গোধুলীর শেষ প্রহরে পর্ব -০৮

#গোধুলীর_শেষ_প্রহরে
#পর্বঃ৮
#রাউফুন (ছদ্মনাম)

আজ ভার্সিটিতে হাফ ডে।কুহু আজকে ক্যাজুয়াল ড্রেস পরবে বলে ঠিক করলো।যদিও ওর সময় নেই মুভি টুভি দেখতে যাওয়ার।

‘যাক গে তাতে আমার কি।ওরা সবাই যাক মুভি দেখতে।আমার কি আর ওতো সময় আছে।’

নিজের মনে বলতে বলতেও দুটানাই পরলো কুহু।তার মন বলছে রেখা মেম এর রিকুয়েষ্ট টা রাখতে।ওর বলা একটা কথায় বাজছে কুহুর কানে,”আমরা কিন্তু কাল আপনাকে এক্সপেক্ট করবো”

কিন্তু তার মাথায় বাজছে এই কথা,’আরে কাল এতো বড় মুখ করে না করে দিলি যাবি না এখন আবার যেতে রাজি হবি?ধুর ধুর তোর কথায় আর কাজের কোনো মিল নাই।’

এরকম দোটানায় বিরক্ত বোধ করলো নিজের উপর।এসব ভাবতে ভাবতে সে রেডি হতে চলে গেলো।ড্রেস বের করতে গিয়ে ওর নজর পরলো একটা মফ কালারের শাড়ীর দিকে।না চাইতেও কেন জানি সে শাড়ী টি পরে নিলো।চুল টা খোলাই রাখলো সে আর সাথে ওয়াইন কালারের লিপস্টিক পরলো।যা ওর ঠোঁটের সঙ্গে একদম মিশে গেছে।দূর থেকে বুঝার উপায় নেই যে সে লিপস্টিক পরেছে।এই টুকু সাজেই যেনো কুহুর রুপ ঠিকরে পরছে।

প্রিতি হসপিটালে বেরোনোর জন্য তৈরি হয়ে নিলেন।মুহুকে আজ কুহু অনেক আগেই বিছানা থেকে উঠিয়ে দিয়েছে।এরপর তানহার বাড়িতে পাঠিয়েছে।ওঁকে নিয়েই যেনো আজ ভার্সিটিতে আসে মুহু এই হুকুম করেছে কুহু।কুহুর হুকুম অমান্য করবে এরম সাধ্যি মুহুর নেই।তিনি কুহুর ঘরে এসে মেয়ের আজকের সাজগোজ দেখে একটু চমকে গেলেন!তিনি হেসে বললেন,

‘কি রে আজকে তো দেখছি খুব সাজুগুজু হয়েছে।কি ব্যাপার?কাউকে মনে টনে ধরলো নাকি?’

মায়ের কথায় কুহু একটু না বেশ লজ্জা পেলো।ইশ তার মা কিভাবে বলে।কথা ঘুরাতে সে বললো,

‘কি যে বলো মা!আজকে ভার্সিটিতে হাফ ডে।তাই ভাবলাম একটু ক্যাজুয়াল ড্রেস পরি।তুমি মা হয়ে আমাকে এরকম লেকপুল করছো!’

প্রিতি হেসে বললেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা।কাউকে মনে ধরলে আমায় বলিস কিন্তু!আঠাশ বছর হয়ে গেলো এখনো একটা প্রেম করতে পারলি না!তা সারাজীবন কি একা থাকার শপথ নিয়েছিস নাকি?’

লজ্জায় কুহুর গাল গুলো টমেটোর মতো লাল হয়ে গেলো।তার মা ও না কেমন কেমন।একটুও ভেবে কথা বলে না।যখন তখন বেফাস কথা বলে ফেলে।কেনো যে সে আজ শাড়ী পরতে গেলো কে জানে।সে কোনো মতে মায়ের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।

মুহু এক প্রকার টেনে হিচরে তানহা কে রেডি করিয়েছে।কোনো মতেই সে আজ তানহা কে ছাড়া ভার্সিটি যাবে না।যেতেই হবে ওঁকে আজ।এতক্ষণ থেকে বুঝাতে বুঝাতে মুহু ক্লান্ত হয়ে গেছে।এরপর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে কোনো রকমে রাজি করিয়েছে।তানহা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুহুর উদ্যেশ্যে বলে,

‘আমার আর পড়াশোনা হবে না।তুই কেন আমার সঙ্গে নিজেকে জড়াচ্ছিস বলতো মুহু।’

‘জড়াচ্ছি না তো আমি তো তোর সাথে আরও অনেক আগেই জড়িয়ে গেছি রে।শোন আমার তোকে ছাড়া চলবে না।কোনো মতেই চলবে না।’

‘তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস না কেন?অনেক কিছু বদলে গেছে এই চার মাসে।আমার জীবনের পাতা উলটে গেছে।আমার যে পড়াশোনার ইচ্ছে টাই ম’রে গেছে।’

মুহু কিঞ্চিৎ রেগে গেলো।তানহার পি’ঠে দুরুম করে একটা কি’ল বসিয়ে বললো,

‘ব্যাস অনেক কথা বলেছিস।আর নয়।এরপর দেরি হলে বুবু আমার পি’ঠে’র ছা’ল তুলে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেবে।তুই কি সেটাই চাস?’

না চাইতেও তানহা হাসলো।কারণ সে খুব ভালো করেই জানে কুহু বুবুকে ঠিক কতটা ভয় পাই মুহু।পরক্ষণেই কিছু তিক্ত স্মৃতি চারন হতেই আবার ওর মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো।ভার্সিটিতে গেলেই যে ওই ছেলেটার মুখোমুখি হতে হবে।আজ না হোক কাল ওই ছেলেটা ওঁকে দেখবেই।যদি আবার কিছু করে বসে তখন।ভেবেই তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।বোরখা ও নেই তার একটু যে সেটা পরে যাবে।কিন্তু উপায় ও নেই।না চাইলেও মুহু যে আজ ওর বারন শুনবে না সে জানে।তাই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ওঁরা বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।

তৌহিদ সবটাই দেখেছে আড়াল থেকে।কত দিন পর তার বোন একটু হাসলো।মনের মধ্যে একটা প্রশান্তি কাজ করলো বোনের এক চিলতে হাসি দেখে।কাল কুহুলতা এসেছিলো তার কাছে।অনেক কথায় হয়েছিলো মেয়েটির সাথে।সন্ধ্যা অব্দি সে এখানেই থেকে গেছে।তানহার পড়াশোনা ছাড়ার আসল ব্যাপার টা জানতে চেয়েছিলো কুহুলতা।রাতের রান্না গুলো সব ই নিজে হাতে করে দিয়ে গেছিলো মেয়েটা।সেদিন তৌহিদ না চাইতেও তার কুহুলতাকে কষ্ট দিয়েছিলো।সে কুহুলতার এমন পাগলামি করার কারণ বুঝে কারণ সেও যে তার কুহুলতাকে*,সে আর কিছু ভাবলো না।মনের সাথে যুদ্ধ করে নিজের অনুভূতি কে ধামাচাপা দিলো সে।তার এসব অনুভূতির কোনো মুল্য নেই।যতটা পারবে সে কুহুলতার থেকে দূর থাকবে।ওর কাছাকাছি যাওয়া যাবে না।যত কষ্টই হোক না কেন তার।গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো।

স্টাফ রুমে ঢুকতেই সজল স্যার বললেন,

‘বাহ বাহ মেডাম আপনাকে তো আজ দারুন লাগছে।তাহলে নিশ্চয়ই আপনি আমাদের সাথে যাচ্ছেন?’

কুহু কিছু বলতে যাবে তখনই হুরমুর করে রেখা মেম ভেতরে এলেন কিছু বলার জন্য।কিন্তু এসেই তার চোখ পরলো কুহুর দিকে।ওর দিকে তাকিয়ে রেখা মেম বলবে বলে যে কথা নিয়ে এসেছিলো তা যেনো হারিয়ে গেলো।উনি যেভাবে এসেছিলেন আবার সেভাবেই ফিরে গেলেন।সবাই ব্যাপার টা লক্ষ্য করে হেসে উঠলো।আর কুহু পরে গেলো লজ্জায়।সজল স্যার বললেন,

‘রেখা মেম কি বলতে এসেছিলেন বলুন তো? আপনাকে দেখে ভুলে আবার চলে গেলেন!তাহলে ভাবুন মেডাম কি অপূর্ব দেখতে লাগছে আপনাকে!’

সজল স্যার এর কথায় সবাই হেসে উঠলো।কুহু কিছু বললো না।এভাবে মুখের উপর কারোর প্রশংসা সে প্রথম বারের মতো শুনলো।কিন্তু ব্যাপার টা সে আমলে নিলো না।নিজের মতো কাজ করতে লাগলো।ওর একটা ক্লাস নেওয়ার আছে সেটা নেওয়ার জন্য চলে গেলো।মনে মনে ভাবলো মুহু তানহাকে আজ আনতে সক্ষম হয়েছে কিনা।ওর সঙ্গে একবার কথা বলা প্রয়োজন।যেই ভাবা সেই কাজ।সে উঠে চলে গেলো।এবং মুহুদের ক্লাসের দিকে নজর দিলো।সামনের বেঞ্চে কোথাও দেখা পেলো না ওঁদের।লাস্ট বেঞ্চে মুহু আর তানহা বসে আছে।তানহাকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত মনে হলো।এদিক সেদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখছে কিছু।ক্লাসে যে তার মন নেই কুহু ঠিক বুঝলো।জহুরির চোখ তার।ঠিকই বুঝতে পারছে তানহার অমনোযোগী।স্যার ক্লাসে আছে বিধায় কুহু ভেতরে যেতে পারলো না।সে চলে গেলো নিজের ক্লাস নিতে।

বারোটার দিকে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে এসে রেখা মেম এসে বললেন,’তাহলে এখন বেরোনো যাক।’

নুর মোহাম্মদ স্যার বললেন, ‘আমরা তাহলে ক্যাব বুক করে নিই?’

রেখা মেম মুচকি হেসে বললেন,’আমার সাথে গাড়ি আছে।সবার জায়গা হয়ে যাবে।’

সজল স্যার রেখা মেমের দিকে তাকিয়ে বলেন,’ওয়াও! তাহলে তো কোনো সমস্যাই নেই।চলুন তাহলে বেরিয়ে পরি!’

সবাই যেতে উদ্যত হলেও কুহু তখনও বসে আছে।সেটা দেখে রেখা বললেন,’আপনারা সবাই বেরিয়ে যান আমরা আসছি।’

নুর মোহাম্মদ স্যার,সজল স্যার,আব্দুল্লাহ স্যার উনারা তিন জন বেরিয়ে গেলেন।বাকি রইলো রেখা আর কুহু।রেখা এগিয়ে এলো কুহুর দিকে,

‘আপনি এতো গম্ভীর হয়ে থাকেন কেন সব সময়?আমি ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের হ্যাড অফ দ্যা ডিপার্টমেন্ট এন্ড আপনি হ্যাড অফ দ্যা এসিস্ট্যান্ট!তাই আপনার আমার কথা শোনা উচিত রাইট।এক সাথে অন্তত একটু হাসি ঠাট্টা করাই যায় তাই না?’

কুহু ফিচেল হেসে জবাব দিলো,’আসলে আমি ছোট বেলা থেকেই এরকম!’

রেখা ফিসফিস করে বলে,’বদলে দেবো আপনাকে।’

‘কিছু বললেন?’

‘না চলুন এখন যাওয়া যাক।সবাই অপেক্ষা করছে।’

কুহুর আর না বলার স্কোপই থাকে না।এরপর বারন করলে অন্য কিছু ভাবতে পারে।হইতো তাকে অহংকারি ভাববে।তাই সে বলে,’হ্যাঁ চলুন।’

রেখা মেম কুহু কে থামিয়ে দিয়ে বলেন,’আপনি সত্যিই খুব সুন্দরী!সকালে স্টাফ রুমে এসে আপনাকে দেখে কি বলতে এসেছিলাম বেমালুম ভুলে গেছি।এখনো মনে পরেনি সে কথা বিশ্বাস করুন।’

বলেই রেখা মেম শব্দ করেই হেসে উঠলো।শিশু দের মতো সরল হাসি তার।সেই হাসিতেই কুহুর হৃদয় গলে জল।রেখা মেম আসলেই অত্যন্ত ভালো।কুহু ভদ্রতার সহিত বলে,

‘চলুন সবাই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য।’

ওরা রেখার গাড়ির দিকে রওনা হলো।কি স্মার্ট রেখা মেম।দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সজল স্যার ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে আছেন রেখা মেম এর দিকে।মেয়ে হয়েও বার বার ওর নজর চলে যাচ্ছিলো রেখা মেম এর দিকে।সেখানে সজল স্যার তো পুরুষ মানুষ।রেখা মেম ধরতে পেরেছেন কিনা জানা নেই কুহুর কিন্তু সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে সজল স্যার কেন এভাবে তাকিয়ে থাকেন রেখা মেম এর দিকে।তবে রেখা মেমও যে সজল স্যারকে আড় চোখে বার বার দেখেই যাচ্ছিলেন সেটা কুহুর নজর এড়াইনি এবারে।

চোখের দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে এটা আড়াল করতে বড় কালো সান গ্লাস টা পরে নিলো রেখা।যাতে ওর চোখের গতিবিধি সজল স্যার দেখে না ফেলে।

পেছনের সিটে তিন স্যার বসলেন।না চাইতেও কুহুকে রেখার পাশের ড্রাইভিং সিটে বসতে হলো।লুকিং গ্লাস দিয়ে রেখার চোখ বার বার চলে যাচ্ছিলো পেছনে বসা সজল স্যার এর দিকে।সজল স্যার তো এমনিতেই তাকিয়েই থাকেন তার কথা আর বলতে।রেখা মেম যে বিরক্ত হচ্ছেনা এতে সেটা কুহু বুঝেছে।সজল স্যার এর তাকানো টা বেশ অনেক দিন থেকেই লক্ষ্য করেছে সে।যদিও কম কথা বলে সে কিন্তু চোখ কান তো খোলাই থাকে সব সময়। সব টা নজরে পরে যায়।

সজল মনে মনে ভাবছে, ‘বেশ তো ছিলাম আমি।কেন এলে তুমি এভাবে আমার জীবনে।কেন এতো আকর্ষণ জাগছে তোমার প্রতি আমার।এই আকর্ষণ কেই কি তবে প্রেমে পরা বলে?’

তার বয়স আটত্রিশ।এই বয়সে এসেও কি মানুষ প্রেমে পরে।তার কি ভিমরতি হলো নাকি এই বয়সে এসে।সব টা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।

গাড়িতে তখন গান বাজছে,

‘মেরা দীল ভি কিতনা পাগল হেই
এএএ প্যায়ার তো তুমছে হি কারতাহে!’

এই গানে সজল স্যার এর মন মস্তিষ্ক আরও আপ্লুত হচ্ছে।ইশ তার বেহায়া চোখের কি বেহাল অবস্থা।বার বার কেমন করে রেখা মেম এর দিকে নজর চলে যাচ্ছে।

এই চোখাচোখির ব্যাপারটা কুহু বেশ এনজয় করছে।তৌহিদকে মনে পরলো তার।আনমনেই গাড়ির সঙ্গে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে।
হৃদয়ের সব টা জুড়ে যে এই একটা মানুষেরই বিচরণ চলে।সব সময় ই এখন যে তার কথায় মন মস্তিষ্ক জুড়ে থাকে।কি হলো তার।আগে তো এমন ছিলো না সে।তবে এখন কেন এই অনুভূতির জালে ফেসে যাচ্ছে মন।বারংবার না চাইতেও একজনের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে ইচ্ছে করছে।তবে সে মনে প্রানে চাই এই অনুভূতি যেনো না হারিয়ে যায় তার জীবন থেকে।প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেনো এই অনুভূতি থাকে।এই অনুভূতির যদি একটু নড়বড়ে হয়ে যায় তবে যে তার নিঃশ্বাস থাকবে না।এভাবেই থাকুক না হয় এই মায়া।বেরোবে না সে এই মায়াজাল থেকে।হোক সেটা এক পাক্ষিক।আচ্ছা তৌহিদ কি তাকে নিয়ে এভাবে কখনোই ভেবেছে?সে কি জানাবে তার মনের কথা নাকি এভাবেই লুকোচুরি খেলবে নিজের মন নিজের সাথে?নাকি কোনো এক গোধুলির শেষ প্রহরে ধরা দেবে এই অব্যাক্ত অনুভূতিরা?ব্যাকুল করবে কোনোদিন দুজনকে এক সাথে।বেধে ফেলবে এই সুন্দর অনুভূতির জালে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here