গুমোট অনুভুতি পর্ব ১১

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১১

মিসেস খান দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই সায়ান সোফায় মাথা এলিয়ে দেয়, মাথা প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে একজন। বিজনেসের কাজে এই তিনদিন দেশের বাইরে ছিলো, রাত তিনটায় বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় ও।তাই নিজের অফিসের সাথে এডজাস্ট করা বেডরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে মাত্রই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন সাহিল ফোন করে বলে যে “মিসেস খান গাজীপুরের খামার বাড়ির দিকে যাচ্ছেন”

কথাটা শুনে দ্রুত জেকেট পরে বেরিয়ে পড়ে, এই মুহুর্তে ওর ঘুমের প্রয়োজন ছিলো খুব তাই হয়তো মাথা এমন করছে!এ তিনদিন অপরাধ বোধ সায়ানকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে,ওর প্রত্যেকটা মুহুর্ত মনে হয়েছে ও চন্দ্রিকে ঠকাচ্ছে। সেটার অবশ্য যথেষ্ট কারণ রয়েছে!

সেদিন এখান থেকে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ও এই মেয়েটির কথা ভেবেছে, কেনো ভেবেছে তার কারণ জানা নেই ওর কিন্তু ও ভেবেছে! কেয়ারটেকারের কাছ থেকে প্রতিমুহূর্ত এই মেয়েটির খোজ নিয়েছে ও। মেয়েটি কি করছে, ওর মুড এখন কেমন আর ওর শরীরের অবস্থা কেমন!যদি কখনো খুব বেশি মিস করেছে তবে ভিডিও কলের মাধ্যমে এক নজর মেয়েটিকে দেখে নিয়েছে। মেয়েটির হাসিমাখা মুখ,গম্ভীর মুখ, চিন্তিত মুখ বা অবাক চাহনি সব কিছুই যেনো দেখতে খুব সুন্দর লাগে! মনে শত ব্যস্ততার মাঝে একটু প্রশান্তি! কিন্তু কেনো এমনটি করেছে ওর জানা নেই,ও এই প্রথম নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করেছে!

আর যতোবার করেছে ততবার মনে হয়েছে ও চন্দ্রিকে ঠকাচ্ছে, ভীষণ ভাবে ঠকাচ্ছে।এভাবে কোনদিন ও চন্দ্রির খোজ নেয়নি,না কখনো ব্যস্ততার মাঝে ওকে দেখতে চেয়েছে। সবসময় চন্দ্রি ওকে কল করেছে, সত্যি বলতে ও কখনো নিজ থেকে খোজ নেয়নি ওর। তাই নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছিলো! তাইতো গতকাল সারাদিন ও মেয়েটির খোজ নেয়নি, নিজেকে ব্যাস্ত রেখেছে হাজারো কাজের ভীরে! কিন্তু নিজের একাকিত্ব সময়ে সবার প্রথম এই মেয়েটির কথা মনে পড়েছে, শেষমেশ আর না পেরে মেয়েটিকে শুধু একটি নজর দেখে নিয়েছিলো! ওই ঘুমন্ত মুখ খানায় ছিলো হাজারো মায়ার ভীড়! অবাধ্য মন নিজের অজান্তেই প্রেমে পড়তে চেয়েছিলো কিন্তু ও তা হতে দেয়নি। ওযে ওয়াদাবদ্ধ! আজীবন কাউকে ভালোবাসার ওয়াদাবদ্ধ। কিন্তু কিছুতেই যেনো নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারছে না।

সত্যি বলতে ও দ্রুত পায়ে এখানে মিসেস খানকে ওদের বিয়ের সত্যিটা বলতে বাঁধা দিতে আসেনি। বরং ওর মনে হয়েছে মিসেস খান যদি মেয়েটিকে কিছু বলে?এই ছোট্ট মেয়েটি কিভাবে সামাল দিবে সেটা। আর যাইহোক ও মেয়েটিকে কোন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চায়নি। আর এখানে আসার পর ও তাদের কথা বার্তা প্রায় অনেকটাই শুনেছে! রুশি যখন বলেছে সে মিসেস খান ব্যাবস্থা করে দিলে ও চলে যাবে তখন ওর খুব রাগ হয়েছিলো। মেয়েটি কি ওকে ভরসা করে ওর সাথে থাকতে পারছেনা?আবার যখন খান বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিলো তখন ও পারেনা ছুটে এসে মেয়েটিকে লুকিয়ে রেখে দেয়।ও ভাবতেই পারছিলো না যে ও মেয়েটিকে কারণে অকারণে দেখতে পারবে না! ওর মনে হচ্ছিলো

“ওর বউকে অন্য কেউ কেনো নিয়ে যাবে?ওর বউ ওর কাছে থাকবে”

তাইতো ওর বউয়ের হাজবেন্ড হিসেবে বলেছিলো

“ওর আপত্তি না থাকলেও আমার ঘোর আপত্তি আছে”

আর যাইহোক ওর বউকে ও কোথাও যেতে দিবে না, কিন্তু নিজের ভাবনায় নিজেই যেনো বোকা বনে গেলো। ওর হঠাৎ হাজবেন্ডের মতো কেনো আচরণ করছে যেখানে মেয়েটিকে কোন অধিকারই দিচ্ছেনা! শুধু মাত্র নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। ওকি তবে নিজের অবাধ্য আবদারের বেড়াজালে মেয়েটিকে জড়িয়ে ফেলছে না? তাকে কি মিথ্যে আশা দিচ্ছেনা?

সায়ান আর ভাবতে পারছেনা, সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এতোদিন তো খুব ভালোই ছিলো ও, নারী নামক সত্তা নিয়ে কোন ভাবনাই ছিলো না ওর। চন্দ্রিকা তার মতো ছিলো আর ও নিজের মতো। কথা ছিলো চন্দ্রিকার গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলেই বিয়ে কিরে নিবে দুজন কিন্তু এখন এই মেয়েটির সাথে সাথে চন্দ্রিকে নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যদি চন্দ্রি জেনে যায় তবে কি হবে? বা এই মেয়েটি যদি হুট করে হারিয়ে যায় তবে কি করবে?
এসব অসংযত অনুভুতির কিছুই বুঝতে পারছে না ও!

মাথা যেনো প্রচণ্ড ভারী লাগছে তাই ভাবলো মেয়েটিকে একটু অনুরোধ করবে ওর মাথা টিপে দেয়ার জন্য!তাই চোখ খুলে মেয়েটির দিকে তাকালো, মেয়েটির মুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে যেনো কিছু বুঝার চেষ্টা করছে! সায়ান ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো আর মুহুর্তেই দাঁড়িয়ে পড়লো। ওর সবচেয়ে বড় ভয় ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে!সায়ান যেনো বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

চন্দ্রিকা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, চোখ দুটোতে যেন হতাশা, অসহায়ত্ব আর কষ্ট সব একসাথে প্রকাশ পাচ্ছে।ওর দৃষ্টি যেনো বলে দিচ্ছে

“আমার এতোকালের ভালোবাসা, বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলে তুমি?কি দোষ করেছি যাতে তুমি এভাবে শেষ করে দিলে আমায়!”

“চন্দ্রি! আমি…আই কেন এক্সপ্লেইন!”

“কি বলবে কিভাবে আমাকে ধোঁকা দিয়েছো? কি ভাবে আমাকে আশা দিয়ে দিনের পর দিন অন্যের সাথে সংসার করে গেছো? এই জন্যই আমাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাইছিলেনা তাইনা?কারণ বাইরে তো রঙলিলা বসিয়েছো!আমার এতো ভালোবাসার পরিবর্তে তুমি এই প্রতিদান দিলে?আমি কি এটা ডিজার্ভ করতাম?”

রুশি চন্দ্রি নামটা শুনেই মেয়েটির দিকে গভীর ভাবে তাকালো, তাহলে এই মেয়েটিই চন্দ্রিকা যাকে তার স্বামী ভালোবাসে! মিসেস খান যাওয়ার প্রায় কয়েকমিনিট পরেই এই মেয়েটি এখানে এসেছে তবে বিনাশব্দে দাঁড়িয়ে ছিলো। মেয়েটি খুব সুন্দর দেখতে যাকে বলে অপরুপা,গৌর মুখখানি যেকোন সাধু পুরুষকেও প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে। অসম্ভব সুন্দর মেয়েটি! নো ডাউট সায়ান জামিল খান এই মেয়েটিকে ভালোবাসে। ভালোবাসারই কথা! খান বাড়ির বউ হওয়ার জন্য এর থেকে বেটার অপশন হতেই পারেনা। দে আর মেড ফর ইচ আদার!

রুশির মনে এখানে থেকে ওর কোন লাভ নেই,দুজন ভালোবাসার মানুষের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে কি লাভ! তাই দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে ও নিজের রুমের দিকে রওনা দিলো,বুকের বাঁ পাশে হাল্কা চিনচিন ব্যথা করলেও তা পাত্তা দিলো না। যতই তার স্বামী সে এখন অন্যকারো আমানত, আর অন্যের আমানতে রুশি কখনোই নজর দিবে না। কখনোই না!

রুশির কয়েকপা এগুতেই কেউ একজন ওর হাত চেপে ধরে তার দিকে ঘুরালো আর কিছু বুঝে ওঠার পুর্বেই থাপ্পড় মারলো। রুশি যেনো আকাশ থেকে পড়লো, এভাবে কারো কাছ থেকে কখনোই ও মার খায়নি। সামনের মেয়েটি আবার হাত উঠাতেই ও চোখ বন্ধ করে নিলো কিন্তু কোন কিছু অনুভুত না হওয়ায় চোখ খুললো আর দেখলো সায়ান হাত চেপে ধরে আছে তার। চন্দ্রি ওর দিকে তাকাতেই সায়ান চড়া গলায় বললো

“তোমার যা বলার যা করার আমার সাথে করো, এখানে রুশানির কোন দোষ নেই তাই ওর গায়ে তুমি কেনো হাত তুলেছো?সে স্যরি টু হার”

প্রায় সাথে সাথেই চন্দ্রিকা হাত নামিয়ে ফেললো আর বিস্ময় নিয়ে বললো

“তুমি আমার সাথে আগে কখনো এভাবে কথা বলোনি সায়ান! তুমি আমাকে বকা দিচ্ছো তাও এই মেয়ের জন্য?তুমি অনেক বদলে গেছো, অনেকটা!”

চন্দ্রিকার ফুঁফিয়ে কান্না দেখে রুশির বেশ মায়া হলো, মেয়েটির কোন দোষ নেই এখানে। নিজের ভালোবাসার মানুষকে কেউ কখনো কারো সাথে শেয়ার করতে পারে না আর যদি ভালোবাসা গভীর হয় তবে তো সেটা কল্পনাও করতে পারেনা। তবে এই পরিস্থিতিতে ওরও কোন দোষ নেই, ও না চাইতেও তাদের মাঝখানে চলে এসেছে। তাই রুশির মনে হলো ওর সবটা ক্লিয়ার করা দরকার তাই ও কিছুটা দম নিয়ে মেয়েটির টলমলে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো

“দেখুন আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুই না,আপনার ভালোবাসার মানুষ আর আমার মাঝে তেমন কোন সম্পর্ক নেই। যা আপনার তা আপনারি আছে!আমি আপনাদের মাঝে কখনোই…”

রুশি শেষ করার পুর্বেই মেয়েটা যেনো তেড়ে আসলো আর রাগি কন্ঠে বললো

“আমাদের মাঝে তোমাকে কে কথা বলতে বলেছে?তুমি আসোনি বলেও তো এসে গেছো আমাদের মাঝে। আমি সায়ানকে ভালোবাসি কিন্তু তুমি তার সাথে বিয়ে করেছো আর তার বাচ্চার মা হতে চলেছো তাহলে তুমি কি করে আমাদের মাঝে আসোনি বলো?”

কথাগুলো বলে চন্দিকা বসে পড়লো ফ্লোরে, যেনো সে নিঃস্ব হয়ে বসে আছে। একটা মেয়ের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার জীবনসঙ্গী, সে মানুষটিই তার না হলে জীবনটাই যেনো মুল্যহীন। সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বললো

“আই এম স্যরি!আমি ভাবিনি এমন কিছু হবে।আমি…”

রুশির মাথা নাড়লো তারপর রুমের দিকে আগাতে শুরু করলো,মুখে ফুটে উঠলো তাচ্ছিল্যের হাসি। সেই তো এখানের তৃতীয় ব্যাক্তি হচ্ছে ও! তাই চলেতো ওকেই যেতে হবে। ওতো আর কারো প্রতি অধিকার দেখিয়ে বলতে পারবে যে এটা আমার। না নিজের স্বামীকে না নিজের অনাগত বাচ্চাকে। এর বড় অসহায়ত্ব আর কি হতে পারে?

“কেনো তোমাকে পেয়েও
আমার পাওয়া হলো না?
কেনো এতো অধিকার থাকা
সত্ত্বেও তা জমানো হলো না?
কেনো তুমি, আমি মিলে
আমরা হওয়া হলো না!”

রুশিকে রুমের দিকে এগোতে দেখে চন্দ্রিকাও দাঁড়িয়ে পড়লো,যে অধিকার পাওয়ার জন্য ও এতোদিন ধরে প্রহর গুনেছে। প্রতিনিয়ত স্বপ্ন বুনেছে সায়ানের বউ হওয়ার,সেটা আজ অন্য কেউ!সায়ানের জীবনে অন্যকেউ আছে সেটা মানা যে কতোটা যন্ত্রণার তা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। ও দৌড়ে বেরিয়ে পড়লো সেখান থেকে, এখানে আর এক মুহুর্তও নয়।

আর দুই নারীর দুদিকে চলে যাও নিশ্চুপে দেখলো। যেই মুহুর্তের সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছিলো তাই ঘটেছে আজ। সত্য লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয় তা নিজের স্বচক্ষে দেখলো। কোন দিকে যাবে ও?
এক দিকে এতোকালের ভালোবাসা অপরদিকে দায়িত্ব! দায়িত্ব আর ভালোবাসার বেড়াজালে ও ঝুলে আছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে,,,

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here