গোধুলীর শেষ প্রহরে পর্ব -০৪

#গোধুলীর_শেষ_প্রহরে
#পর্বঃ৪
#রাউফুন (ছদ্মনাম)

মুহু সারাফের দিকেই তাকিয়েই বলে,”ফুলবাবু মানে ট্যাডি বয়!”

“হেই হু দ্যা হ্যাল আর ইউ ষ্টু’পি’ড গার্ল।তুমি আমার ভাইয়াকে ফুলবাবু বলছো?তুমি জানো উনি কে?”

মুহু এতক্ষনে শৈবালকে লক্ষ করলো।উফফ! এতো বিরক্ত করছে কেন ছেলেটা।এই ছেলেটা ফর্সা হলেও ওঁকে ওতোটাও ভালো লাগে নি মুহুর কাছে।ধলা বিলাই একটা।খ্যাচা লোক মনে হচ্ছে তাকে।মুহু কিছু টা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো শৈবালের পানে।ক্ষীন স্বরে বললো,

“এই আমি কি তোমার সঙ্গে কথা বলছি?তুমি আমাকে ডিস্টার্ব করছো কোন সাহসে?”

শৈবাল যেনো আকাশ থেকে পরলো মেয়েটির সাহস দেখে।আজ পর্যন্ত কারোর সাহস হয়নি তার মুখের উপর কথা বলার।এই মেয়েটা বোধহয় ভার্সিটিতে নতুন।নতুবা এতো স্পর্ধা হতো না তার।সে দাঁতে দাঁত চেপে মেয়েটিকে বলে,”তোমাকে আমি কখন ডিস্টার্ব করলাম ছোট চুলওয়ালি।”

“এই ধ’লা বি’লা’ই ডিস্টার্ব তো করলেই।

“ইউ!আমি ধ’লা বি’লা’ই?”

“আমাকে ছোট চুলওয়ালী বললে আমিও ধলা বিলাই বলবো।না হলে খা’ম’চি দিবো।এই
তুমি দেখছো না আমি ফুলবাবুকে দেখছি।বার বার কথা বলে আমার ফুলবাবুকে দেখাই ব্যাঘাত ঘটাচ্ছো?সাহস তো কম নয় তোমার!”

“তা শ্যাম বর্নের ছেলের দিকে তাকাচ্ছো যে বরং?আমারই সামনে আমার ভাইয়াকে পটানোর চেষ্টা!ধান্দা টা ভালোই।যেই দেখেছো দামী গাড়ি থেকে নেমেছে ওমনি প’টা’তে এসেছো তাই না?তোমাদের মতো মেয়েরা এছাড়া আর কিই বা পারে!”

মুহু ভীষণ ভাবে রেগে গেলো।ক্ষীপ্র হলো মন।ভেতরে ভেতরে বাচ্চাওয়ালা মুরগীর মতো ক্ষেপে উঠলো সে।ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে কয়েক কদম এগিয়ে এলো মুহু।পা উঁচু করে হাত এগিয়ে শৈবালের মুখে সেটা মাখিয়ে দিয়ে এক লাফে সরে এলো।ঘটনাটি অতি দ্রুত হওয়ায় শৈবাল নির্বাক হয়ে গেছে।মুহুর হাতের দিকে তাকালো সে।এরপর নিজের মুখে হাত দিয়ে দেখলো।ক্ষ্যাপাটে পাগলের মতো এগিয়ে এলো মুহুর দিকে।শৈবাল কিছু বলতে যাবে তখনই সারাফ ওর দিকে তাকিয়ে ওর ঠোঁট দুটো আলতো ফাঁক করে বলে,

“স্টপ শৈবাল।তুই ক্লাসে যাহ।”

শৈবাল দমে গেলো।তাকিয়ে রইলো নিজের ভাইয়ের দিকে।রাগে ফুসফুস করছে সে।মেয়েটি তার মুখে কালি লেপন করলো?শৈবাল ভেতরে এলো ভার্সিটির।রুমালে নিজের মুখ ঢেকে চললো ভার্সিটির ওয়াশরুমের দিকে।এই মুহুর্তে কেউই ভার্সিটির মাঠে নেই তেমন।সবাই হইতো ক্লাসে।খুবই কম স্টুডেন্ট ক্লাস বাংক করে গাছের নিচে বসে আছে।এই অবস্থায় যদি ভার্সিটির কেউই তাকে দেখতো তাকে নিয়ে মজা লুটতো।এতো বাজে ভাবে অপমান জীবনে কেউ তাকে করেনি।এই মেয়েটির এতো সাহস যে শাহরিয়ার শৈবাল কে কালি মাখিয়েছে।শৈবাল ছোট বেলা থেকেই নিজের ভাই ছাড়া কিছুই বুঝতো না।যথেষ্ট সম্মান ও করে।আজ ভাইয়া না থাকলে মেয়েটিকে হইতো এতক্ষণে অনেক কিছুই করে ফেলতো।তার ভাই তো আর তার আরেকটা ভয়ংকর রুপ সম্পর্কে জানে না।এই মেয়েটির যে কি অবস্থা করবে সে মেয়েটির ধারণার ও বাইরে।ভাবতেও পারছে না আজ তার জন্য কি বিপদ অপেক্ষা করছে!

মুহু এতো টুকুও পাত্তা দিলো না শৈবাল কে।ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে তাকালো সারাফের পানে।তার সম্পুর্ন ধ্যান শুধুই তার ফুলবাবুর উপরে!

সারাফ মেয়েটির এমন কর্মকাণ্ডে ভড়কে গেছে খুব।নির্বোধের মতো তাকিয়ে রইলো সে।সামনের মেয়েটির সাহস আর কথা বার্তার তেজ দেখে তার চোক্ষু চরক গাছ।তার ভাইকে মেয়েটি কালিই বা কেন মাখালো?

মেয়েটির চাহনি নিনির্মেষ।বাচ্চা বাচ্চা ফেইস মেয়েটির।ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চোখের মনি কালো কুচকুচে।ন্যাচারাল কপলে তার গোলাপি আভা।গোলাপি ঠোঁটে তার লিপস্টিকের প্রয়োজন হয়নি।ছোট ছোট সিল্কি চুল কাধ পর্যন্ত।সারাফ মেয়েটির কাধে ব্যাগ দেখেই বুঝে নিলো সে হইতো এই ভার্সিটির স্টুডেন্ট।কিন্তু ভার্সিটিতে এসেছে কিনা সাইকেলে করে?সে আরও বেশি অবাক হয়েছে ওর দেওয়া ফুলবাবু নামটাই!ওঁকে দেখে কি সত্যিই ফুলওয়ালা মনে হয়।লাইক সিরিয়াসলি!কোন দিক থেকে ফুল বিক্রেতা লাগছে তাকে।তবুও সে কিছু বললো না।সে আগে মেয়েটি ব্যথা পেয়েছে কিনা সেটা নিয়ে চিন্তিত হলো।সে সরস গলায় মুহুকে প্রশ্ন করলো,

“হেই সাইকেলওয়ালি তোমার কোথাও লাগে নি তো?”

মুহু নিনির্মেক্ষ ভাবে বলে,”লেগেছে তো।এই যে এখানে!”

“কই দেখি!”

সারাফকে মুহু ওর ডান হাতের কনুই দেখালো।ওর কনুই ছু’লে গেছে কিছুটা।তাতে ওর কোনো কিছুই না।সারাফ এগিয়ে আসলো।মুহুর কনুই হালকা র”ক্তা”ক্ত।সারাফ রুমাল বের করলো পকেট থেকে।এরপর সন্তপর্ণে মুহুর হাত টা বেধে দিতে লাগলো।তাদের মধ্যে বেশ দূরত্ব।দুরত্ব বজায় রেখেই সে তার লম্বা হাতে ওর হাত টা বাধছে।একটুও স্পর্শ লাগাই নি মুহুর হাতে।পুরো টা সময় মুহু শুধুই সারাফ কেই অবলোকন করেছে।হাত বাধা শেষ হতেই মুহু বলে,

“আই লাভ ইউ ট্যাডি বয়!”

সারাফের মুখ থেকে বিস্ময়ে আপনা আপনি বেরিয়ে এলো,”হাহ?”

মুহু আর দাঁড়াইনি।সাইকেল রেখেই দৌড়ে পালালো সে।সারাফ বেক্কল বনে গেলো।চমকপ্রদ হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির যাওয়ার পানে।বোবার মতো শুধু ওই মেয়েটির চলে যাওয়া দেখলো।সব কিছুই যেনো ওর মাথার উপর দিয়ে গেলো।প্রথম দেখাতেই একেবারে প্রেম নিবেদন করলো মেয়েটি।মেয়েটির সাহসের তারিফ করতে হয়।সরাসরি প্রপোজাল তাও আবার এভাবে।মাথায় সমস্যা আছে নাকি মেয়েটির।সে অপ্রসন্ন গলায় বিড়বিড় করে আওড়ালো,

“ক্রে’জি গার্ল!”

শিশির রা ক্লাস রুমে আসার পর থেকেই রোজকার মতোই মেয়েদের কে ডিস্টার্ব করছিলো।প্রথমত কুহু আগেই প্রিন্সিপাল স্যার এর কাছ থেকে এঁদের ব্যাপারে জেনেছিলো।কয়েকটি ছেলে আছে যারা ভীষণ বাজে ভাবে মেয়েদের কে উত্ত্যক্ত করে।ক্লাস ও ঠিক করে করতে দেই না।ক্লাস রুমে পার্মিশন না নিয়ে আসায় সে যতটা না তেতে গেছিলো তার থেকেও বেশি এখন তার শিরা উপশিরায় রাগ চড়ে বসেছে।সে নিরবে ক্লাস রুম ত্যাগ করেছিলো সে সময়।ওরা ভেবেছিলো নতুন মেম ভয়ে পালিয়েছে।বিদঘুটে হাসি হাসে তারা।কিন্তু ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার যখন সে ফিরে এলো তখন শিশির সহ ওর দলবল অবাকই হয়েছে।ভেবেছিলো আর আসবে না নতুন মেম।কিন্তু ওঁদেরকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে হাতে বড় সড়ো শপিং ব্যাগ সমেত ফিরে এসেছে সে।ক্লাস রুমের দরজা আস্তে করে লক করে দিলো সে।

ওর মধ্যে কোনো রকম কথা বলেনি কুহু।সবটাই নিরবে করছিলো কুহু।এ যেনো ঝড় আসার পূর্বাভাস।শিশির রা অবাকে হা হয়ে দেখছে সব টা।কি হচ্ছে সবটাই যেনো ধোয়াসা লাগছে।নতুন মেমের হাতে থাকা শপিং ব্যাগটার দিকে দেখলো ওরা।তবে বুঝলো না কিছুই।

কুহু ঘ্রানেদ্রীয় ফুলিয়ে আক্রোশের সহিতে মেয়েদের কে আদেশের স্বরে বললো,

“এখানে ছাব্বিশ টি বে’ত আছে।মেয়েরা আসবেন আর একটা করে নিয়ে যাবেন।ইটস মাই অর্ডার।কাম অন!ফার্স্ট!”

তার হুকুম শুনে একে একে সব মেয়েরাই এলো হাতে করে বেত নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিঃশব্দে।নতুন মেম ঠিক কি করতে চাইছেন কেউই কিচ্ছু বুঝতে পারছে না।এমন সুন্দর কন্ঠের অধিকারীনির গলায় তীব্র আক্রোশের কন্ঠে কিছু টা কেঁপে উঠলো শিশির সহ বাকিরাও আশিক, মোর্শেদ, শাহেদ,স্বপন,রিমন।

“কি হলো মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছো কেনো?ওঁদেরকে এমন ভাবে বেত্রা’ঘাত করো যাতে ভবিষ্যতে তোমাদেরকে আর উত্তক্ত করার সাহস না দেখাই এই নর পিশাচ গুলো।”

আশিক খেপে গেলো,”এই যে নতুন মেম যা বলছেন ভেবে বলছেন তো?প্রথম দিন এসেই এইরকম বাড়াবাড়ি টা করছেন?টিকতে পারবেন না কিন্তু!”

কুহু কন্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে আবারও হুকুম করলো,”মেয়েরা আপনাদেরকে যা বললাম তা কি শুনতে পাননি!”

এবার সকল মেয়েরা হঠাৎ করেই ঝাপিয়ে পরলো বিষাক্ত লাল পিপড়ার মতো।যে যেভাবে পারছে ওঁদের ছয় জন কে পি*টি*য়ে*ই যাচ্ছে।এতো দিনের পুষে রাখা ক্ষোভ মেটাচ্ছে সকলে।ছাব্বিশ জন মেয়ের সাথে ওরা ছয় জন পেরে উঠে নি।ওরা ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু পারলো না।কি’ল, ঘু’সি,লা’থি যে যেভাবে পারছে মে’রে’ই যাচ্ছে।ছেলেরা নিরব দর্শক হয়ে সব টা উপভোগ করছে।এতোদিন ওদেরকেও কম অশান্তিতে থাকতে হয়নি।ওঁদের ও যেনো জ্বালা মিটছে এতে।

কুহু থামতে বললো সবাইকে।সবাই থেমে গেলো মুহুর্তের মধ্যে।ওঁদের বেহাল অবস্থা।ওরা এক কোণাতে বসে আছে।বেত্রা’ঘাত কাটবে না কিন্তু বিষের ন্যায় ব্যাথা থাকবে সেই মা’রে সারা শরীরের আঘাত প্রাপ্ত স্থানে।

এতো সুন্দরী একজন মেয়ে যে এমন আ’গু’নের ফুলকির ন্যায় জ্বলে উঠতে পারে ওঁদের ধারণাও ছিলো না।তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে এমনও একটা প্রতিবাদী রুপ রয়েছে তার।সব নারীর এমন রুপ হওয়া উচিত।যে পুরুষের নজর খারাপ তার বেঁ’চে থাকার অধিকার নেই।এক হয় ম’রো না হয় বে’চে থেকে মা’রো!কুহু শীতল নরম গলায় বললো,

“অত্যাচার সহ্য করতে নয় বরং অত্যাচার দমন করতে শিখুন।এই বে’ত গুলো নিজেদের কাছে রাখুন।এরপর যখনই ওরা আপনাদের বিরক্ত করতে আসবে তখনই বে’ত চালাবেন।ভিতু না হয়ে সাহসী হোন।দেখবেন আপনারা সবাই নিজেদের মতো করে সাহসী হয়ে উঠছেন।আর কত দিন এভাবে সহ্য করতেন।আজ আর আমার ক্লাস নেওয়া হলো না।দুঃখিত!কিছু কিছু আগাছা থাকে তাদেরকে যত দ্রুত সম্ভব উপরে ফেলায় শ্রেয়।”

সকলের করতালি পরে গেলো মুহুর্তের মধ্যে। মুগ্ধ হয়ে দেখলো তারা তাদের নতুন শিক্ষিকাকে।প্রথম দিন এসেই তিনি বুঝিয়ে দিলেন মেয়েরা দুর্বল নয়।তারা চাইলেই প্রতিবাদ করতে পারে।এই ঘটনা পুরো ভার্সিটিতে ছড়িয়ে পরলো প্রায়।

এদিকে কুহু ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে এলো।তার মনে পরলো মুহুর কথা।মেয়েটা কি আজকে আসেইনি ভার্সিটিতে।এই অলস মেয়েটাকে নিয়ে তার হয়েছে যত জ্বালা।সে তার আম্মু কে ফোন করলো।প্রিতি রিসিভ করলেন কল,

“হ্যালো আম্মু আজকে কি মুহু ভার্সিটিতে এসেছে?”

“হ্যাঁ যাওয়ার তো কথা।আমি ওঁকে ঘুম থেকে তুলে দিয়েই এসেছি।কেন তোর সাথে ওর দেখা হয়নি?”

“না আম্মু ওঁকে তো দেখলাম না।তাহলে কি আসেনি ও।আচ্ছা আম্মু আমি একবার খু্ঁজে দেখি এখানে।তুমি বরং শারমিন কে ফোন করে জেনে নাও মুহু বাড়িতে আছে কিনা!”

কুহু ফোন টা রেখে দিলো।এদিক সেদিক খুজলো নিজের বোন কে।কিন্তু না কোথাও পেলো না।ক্লাস রুমেও খু্ঁঁজলো সে।এরপর প্রিতি একবার ফোন করে জানালেন মুহু আজকে এসেছে ভার্সিটিতে।কিন্তু মেয়েটি গেলো কোথায়।কুহু ভীষণ চিন্তায় পরলো।নিশ্চয়ই ও সাইকেল করেই এসেছিলো।গেটের বাইরে গিয়ে দেখলো ওর সাইকেল আছে কিনা।বাইরে সাইকেল দেখেই চিনে ফেললো এটার তার বোনের।তার মানে মুহু এসেছে আজকে।কিছু হলো না তো আবার মুহুর?কোথায় তার বোন?ওর কোনো ক্ষতি হলো না তো।সে আঁতকে উঠলো এই কথা মাথায় আসতেই।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here