গুমোট অনুভুতি পর্ব ১০

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১০

রুশি ধীর পায়ে বসার ঘরে এসে দাঁড়ালো, অদুরেই একজন নারী অবয়ব দেখা যাচ্ছে। শাড়ি পরিহিত, হাতে দামী ঘড়ি, চুল সুন্দর করে খোপা করা তবে কিছু চুল হাল্কা পাক ধরেছে। রুশি আন্দাজ করতে পারছে তিনি একজন মাঝবয়সী মহিলা বয়স হয়তো পঞ্চাশের কাছাকাছি।সেই ভদ্রমহিলার পোষাকে আভিজাত্যের ছোঁয়া, হয়তো বড় ঘরের কর্তী তিনি।
রুশি ধীর গলায় বলে উঠলো

“আপনি ডেকেছিলেন আমায়?”

মহিলাটি রুশির দিকে ফিরলো, বয়সের ছাপ একদমি পড়ে নি তার চেহারায়। চেহারায় যেনো এখনো তারুণ্য খেলে যায়, যৌবনে তিনি খুব সুন্দর ছিলেন তা তাকে এই বয়সে দেখলেই বুঝা যায়।চশমা পরিহিত এই নারীটির মুখে বিরাজ করছে একরাশ গাম্ভীর্য! তবে এতে যেনো তার সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও নষ্ট হয়নি বরং বেড়ে গেছে। তিনি চশমাটা ঠিক করে সোফায় বেশ মার্জিত ভাবে বসলেন তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললেন

“তুমিই তাহলে সেই মেয়ে?নামকি তোমার?”

“জি রুশানি আনাম”

প্রথম প্রশ্নের জবাব রুশির জানা নেই, তিনি কোন মেয়ের কথা বলছেন সেটা ওর জানা নেই।ভদ্র মহিলা কি ইংগিত করছে তাই বুঝতে পারছেনা ও। তাকে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ছেনা ওর।কিন্তু আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না, যদি কিছু মনে করে?তাই চুপ থাকা শ্রেয়! সেই মহিলা কিছুটা শীতল কন্ঠে বলে উঠলো

“ডাকনাম কি তোমার?”

“আলাদা ডাকনাম নেই তবে বাবাই রুশি বলে ডাকে”

“তো রুশি! তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো?”

“স্যরি আন্টি! আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারিনি। আগে কখনো আমাদের কথা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না”

মহিলার মুখ নিমিষেই গম্ভীর হয়ে গেলো, হয়তো রুশির বলা কথা উনি পছন্দ করেননি।পুর্বের ন্যায় গম্ভীর কন্ঠে বললো

“আমি সাবিনা জামিল খান!”

কথাটা শুনে রুশি কিছুটা অবাক হলো,নামটার বড্ড মিল…

“তুমি যা ভাবছো ঠিক তাই। তুমি যার সাথে তিনদিন পুর্বে বিয়ে করেছো অর্থাৎ সায়ান জামিল খান সম্পর্কে আমার ছেলে”

কথাটা শুনে রুশি চুপটি মেরে গেলো,সায়ান রুশিকে তার পরিবার সম্পর্কে কিছুই বলেনি আর না রুশি জানতে চেয়েছে। যেখানে সম্পর্কটাই মনের অবাধ্যে করা সেখানে এসব জেনে কি করবে ও? আর যাইহোক ওর মতো অনাথকে খান বাড়ির লোকেরা বউ হিসেবে কিছুতেই মেনে নিবেনা। কারণ বড় লোকদের কাছে মানুষের জীবন থেকেও স্ট্যাটাস এর মুল্য অনেক বেশি! এসব জীবনে নিজেকে না জড়ানোই ভালো। কিন্তু এই মহিলা কি করে জানলো ওদের বিয়ের কথা যেখানে অন্য কেউ জানেই না!

“হয়তো ভাবছো আমি কি করে জানলাম তোমাদের বিয়ের কথা! যাকে বিয়ে করেছো সে আমার ছেলে হয় আর তার প্রত্যেকটা খবর সবার আগে আমার কাছে যায়।আমি সবটাই জানি! এখন বলো তুমি ওকে কেনো বিয়ে করেছো টাকার জন্য!তাহলে বলো কতো টাকা দরকার তোমার? কতো টাকা হলে আমার ছেলের লাইফ থেকে চলে যাবা!”

কথাগুলো শুনে রুশি তেতে উঠলো, ওর আত্মসম্মানে তীব্র আঘাত করা হয়েছে তাই চুপ করে থাকার প্রশ্নই আসেনা। ও কখনোই কারো ব্যাংক ব্যালেন্স দেখে বিয়ে করেনি, করেছে নিজের সম্মান রক্ষার্থে আর অনাগত সন্তানকে বাবার ছায়ায় বড় করতে। কখনো যাতে ওকে শুনতে না হয় যে সে বাবা ছাড়া পৃথিবীতে এসেছে!রুশি যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে বললো

“আপনি আমার থেকে বড় তাই আপনাকে আমি সম্মান করি কিন্তু আমি আপনার ছেলের টাকা দেখে বিয়ে করিনি। যেহেতু বিয়ের খবর জানেন সেহেতু এটাও নিশ্চই জানেন যে আমাদের বিয়েটা কেনো হয়েছে! আমি এই ততোকথিত সমাজে নিজের সম্মান রক্ষার্থে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি কারণ আমার চরিত্রে কেউ আংগুল তুলুক তা আমি চাইনা। হ্যা আপনার ছেলে আমাকে বলেছে সে আমার পড়াশোনার খরচ উঠাবে আর আমি রাজি হয়েছি। হয়তো বলতে পারেন আমি তার কিছুটা ফায়দা উঠাচ্ছি কিন্তু আমি যদি চাকরি পাই তবে তার সম্পুর্ণ টাকা আমি ফেরত দিয়ে দিবো। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা তবে সত্যি বলছি যদি অন্য কোন উপায় থাকতো তবে এমন দাম্পত্য জীবনে আমি ঘুণাক্ষরেও আমি জড়াতাম না”

রুশি একটানা কথাগুলো বলে একটু থামলো তারপর আবার বলে উঠলো

“হয়তো আমি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বিলং করি, আমার আপনাদের মতো টাকা নেই কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমার আত্মসম্মান! তাই আমাকে টাকার লোভ দেখিয়ে লাভ নেই। হ্যা আমি জানি আমি স্বার্থপর হয়ে নিজের কথা ভেবে আপনার ছেলের শর্তে রাজি হয়েছি তবে তার ঘাড়া সারাজীবন বোঝা হয়ে থাকার কথা আমি কোন কালেই ভাবিনি। আমি সময়মত আপনার ছেলেকে মুক্ত করে দিবো তবে এখন সেটা সম্ভব নয়, আমার কাছে এই মুহুর্তে যাওয়ার মতো কোন জায়গা নেই”

রুশি কথাগুলো বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো, ও জানেনা মহিলার মুখভঙ্গি এখন কিরুপ তবে তাই বলে চুপ করে থেকে অপমান সহ্য করার মেয়ে ও কখনোই ছিলো না। তাতে যে যাই ভাবুক না কেনো! হয়তো মহিলা এখন রাগ দেখিয়ে চলে যাবে কিন্তু তাতে ওর কিছুই যায় আসেনা।

“যদি আমি তোমাকে থাকার ব্যাবস্থা করে দেই আর পড়াশোনার খরচ চালাই তবে তুমি সায়ানকে ছেড়ে দিবে?”

“যদি আমি একা হতাম তবে ছেড়ে দিতাম কিন্তু আমার সাথে আমার সন্তানের জীবন জড়িত আর আমি চাই সে তার বাবার পরিচয় জানুক তার ভালোবাসা পাক”

কথাগুলো মনে মনে আওড়ালেও মুখে বললো না রুশি,যেখানে কোন অনুভুতিই নেই সেখানে থেকে কি লাভ। আর তিনবছর পর নিজের সন্তানকে সায়ানের কাছে দিয়ে চলে যাবে এটা ও ভাবতেই পারছেনা। তাই ও নাহয় একা নিজের সন্তানকে নিয়ে থাকলো। ওর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওর সন্তান আর কিছুই চাইনা। পেটে হাত রেখে রুশি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো তারপর সায়ানের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো

“হুম! যদি আপনি আমার জীবনের নিশ্চয়তা নেন তবে আমি রাজি। আমি আপনার ঋণ শোধ করে দিবো নাহয় পরে”

মিসেস খানের চেহারায় এখন আর গাম্ভীর্যের ছোঁয়া নেই বরং ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। সামনে থাকা মেয়েটির দিকে তাকালেন উনি। মেয়েটি অনেক বেশি সুন্দর নয় তবে মুখ জুড়ে একরাশ মায়া বিরাজ করছে। উজ্জ্বল শ্যামল বর্ণের গোলগাল মুখখানা দেখে যে কেউ বলবে “আস্ত এক মায়াবিনী”

তিনি মৃদু কন্ঠে বলে উঠলেন

“কেনো জানিনা তোমার থেকে এমন জবাবই আশা করছিলাম। তুমি ঠিক বলেছো একজন নারীর নিকট সবচেয়ে মুল্যবান বিষয় তার আত্মসম্মান যেটা কখনো খোয়াতে নেই। আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে!”

ভদ্রমহিলার হঠাৎ সুর পরিবর্তনে রুশি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লো। ও ভেবেছিলো মহিলা রেগে চলে যাবে কিন্তু মহিলা উল্টো মিষ্টি ভাষায় কথা বলছে!

“আমি অনেক খুশি হয়েছি যে তুমি আমার ছেলের বউ, আমার ছোট্ট সায়ানের অর্ধাঙ্গিনী। সত্যি বলতে তোমার মাঝে আমি নিজেকে দেখতে পাই, আমিও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বিলং করি তবে কখনো নিজের আত্মসম্মান হারাই নি। তাই তোমার শশুর যখন প্রস্তাব দিয়েছিলো সোজা নাকচ করে দিয়েছিলাম। পরে যখন বুঝতে পেরেছি সে আসলেই আমার প্রতি সিন্সিয়ার তখন পারিবারিক ভাবে আমাদের বিয়েটা হয়। সে যাইহোক তুমি আজ থেকে আমার বউমা না বরং আমার মেয়ে। আর আমার মেয়েকে আমি আমার কাছে নিয়ে রাখতে চাই তাতে তোমার কোন আপত্তি আছে?”

রুশি কিছু বলতে যাবে তার পুর্বেই দরজার কাছ থেকে চড়া গলায় একজন বলে উঠে

“তার আপত্তি আছে কিনা জানিনা তবে আমার ঘোর আপত্তি আছে”

রুশি তাকিয়ে দেখে সায়ান দাঁড়িয়ে আছে, পুরো মুখ জুড়ে একরাশ ক্লান্তি।মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি উঠেছে হয়তো অবহেলার ফসল!রুশি চোখ সরিয়ে নিলো সায়ান থেকে, কেনো যেনো ওই বাদামি চোখ জোড়ায় বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা হয়ে উঠে না ওর। মনে হয় ওই চোখের মায়ায় ডুবে যাবে ও, যা ও চায়না!

সায়ান গম্ভীর চেহারায় ঘরে ঢুকে সোফায় বসলো তারপর বলে উঠলো

“মিসেস খান আপনি এখানে কি করছেন?আর আপনি ওর সাথে কেনো দেখা করতে এসেছেন?”

“সায়ান! ভুলে যেওনা আমি তোমার মা। তুমি আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছো তা আমি নাহয় মেনে নিলাম কিন্তু তুমি ভাবলে কি করে আমি খান বাড়ির বউকে এখানে থাকতে দিবো?তাছাড়া ও এখন একা নয় ওর মাঝে খান বংশের বংশধর বেড়ে উঠছে!ওর পাশে এখন মানুষ দরকার”

“সেটা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না, ওর খেয়াল রাখার জন্য মেইড আর কেয়ারটেকার আছে”

“তুমি আর কতোকাল এরুপ থাকবে সায়ান?তুমি আমার সাথে এমন ব্যাবহার করে যাবে আজীবন? তাও আবার চন্দ্রিকা! ওই সেই দুদিনের মেয়ের জন্য?”

“ওই দুদিনের মেয়েটাকেই আপনি মারতে চেয়েছিলেন মিসেস খান যেখানে জানতেন আমি তাকে বিয়ে করতে চাই”

“আমি কতোবার বলবো আমি তাকে মারতে চাইনি, শুধুমাত্র ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম”

“আমি হয়তো বিশ্বাস করে নিতাম কিন্তু নিজের চোখকে তো অবিশ্বাস করা যায়না মিসেস খান। আমি স্বচক্ষে সবকিছু দেখেছি!”

সায়ান অন্যদিকে ফিরে বললো, চেহারায় ক্রোধ স্পষ্ট! মিসেস খান আর কথা বাড়ালেন না। সোজাসাপ্টা ভাবে বললেন

“এখনো সেই মেয়ের পক্ষেই আছো তবে রুশিকে কেনো বিয়ে করেছো?এতোই যদি তাকে ভালোবাসো তবে আরেকজনকে কেনো জড়ালে নিজের সাথে?”

“সেটা আমার ব্যাপার,আপনার মাথা ঘামানোর দরকার নেই।আপনি এখন আসতে পারেন”

মিসেস খান ছেলের জেদের সামনে ঠিকতে পারলো না, তিনি উঠে দাঁড়ালেন তারপর পা বাড়ালেন যাওয়ার জন্য কিন্তু কি মনে পেছনে তাকিয়ে বললেন

“তোমার চন্দ্রিকা জানে তুমি বাবা হতে চলেছো তাও সেই মেয়ের সন্তানের যাকে তুমি বিয়ে করেছো তিনদিন পুর্বে। নাকি সবার মতো তাকেও জানাও নি!”

রুশি সায়ানের চোখে স্পষ্ট ভয় দেখতে পেলো যেনো কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়। রুশির মাথায় শুধু একটা জিনিসই ঘুরপাক খাচ্ছে ‘কে ওই চন্দ্রিকা?’
তবে এটা সেই যার কাছে সায়ান ওয়াদাবদ্ধ!

সায়ান চড়া কন্ঠে বললো

“ইউ কান্ট ডু দিস! চন্দ্রিকে এই ব্যাপারে কিছু জানাবেন না।ও যাতে জানতে না পারে আমি বিয়ে করেছি”

মিসেস বিনিময়ে কিছু না বলে সামনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন!সেই হাসি যেনো অনেককিছু বলে দিচ্ছিলো!

#চলবে
(সময় পাইনি বেশি লিখার তাই এটুকুই পোষ্ট করেছি। কালকে বড় করে দেয়ার চেষ্টা করবো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here