গুমোট অনুভুতি পর্ব ৮+৯

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৮

বাংলার মধ্যাঞ্চলের ঢাকা বিভাগের প্রশাসনিক জেলা গাজীপুর,প্রাচীন যুগে এটি ঘন বনাঞ্চলে আবৃত ছিলো যার কিছু নিদর্শন বর্তমানেও দেখা যায়। চারদিকে সারি সারি গাছপালা,কিছু কিছু পুকুর,সকাল হলেই পাখির কিচিমিচির আওয়াজ! নগর জীবন থেকে একটু দূরে একটা শান্তির আবাস বলা চলে।

এখানে এখনো অনেক টিনের ঘর দেখা যায় সাথে কিছু দরিদ্র মানুষের আর্তনাদ। সমাজের উপস্তরের এবং নিম্নস্তরের মানুষগুলো একসাথে বাস করে এখানে। দেখা যায় পাশে কতোগুলো হাই প্রোফাইল বিল্ডিং এর পাশেই দোচালা টিনের ঘর যেন মাঝখানে একটা লাইন টেনে দেয়া হয়েছে হতদ্ররিদ্র আর সমাজের ততোকথিত উচ্চজাতের মানুষের মাঝে!যে লাইনটা ঠিক পাশাপাশি হলেও তাদের মধ্যকার দুরত্ব বিশাল। যেখানে কেউ হয়তো কেউ খেতে পায়না অথচ তার পাশেই ধনীদের বাস্কেট ভর্তি খাবারে ডাস্টবিন পুরে টইটুম্বুর!

এ অঞ্চলের এই বিস্তর ফারাকগুলো রুশির মন বড্ড নাড়া দিয়ে গেলো, জানালার কাচের বাইরে সারি সারি গাছপালার মোহনীয় দৃশ্যের সাথে সমাজের করুণ বাস্তবতা ওর চোখ এড়ায়নি।দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো রুশি,গাড়িতে ও সায়ান পাশাপাশি বসে আছে মাঝে সামান্য ফাঁকা জায়গা। তবে মনের দুরত্ব আকাশ সমান হয়তো যোগ্যতারও! কারণ এপারের নিচুজাতের মানুষগুলোর মধ্যে ও একজন, তাই ওপারের মানুষের সাথে যতই দিন পান করুক তাদের একজন হওয়া সম্ভব নয়। কারণ কাক যতই ময়ুর সাজুক, তার কখনোই ময়ুর হয়ে উঠা হয় না।

তাই রুশি যতই চেষ্টা সায়ানের মন অবদি পৌঁছানো সম্ভব নয়। নিজেকে পাতালপুরীর কোন কুৎসিত রাজকন্যা মনে হচ্ছে যার আকাশের ওই চাঁদ ধরার স্বপ্ন! কিন্তু চাঁদ এমন একটা সুদর্শন বস্তু যা রোজ দেখা যায়, তাকে নিয়ে হাজারো কাব্য, কলি আর রুপকথার গল্প সাজানো যায় কিন্তু সেটা ছোঁয়ার ক্ষমতা কারোই থাকে না,ওরো নেই!

কিন্তু মনের কোথাও একটা খুব মনোবল দিয়ে কেউ একজন বলছে পাশে বসে থাকা স্বল্প দুরত্বের মানুষটি ওর যাকে রেজিট্রির মাধ্যমে নিজের নামে লিখে নিয়েছে, সম্পুর্ণ তার নামে। এমন অদ্ভুত ভাবনা মাথায় চাপতেই রুশি চোখ বন্ধ করে ফেললো, গাড়ির কাচ কিছুটা নামানো থাকায় অবাধ্য চুলগুলো মুখের উপর ঝাপটে পড়ছে। রুশি অলস ভংগিতে ভ্রু কুচকে মাথা নেড়ে সেগুলো সরানোর ব্যার্থ চেষ্টা করছে। মাথার ঘোমটা সেই কবেই পড়ে গিয়েছে তার খেয়াল নেই তার।

লম্বা দীঘল চুলের সাথে রুশির খুনসুটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সায়ান, মেয়েটির মুখে মেকাপের লেশমাত্র নেই বললে চলে। হরিণির ন্যায় টানা চোখদুটিতে বেখেয়ালি ভাবে দেয়া কাজল লেপ্টে আছে, সাথে ঠোঁটের নিচের সেই তিল!সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা এক আঠারো পেরিয়ে যাওয়া বাঙালি নারী, যেনো সদ্য ফোটা কোন গোলাপ যাতে শিশির বিন্দু জমে আছে! এই নারীকে ঘিরেই যেন হাজারো কবির লিখা কবিতা,লেখকের লেখা উপন্যাস আর চিত্রকরের হাতের চিত্রশিল্প! যেনো জীবন্ত কোন শ্যামল বর্ণের অপরুপা,,,

সায়ানের খুব ভয়ংকর একটা ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহুর্তে, নিজের হাতে অবাধ্য চুলগুলো গুজে দেয়ার। হাত বাড়িয়ে রুশির অবদি নিয়ে গিয়েও ফিরিয়ে আনলো। কি করতে যাচ্ছিলো ও?চন্দ্রিকাকেও এমন গভীর ভাবে কখনো দেখেনি ও আর না কখনো ইচ্ছে জেগেছে তার দিকে তাকিয়ে থাকার! তবে কেনো এই মেয়ের মেয়ের দিকে তাকালে মনে হয় যুগ যুগ তাকিয়ে থাকলেও চোখের তৃষ্ণা মিটবে না! তবে কি ও মেয়েটিকে দেখে এট্রাকটেড হচ্ছে?নিজেকে জঘন্য পুরুষের কাতারে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে, তবে কি এক সাথে দুটো মেয়েকে ব্যবহার করছে?

নিজের দৃষ্টিতে সংযত করে বাইরে তাকালো, রুশির মুখের দিকে আরো একবার তাকানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগলেও সেদিকে আর তাকালো না। কোন একজনের কাছে ওয়াদাবদ্ধ ও, আর যাইহোক সেই ওয়াদার বরখেলাপ ও কখনোই করবে না। নিজেকে কয়েকদফা শাশিয়ে চুপটি মেরে বসে রইলো। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো

“একটা মেয়ে এতো সুন্দর কি করে হতে পারে?হাউ?মাথাই পুরো বিগড়ে দিবে আমার!মেয়েটি কি আসলেই সুন্দর নাকি আজ কালো শাড়ি পরেছে বলে সুন্দর লাগছে! আচ্ছা লাল শাড়িতে কেমন লাগতো তাকে?ঠিক এতোটাই সুন্দর নাকি তার থেকেও বেশি!”

নিজের উদ্ভট চিন্তায় নিজেই যেনো বোকা বনে গেলো সায়ান। ও এতো কেনো ভাবছে মেয়েটাকে নিয়ে?তবে কি মেয়েটির উপর বড়োশড় ক্রাশ খেয়েছে ও? কথাটা ভাবতেই হালকা কেশে উঠলো সায়ান। নিজের কলার ঠিক করতে করতে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বিড়বিড় করে বললো

“সেটা কি করে সম্ভব? সায়ান জামিল খান কারো উপর ক্রাশ খাবে! ইম্পসিবল”

রুশি সায়ানের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে, কিছুক্ষণ পুর্বে চোখ বুঝে থেকে মৃদু আওয়াজ শুনতে পেলো। পাশে তাকাতেই দেখে সায়ান কিছু একটা বলছে আবার নিজেকেই যেনো বুঝাচ্ছে! কিন্তু তা স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে না। এই ভর দুপুরে লোকটিকে জিনে ধরলো নাতো??

রুশি হাল্কা স্বরে বলে উঠলো

“আপনি কি কিছু বলছেন?”

সায়ান চমকে উঠে ধরা খাওয়ার মতো মুখভঙ্গি করে বললো

“কই না্ নাতো! আপনি ভুল শুনেছেন”

“নাহ দেখলাম ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু একটা বলছেন,তাই ভাবলাম আমাকে কিছু বলেছিলেন কিনা!”

“নাহ নাহ তেমন কিছু না।এনিওয়ে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে, নাহ অনেক না একটু সুন্দর লাগছে। আই মিন শাড়ি পড়লে সকল নারীকেই সুন্দর লাগে”

বলেই ভ্রু চুলকিয়ে বাইরে তাকিয়ে গেলো যেনো কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। কান দুটো লাল হয়ে আছে,হয়তো লজ্জা পাচ্ছে! রুশি মুচকি হাসলো, হয়তো সচারাচর কারো প্রশংসা করার অভ্যস নেই তার তাই অস্বস্তিতে পড়েছে। রুশি গলা খাঁকারি দিয়ে বললো

“ধন্যবাদ”

এই ছোট্ট শব্দটি যেনো সায়ানের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিলো,পাশে ফিরে রুশির মুখটা প্রবল ইচ্ছে দমিয়ে রাখলো। আচ্ছা মেয়েটি কি লাজুক হেসে আচলে মুখ ঢেকে রেখেছে!এদিকে রুশির মনটা যেনো নিমিষেই ভালো হয়ে গেলো, এতো এতো খারাপ লাগার মাঝে এই সামান্য ভালো লাগার অনুভুতিকে প্রাধান্য দিতে ইচ্ছে করছে। সরাসরি ওকে আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি যে ও সুন্দর তাই এই মুহুর্তে খুব আনন্দ লাগছে ওর, যেনো চারপাশে ফুলের পাপড়ি উড়ে বেড়াচ্ছে, গিটারের সুর তুলে কেউ মৃদু স্বরে গাইছে

“তুমসে মিলনা, বাতে কারনা
বাড়া আচ্ছা লাগতাহে”

জীবন কোথা থেকে কোথায় চলে যায় কেউ বলতে পারে না, হয়তো পরের মুহুর্তে জীবনের শেষ প্রহর গুনতে হতে পারে বা কোন এক ঝড় এসে সবটা ছারখার করে দিবে। কিন্তু এই মুহুর্তটা সম্পুর্ণ বাচঁতে ইচ্ছে করছে, প্রতিটা অনুভুতির সমারোহ ঘটিয়ে নিজের মনের খাচায় বন্ধি করে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কেয়া পাতা কাল হো না হো!
_____________________

খান বাড়িতে এই মুহুর্তে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, যেনো জাঁকজমক পুর্ণ বাড়িটি মুহুর্তেই মৃত্য পুরিতে পরিণত হয়েছে। আজ প্রায় দুদিন ধরে সামু নিজেকে ঘর বন্দি করে রেখেছে। মিসেস খান বিজনেস ট্যুরে দেশের বাইরে ছিলেন কিন্তু মেয়ের অবস্থা শুনে সাথেসাথেই দেশে ফিরে এসেছেন। অনেক চেষ্টা করেও সায়ানের সাথে কন্টাক্ট করতে পারেননি তিনি, ফোন বেজে বেজে ক্ষান্ত হয়ে গেলেও ওপাশ থেকে থেকে কেউ ফোন তুলে নি, আর তিনি হয়তো আশাও করেননা যে সায়ান ফোন তুলবে। যে ছেলে তার কথা ব্যতীত একপাও এদিক সেদিক হতো না সে আজ এতোদিন হয়ে যাওয়ার পরেও মায়ের খোজ নেয় না,ফোন করে বলে না

“মাম্মা কেমন আছো তুমি?”

কারণ তার কাছে সে মাম্মা নয় বরং মিসেস সাবিনা জামিল খান।তার ছোট্ট সায়ান সত্যিই বড় হয়ে গেছে, মাকে ছাড়া চলতে শিখে গেছে। তিনি দ্রুত হাতে ইনানকে ফোন দিলেন, এই মুহুর্তে এই নামটি ব্যতীত কারো কথা মাথায় আসেনি। একটা রিং হয়ে কেটে গিয়ে দ্বিতীয়বারের সময় ফোন তুললো ইনান। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো

“হেলো আন্টি! কেমন আছেন? এতো রাতে হঠাৎ!”

“ইনান! তুমি একটু আমাদের বাসায় আসবে?”

“এতো রাতে?কিছু হয়েছি কি?”

“সামু আজ দুদিন ধরে দরজা খুলছে না, ভিতর থেকে সাড়া শব্দও পাচ্ছিনা। সায়ানকে ফোন করেছি কিন্তু ধরেনি তাই বাধ্য হয়ে তোমায় ফোন করলাম। তোমার কথাতো সামু খুব মানে, একটু কষ্ট করে আসবে?”

ইনান এতোক্ষন ঘুমের জড়ানো কন্ঠে কথা বললেও এবার ওর ঘুম পুরো ছুটে গেলো। দ্রুত উঠে বসলো

“আন্টি আমি আসছি, আপনি চিন্তা করবেন না”

ইনান দ্রুত বেরিয়ে পড়লো, সামায়রাকে ও হারে হারে চিনে। প্রচণ্ড জেদি আর এক ঘেয়ো টাইপ মেয়ে। ওর যা চাই তা ওকে পেতেই হবে আর না পেলে নিজের ক্ষতি করতে একবারো ভাবে না। ইনান রিতীমত ঘামছে, যদি এবারো উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলে?ওর কিছু হলে ইনান নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না, কক্ষনো না!

“সামু! ফর গড সেক ডোন্ট ডু এনিথিং রাবিশ।”
#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৯

আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী,দীর্ঘ বরষ-মাস।
যদি আর-কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও,
আমি যত দুখ পাই গো
আমারো পরাণ যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাইগো॥

ক্ষীণ কন্ঠে গাওয়া রবিঠাকুরের প্রেমের গান কামরায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,ফ্লোরে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে একটি মেয়ে,পরনে খুব সুন্দর করে জড়ানো লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। দীর্ঘ আচল আশেপাশে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে। চোখে নিচে দেয়া কাজল হয়তো কোন ভারী বর্ষনে লেপ্টে আছে, চোখের জল শুকিয়ে আছে কপলে তবুও মোহনীয় লাগছে তাকে।

আজ আকাশটা বড্ড মেঘলা, খণ্ড খণ্ড মেঘের ভেলায় আকাশের ওই চাঁদটা হারিয়ে গেছে দূর অজানায়। আকাশ জুড়ে কালো মেঘের গম্ভীর এক নিস্তব্ধতা! চারপাশে সবকিছু অন্ধকার ঠিক সামুর জীবনের মতো! ছুরি হাতে বসে আছে ও, কিন্তু সাহস করে হাতে চালাতে পারছেনা। শুধু একটাই ভয় যদি ওর শেষ শ্বাসটুকু নেয়ার পুর্বে ইনানকে আরেকটি বার দেখা না হয়?তাকে দেখার এই প্রবল লোভ সে সামলাবে কি করে?

নিজেকে কেনো যেনো কাদম্বরী দেবি মনে হচ্ছে, যে রবিঠাকুরের প্রেমে বিলিন হয়ে আছে অথচ কোন এক অদৃশ্য দেয়ালের দোহায় দিয়ে তাদের এক হওয়া হলো না। তবে কি তার রবিঠাকুরের জীবনে কোন মৃণালিনীর আগমন ঘটেছে! নাকি তার পুর্বেই কেউ ছিলো যার ঘোরে সে এতোটাই মগ্ন যে ওর তীলে তীলে শেষ হয়ে যাওয়া তার চোখে পড়ছে না। খুব ইচ্ছে ছিলো তার লাল টুকটুকে বউটি হওয়ার তাইতো মৃত্যুর পুর্বে ও সেজেছে ঠিক সদ্য বিয়ে হওয়া বউয়ের মতো।খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে

“ভালোবাসি! বড্ড ভালোবাসি ঠিক যতোটা বাসলে তোমায় ছাড়া শ্বাস নিতে কষ্ট হয় হয়তো তার চেয়েও বেশি বাসি ইনান ভাই!”

“আমি তোমার স্মৃতিপটে নাই বা এলাম
এ জীবনে তুমি নামক বস্তুটা নাই বা পেলাম,
তাতে কী?রেখে দিবো তোমায় হৃদ মাঝারে
কতোগুলো আবেগ আর অনুভুতি দিয়ে মুড়ে
তুমি রবে পুরো এই আমিটা জুড়ে!”
~~লিজা~~

দরজায় খুব বড়োশড় তোড়জোড় চলছে,কড়াঘাতে জর্জরিত দরজা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো! এটা নতুন কিছু নয় সামুর কাছে, আজ সারাদিন এই পরিস্থিতি অনেক বার হয়েছে কিন্তু ও এই দরজার সন্নিকটে একবারো আসেনি। নিজের স্থানে বসে আছে সেই কখন থেকে, এই মুহুর্তে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বিছানায় মাথা হেলিয়ে দিয়ে বসে আছে, মস্তিষ্ক জুড়ে হাজারো ভাবনা আর তার সমাপ্তি ঘটে তিনটা মাত্র অক্ষরে ইনান!
এই ওয়ান সাইডেড ভালোবাসা বড্ড কষ্ট দেয়, তুমি যানো সে তোমায় কোনদিন ভালোবাসবে না তবুও তার আশায় বসে থাকা!

দরজার অপার থেকে হাল্কা শব্দ আসছে, কেউ খুব ধীরে ধীরে কড়াঘাত করছে,মৃদু আওয়াজ ভেসে আসলো দরজার ওপার থেকে।কেউ অতি সহানুভূতিশীল কন্ঠে বলছে

“সামু!”

কন্ঠটা কানে আসতেই সামুর চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো, দীর্ঘ এক বছর পর এই ডাকটা শুনেছে ও। আগে প্রায়ই এই মানুষটি সামু বলে ডাকতো, তার আশা যাওয়া এই বাড়িতে বেশ হতো!এক বছর পুর্বে নিজের বার্থডে তে নিজের মনের কথা বলেছিলো ইনানকে, সেদিন ইনান ওকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিলো। যেখানে সামু অধীর আগ্রহে বসে ছিলো জবাবের আসায় সেখানে ওপাশ থেকে কেউ টু শব্দও করে নি। তাই নিজের থেকেই ফোন দিয়েছিলো,আর মিষ্টি হেসে বলে উঠেছিলো

“ইনান ভাই!আমার অনুভুতির আত্মপ্রকাশের জবাব পেলাম না। নিরবতাই সম্মতির লক্ষন তবে আমি হ্যা ধরে নিবো?”

কিন্তু ওপাশ থেকে খুব চড়া কন্ঠে বলে উঠলো ইনান

“জাস্ট শাট আপ, ভুলে যেওনা আমি কে?তোমার বড় ভাইয়ের বন্ধু মানে তোমার আরেক ভাই। তাই নিজের ভাইকে প্রেম নিবেদন করতে বিবেকে বাধলো না?আমি তোমার থেকে এমন আচরণ আশা করিনি সামায়রা!”

সেদিনের পর থেকে ইনান কন্ঠে সামু ডাকটা শোনা হয়নি বরং সামায়রা শুনেছে। সামু এই একটা বছর ইনানকে নিজের করার জন্য অনেক পাগলামি করেছে। কখনো শাড়ি পড়ে ইনানের এপার্টমেন্টে চলে গেছে তো কখনো খাবার নিয়ে সোজা অফিসে গিয়ে বলেছে ও ইনানের হবু বউ। এমনকি পাশে থাকা সুন্দরি মেয়ে কলিগকে হুমকিও দিয়ে এসেছে। তাতে অবশ্য কম বকা খায়নি ইনানের কাছ থেকে!

রাত বিরাতে ফোন দিয়ে বকা খেয়েছে কিন্তু তাতে কি তার কন্ঠতো শুনতে পেরেছে ও! হাজারো বাহানায় তার সামনে গিয়ে থাকতো যদি একটু হলেও তার প্রেমে পড়ে!অন্য ছেলেদের দিয়ে জেলাস ফিল করাতেও চেয়েছিলো কিন্তু ইনানের থেকে কোন রিয়াকশন আসেনি, পুরোটা সময় জুড়ে সে খুব নিস্তব্ধ ছিলো। আজ সারাদিন এই পুরো এক বছরের হিসেব মিলালো ও, ও অনেক চেষ্টা করেছে ইনানকে নিজের প্রেমে ফেলার কিন্তু সে ব্যার্থ! কারণ জীবন কোন সিনেমা নয় যে শেষ অংশে হিরো প্রেমে পড়ে যাবে। এটা বাস্তবতা যা কোন মানুষের লিখা স্ক্রিপ্ট নয়,এখানে জোর করে কাউকে ভালোবাসানো যায়না। আর যাইহোক কারো মনের উপর জোর করা সম্ভব নয়।

দরজায় ইনানের ধীর কড়াঘাত আর মৃদু কন্ঠে সামু একটুও নড়েনি, এই একবছরের অনেক অভিমান জমেছে। সামান্য সহানুভূতিতে তা গলবে না, আজ কেন এসেছে সে?মরে গেছে কিনা তা দেখতে?”

দরজার অপরপাশে ইনান বসে আছে ফ্লোরে, ওর মন বলছে সামুর কিছু হয়নি হয়তো সামু ওকে শুনতে পাচ্ছে কিন্তু দরজা খুলছে না। তাই আবারও বলে উঠলো

“সামু! আমি জানি তুমি শুনতে পাচ্ছ আমায়।প্লিজ দরজা খোলো। তোমার সাথে কথা আছে আমার”

অপরপাশ পাশ থেকে সামুর দুর্বল কন্ঠ ভেসে আসলো

“আমি মরে গেছি কিনা সেটা দেখতে এসেছেন? তাহলে আম স্যরি আমি এখনো বেচে আছি, আমার শ্বাস এখনো চলছে যদিও বুকের বাঁ পাশে বড্ড চিনচিন করছে। তবে চিন্তা করবেন না, আই সামু আপনাকে আর বিরক্ত করবে না। আর যদি ভুলে আবেগের বসে দিয়েও ফেলে তার নাম্বারটা আপনি ব্লক লিস্টে ফেলে দিয়েন”

সামুর অভিমাণি কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনে ইনান চুপ করে রইলো,ছোট থেকে সামুকে বড্ড আদর করতো ও কিন্তু সামুকে অনন্যদৃষ্টিতে কখনো দেখা হয়নি।হয়তো ওর সামুর সাথে ফ্রি ভাবে মেলামেশা সে অন্যভাবে নিয়ে নিয়েছে। দোষ সম্পুর্ণ সামুর নয়, সামু অতীতে অনেক ভাবেই বুঝিয়েছিলো যে ও তাকে পছন্দ করে তবে ইনান পাত্তা দেয়নি। ভেবেছে হয়তো ও বেশি ভাবছে, কারণ ছেলেদের সিক্সথ সেন্স মেয়েদের মতো প্রখর নয়। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়তো বুঝতেই পারেনা তাদের আশেপাশের মানুষ তাদের সম্পর্কে কি ভাবছে!ইনান মৃদু গলায় বললো

“স্যরি সামু!এতোদিন কষ্ট দেয়ার জন্য। আই প্রমিস আমি আর এমন কাজ কখনো করবো না। একটা সুযোগ দিবিনা আমাকে?আচ্ছা গত বছরের সেই প্রোপোসালের জবাব দেয়ার সুযোগ কি এখনো…”

ইনানের সামনের দরজা কট করে খুলে গেলো, সামু বেরিয়ে এলো রুম থেকে। লাল পাড়ের সাদা শাড়ির লম্বা আচল ফ্লোরে গড়াচ্ছে, মলিন মুখটা জুড়ে ফুটে উঠেছে একরাশ অভিমান। তাইতো এতো কাছে থেকেও কাছে আসছে না, অন্যসময়ের মতো হাত জড়িয়ে ধরছে না। ইনান এগিয়ে গেলো কিছুটা সামুর দিকে, যা দেখে সামু দৃষ্টি অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলো। ইনানের সাথে তার অভিমান হয়েছে কিন্তু তাকে এক নজর দেখার লোভও সামলাতে পারেনি। ইনান হঠাৎ করেই বলে উঠলো

“আই এম স্যরি”

বলেই সামুকে জড়িয়ে ধরলো,খুব শক্ত করে নয় আলতো হাতে। সামু প্রথমে অবাক হলেও পরে নিজেকে সামলে নেয় আর ইনানের পিঠে হাত রাখে আলতো হাতে।ইনান মৃদু কন্ঠে বলে উঠে

“আম্মুকে বলবো এই সপ্তাহে তোমাদের বাসায় আসতে,তারপর তারা কথা বলে নাহয় বিয়ের ডেট পাকা করবে”

সামু লজ্জায় ইনানের বুকে মুখ লুকালো,বিয়ের কথা শুনতেই বড্ড লজ্জা লাগছে ওর। এতোদিন বেহায়াপনা করে ইনানকে প্রেম নিবেদন করলেও তার মুখ থেকে বিয়ের কথা শুনে ভারী লজ্জা পেলো! তা দেখে ইনান মজার ছলে বললো

“বাহ যে কিনা পুরো এলাকাকে আমাকে ভালোবাসার কথা জানাচ্ছিলো সে আজ নিজেই লজ্জা পাচ্ছে?এতো লজ্জা হঠাৎ কই থেকে ইন্সট্রল হলো মেডাম!”

“ইনান ভাই! ভালো হচ্ছে না কিন্তু”

সামুর শাসনের স্বর শুনে ইনান মৃদু হাসলো তারপর আর কিছু কথা হয়নি ওদের মাঝে। হয়তো নিশ্বাসে নিশ্বাসে কথা হচ্ছিলো তাদের যা এক হৃদয় থেকে অন্য হৃদয় বুঝে নিচ্ছিলো। ইনান মনে মনে বলতে লাগলো

“আমি চাওয়াটা আমি নাই বা পেলাম, কেউ তো তার ভালোবাসা পাক!একজন তো সুখে থাকুক!আমি নাহয় আমার চাওয়াকে মনের গহীনে লুকিয়ে রাখবো চিরকাল”

_____________________

গাজীপুরের এই দোতলা বাড়িটিতে রুশি এসেছে আজ তিনদিন। চারপাশে বাগান, পুকুর, বিভিন্ন খামার আর তরুতরকারির বাগান। মুলত বাড়িটি একটি খামার বাড়ি। প্রকৃতির আসল রুপ যেনো দেখা যায় এখানে।আজ তিনদিনে সায়ানের সাথে একবারো কথা হয়নি ওর আর না দেখা হয়েছে।সেদিন সায়ান ওকে এখানে পৌঁছে দিয়ে সবাই বুঝিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলো। শুধু যাওয়ার সময় ছোট্ট করে বলেছে

“ভালো থাকবেন, কোন দরকার হলে আমাকে জানাবেন”

তবে তা নিয়ে রুশির বিশেষ মাথা ব্যাথা নেই বরং সে ভালোই আছে। এমন আলিশান জীবন ওর কল্পনাতীত ছিলো, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এসব কথাই ভাবছিলো ও। বাগানের ঠিক মাঝখানে চেয়ার টেবিল পাতানো, চারপাশে নাম না জানা ফুলের থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে! সবমিলিয়ে প্রকৃতিকে পুরোদমে উপভোগ করছে ও।

এই মুহুর্তে বাবাইকে মিস করছে ও, না জানি কি অবস্থায় আছে সে!সকালের ঔষুধটা ঠিকমতো নিয়েছে কিনা কে জানে?রুশি ফোনটা হাতে নিয়ে বাবাকে ফোন করবে তার পুর্বেই এ বাড়ির কেয়ারটেকার এসে বললো

“ছোট মেডাম! আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। উনি হলরুমে অপেক্ষা করছে।”

রুশি বেশ অবাক হলো কথাটা শুনে, সায়ান আসেনি অবশ্যই নাহয় নিশ্চই বলতো

“ছোট সাহেব আপনাকে ডাকছে”

ওর পরিচিত বলতে এখানে কেউ নেই আর বাবাই এখানকার ঠিকানা জানে না।তবে কি সায়ানের পরিচিত কেউ ওর সাথে দেখা করতে এসেছে?কিন্তু সে কে হতে পারে?এমন কেউকি আছে যাকে ও চিনে!

#চলবে
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)
#চলবে

(কারেন্ট ছিলো না তাই লিখা হয়ে যাওয়ার পরও আগে পোস্ট করতে পারিনি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here