গোধুলীর শেষ প্রহরে পর্ব -০৬

#গোধুলীর_শেষ_প্রহরে
#পর্বঃ৬
#রাউফুন (ছদ্মনাম)

ভার্সিটিতে কাল কে হাফ ডে।ইংরেজি ডিপার্টমেন্ট থেকে দুপুরের পর মুভি দেখতে যাওয়ার প্ল্যান করা হচ্ছে।আর তারপর বিরিয়ানি,কাবাব,কালা ভুনা খেয়ে বাড়ি ফেরা হবে।নতুন আরেকজন শিক্ষিকা এসেছেন এরি মধ্যে।তিনি ডিপার্টমেন্টাল হ্যাড।উনার নাম কামরুন রেখা।রেখা মেম বাকি স্যার দের কে কাছে প্রস্তাব টি রেখেছেন।তাদের ডিপার্টমেন্টের পাঁচ জন স্যার শিক্ষিকা রয়েছেন।সজল স্যার,আব্দুল্লাহ স্যার,নুর মোহাম্মদ স্যার উনারা সবাই এক জায়গায় বসেছেন এই মুহুর্তে।তিন জন স্যার আর দুই জন মেম।কিন্তু কুহু অন্য সাইডে বসে কিছু একটা করছে।কালকের জন্য চার জন প্ল্যান করছেন দুপুরের খাওয়ার সময়।

আব্দুল্লাহ স্যার আর নুর মোহাম্মদ স্যার সহ বাকিরা বিবাহিত।সজল স্যার এখনো বিয়ে করেন নি।তিনি থেকে থেকে রেখা মেম কে দেখে যাচ্ছেন নিজের কেবিন থেকে।স্বচ্ছ কাচের জানালা ভেদ করে আবছা দেখা যাচ্ছে রেখা মেম কে।এ চাহনি অন্য কিছু বলছে।একেই ছোট গ্রুপ তার উপর কুহু যাবে না।এতে সবাই যেনো নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন।কারণ বাকি স্যার আর রেখা মেম সবাই রাজি থাকলেও কুহু রাজি নয়।সবাই মিলে কুহুকে রিকোয়েস্ট করেই চলেছে।তম্মন্ধে সজল স্যার বললেন,

“আমাদের কুহুলতা মেম যথারিতি জানিয়ে দিয়েছেন তিনি যাবেন না।একেই ছোট গ্রুপ তার মধ্যে যদি একজন না যান এটা কেমন দেখাই না?”

আব্দুল্লাহ স্যার অনুনয় করে বলেন,”চলুন না মেম আমাদের সাথে একদিন সময় কাটাবেন।দুই মাস থেকে জয়েনিং করেছেন আপনি।এর মধ্যে একবারও আমাদের সাথে যেতে চান নি।”

“হ্যাঁ রোজ রোজ তো আর যাওয়া হয় না।আমরা কত জন ই বা আছি বলুন।পাঁচ জনের মধ্যে একজন ও যদি কমে যায় তাহলে এনজয় করবো কি করে।”

কুহু নুর মোহাম্মদ স্যার এর দিকে তাকালো উনার কথায়।মুচকি হেসে জবাব দিলো,”আপনারা যান ঘুরে আসুন স্যার আমার হবে না।”

সবার এতো রিকোয়েস্ট করা শর্তেও কুহু অনড়।সে ভার্সিটিতে বসে পিএইচডি এর থেসিস লিখবে তাই ওর যাওয়া সম্ভব না পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে।সে চেয়েছিলো বাইরের দেশ থেকে পিএইচডি করবে।কিন্তু মা-বাবা,বোনকে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না।
তাই ময়মনসিংহ কেবি তেই পিএইচডি টা কমপ্লিট করবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।বাংলাদেশে একটাই পিএইচডি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে কিনা।ঢাকা থেকে কেবি দূরে হলেও কিছু করার নেই তার।এমন সময় রেখা মেম এলেন উনার কেবিন থেকে।কুহুর ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন,”কালকের গেট টু গেদারে আপনার যাওয়া টা আমি কাম্য করছি।শুনলাম সবাই রিকোয়েস্ট করার পরেও রাজি হচ্ছেন না।দেখুন এরকম করলে কি করে হবে।টিমস স্পিরিট বলেও তো কিছু আছে নাকি?”

সজল গোলগোল আঁখি দুটি তাকিয়ে থাকে রেখা মেমের দিকে।সে ক্যাবলার মতো হেসে বললেন,”হ্যাঁ মেম আমরা তো কতক্ষণ থেকে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম।কিন্তু কুহুলতা মেম তো রাজিই হচ্ছেন না।”

রেখা সজল স্যার কে একবার পরখ করে নিলেন।এই লোকের হাবভাব মোটেও সুবিধার না।কেমন ক্যাবলা লোক।সে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো কুহুর পাশে।এরপর শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কুহুকে বলে,”দেখুন আপনার পার্সনাল কাজ থাকতেই পারে।কিন্তু এক বেলার জন্যও কি ডিপার্টমেন্টের সবার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া যায় না?আপনাকে আমরা সকলেই এক্সপেক্ট করবো কালকে।”

কুহু এই প্রথম বার রেখা মেম কে ভালো করে দেখলো।দেখেই যে কথা গুলো ওর মনে হলো, স্মার্ট, বুদ্ধিদীপ্ত,সুন্দরী,মায়াময় চোখ তার এক অপরুপ মহোময়ী নারী।এক ঝলক দেখেই ও নজর নামিয়ে নিলো।কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না।রেখা উঠে নিজের ক্যাবিনের দিকে চলে গেলো।

কুহু একবার তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলো।তার যে মন টা ভালো নেই।সে তৌহিদের সে বিদ্ধস্ত সেই চেহারা আজও ভুলতে পারে না।আজ দুই মাস থেকে তার বাবা মারা গেছে।কুহু একবার বলেছিলো তৌহিদ কে যে সে যেনো তার বাড়ি এসে থাকে একেবারে।এই কথায় তৌহিদ কুহুকে বলে,

“দয়া করতে চাইছেন আমাকে?আমার কারোর দয়ার প্রয়োজন নেই!”

এরপর কুহুর মুখে আর কোনো কথা বের হয়নি।জীবনে কখনো কোনো পুরুষের সংস্পর্শে সে যায়নি।তানহার সঙ্গে মুহুর পরিচয় হওয়ার পর থেকেই এই একটা মানুষ কে নিয়ে সে ভেবেছিলো।এর আগে কখনো পুরুষের সান্নিধ্য সে পাইনি তাই হইতো এক পাক্ষিক ভাবেই তৌহিদ কে নিজের মন দিয়ে বসেছে।সে তৌহিদকে তার বাড়িতে থাকার জন্য এটা ভেবেই এই প্রস্তাব দিয়েছিলো যাতে ওকে মানসিক ভাবে সাপোর্ট করতে পারে সামনে থেকে।তাছাড়া সবার সঙ্গে থাকলে এতো টা শুন্যতা অনুভব হবে না তার।অবশ্য তৌহিদ একটা প্রাইভেট কোম্পানি তে জব করছে এখন।
_
তানহা মেয়েটা বড্ড ভালো।সে চুপচাপ স্বভাবের কিন্তু ইদানিং মেয়েটাকে বেশিই উদাসীন লাগছে।আরও কথা কম বলছে মেয়েটি।মুহুর থেকে জেনেছে সে এই বিষয়ে।মুহু কিছু জিজ্ঞেস করলেও তেমন কোনো ফল পাইনি।মুহু ভেবেছে হইতো ওর বাবার চিন্তায় এমন টা হয়েছে।কিন্তু এখন অন্য কিছু মনে হচ্ছে।আগে তানহা ওর মামা মামির কাছে থেকেই পড়াশোনা করতো।সে অন্য কলেজ পড়লেও মুহুর সঙ্গে তার দেখা হতো প্রায়ই।সে থেকে ওঁদের বন্ধুত্ব।ওঁদের ইচ্ছে ছিলো এক ভার্সিটিতে পড়বে।কিন্তু আলাদা আলাদা ভার্সিটিতে ওঁদের চান্স হলো।
_
এরপর কুহু ভার্সিটি থেকে অফার লেটার হাতে পেলো।সে জানতো তানহা এই ভার্সিটিতেই পড়ছে।এরপর সে ভাবলো মুহুকেও এখানে নিজের চোখের সামনে রাখবে।মুহুটা আজও ভার্সিটি আসেনি।বড্ড ফাঁকি দিতে শিখেছে মেয়েটা।ওঁকে বুঝাতে হবে ভালো ভাবে।এখন তো আর মা’রে’র বয়স নেই যে মে’রে বুঝাবে।এরপর সে আবার শুনেছে তানহা নাকি পড়াশোনা টা নিয়ে আর এগোতে চাই না।কুহু ঠিক করেছে এই বিষয় নিয়ে ভালো ভাবে কথা বলবে তৌহিদের সাথে।আংকেল গত হওয়ার আরও দুই মাস আগে থেকে তানহা ভার্সিটিতে আসে না।কেন তানহা পড়তে চাইছে না?শুধুই কি আংকেল এর মৃত্যুর জন্য নাকি অন্য কোনো কারণে?

দ্বিপ্রহরের সময় সূর্য ঠিক মাথার উপরে থেকে নিজের তেজ বাড়িয়ে দিতে থাকে।রোদের তীব্র প্রখরতা সহ্য হচ্ছে না সারাফের।ঢাকা শহরে জ্যাম থাকবে না তা কি আর কখনো হতে পারে।গাড়িতে এসি থাকা সত্ত্বেও সে ঘামছে।সে ড্রাইভার কে বলল এসির পাওয়ার বাড়াতে।ড্রাইভার তাই করলো।সে এইচএসসি তে স্কলারশিপ পেয়ে জার্মানিতে পড়তে গেছিলো।জার্মানির কোথাও কোনো ধুলোবালির বালাই নেই।জার্মানিতে এতো যনযাট ও নেই।সেখানে থেকেই সে পড়াশোনা শেষ করেছে।জার্মানি তে তার নাগরিকত্ব লাভ হয়ে যাবে কিছু দিনের মধ্যে।এবার নিজের দেশের প্রতি টান থেকেই কয়েক মাসের জন্য এখানে এসেছে সে।এই তিন মাসের মধ্যে দুই মাস চলে গেছে তিরতির করে।আর একটা মাস আছে তার হাতে।এরপর সে আবার পারি জমাবে জার্মানিতে।

নিজের বাবা স্যরি নিজের বাবা নয় তিনি তো তার নিজের বাবা নয়।সে তো এডোপ্টেড সন্তান ওই বাড়ির।শৈবাল টা তাকে খুব ভালোবাসে।নিজের মাকে তো ছোট বেলায় তেমন পাইনি ছেলেটা।তাই এমন ভবঘুরে হয়েছে ছেলেটা।ওর মায়ের ওই ভাবে মৃত্যু টা মেনে নিতে পারে নি ও।ছোট বেলায় সারাফ থাকতো একটা অনাথ আশ্রমে।সে সময় মিস্টার শাহরিয়ার সাইফ আসেন শৈবাল কে নিয়ে।শৈবাল অনেক কেঁদে কেঁদে বলেছিলো,”বাবা আমি থাকবো না তোমাকে ছাড়া।তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না আমি।আমাকে রেখে যেও না এভাবে।”

এসবই দশ বছরের সারাফ দেখেছিলো নিজ চোখে।শৈবালের এতো কাঁন্নাও তার মনে দয়ার সঞ্চার করেনি।তিনি জোর পূর্বক রেখে গেছিলো শৈবাল কে।প্রথম দিন থেকেই শৈবাল একা থাকতো।ওই সময়ে সারাফ হয় ওর সবচেয়ে প্রিয় আর কাছের মানুষ।যত দিন যাচ্ছিলো ওর আরও প্রিয় হয়ে উঠে সারাফ।শৈবাল ওঁকে চোখের আড়াল করতো না এক মুহুর্তের জন্যও।কয়েক মাস পর আসেন আবার মিস্টার শাহরিয়ার সাইফ।তিনি একা আসেন নি সেদিন।সাথে উনার নতুন বউ সাহিরা কেও এনেছিলেন।সেদিন শৈবাল আরও নিদারুণ ভাবে কেঁদেছিলো।হইতো নিজের মায়ের জায়গায় অন্য কাউকে মানতে পারেনি ছোট্ট শৈবাল।শৈবাল যেতে চাইনি তখন সারাফ কে ছেড়ে।সে বলেছিলো সারাফ কে ছাড়া সে যাবে না কোথাও।ছেলের জেদের কাছে হাড় মেনে বাধ্য হয়ে সারাফ কে এডপ্ট করেন তিনি।ড্রাইভার এর ডাকে হুস ফেরে সারাফের।সে আনমনে গাড়ি থেকে নেমে সিড়ি বেয়ে উঠছিলো।সে সময় সাহিরা বেগম পেছন থেকে ডাকলেন,

“বাবা সারাফ তুমি কি আজ বিকেলে ফ্রী আছো?”

সারাফ থেমে গেলো।এই মানুষটা কে সারাফ ছোট বেলায় অনেক খারাপ ভাবতো।কিন্তু না যত দিন যাচ্ছিলো সে উপলব্ধি করে মানুষ টা খারাপ নয়।বরং ওঁদের দুই ভাইয়ের জন্য নিজে সন্তান জন্ম দেন নি তিনি।যাতে আমাদের কষ্ট না হয়।পরে যদি আমরা বলি আমাদের তিনি ভালোবাসেন নি।শৈবাল অবশ্য এখনো উনার সাথে কথা বলে না।কিন্তু সারাফ এই মানুষ টাকে সম্মান করে মনে মনে অনেক।তার তো কাজ আছে কিন্তু রাতেও করে নিতে পারবে সেটা।আপাতত বিকেলে ফ্রী আছে সে।সারাফ পিছনে ঘুরে মুচকি হেসে বলে,

“জ্বী মা আমি ফ্রী আছি।আপনার কিছু দরকার আছে?”

সাহিরা বেগমের চোখ টলমল করছে।শৈবাল এখনো অব্দি তাকে মা বলে ডাকে না।অন্তর টা খা খা করে উঠলো তার।শৈবাল তার মুখ ও দেখতে চাই না।তিনি এতো বছর আড়াল থেকেই শৈবালের দেখাশোনা করেছে।ওর মুখ থেকে মা ডাক শুনার জন্য তার মন টা ছটফট করে।আকুপাকু করে মন।কিন্তু সারাফ তাকে বড় হওয়ার সাথে সাথে মা বলে ডাকে।তার ভীষণ শান্তি লাগে।এ যেনো কাঠ ফাটা রোদ্দুরে এক পলশা বৃষ্টি।এই ছেলেটা তাকে এতোটা সম্মান করে যে সে তাকে যেকোনো কিছু বলতে পারে নির্দ্বিধায়।

“তোমার যদি কোনো অসুবিধা না হয় বাবা সারাফ আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবে।দেখো না বাবা আমি একা যেতে পারছি না।যদি তুমিও আমার সঙ্গে যেতে ভালো হতো তবে।”

“এভাবে বলছেন কেন মা?আমি কি আপনাকে কখনো কোনো কিছু তে না করেছি এসে থেকে।”

“কাজ থেকে ফিরলে।এসে থেকেই তো অনেকে ব্যস্ত থাকো তুমি।শৈবালের বাবার বিজনেস টা দেখছো।কাজের মানুষের তো আর সব সময় মাথা ঠিক থাকে না।যদি তোমার খারাপ লাগে তাই জিজ্ঞেস করে নিলাম বাবা।”

সারাফ উনার অনুরোধ ফেলতে পারবে না কোনো দিনও।তাই সে বললো,

“আমি আপনাকে অবশ্যই নিয়ে যাবো।আপনি রেডি হয়ে আমাকে জানাবেন কেমন।”

সাহিরার মুখ হাসি ফুটলো।চমৎকার সেই হাসি।উনার চোখ যেনো হাসছে উনার মুখের হাসিতে।তিনি হেসে বললেন, “তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো আমি তোমাকে খাবার দিচ্ছি।”

সারাফের বেশ ভালো লাগলো।এইভাবে কবে হেসেছেন তিনি তার মনে পরে না।সে এখানে এসেও উনাকে দেখেছে গুমরে গুমরে থাকতে।যদিও সে জার্মানি থেকে রোজ একবার হলেও ফোন করে উনার খোঁজ নিয়েছে।এই দুই মাসে সে প্রথম বার এভাবে হাসতে দেখলো উনাকে।সারাফ আর দাঁড়ালো না।তার ভালো লাগছে ভীষণ উনাকে হাসতে দেখে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here