধ করে অতি কষ্টে বলল,

—“আমি তোমাকে!আমি তোমাকে!আমি তোমাকে, আই লাভ ইউ।”

অহি দাঁতে দাঁত চেপে হাসি থামাল।প্রোপোজের কি শ্রী!বাহ!সে অন্য দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো।কিছু বলতে নিতে রোদ্দুর আরেক ঝটকায় তাকে সোফায় বসিয়ে দিল।তারপর চোখ বন্ধ করে অহির কোমড় জড়িয়ে তার কোলে মাথা রাখলো।

অহি নিশ্চুপ বসে রইলো।তার বুকের ভেতর অজানা,নতুন অনুভূতি!মন নদীতে যেন উথাল পাথাল ঢেউ।আছড়ে পড়ছে এ পাড় থেকে ও পাড়ে!

রোদ্দুরের শরীর কাঁপছে।সে আরো শক্ত করে অহির কোমড় জড়িয়ে ধরলো।অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,

—“অজান্তা আমার মাথার চুল টেনে দাও!”

অহির শরীর পুরোপুরি সুস্থ নয়।গত দুদিনের জ্বরে একদম কাহিল হয়ে গেছে সে।এখন অবশ্য জ্বর নেই।তবে শরীর অনেক দূর্বল।হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাতে পারলে ভালো হতো।ডান হাত আলতো করে রোদ্দুরের ঘন চুলে রাখলো।

রোদ্দুর বন্ধ চোখে অহির হাতটা টেনে নিজের বুকের উপর রাখলো।অহির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।আস্তে করে বলল,

—“এভাবেই সারা রাত থাকবেন এসআই?”

রোদ্দুর উত্তর দিল না।অহির পেটে মুখ গুঁজে আরো গভীর ভাবে জড়িয়ে নিল।

১৯.

শেষ রাতের দিকে ঘুম ভাঙলো অহির।চোখ কচলে খুলতেই নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করল।লাইটের আলোতে চারপাশ অপরিচিত দেখে ঘাবড়ে গেল।আস্তে আস্তে সব ক্লিয়ার হলো।সে অন্য কারো ঘরে এসেছে।তার স্বপ্ন পুরুষের বউ হয়ে!

হঠাৎ করে মনে পড়লো সে তো সোফাতে ছিল।এখানে কি রোদ্দুর এনেছে? হয়তো!নিজের দিকে ভালো মতো লক্ষ্য করলো সে।তার পরণে বিয়ের শাড়ি এখনো।চোখ ঘুরিয়ে ডানপাশে তাকালো।বিছানা খালি।রোদ্দুর কোথায়?

বিছানা ছেড়ে উঠে নিচে নামতে নিতে ভয় পেয়ে গেল সে।প্রচন্ড ভয়ে মৃদু চিৎকারও করলো।সেই শব্দে রোদ্দুর মাথা তুলে তাকালো।

রোদ্দুর হাত পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে আছে।ডান হাতটা বিছানায় হেলান দিয়ে তার উপর মাথা রেখেছে।পরণের পাজামা পাঞ্জাবি এবড়োথেবড়ো।অবিন্যস্ত মাথার চুল,চোখ দুটো ভয়ানক লাল।দেখেই বোঝা যাচ্ছে সমস্ত রাত ঘুমায়নি।

অহি বিরক্ত হয়ে বলল,

—“এভাবে ফ্লোরে বসে আছেন কেন?একটুর জন্য হার্ট অ্যাটাক হয়নি!”

রোদ্দুর নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকালো।চারটা বেজে বাইশ মিনিট।সে লাল লাল চোখে অহির দিকে চেয়ে বলল,

—“অজান্তা,তোমার ঘুম কেমন হয়েছে?”

—“ঘুম ঘুমের মতো হয়েছে।আপনি আমার শিয়রের কাছে ফ্লোরে বসে কেন সেটা বলুন!”

—“তুমি মাঝরাতে যাতে ভয় না পাও সেজন্য কাছাকাছি ছিলাম।”

—“তো আমার পাশে কি ঘুমানো যায়নি?ভয় পেলে আপনাকে ডেকে দিতাম!”

রোদ্দুর মাথা চুলকে বলল,

—“ইয়ে মানে,অজান্তা শফিক সেদিন ঠিকই বলেছিল।আমার ঘুমানোর কোনো শ্রী নেই।অবশ্য প্রথম দিকে আমিও বিশ্বাস করতাম না।শফিকের মুখ থেকে শোনার পর একদিন রাতের বেলা ফোনের ভিডিও অন করে ঘুমিয়ে গেছিলাম।পরদিন ভোরবেলা নিজের ঘুমানোর স্টাইল দেখে নিজেই আঁতকে উঠেছি।তোমার পাশে ঘুমালে নিশ্চিত তোমাকে ভর্তা করে ফেলবো।”

রোদ্দুর লজ্জিত মুখে অন্য দিকে তাকালো।অহির ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল চিন্তায়।তার মানে এই ছেলে কি এখন কোনোদিন তার পাশে ঘুমাবে না?তাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাবে না?

অহি কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিল,

—“এতই যখন আমাকে ভর্তা করার ভয়,তাহলে আপনি কি অন্য রুমে গিয়ে ঘুমাতে পারেননি?রুম তো একটা নয়!”

রোদ্দুর নিজের চুল গুলো এলোমেলো করে অহির দিকে তাকালো।ভয়ংকর কিছু বলার জন্য চোখ ছোট ছোট করে মিথ্যে বলল,

—“অজান্তা,পরশু দিন এই ফ্ল্যাট ভাড়া করি।গতকাল বিদ্যুৎকে সাথে নিয়ে মোটামুটি সাজিয়ে ফেলি।বিদ্যুৎ নাকি দুই তলার ফ্ল্যাটের ভুড়িওয়ালা লোকটির কাছে শুনেছে আমাদের ফ্ল্যাটে ভূত আছে।গভীর রাতে নাঁকি সুরে কান্না করে।ভাবলাম তুমি মাঝরাতে ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করবে।সেজন্য সারা রাত তোমার পাশে রয়ে গেলাম।”

—“খুবই উত্তম কাজ করেছেন।”

বলে অহি বিছানা থেকে নামলো।ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে রোদ্দুর কন্ঠে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে বলল,

—“অজান্তা!তুমি কি কোনো কারণে আমার উপর রেগে আছো?প্লিজ রেগে থাকবে না।কত কষ্টে তোমায় কোলে করে ড্রয়িং রুমে থেকে নিজের রুমে নিয়ে আসলাম।এরপরও রেগে থাকবে?”

অহি কিছু বলল না।রোদ্দুরকে সম্পূর্ণ ইগনোর করে রুম থেকে বের হলো।ড্রয়িং রুমে রাখা লাগেজ থেকে কাপড় বের করে চুপচাপ ওয়াশরুমের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।।

অহি চলে যেতে রোদ্দুর এক টানে পাজামা পাঞ্জাবি খুলে পাতলা টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়ে নিল।ড্রয়িং রুমের ওয়াশরুম থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে বের হলো।শুকনো টাওয়াল দিয়ে মুছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে পড়লো।একটু সাজুগুজু করে দেখা যাক।অহির মন ভালো হয় কিনা!ছেলেদের পারফিউমের গন্ধে মেয়েরা নাকি দূরে থাকতে পারে না!

আঙুলের ডগায় তৃতীয় বারের মতো স্নো নিয়ে মুখে ঘঁষা শুরু করলো রোদ্দুর।মুখ অনেক ফর্সা হয়ে গেছে।বাহ!হাতে জেল নিয়ে চুলে লাগালো।নিঁখুত ভাবে চুল ব্রাশও করলো।হাতে পায়ে লোশন মেখে নিজেই শুঁকে দেখলো।অনেক সুন্দর সুগন্ধ!এরপর পারফিউম বের করে কড়া করে স্প্রে করলো।সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ রুম গন্ধে ভরে গেল।রোদ্দুর চোখ বন্ধ করে দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে শ্বাস নিল।এত সুন্দর গন্ধ নিয়ে অহির কাছে গেলে সে নিশ্চিত মাতাল হয়ে যাবে!ভাবতেই তার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক খেলে গেল।

রোদ্দুর ফোনটা হাতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো।একপাশে বালিশ সোজা করে বিছানার চাদর টেনে ফিটফাট করে রাখলো।অহি এসে এখানে ঘুমাবে!অনেক দ্রুত বিয়ে করায় রুম সাজনোর সময় পায়নি সে।

আজ সকাল দশ-টার বাসের কক্সবাজারের দুটো টিকেট কাটা!ফোনেই কেটে রেখেছে রোদ্দুর।অহিকে নিয়ে প্রথম হানিমুন ট্রিপটা সে কক্সবাজার রেখেছে।মাকে নিয়ে গত বছর সে কক্সবাজার ঘুরে এসেছে।অনেক ভালো লেগেছে জায়গাটা।এরপর মিশন থেকে ভালো ভাবে ফিরলে বিদেশ টিদেশ যাবে সবাইকে নিয়ে !একটা মিশনে কম সে কম ৪০-৫০ লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা!এত টাকা দিয়ে সে কি করবে!

ওয়াশরুমের দরজায় খুট করে ছিটকিনি খোলার শব্দ হলো।রোদ্দুর আগ্রহ নিয়ে সেদিকে তাকাল।তাকাতেই তার কলিজা শুকিয়ে গেল।

অহি হালকা গোলাপি রঙের তাঁতের শাড়ি পরে বের হয়েছে।চোখে মুখে বিন্দু বিন্দু পানি।মাথার চুল বরাবরের মতো হাত খোঁপা করা।প্রথম যখন সে অহিকে দেখে শাড়ি পরা ছিল সে।কি যে ভালো লাগছিল!আজও পরীর মতো লাগছে।ভেজা পরী!

অহি নিজের শাড়ির আঁচলেই মুখ মুছে ফেলল।রোদ্দুরের দিকে ভুলেও তাকাল না।রোদ্দুর এতে প্রচন্ড কষ্ট পেল।অহি রুমের দরজার দিকে পা বাড়াতে রোদ্দুর ঝটপট বলল,

—“অজান্তা!কোথায় যাচ্ছো?আমার পাশে শুয়ে পড়ো!সকাল হতে এখনো অনেক দেরি!”

অহি ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে বলল,

—“আমি ঘুমানোর জন্যই পাশের রুমে যাচ্ছি।কারো চিপায় পরে ভর্তা হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই।”

—“অজান্তা,আমি ঘুমাব না।জেগে থাকবো।সত্যি বলছি।তুমি আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ো।একা ও রুমে থাকতে ভয় পাবে।তাছাড়া ওই রুমেই তো সতেরো বছর বয়সী একটা মেয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়েছিল।মানে সুইসাইড কেস!”

অহি নিতান্ত হেলাফেলা করে বলল,

—“আমি বরং আজ থেকে ওই রুমেই ঘুমাব।মেয়েটা কেন সুইসাইড করেছে তার কারণ জিজ্ঞেস করতে হবে তো!”

অহি এগিয়ে দরজার কাছে যেতে রোদ্দুর এক লাফে উঠে পড়লো।কয়েক লাফে দরজার কাছে পৌঁছে ছিটকিনি আটকে দিল।বড় করে শ্বাস নিয়ে হাসিমুখে অহির দিকে ঘুরে দাঁড়াল।অহি মনে মনে বলল,

—“শালা ভিতুর ডিম!এক বিছানায় থাকতে পারবি না বিয়ে কেন করলি?”

কপাল কুঁচকে মুখে বিরক্তি ঝরা কন্ঠে বলল,

—“দরজা বন্ধ করছেন কেন?বললাম না আমি ঘুমাব!”

রোদ্দুর তোতলানো স্বরে বলল,

—“সেটাই!সে-সেটাই!এই রুমে ঘুমিয়ে পড়ো না।তোমাকে না দেখলে ভালো লাগে না।”

—“একদম ন্যাকামি করবেন না।অনেক সহ্য করেছি।আর না!দরজা থেকে সরে দাঁড়ান।পাশের রুমে গিয়ে ঘুমাব আমি!”

রোদ্দুর হাত মুঠ করে সাহস সঞ্চয় করলো।বড় বড় করে শ্বাস নিল।তারপর বুক ফুলিয়ে চোখের পলকে অহির কাঁধ শক্ত করে ধরে দরজায় চেপে ধরলো।

অহি এমন কান্ডে প্রথমে অবাক হলেও বেশিক্ষণ সে অবাকত্ব ধরে রাখতে পারলো না।রোদ্দুরের গা থেকে কড়া পারফিউমের গন্ধ আসছে।তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ।পারফিউমের গন্ধ অহির সহ্য হয় না।সেখানে এত কড়া গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে।মাথা ঘুরছে।বমি বমি পাচ্ছে।

অহি চোখ বন্ধ করে মুখ অন্য দিকে ঘুরাল।কোনো রকমে বলল,

—“সরে দাঁড়ান এসআই!বাজে গন্ধ নাকে লাগছে!মরে গেলাম।”

রোদ্দুরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।বাহ!এই তো অহি তার পারফিউমের গন্ধে মাতাল হয়ে গেছে।তাকে কাবু করতে পেরেছে।রোদ্দুর একদম ঘেঁষে দাঁড়াল অহির।

অহির দম বন্ধ অবস্থা।রোদ্দুরের পায়ের তলায় পিষ্ট হওয়া নিজের পা দুটোর চিন্তা বাদ দিয়ে জড়ানো গলায় বললো,

—“দূরে গিয়ে দাঁড়ান।আমি কিন্তু বমি করে দিবো!”

রোদ্দুর শুনলো না।সে একদম অহির ঘনিষ্ঠ হয়ে বগল উঁচু করে অহির নাক বরাবর ধরলো।দু হাত দরজার দু পাশে দিয়ে অহির মুখের কাছে মুখ নিতেই অহি হড়হড় করে তার গা ভর্তি বমি করে দিল!

(চলবে)#গল্পের_নাম: ||গাঙচিল ||
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____১৩

২০.

বাইরে থেকে সমুদ্রের গর্জন কানে আসছে।কানে মৃদু ঝংকার তুলে যাচ্ছে।সেই সাথে মনে শান্তি যোগানো কেমন কুলকুল ধ্বনি।অহি বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার সামনে দাঁড়াল।ডান হাতে মসৃণ পর্দা সরিয়ে কাচ ঠেলে সরাতেই স্নিগ্ধ বাতাস ছুঁয়ে গেল।সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ মুত্ত শ্বাস নিল।

চোখ খুলে বাইরে তাকাল।জানালা দিয়ে সমুদ্রের অনেকখানি দেখা যাচ্ছে।কেমন হালকা নীল জলরাশি।গোধূলি সন্ধ্যার লাল লাল আভা বিচ্ছুরিত হয়ে সেই জলরাশির উপর পড়েছে।কি সুন্দর লাগছে দেখতে!

দরজায় মৃদু টোকা পড়ছে।রোদ্দুর ফিরেছে হয়তো।অহি জানালা থেকে সরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

সকাল দশটার বাসে তারা কক্সবাজার রওনা দিয়েছিল।বিকেলের দিকে পৌঁছে গেছে।এসেই লম্বা এক ঘুম দিল সে।দূর্বল শরীর নিয়ে অহির জার্নি করার ইচ্ছে ছিল না।কিন্তু রোদ্দুরের রিকুয়েষ্ট ফেলতে পারেনি।শেষমেশ রাজি হয়েছে।

দরজার উপর হাত রেখে অহি আলতো স্বরে বলল,

—“কে?”

ওপাশ থেকে কেউ দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল,

—“তোমার এসআই!”

অহি কিছু বলল না।দরজা খুলে সরে দাঁড়াল।রোদ্দুরের দিকে ভুলেও তাকাল না।রোদ্দুরকে সম্পূর্ণ ইগনোর করে বিছানার পাশে রাখা লাগেজ খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

রোদ্দুর কাগজে মোড়ানো ব্যাগটা লুকিয়ে বালিশের নিচে রেখে ছোট্ট টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।তার এক হাত ভর্তি খাবারের প্যাকেট।বিকেলবেলা পৌঁছে শাওয়ার নিয়ে সে বাইরে বের হয়েছিল।সন্ধ্যার সময় ফিরলো!

—“অজান্তা,খাবার এনেছি।”

রোদ্দুরের আগ্রহ ভরা কন্ঠে অহির কোনো হেলদোল হলো না।সে লাগেজে কাপড় খুঁজতে ব্যস্ত!সাবধানে কাপড়ের তলদেশ থেকে সাদা রঙের সিল্কের শাড়ি বের করলো অহি।রোদ্দুর বিয়ে উপলক্ষে তাকে আটটা শাড়ি গিফট করেছে।

অহি কাপড়চোপড় হাতে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে রোদ্দুর এগিয়ে এসে বলল,

—“এক ছটাক রক্ত শুকিয়ে, সাহস সঞ্চয় করে ভোরবেলা কারো দিকে একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম।সে কি করলো?মুখ ভর্তি বমি করে দিল!”

অহি কিছুই বলল না।রোদ্দুর তার সামনে এসে দাঁড়াতে কাপড় শক্ত হাতে চেপে থেমে গেল।তার ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে রোদ্দুর অনুনয়ের স্বরে বলল,

—“অজান্তা,ইগনোর কেন করছো আমাকে?তুমি নিজেই আমার গায়ের উপর বমি করে দিলে,আবার নিজেই রাগ করছো!বিষয়টা কেমন হয়ে যাচ্ছে না?আচ্ছা, বলো!আমি কি তোমাকে কোন ভাবে হার্ট করেছি?করলে শাস্তি দাও।কিন্তু প্লিজ কথা বলা বন্ধ করো না!এখানে কষ্ট হয় তো!”

রোদ্দুর ডান হাত বুকের বাঁ পাশে নিল।তার কন্ঠে গভীর আবেগ।অহি সে আবেগের জোয়ারে ভাসলো না।মুখের অভিব্যক্তিরও কোনোরূপ পরিবর্তন সাধিত হলো না।রোদ্দুরকে অভারটেক করে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো।

রোদ্দুর ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলল,

—“অজান্তা,এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।আমি এবার রেগে যাব।সত্যি সত্যি রেগে যাব বলে দিলাম।দরজা খুলো!কথা আছে!”

অহি কোনো প্রতিত্তর করলো না।ভেতর থেকে পানি পরার শব্দ কানে যেতে রোদ্দুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে আসলো।

ভোর রাতে অহি তার গায়ের উপর বমি করার পর থেকে এখন অবধি একটা কথাও বলেনি তার সাথে।সে নিজেই বকবক করে যাচ্ছে।নানাভাবে হাসানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু ফলাফল শূন্য।রোদ্দুর ফোন বের করে বিদ্যুৎকে কল দিল।এবার তাহলে বিদ্যুৎতের পরামর্শ অনুসরণ করা যাক!কোনো উন্নতি হয় কি না!

২১.

দীর্ঘ সময় নিয়ে শাওয়ার নিল অহি।কক্সবাজারের হোটেল গুলোর ওয়াশরুম তুলনামূলকভাবে অনেক সুন্দর না হলেও অন্তত এটা সুন্দর।শাড়িটা সুন্দর মতো পড়ে মাথার চুল টাওয়ালে মোড়ালো।ভেজা কাপড়গুলো দু হাতে নিয়ে ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে পড়ল সে।

দু পা সামনে এগোতেই তার চোখ আটকে গেল রুমের মাঝামাঝি চেয়ারে পা তুলে বসে থাকা মানবটির উপর।সঙ্গে সঙ্গে কপাল কুঁচকে চিন্তার বলিরেখা দেখা দিল।

কয়েক পা এগিয়ে ভালো মতো লক্ষ্য করলো।হ্যাঁ,রোদ্দুর হিমই তো!এমন সাজ দিয়েছে কেন?আর এত মুড নিয়ে বসে থাকারই কি মানে?

রুমের মাঝামাঝি দুটো চেয়ার।রোদ্দুর বসে আছে একটাতে।আরেকটাতে পা তুলে ত্রমাগত নেড়ে যাচ্ছে।তার পায়ে কালো বুট!ছেঁড়া ফাঁড়া জিনস!পরণে কালো সাদার সংমিশ্রণে শার্ট!শার্টের কলার উঁচু করা,কনুই গুটানো,সামনের তিনটা বোতাম খোলা!যার জন্য উদাম বুকের অনেকখানি দৃশ্যমান।একহাতে মোটা ঘড়ি।ডান হাতে প্রচুর হাবিজাবি লাগানো।কব্জি বরাবর এক টুকরো কাপড়ও পেঁচানো।আঙুল গুলোতে আঙটির বহর।গলায় অদ্ভুত রকমের লকেটসহ দু তিনটা মালা পড়া।বুকপকেটে সানগ্লাস ঝুলছে একটা।আরেকটা সানগ্লাস চোখে লাগানো।চুলগুলো উঁচু করে ব্যান্ড লাগানো।কপালে দড়ির মতো কিছু একটা বাঁধা।সর্বোপরি বাম হাতে সিগারেট নিয়ে ক্রমাগত তার ধোঁয়া উড়িয়ে যাচ্ছে।

অহি বিস্ময়ে হা হয়ে গেল।এ কোন রোদ্দুরকে দেখছে।গুন্ডা,বদমাশদের মতো সাজ দিয়েছে কেন?

সে আর নির্বাক থাকতে পারলো না।এগিয়ে গিয়ে বিস্ময় মাখা কন্ঠে বলল,

—“রাতেরবেলা রুমের মধ্যে সানগ্লাস পড়ে আছেন কেন এসআই?তাও আবার দুটো?একটা চোখে আর একটা বুকপকেটে ঝুলানো?”

রোদ্দুর কোনো উত্তর দিল না।চোখের সানগ্লাসটা মাথায় ঝুলিয়ে বড় করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো।অহি ভ্রু যুগল কুঁচকে চিন্তিত কন্ঠে বলল,

—“আপনি মাস্তানদের মতো সেজেছেন কেন? গুন্ডা বদমাশদের মতো লাগছে আপনাকে!আর! আর আপনি তো ধূমপান করতেন না।এসব কি তাহলে?”

রোদ্দুর উঠে দাঁড়ালো এবার।ঠোঁটে বাঁকা করে সিগারেট ঝুলিয়ে দু হাতে শার্টের কলার পেছন দিকে দিল।চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে অহির কাছে এগিয়ে এসে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লো তার মুখের উপর।অহি নাক মুখ কুঁচকে ডান হাতে হাওয়া করে সিগারেটের ধোঁয়া সরিয়ে বলল,

—“আপনি কোন ধরনের পাগলামি শুরু করেছেন মি. রোদ্দুর হিম?এসবের মানে কি?”

রোদ্দুর হাতের সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে বুট দিয়ে পিষে ফেলল।তারপর অহির কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,

—“বাহ!আমার মাফিয়া লুকে দেখি ভয় পেয়ে গেছিস!এখন মুখে কথার খই ফুটেছে!”

রোদ্দুরের মুখ দিয়ে সিগারেটের দূর্গন্ধ আসছে।অহি নাক চেপে বলল,

—“মাফিয়া?আপনি?এসআই আপনাকে রাস্তার দু পয়সার পকেটমারের মতো লাগছে।ভং ছাড়ুন!”

রোদ্দুর চোয়াল শক্ত করে বলল,

—“আমাকে ভয় পাচ্ছিস না?আজ তোকে জন্মের শিক্ষা দিবো।আমাকে ইগনোর করিস?তোর ইগনোরের গোষ্ঠীর ষষ্ঠী পূজো করবো!”

অহি অবাক হয়ে বলল,

—“আপনি আমার সাথে তুই তুকারি করছেন কেন?খবরদার!তুই তুকারি করবেন না।”

—“একশবার করবো!হাজার বার তুই তুকারি করবো!তুই কি করবি রে?”

রোদ্দুরের কন্ঠে কিছু একটা ছিল যা শুনে ঘাবড়ে গেল অহি।মুখের কথাও যেন ফুরিয়ে গেল।কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।ডান হাতের ভেজা কাপড়গুলো শক্ত হাতে চেপে ধরলো।রোদ্দুর হঠাৎ এক ঢিলে তার হাতের ভেজা কাপড় গুলো ফেলে দিল।তারপর একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল অহির।

এই প্রথম অহির মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেল।একে আবার ভূতে ধরলো নাকি?জ্বিনে টিনে আছড় করেছে কি?কেন যে এতদূর আসলো!রোদ্দুর কাছ ঘেঁষে দাঁড়াতেই সে পেছাতে শুরু করলো।তোতলানো স্বরে বলল,

—”কাপড় গুলো ফেলে দিলেন ক-কেন?ওগুলো ধুতে কষ্ট হয়নি?”

রোদ্দুরের কানে হয়তো সেসব ঢুকল না।আপনমনে তার দিকে এগোতে এগোতে বলল,

—“আমাকে ইগনোর করা?এই রোদ্দুর হিমকে ইগনোর করা?সকাল থেকে কথা কথা বলার চেষ্টা করছি!তার পরো ইগনোর করা!তুই আমাকে চিনিস?”

অহির দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।অসহায় দৃষ্টিতে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।রোদ্দুর এখনো চোখ মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

রোদ্দুর ডান হাত ক্ষীণ গতিতে উঁচু করতেই অহি মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করলো।রোদ্দুর এক টানে তার মাথার টাওয়াল খুলে কোথাও ছুঁড়ে মারলো।ভেজা চুল চোখের সামনে আসতেই সে চোখ খুলল।ডান হাতে চোখের সামনের চুলগুলো সরিয়ে রোদ্দুরের চোখে চোখ রেখে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,

—“আপনি হঠাৎ সাহসীদের মতো আচরণ করছেন কেন এসআই?আপনার সাথে এসব যাচ্ছে না।”

মনে মনে বলল,

—“শালা ভিতুর ডিম।সাহসী সাজতে এসেছে।”

সে সরে যেতে নিতে রোদ্দুর বাম হাত দেয়ালে দিয়ে তাকে আটকে ফেলল।রাগী গলায় দু বার বললো,

—“ভালোবাসা দিবি কি না বল!”

এটুকু বলেই ডান হাতের তালু সমস্ত শক্তি দিয়ে সজোরে অহির মাথার কাছের দেয়ালে আঘাত করলো।অহি চমকে চোখ বন্ধ করলো।তার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে।হার্টবিট বেড়ে গেছে।এক্ষুনি হয়তো রোদ্দুর কিছু একটা করে বসবে।

কয়েক সেকেন্ডে কোনো সাড়া না পেয়ে আস্তে আস্তে চোখ খুলল সে।রোদ্দুরের মুখের দিকে চোখ পড়তে কপাল কুঁচকে গেল।রোদ্দুরের মুখের সর্বত্র ব্যথা ছড়িয়ে পড়েছে যেন।মুখটা কাঁদো কাঁদো।দাঁত চেপে কিছু একটা সহ্য করছে।অহি কুঁচকানো কপালই বলল,

—“সাহসের চাকা পাংচার হয়ে গেছে?আর বের হচ্ছে না?”

রোদ্দুর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে বলল,

—“অজান্তা!আমার ডান হাত!আমার ডান হাত ছিঁড়ে গেছে।বিস্ফোরণ হয়ে উঁড়ে গেছে হয়তো।দেখো,আমি ফিল করতে পারছি না।মনে হচ্ছে শরীরে হাত নেই!”

অহি চমকে তার বা পাশে মাথার কাছে তাকালো।সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো।রোদ্দুরের হাত সোজা একটা ক্ষীণ রক্তের ধারা।সে আস্তে করে রোদ্দুরের হাতটা টেনে সরাতেই রোদ্দুর আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো।অহি দেয়ালের দিকে তাকালো।দেয়ালে একটা সূচালো তারকাঁটা আটকানো।হয়তো ট্রিপে আসা মানুষদের প্রয়োজনীয় কিছু ঝুলিয়ে রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা।

রোদ্দুর না দেখেই সমস্ত শক্তি দিয়ে দেয়ালে আঘাত করেছে। তৎক্ষনাৎ পিনটা হাতের তালুতে গেঁথে গেছে।অহি ব্যথাতুর চোখে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।রোদ্দুরের চোখে মুখে যন্ত্রণার ছাপ।

সে রোদ্দুরের হাতের কব্জিতে বেঁধে রাখা কাপড়টা একটানে খুলে রোদ্দুরের হাতে চেপে ধরলো।বিরক্ত কন্ঠে বলল,

—“আপনি মানুষ হবেন না?কবে পাগলামো করা বাদ দিবেন?”

রোদ্দুর শান্ত গলায় বললো,

—“আমার কি দোষ!বিদ্যুৎ বলেছিল, মাফিয়া সেজে তোমাকে ইমপ্রেস করতে অজান্তা।তুমি কি ইমপ্রেসড হয়েছো?”

অহি রোদ্দুরের মাথায় আলতো করে ছুঁয়ে দিল।মাথার ব্যান্ড,কপালের দড়ি টড়ি খুলে ফেলল।অতিরঞ্জিত প্রতিটা জিনিস খুলে শার্টের কলার ঠিক করে দিল।সামনের বোতামগুলো লাগিয়ে বলল,

—“আমার সাথে আসুন।ডক্টরের কাছে যেতে হবে।হাতটা ড্রেসিং করতে হবে!”

২২.

—“অজান্তা,তুমি খাবে না?”

রোদ্দুর ড্রেসিং করা হাতটা বিছানায় মেলে রেখে অহির দিকে চেয়ে বলল।অহি ফ্লোরে পরে থাকা কাপড়গুলো পুনরায় ধুয়ে শুকাতে দিচ্ছিল।শেষ কাপড়টা শুকাতে দিয়ে এগিয়ে এলো রোদ্দুরের কাছে।

পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

—“হুঁ, খাবো তো!”

—“ইয়ে মানে অজান্তা!আমি তো অকেজো হয়ে গেছি।না মানে আমি না!আমার হাত!খাবো কি করে?”

—“বাম হাতে খাবেন!”

—“অ্যা?একদম উল্টা পাল্টা কথা বলবে না তো অজান্তা!আমায় খাইয়ে দাও তুমি!”

অহি মুখ ঘুরিয়ে হাসলো।টেবিলের উপর থেকে খাবারের প্যাকেট বের করলো।

রোদ্দুরের পাশে বসে এক লোকমা তার মুখে তুলে দিল।রোদ্দুর পরম আয়েশ করে তা চিবিয়ে খেল।ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

—“হাত ফুঁটো হয়ে ভালোই হয়েছে একদিকে।এখন সারাজীবন তোমার হাতে খেতে পারবো।”

অহি আরেক লোকমা রোদ্দুরের মুখে পুড়ে দিয়ে বলল,

—“এক সপ্তাহের মধ্যে হাত ঠিক হয়ে যাবে।”

রোদ্দুর মুখ গোমড়া করে বলল,

—“হাত ঠিক হয়ে গেলে এইবার ইচ্ছে কৃত ভাবে ফুটো করবো।তুমি আমার সাথে সাথে খাও তো অজান্তা!”

অহি নিজের মুখেও খাবার পুড়ে দিল।

অহি ফোন কেটে জানালা থেকে সরে আসলো।বাড়িতে কথা বলে নিল সবার সাথে।তিনদিনের ট্রিপে তারা এসেছে।তার একদিন শেষ হয়ে গেল।অথচ ক্লান্তিতে কিছুই দেখা হলো না।

অহি বিছানার দিকে তাকালো।রোদ্দুর ডান হাতটা মেলে বিছানায় শুয়ে আছে।সে অপলক রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে রইলো।এরকম একটা পাগলাটে মানুষকে পাশে পাওয়ার জন্য সে মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিল।

দক্ষিণের দেয়ালের সুইচ চেপে লাইট বন্ধ করে দিল অহি।আরেকটা সুইচ টিপার সঙ্গে সঙ্গে হালকা সবুজ শেডের আলোতে রুম ভরে গেল।সে মাথার চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল।রোদ্দুরের দিকে ঝুঁকে দীর্ঘক্ষণ তার দিকে চেয়ে রইলো।মাথার চুলে হাত বুলিয়ে সরে আসলো সে।

জানালার পর্দা বাতাসে নড়ছে।সে এগিয়ে গিয়ে জানালা ঘেঁষে দাঁড়াল।ওপাশের জলরাশি যেন ফুলে ফেঁপে উঠছে।গর্জনের মৃদু মধুর স্বর আর মাতাল করা বাতাসে অহি যেন অন্য জগতে চলে গেল।

তার ঘোর কাটলো কারো গভীর স্পর্শে।পেছন থেকে কেউ তাকে গভীরভাবে জড়িয়ে নিয়েছে।মানুষটার শরীরের কাঁপুনি টের পেয়ে অহি মৃদু কেঁপে উঠলো।

মানুষটার একটা হাত তার পেটের কাছে।অহি সেই হাতের উপর নিজের হাতটা স্পর্শ করালো।মানুষটা তার ঘন আধভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে জড়ানো গলায় বলল,

—“অজান্তা,আ-আমার ঘুম আসছে না।”

অহির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।নিজেকে ছাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে।আবছা আলোয় রোদ্দুরের চোখের দিকে গভীর মায়া নিয়ে তাকালো।ডান হাতে আলতো করে রোদ্দুরের মুখে হাত বুলাল।তার চোখ বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে রোদ্দুর ফট করে মুখটা নিচু করে তার ঠোঁটে চুমু খেল!

বাইরে সমুদ্রের গর্জন সময়ের সাথে বেড়ে যাচ্ছে। জানালার পর্দাগুলো এলোমেলো গতিতে উড়ে চলেছে। সেই সাথে উড়ে চলেছে দুটি মন!দূর থেকে সূদুরে!

(চলবে)

রিচেক করা হয়নি!ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।

আমি একটু (একটু না!ভালোই) অসুস্থ।মেডিসিন খাওয়ার জন্য দিন-রাত ঘুম পাচ্ছে।🥱চোখ টেনেও খুলতে পারি না এমন অবস্থা।অনেক কষ্টে এতটুকুন লিখেছি।রাতে আরেক পর্ব দেয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।😒

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here