#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৩
সেই কন্ঠস্বর যা রাগিনীর সর্বাঙ্গ অস্থির করে তোলে তা শুনে আর রাগিনীর পক্ষে স্থির থাকা যেন সম্ভব হলো না। নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ল। এই কন্ঠের সুর তো সে ভুল শুনতে পারে না। আর দেরি করল না রাগিনী। রিসেপশন থেকে দ্রুত পায়ে চলে গেল লিফটের দিকে। সে যেতে যেতে লিফটের দরজা বন্ধ হলো। রাগিনীর মাথায় পড়ল হাত। অন্যদিকে রিসেপশনিস্ট বার বার তাকে পিছু ডাকছে ফর্মালিটি পূরণ করতে। কিন্তু রাগিনীর ধ্যান যেন অন্যদিকে। কিছুক্ষণ থম মেরে লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল রাগিনী। স্মরণে এলো একজনের নাম। আপনমনে বলল,
“ইন্সপেক্টর রায়ান!”
রাগিনী ছুটে এলো রিসেপশনিস্টের কাছে। রিসেপশনিস্ট তাকে দেখেই বলে উঠল,
“ফর্মালিটি পূরণ না করে কোথায় যাচ্ছেন এভাবে ম্যাম?”
রাগিনীর মনে পড়ে ফর্মালিটির কথা। মূহুর্তের জন্য যেন বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল তার। সেই মূহুর্তেই আগমন ঘটে ফাহমিদের। তাকে দেখেই যেন আশার আলো পায় রাগিনী। দ্রুততার সঙ্গে বলে ওঠে,
“ফাহমিদ, র’ক্ত দিয়েছো? এখন কেমন আছে সে? ইমারজেন্সিতে তো ঢোকানো হয়েছিল বাচ্চাটাকে।”
“হ্যাঁ। হি ইজ আউট ওফ ডেঞ্জার। চিন্তা করো না রাগিনী। চোখমুখ শুঁকিয়ে গেছে তোমার।”
“আরেক হেল্প করে দাও প্লিজ! ছেলেটার ফর্মালিটিস্ পূরণ করে দাও। আমার একটা কাজ আছে।”
অনুনয়ের সুরে কথাগুলো শেষ করেই সে রিসেপশনিস্টের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল।
“ই…ইন্সপেক্টর রায়ান কি এই হসপিটালে ভর্তি আছেন? কত নম্বর রুমে আছেন বলতে পারবেন একটু? আমার খুব দরকার। আর ফর্মালিটিস্ ইনি পূরণ করতে হেল্প করবেন আপনাকে।”
বলেই ফাহমিদকে দেখিয়ে দিল রাগিনী। রিসেপশনিস্ট সময় নিয়ে চেক দিয়ে দেখে বলল,
“রুম নম্বর ৩০৭। থার্ড ফ্লোর। গু’লিতে আহত হওয়া পেশেন্ট।”
রাগিনীকে আর পায় কে? দ্রুত পায়ে সে লিফটের কাছে গিয়ে ঢুকে যায়। পেছন থেকে বোকা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ফাহমিদ। মেয়েটা কোথায় চলে গেল হঠাৎ? কিছুই বুঝে উঠতে পারল না সে। অতঃপর চশমা ঠিক করে রিসেপশনিস্টকে ফর্ম ফিলআপ করতে সাহায্য করতে লাগল।
থার্ড ফ্লোরে পৌঁছে আশেপাশে পাগলের মতো খোঁজ করল রাগিনী। কোথাও যদি সেই চেহারার দেখা মেলে! আবারও যদি সেই কন্ঠ কানে ভেসে আসে। কিন্তু তা আর হলো না। তবে কি সে ভুল শুনলো? রাগিনী এটা মানে না। সে ভুল শোনে নি এটা সে বিশ্বাস করে। সে স্পষ্ট শুনেছে সেই কন্ঠ। তার নাকে এসেছে সেই ঘ্রাণ। যা কোহিনূরের জামা থেকে আসতো। এটাও কি ভুল?
রাগিনী হেঁটে এগোতে থাকে ৩০৭ নম্বর কেবিনের দিকে। মাথায় ঘুরছে অসংখ্য প্রশ্ন। যার উত্তর তার কাছে নেই। সবথেকে বড় প্রশ্ন হচ্ছে কোহিনূর কি তবে সুস্থ? সুস্থ হলে তার সঙ্গে এমন করছে কেন আর হসপিটালেই বা পড়ে আছে কেন? মাথা বিগড়ে যাচ্ছে রাগিনীর। আগপাছ আর না ভেবে সে এসে থামলো নির্ধারিত কেবিনের সামনে। কেবিনের দরজাটা একটু ভিড়িয়ে দেওয়া। রাগিনী হাতটা বাড়িয়ে দরজায় একটু ধাক্কা দিতে চায়। কিন্তু অস্থিরতা বোধ হচ্ছে ভেতর থেকে। ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছে। শুঁকিয়ে শুষ্ক হয়ে গেছে তার ঠোঁট। একটা দম নিয়ে আস্তে করে ধাক্কা দিল দরজায়। ধীর পায়ে প্রবেশ করল কেবিনে। দুই ধাপ হাঁটতেই থামলো সে। পা আর চলতে চাইল না। বেডে অজ্ঞানরত অবস্থায় শুয়ে আছে একটা লোক। রাগিনী তাকে চেনে না। তবে লোকটার বয়স বেশি না। হবে কোহিনূরের বয়সী। চোখেমুখে তার বিশাল ক্লান্তি! বাম হাতে স্যালাইনের সুঁচ ফুটানো। হঠাৎ করেই অচেনা পুরুষালি কন্ঠে পিলে চমকে উঠল রাগিনীর। হুড়মুড়িয়ে তাকালো কেবিনে থাকা একটা সিঙ্গেল সোফার দিকে। এই পুরুষটিকে রাগিনী না চিনলেও তার চেনা চেনা লাগছে এবার। মাথায় ঝাঁকড়া চুলের বাহার, স্টাইল করে কাটা খোঁচা দাড়ি। শার্টের ভাঁজে রেখে দেওয়া তার দামি সানগ্লাস আর হাতে ব্র্যান্ডের ঘড়ি। লোকটির চাহনিও উদ্ভট। তার চাহনি দেখে রাগিনী ভড়কালো। কিছু বলতে উদ্যত হলো। তবে পারল না। তার আগেই সেই সুদর্শন পুরুষ কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,
“আ…আরে আপনি এখানে! এখানে কী করে?”
বলেই দাঁড়িয়ে গেল অভিরূপ। রাগিনী এবারও কিছু বলতে চাইলো। তবে মুখ থেকে শব্দ বের হতে সময় লাগছে। অভিরূপ নিজ থেকে বলে উঠল,
“আপনিই তো ওই বাচ্চাটাকে বাঁচিয়েছিলেন। রাইট?”
অভিরূপ বেশ আগ্রহী। তার পুরো শরীরে কাঁপুনি ধরেছে। কী বলবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। আবারও এই সাহসী নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যাবে সেটা তার কল্পনাতীত ছিল। অভিরূপ ভেবেছিল সেই সাহসী দৃষ্টি সে সেই ঝামেলার সাথেই হারিয়ে ফেলবে। মনের মধ্যে এক টান টান উত্তেজনার উদ্ভব হয়েছে যা দমাতে চেষ্টা করছে অভিরূপ। অপরদিকে রাগিনী চিন্তায় মগ্ন। লোকটা কীসের কথা বলছে? সে কি ওই বাচ্চা ছেলেটার কথা বলছে যাকে রাগিনী রেসকিউ করে হসপিটালে নিয়ে এসেছে? তাই হবে হয়ত। এটা ভেবেই সে ঝটপট করে উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?”
“আমি তো সেখানেই ছিলাম। সামনের গাড়িতে ছিলাম আমি।”
রাগিনী প্রতিত্তোরে কী বলবে যা ভেবে পায় না। শুধু বোঝার চেষ্টা করে এই লোকটা আসলে কে। মনে আসতেই সে হতভম্ব হয়ে বলে,
“আ…আপনি অভিরূপ চৌধুরী না?”
অভিরূপ হালকা হেঁসে উত্তর দেয়,
“ইয়েস। ইউ আর রাইট। আপনি কী ইন্সপেক্টর রায়ানের পরিচিত কেউ হন?”
রাগিনী থতমত খেয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“না, না। আমি রাগিনী তাজরীন। ভুল করে এই কেবিনে ঢুকে পড়েছি। আই এম সরি। এক্সকিউজ মি!”
আর এক মূহুর্ত সেখানে দাঁড়াল না রাগিনী। পেছন ঘুরে দরজা দিয়ে সেকেন্ডেই হাওয়া হয়ে গেল। অভিরূপ তাকে আরো কিছু বলতে গিয়েও পারল না। হতাশ হয়ে বলল,
“আশ্চর্য! মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেন? নাকি নারীজাতিই অদ্ভুত? এতো এতো আ’তঙ্কবাদীর সামনে সুপারওম্যান হয়ে বাচ্চাটাকে বাঁচালো অথচ আমার সামনে এক মূহুর্তও টিকতে পারল না? দ্যাটস্ নট ফেয়ার।”
অভিরূপ ফিরে এসে বসল সোফায়। রায়ানের আ’হত হবার খবর শুনে অভিরূপ জেদ ধরেই হসপিটালে এসেছে। তার মতে, যে তার এতো খেয়াল রাখলো তার পাশে না থাকা এক ধরণের স্বার্থপরতা। আর অভিরূপ চৌধুরী এতো স্বার্থপর নয়! নিজের গালে হাত রাখল অভিরূপ। মেয়েটির দৃষ্টির ধরণ আলাদা আলাদা। সেটাই মনে পড়ছে অভিরূপের। আনমনে সে আওড়ালো,
“বাট দ্যাট গার্ল! যখন প্রথম দেখেছিলাম মনে হয়েছিল তার দৃষ্টি থেকে অগ্নি ঝরছে। আর একটু আগে মনে হয়েছিল তার ভয়ার্ত দৃষ্টি দ্বারা কাউকে খু’ন করছে। কী যেন নাম তার। রাগিনী তাজরীন! তার সঙ্গে নামটা আসলেই স্যুট করে। গান গাইতে ইচ্ছে করছে খুব। মিস. রাগিনীকে ডেডিকেট করে!”
বলে কিছু একটা ভেবে নিজের কপালে হালকা করে চাপড় মা’রে সে। আর নিজে নিজেকে বলে,
“অভি! ইউ আর গোয়িং ক্রেজি। তোর সামনে একজন পেশেন্ট ঘুমিয়ে আছে আর তুই সেই সাহসী নারীকে ডেডিকেট করে গান গাওয়ার চেষ্টা করছিস! তুই সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছিস এবার।”
বাচ্চা ছেলেটির কাছে নির্বিঘ্নে বসে ছিল ফাহমিদ। কারোর পায়ের শব্দে পিছু ফিরে তাকায় সে। রাগিনী অন্যমনস্ক হয়ে কেবিনে ঢুকছে। তাকে দেখেই ফাহমিদ প্রশ্ন করে উঠল,
“কোথায় গিয়েছিলে? ছেলেটা তোমায় খুঁজছিল।”
রাগিনী চকিতে তাকায়। আমতা আমতা করতে থাকে। ছোট ছেলেটার মায়াবী মুখশ্রীর পানে চায়। শ্যামলা চেহারা হলে কী হবে? সারা মুখে যেন নূর ছড়িয়ে আছে। মাথায় সাদা রঙের ব্যান্ডেজ। হাতে প্লাস্টার করে দিয়েছে। রাগিনী প্রসঙ্গে কাটিয়ে বলে,
“সে ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“হ্যাঁ, তোমার কথা ওকে বলেছিলাম। তারপর থেকে তোমার খোঁজ করছিল। করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক ক্লান্ত মনে হয়।”
“হওয়ারই তো কথা। এতটুকু বয়সে ইন’কাম করতে নেমেছে রাস্তায়। অথচ এদের প্রতিই জনগনের কোনো দায়িত্ব নেই।”
ফাহমিদ শান্ত গলায় বলে,
“সবাই তো রাগিনী তাজরীন হতে পারে না!”
রাগিনী চোখ গোল গোল করে তাকায়। একটু ভেবে বলে,
“সবাই ফাহমিদও হতে পারে না। থ্যাংক ইউ ফাহমিদ। শুরু থেকে তুমি আমাকে এতোটাই হেল্প করে এসেছো যে তোমায় যতবারই থ্যাংক ইউ বলি লজ্জা নিজেরই লাগে।”
প্রতিত্তোরে কিছু বলতে চায় ফাহমিদ। তার বিপরীতে রাগিনী আবারও বলে ওঠে,
“আমার জীবনে সবথেকে বড় উপকার তুমি করেছো। যদি তুমি সেই রাতে না থাকতে তাহলে ওই নোংরা ছেলেগুলোর বাজে স্পর্শ হয়ত আমাকে অসম্মানিত করে ফেলতো। আমার সম্মান মাটিতে মিশে যেতো। এখনো মনে আছে আমার! ওইদিন কোহিনূরের সঙ্গে দেখা করে ফিরতে দেরি হয়েছিল। ড্রাইভার চাচা গাড়িতে ছিলেন না। আমি উনাকে খুঁজতে এক ওফসাইডে গিয়েছিলাম। ওটাই আমার কাল হলো। অসভ্য আর মাতাল ছেলেগুলো আমাকে ধাওয়া করল। আমি পড়ে গেলাম দৌড়াতে গিয়ে মাঝ রাস্তায়। কাঁচ পড়ে থাকায় হাতে ফুটে গেল। হাত থেকে র’ক্ত ঝরছিল। পায়ে এতোটা আ’ঘাত পেয়েছিলাম যে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি অবধি পাচ্ছিলাম না। সঠিক সময় তুমি এসেছিলে ভাগ্যিস। আর আজকে একটা বাচ্চা ছেলেকে র’ক্ত দিয়ে তার প্রাণ বাঁচালে। ভাগ্যিস তোমার সাথে তার র’ক্তের গ্রুপ ম্যাচ করেছিল। তুমি মানুষটা অনেক ভালো। কখনো তোমার কোনো উপকারে আসতে পারলে অবশ্যই আমাকে মনে করবে।”
ফাহমিদ তার এতো এতো প্রশংসা শুনে কেমন যেন লাজুক হাসি দিল। মাথা চুলকে চমশা ঠিক করল। তা দেখে মুখ টিপে হাসলো রাগিনী। এই ফাহমিদ ছেলেটার সঙ্গে সে আগে কলেজে পড়তো। ক্লাসমেট ছিল তারা। তবে আগে ফাহমিদ রাগিনীকে পছন্দ করতো। কিন্তু আগে তার এমন বোকাসোকা ভাব ছিল না। তবে মিশুক ছিল মানুষদের সঙ্গে। রাগিনীকে প্রেম নামক প্রস্তাব দেওয়ায় রাগিনী তা নাকচ করেছিল। তার কয়েকদিন পর উধাও হয় ফাহমিদ। অনেকদিন পর সেদিন রাতে তাদের দেখা। রাগিনী শুনেছে ফাহমিদদের পারিবারিক সমস্যার কারণে মাঝখানে পড়াশোনা বাদ দিতে হয়েছিল। তবে ছেলেটা বেশ সরল। কোহিনূরের মতো সরল বুঝি? তৎক্ষনাৎ মাথায় নাড়ায় রাগিনী। একদমই না। কোহিনূর নামক ব্যক্তিটির সঙ্গে অন্য কোনো মানবের তুলনা চলে না। মানুষটি অনন্য। ফাহমিদ বলে উঠল,
“তুমি কি কম সাহায্য করেছো? তোমার সঙ্গে এতোদিন পর যেদিন দেখা হলো অনেক রাত ছিল। আমার বাইক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এতো রাত হওয়া সত্ত্বেও তুমি আমাকে এড়িয়ে না গিয়ে সাহায্য করলে। আঙ্কেল বকেছিল না সেদিন?”
রাগিনী মাথা নাড়ায়। মিস্টি হেঁসে বলে,
“আমার বাবা তেমন মানুষ নয়। আমার সঙ্গে উচ্চস্বরে কখনো কথা বলেনি। কোনো ভুল হলে আমাকে আদর করে বুঝিয়ে দেয়। আমার বাবা পৃথিবীর সব বাবার থেকে আলাদা। হয়ত সব সন্তানের কাছেই তার বাবা-মা সবচেয়ে আলাদা!”
ফাহমিদ এবার নিরব রইল। চোখমুখের রঙ হঠাৎ করেই পাল্টে গেল তার। মুখে দেখা গেল লাল রঙের আভা। মুখটা ভার হলো। হাত মুঠো করে উঠে দাঁড়িয়ে জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
“আমার তৃষ্ণা পেয়েছে। আমি একটু পর আসছি।”
ফাহমিদ বেরিয়ে যায়। রাগিনী সেদিকে আর পাত্তা না দিয়ে টুল নিয়ে এসে এগিয়ে ছেলেটির পাশে বসে। কী মায়াবী মুখখানা। রাগিনী আলতো করে ছেলেটির গালে হাত রাখে। নিচু সুরে বলে,
“চিন্তা করো না। তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে।”
কথাগুলো বলতে বলতে রাগিনী খেয়াল করল জানালার থাইয়ের কাঁচের দিকে। দরজার পাশে কারো অবয়ব দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত কোনো পুরুষের। তার হাতের ঘড়ি চকচক করছে। তড়িঘড়ি করে পেছন ঘুরল সে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“কে? কে ওখানে?”
কারোর আওয়াজ না পেয়ে রাগিনী দ্রুত পায়ে হেঁটে গেল দরজার কাছে। পর্দা সরিয়ে কারোর অস্তিত্ব পেল না রাগিনী। দরজা দিয়ে বাহিরে এসে সবদিকে ঘুরেফিরে তাকালো। কাঙ্ক্ষিত সেই ব্যক্তিকে না পেয়ে হতাশ হলো সে। সে কি ভুল দেখলো? কীসব হচ্ছে তার সাথে? সে কি হ্যালুসিনেট করছে?
তড়িঘড়ি করে হাঁটতে গিয়ে কারোর সঙ্গে ধাক্কা খেল নির্জন। ঠোঁট চেপে চাপা গলায় বিপরীত মানুষটিকে বলে উঠল,
“সরি। দেখতে…”
পুরো কথা শেষ না করেই থামলো সে। বিপরীতে মেহরাজকে দেখে চোখ সরু হয়ে এলো তার। এবার কন্ঠে কাঠিন্য ভাব এনে বলল,
“ওহ, তুমি! চোখ কি মাথায় উপরে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াও নাকি? দেখতে পাও না?”
মেহরাজ ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে বিরবির করে বলে উঠল,
“স্যার, মানুষটা আমি জন্যই এভাবে ধমকাচ্ছেন। অথচ ধাক্কাটা আপনি মেরেছিলেন। যে বলেছিলো ঠিকই বলেছিলো, ‘নরমের উপর মানুষ গরম ঝাড়ে।'”
কথাটা নির্জনের কানে আসতেই চোখ গরম করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই মাথা নিচু করল মেহরাজ। দৃষ্টি নিচু হতেই তার নজরে এলো নির্জনের র’ক্তাক্ত হাত। র’ক্ত শুকিয়ে গেছে প্রায়। ফট করে মেহরাজ তার হাত ধরে ফেলে। আর উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
“স্যার, আপনার হাতের অবস্থাও খারাপ। একটু ড্রেসিং করিয়ে নিতে হবে তো। সবার খেয়াল আপনি রাখেন। কিন্তু আপনার খেয়ালও তো রাখতে হবে। আসুন তো আমার সাথে।”
নির্জন ধীর গলায় উত্তরে বলে,
“আমার খেয়াল রাখতে তোমার মতো একটা মাথামোটা থাকলেই চলবে।”
বলেই ঠোঁট চেপে হেঁসে ওঠে নির্জন। মেহরাজ তার হাত ছেড়ে অসহায় ভঙ্গিতে তাকায়। ভাবতে থাকে, মানুষটা তাকে ইনসাল্ট করল নাকি সুনাম করল?
সেদিন ব্যস্ত দিন কাটলো রাগিনীর। ছেলেটার দেখভাল থেকে শুরু করে ছেলেটির মাকে খবর দেওয়া থেকে শুরু করে উর্মিলা থেকে কিছু ফাইলস্ কালেক্ট করা অবধি করে আর কোহিনূরের কাছে যাওয়া হয়ে ওঠেনি তার। বাবা পৌঁছার আগে যে করে হক বাড়ি ফিরতে হবে। তাই সেদিন বাড়ি ফিরেছিল সে দ্রুতই। সবমিলিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল না খেয়েই। তবুও বাবার যত্ন থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হয়নি তার। ঘুম থেকে তুলে খাইয়ে তবেই ছেড়েছিলেন রাশেদ সাহেব। এভাবেই চলে গেল রাত। কেটে গেল প্রতিদিনের সাক্ষাৎ ছাড়া একদিন।
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৪
“রাগিনী, তোমার নাদিম আঙ্কেলের কথা মনে আছে?”
রাগিনী রাশেদ সাহেবকে সকালের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিল। তাড়াহুড়ো রয়েছে তার আজ ভীষণ। আবারও হসপিটালে দৌড়াতে হবে। তবে এর মাঝে রাশেদ সাহেবের প্রশ্নে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবুক হয়ে পড়ে রাগিনী। নামটা তার চেনা চেনা লাগছে। একটু ভাবতেই যেন স্মরণে এলো তার। বলে উঠল,
“ইন্ডিয়ায় যিনি থাকেন উনার কথা বলছো?”
“হ্যাঁ ঠিকই ধরেছো। তোমাকে বলব বলব করে বলা হয়ে ওঠেনি। ওর ছেলে তো আমাদের এখানে এসেছে। অভিরূপ চৌধুরী! তোমার চেনার কথা। তো আমি চাইছিলাম না সে আমাদের দেশে এসে কোনো হোটেলে থাকুক। তাই ভাবছিলাম আজ ওকে নিয়ে আসব।”
এবার টনক নড়ে রাগিনীর। খানিকটা চকিতে তাকায়। বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,
“নাদিম আঙ্কেলের ছেলে দ্যা ফেমাস সিঙ্গার অভিরূপ চৌধুরী?”
“হ্যাঁ। তোমার ভুলে যাওয়ারই কথা। তুমি তখন তো অনেক ছোট ছিলে।”
রাগিনী আর কোনো কথা বলল না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে ভাবলো গতকালকের ঘটনা। কীভাবে তাড়াহুড়ো আর খাপছাড়াভাবে কথাবার্তা বলে একরকম পালিয়ে এসেছে সে। ব্যাপারটা হয়ত একদম ঠিক হয়নি। এবার মুখোমুখি হলে কী হবে? এসব ভাবতে ভাবতেই নিজেকে সামলে নিল রাগিনী। যা হবার হবে। এখন এতো কথা ভাবার সময় নেই। তাকে বের হতে হবে।
সিঙ্গেল একটা বেডে উপুড় হয়ে পড়ে থেকে গভীর ঘুমে মগ্ন কোহিনূর। বেডের সাথে লাগানো জানালা দিয়ে তার মুখে রোদের তীব্র আলো পড়াতে মাথার নিচে রাখা বালিশটা মাথার উপরে মুখ ঢেকে রয়েছে সে। বেড ছোট হওয়াতে তার একটা পায়ের অর্ধেক বাহিরে চলে গিয়ে ঝুলছে। হঠাৎই তার তীব্র ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালো কেউ। মুখের উপর থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো বালিশ। ফোলা ফোলা সেই মুখে এসে পড়ল রৌদ্রজ্বল রেখাগুলো। শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল তার। কোনোরকমে সোজা হয়ে শুয়ে হাতিয়ে কাছে থাকা একটা চাদর নিয়ে মুখ ঢেকে অস্পষ্ট সুরে ধমকের সুরে বলে উঠল,
“মেহরাজ! মাথা গরম করে দিও না সকাল সকাল। এমনি বিগত কয়েকদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। মাঝখান থেকে ঘুম বিগড়ে দিলে একটানা পাঁচ দিন তোমায় রাত জাগিয়ে কাজ করে নেব।”
বলেই কাছে থাকা কোলবালিশ চেপে ধরল কোহিনূর। অতঃপর সেটা দিয়ে মুখ ঢাকল। তার মুখে বিরক্তির ছাপ প্রবল এখনো। তার বিরক্তি বাড়ানোর জন্য যেন কোলবালিশটাও চট করে টেনে নেওয়া হলো। চোখ মেলতে ইচ্ছে করল না কোহিনূরের। তীব্র রেগে বলে উঠল,
“আহহ…এমনি ঠেলায় পড়ে এই গরমে এসি ছাড়া ফ্যানের নিচে ঘুমোতে ঘুমোতে আমি শুঁকিয়ে যাচ্ছি। আর একবার যদি জ্বালিয়েছো মুখের ভেতর পরপর তিনটা গু’লি ঢুকিয়ে দেব। রাবিশ!”
“তা আপনি রি’ভলবার কোথায় পাবেন গু’লি মুখে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য?”
কোহিনূর এবার চুপ থাকে। ঘুমটা ছাড়তে চাইছে না। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবে মেয়েলি কন্ঠ শুনে নড়েচড়ে উঠল সে। শ্রবণেন্দ্রিয় কি ভুল শুনলো নাকি? বড় একটা হাই তুলে প্রশ্ন করল,
“মেহরাজ! আজকাল কি মেয়েদের কন্ঠস্বর প্র্যাক্টিস করছো? এমন মেয়ে মেয়ে লাগছে কেন?”
“বিকজ, আই এম অ্যা গার্ল। আমি রাগিনী।”
এখনো ঘুমের ঘোর কাটাতে পেরে ওঠেনি কোহিনূর। ঘুম জড়ানো কন্ঠে এবার ফট করেই বলে দিল,
“রাগিনী আবার কে?”
কোহিনূরের মুখ থেকে যখন রাগিনী নামটি বের হলো তখন মস্তিস্ক যেন এক কঠিন আ’ঘাত দিল কোহিনূরকে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে পিটা’তে থাকল। হম্বিতম্বি করে চোখ মেলে তাকালো সামনে থাকা সেই মানবীর দিকে। রাগিনী কোমড়ে হাত দিয়ে সন্দিহান হয়ে চেয়ে আছে। কোহিনূরের চোখেমুখে তখন স্পষ্ট আতঙ্ক দেখতে পায় রাগিনী। কোহিনূর ঘুমের কিছু মূহুর্তের জন্য ভুলে বসেছিল তার বর্তমান জীবন! অনেক কথায় বলে বসেছে সে। ঢক গিলে নিল এবার। চোখটা বড় বড় করে আনন্দিত হবার চেষ্টা করে বলল,
“রা…রাগের রানী, রাগের রানী। তুমি এসেছো।”
বালিশটা বিছানায় রাখল রাগিনী। কোহিনূরকে কটাক্ষ করে প্রশ্ন করল,
“এসেছি তো বটেই। কিন্তু আমাকে কার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছিলেন আপনি?”
কোহিনূর থতমত খায় এবার। ঠিক চুরি করার পর চোর ধরা পড়লে যেমন অবস্থা হয় ঠিক তেমন হয়েছে তার চেহারা। সে তার ঘন এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলোতে হাত দিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
“কার সঙ্গে?”
“মেহরাজ কে?”
কোহিনূর আবারও চুপ থাকে। কপালে পড়ে কিঞ্চিৎ ভাঁজ। একটু চুপ থেকে বলে ওঠে,
“জানি না তো। তুমি জানো!”
“আশ্চর্য! আমি কী করে জানব? আপনি ঘুমের মধ্যে বলছিলেন তার কথা।”
কোহিনূর এবার বোকা হাসি দিল। রাগিনীর হাতটা টেনে ধরে বলল,
“ঘুমের মধ্যে কত কী বলে! ওসব পাত্তা দিতে নেই। আগে বলো কাল আসো নি কেন?”
রাগিনী এবার বেডের সাইডে বসে। আর ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
“কারণ আছে নিশ্চয়। ব্যস্ত ছিলাম।”
“ব্যস্ত ছিলে নাকি থাকার চেষ্টা করছিলে?”
“ব্যস্ত ছিলাম। এখন যদি কাইন্ডলি ফ্রেশ হয়ে আসতেন তাহলে দ্রুত ব্রেকফাস্ট করে আমরা বের হতাম।”
ফ্যালফ্যাল করে তাকায় কোহিনূর। বিস্ময়ের সুরে বলে,
“কোথায়?”
“আপনার শ্বশুরবাড়ি।”
দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ে আওড়ালো রাগিনী। কোহিনূর তা শুনে মুখ হা করে অবাক হওয়ার ভং ধরে মুখে হাত দিয়ে বলল,
“এতো বড় অপবাদ তুমি দিতে পারলে? আমি বিয়েই করলাম না আর তুমি শ্বশুড়বাড়ি বানিয়ে দিলে।”
সরু চোখে তাকালো রাগিনী। কোহিনূর বালিশ সরিয়ে এগিয়ে রাগিনীর কাছে এসে বসল। রাগিনীর দিকে একটু ঝুঁকে বলল,
“বাই এনি চান্স তুমি আমাকে ফাঁসানোর প্ল্যান করছো না তো? লাইক আমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করা? হয়, হয়। আমার মতো একটা ড্যাশিং ছেলেকে সামনে দেখলে সব মেয়েরই এমন ইচ্ছা জাগে। এটা তোমার দোষ নয়। আমার এই হ্যান্ডসাম লুকের দোষ।”
কোহিনূর নিজের মাথার চুল স্টাইলের সাথে ঠিক করতে থাকলো বেশ ভাবসাব নিয়ে। রাগিনী তবুও চুপ রইল। কোহিনূরের কথা শেষ হবার পর সে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসি দিয়ে বলে,
“বর্তমানে আপনার এই অ্যামাজন জঙ্গলের মতো চুল, আলুর থেকে বেশি ফুলে যাওয়া চোখমুখ দেখলে আপনার জন্য পাগল হয়ে যাওয়া সো কলড মেয়েরা দৌড়ে পালাবে। বিলিভ মি!”
তৎক্ষনাৎ কোহিনূরের হাতটা চলে যায় তার মুখে। আসলেই তাকে এমন লাগছে! কি বিশ্রী ব্যাপার। প্রেস্টিজ সব ফুটো হয়ে গেল। রাগিনী মেয়েটা শান্ত ভাবে কী করে বাঁশঝাড় গছিয়ে দিতে হয় সেটা বেশ ভালো করে জানে। সে কথাটুকু বলার পর একেবারে সাইলেন্ট মুডে চলে গেছে। আর কোহিনূর সে আর বিলম্ব না করেই উঠে দাঁড়িয়ে ছুট লাগালো ওয়াশরুমে। তার কান্ড দেখে পিছনে বসে থাকা রাগিনীর মুখে ফোটে চাপা হাসি। মুখে হাত দিয়ে হেঁসে ফেলে ঝংকার বয়ে যায় ছোট্ট ঘরে। হাসতে হাসতে বলে ওঠে,
“পাগল লোকটা একটু বুঝতে পারতেন যে উনার ঘুম থেকে ওঠার পর ফুলিয়ে রাখা চোখমুখে কঠিন স্নিগ্ধতার ছোঁয়া লেগে ছিল তবে হয়ত এতো তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হতে যেতেন না।”
কোহিনূর তখন টাওয়াল নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করল। টাওয়াল মুখ থেকে সরিয়ে বেডের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই চোখ ছানাবড়া হলো তার। দ্রুত নিকটে এসে বসল ধপ করে। রাগিনী দুটো টিফিনবক্স থেকে একেক পদের খাবার বের করতে আরম্ভ করেছে। খাবারের পদ যেন শেষ হচ্ছে না। দুটোই বড় বড় টিফিনবক্স। কোহিনূর আশ্চর্য হয়ে বলে,
“তুমি কি শুধু আমাকে খাওয়াতে এসব এনেছো নাকি আজকে এখানকার সবাইকে খাওয়ানোর প্ল্যানিং করেছো?”
রাগিনী একটা একটা করে সবচেয়ে শেষের বক্সের পার্ট খুলে রেখে কোহিনূরের দিকে মাথা উঠিয়ে তাকায়। ছেলেটার কপালে এখনো বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা। চুলের কিছু অংশ ভিজে নেতিয়ে পড়েছে। রোদের আলোয় পানির ফোঁটাগুলো কেমন চিকচিক করছে। রাগিনীর হাত যেন আপনাআপনি চলে গেল কোহিনূরের চুলে। বেশ উচ্ছ্বাসে সাথে ঝেড়ে দিল চুলের পানি। তার মুখ দেখে মনে হলো বেশ মজা পেয়েছে সে। কোহিনূর নিজের মাথা নিচু করে বেশ কোমল সুরে বলে ওঠে,
“ম্যাসাজে খুব আরাম লাগল। আরো ম্যাসাজ করে দিতে পারো। মাইন্ড করব না। বিনা ফি তে এতো সুন্দর কোমল হাতের ম্যাসাজ কে না চায়!”
রাগিনী ভ্রু আর নাক কুঁচকায়। তারপর হাত বাড়িয়ে কোহিনূরের চুল ফট করে টেনে বলে ওঠে,
“আরো লাগবে?”
মাথা সোজা করে চুলগুলো সযত্নে নেড়ে ঠিক করে কোহিনূর। কিছু বলার আগেই রাগিনী আবারও খাবারের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে বলে,
“মনে আছে? আপনি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন? ওইতো সেদিন গ্রামের রাস্তায় পুলিশের লোকের এট্যা’ক থেকে। আপনি বলেছিলেন না? আপনার জন্য অন্তত পাঁচ আইটেমের খাবার করে আনতে? আমার মন আবার অনেক বড়। তাই দশ আইটেমের খাবার এনেছি। আজকে এগুলো না শেষ করে উঠলে আমি আপনাকে ধরে বেঁধে খাওয়াব।”
কথাটা কোহিনূরের কর্ণকুহরে আসা মাত্র তার হাত চলে যায় পেটে। দৃষ্টিও নিচু হয়ে পেটে চলে আসে। কত পারফেক্ট তার বডি! কোনো মেদের চিহ্ন নেই পেটে। এই পেটে এতোগুলো খাবার ঢুকলে ঠিক কী কী হতে পারে ভেবেই বিষম খেয়ে ওঠে সে। চেহারা জড়িয়ে তুলে ক্লান্ত আর ব্যথিত ভঙ্গিমায় আধশোয়া হয়ে বলে,
“আমার শরীর আজকে ভালো নেই। মাথাব্যথা, পেট ব্যথা! আজকে না হয় থাক। অন্য একদিন এসব হবে। আমি তো ওসব মজা করে বলেছিলাম।”
রাগিনী একটা খাবারের বাটি হাতে তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“খুব খাওয়ার শখ আপনার। আপনার আজকে পুরো শরীর ব্যথা করলেও ছাড়ব না। এখনি আজিম আর পলাশ ভাইকে ডেকে আপনার দুহাত বেঁধে মুখে ঠুসে দেব। ডিসিশন ইজ ইউরস।”
কোহিনূর কিছু বলতে গিয়েও পারে না। ফেঁসে গেছে নিজেরই বলা কথায়। সে উঠে সোজা হয়ে বসে বাটি ধরে। লোভনীয় সব খাবারই। তবে এতোগুলো পেটের কোন স্থানে জমা হবে সেটাই সে ভেবে উঠতে পারছে না। কোহিনূর আরো কিছু বলতে উদ্যত হয়। তাকে থামিয়ে রাগিনী আগেই বলে ওঠে,
“খাবার পর কথা হবে। স্টার্ট করুন।”
কোহিনূর খাবার দেখে জোরপূর্বক হাসে। শেষবারের মতো নিজের পেটের দিকে তাকায়। পেট এবার শহীদ হতে চলেছে। একটা খাবার হাতে তুলে খাওয়া শুরু করে সে। বুঝতে বাকি থাকে না মেয়েটা পাকাপোক্ত পরিকল্পনা করে এসেছে কোহিনূরের খাবার আবদার সারাজীবনের জন্য ঘুচিয়ে দেওয়ার। এই প্রথম কোহিনূরের এতো খাবার দেখে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কাঁদলেও এক নারীর সামনে মানসম্মানের দফারফা হয়ে যাবে! সব দিকেই যেন বিপদের অন্ত নেই।
জানালের ধারের সামান্য জায়গায় বেশ ভালোমতো বসেছে অভিরূপ। পরনে একটা চকলেট কালার টিশার্ট আর কালো টাউজার। সদ্য শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে সে। তার চুলগুলো একটু বড় বড় এবং ঝাঁকড়া হওয়ায় শুঁকাতে সময় লাগে কিছুটা। তাই ভেজা গুলো খুব সুন্দরভাবে সামনের সবটা কপাল পড়ে থেকে ভ্রু জোড়াও ঢেকে দিয়েছে। ছোট ছোট দুটো চোখ বন্ধ। মনোযোগ পড়েছে গিটারের সুরে এবং চোখ বন্ধ করে এঁকেছে সেই সাহসী দৃষ্টি। সেই টানা চোখে ভয়হীন এক নজর কেন যেন ভুলতেই পারা যায় না। মন মেতেছে এক গানে।
“Pehli nazar mein
Kaise jaadu kar diya
Tera ban baita hai Mera jiya..”
এই গানটা যেন সেই রাগযুক্ত রাজরানীর জন্যই বানানো। প্রথম নজরেই কাবু করার ক্ষমতা রয়েছে তার। চোখ মেলে আকাশে তাকালো অভিরূপ। স্বচ্ছ সেই মেঘেও যেন সেই নেত্রপল্লবের প্রতিচ্ছবি। অভিরূপ দৃষ্টি বানিয়ে নিল। মুখ খুলে গেয়ে উঠল,
“Jaane kya hoga
Kya hoga kya pata
is pal ko milke Aa jee le zara…”
আর গাওয়া হলো না অভিরূপের। থামালো সে গিটারে সুর তোলা। হাত বাড়িয়ে একটু দূরে থাকা নরম বিছানায় গিটার রাখল। গভীর কিছু চিন্তা করে ভাবল,
“কেন যেন আপনার সেই অস্থির দৃষ্টির থেকে আপনার ভয়হীন দৃষ্টি আমার কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠেছে। কেন আমি জানি না। বার বার মন চাইছে সেই দৃষ্টিটাকে যদি কোনোভাবে বন্দি করতে পারতাম। সারাদিন পলকহীন ভাবে সেই দৃষ্টি দেখে কাটিয়ে দিতে পারতাম।”
“সিউর হলাম। আমি একটা আস্ত পাগলের সাথেই থাকি। এতোদিন একটু হলেও ডাউট ছিল। বাট নাউ আই এম সিউর। একা একা কথা বলতেও শুরু করে দিয়েছে।”
নিজের ভাবনায় মাঝে ব্যাঘাত ঘটায় চোখেমুখ কুঁচকে ওয়াশরুমের দিকে তাকালো অভিরূপ। নোমান সবে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। পরনে শুধুমাত্র একটা খয়েরী টাওয়াল আর আরেকটা টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছে চলেছে অনবরত। এখনো আধভেজা শরীরে ঘরে এলো নোমান। অভিরূপ নোমানের কথার জবাব দিয়ে বলল,
“পাগলের সাথে ঘুরলে তো পাগল হবোই তাই না?”
চুল মুছতে মুছতে থামলো নোমান। ঘাড় ঘুরিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“আমি তোর মতো নই। তোকে সামলাতে আমি আসলেই কোনদিন যেন পাগল হই।”
অভিরূপ ভেংচি কাটে এবার বাচ্চা ছেলেদের মতো। অতঃপর গিটারে হাত দিয়ে বলে,
“যাহ্। তোকে এবারের মতো তর্কে জিততে দিলাম। শুধুমাত্র আমার গিটারটা আনতে মনে রেখেছিস বলে। তুই কী করে জানলি এটা আমার লাগবে?”
“এটা তোর সঙ্গে আমার পরিচয় হবার পর থেকে হয়ে আসছে। যে তোর কী কী দরকার তোর নিজের থেকে বেশি আমাকে জেনে নিতে হয়।”
সহজ ভাবে বলে দিল নোমান। এবার সোফায় সেভাবেই গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘাড়ে নিজেই জোরে চাপ দিতে থাকল। ঘাড় ব্যথা করছে তার। চোখ একটু মেলতেই অভিরূপের ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে মারা চোখে পড়তেই সে তড়তড় করে বলে উঠল,
“ওগুলো তোর কাছেই রাখ। আমার লাগবে না। গার্লফ্রেন্ড বা বউ পেলে তাকে দিস। এসব স্টুপিড জিনিস লাগবে না আমার।”
বলেই একটু থেমে থেমে সে আবার বলল,
“কাল থেকে এতো দখল গেছে যে এখনো ঘাড়ের ব্যথা সাড়েনি।”
এবার ফোনের রিংটোন বেজে উঠল সজোরে। দুজনেরই নজর দুজনের ফোনের দিকে গেল। অভিরূপের ফোন বাজছে। অভিরূপের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ল। আন্দাজ করতে পারল কিছু। তবুও সাহস করে উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে ধরতেই স্ক্রিনে নজর পড়তেই বুঝতে পারে সে যা ভাবছিল তাই। কিন্তু কল ইগনর করার উপায় নেই। এর পরিণতি আরো বাজে হতে পারে। সে ফোনটা রিসিভ করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“হ্যালো, বাবা।”
ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো বয়স্ক কন্ঠ ভেসে এলো এবার।
“আমি জানতাম। এমন কিছুই ঘটবে। তুমি তো আমার কথা এই জন্মে কোনোদিন শুনবে না বলে ঠিক করে রেখেছো। আমার হেঁসেই উড়িয়ে দেওয়া যায়। ফলাফল দেখো এখন। কোথাও লেগেছে নাকি তোমার?”
এতো ঝাঁঝ পূর্ণ কন্ঠ হজম হলো না অভিরূপের। ফোনটা কান থেকে একটু দূরে ধরে চুপসানো মুখে নোমানের দিকে তাকায় সে। অভিরূপের উত্তর না শুনতে পেয়ে ওপাশ থেকে আবার কঠিন সুরে ভেসে আসে নাদিম সাহেবের গলা।
“অভি! তুমি শুনেও এন্সার করছো না। আমাকে রাগিয়ে দিও না। ভালো করে বলছি যত তাড়াতাড়ি পারো আমাদের এখানে চলে এসো। আমার কথাটা শোনো এবার।”
অভিরূপ এবার বেশ ভেবেচিন্তে কন্ঠস্বর চিকন করে মেয়েদের মতো করে বলার চেষ্টা করল,
“হ্যালো, হ্যালো! হু আর ইউ? কে আপনি? রং নম্বরে ফোন করেছেন। ডোন্ট কল মি এগেইন। আন্ডারস্ট্যান্ড?”
বলেই তড়িঘড়ি করে কল কাটলো অভিরূপ।
ওপাশ থেকে হতভম্ব হলেন নাদিম সাহেব। হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলেন ফোনের দিকে। উনার রাগ বাড়ল এবার। সবে ঘরে প্রবেশ করছিলেম উনার স্ত্রী অর্থাৎ অভিরূপের মা মিসেস. সুরভী। তাকে দেখতে পেয়ে তৎক্ষনাৎ নাদিম সাহেব কাঠকাঠ গলায় বলে উঠলেন,
“তোমার ছেলেকে দেখেছো? কত বড় সাহস হয়েছে। আমার মুখের উপর কল কেটে দেয়। আর বলে কিনা আমি রং নম্বরে কল করেছি!”
“ও তো ওমনই দুষ্টু ছোটবেলা থেকে। একটু বুঝিয়ে বলছি আমি। ফোনটা আমায় দাও। ওখানে থাকা ওর সেফ নয়।”
মিসেস. সুরভীর বলা কথা নাকচ করলেন নাদিম সাহেব। আবারও অভিরূপের নম্বরে কল লাগিয়ে বলে বললেন,
“তোমার এই নরম সুর শুনলে তোমাকেই উল্টে কনভিন্স করে দেবে। আমিই ওকে বলছি।”
ক্ষ্যান্ত হলো না অভিরূপ। ফোনটা বেজে উঠতেই হাতটাও কেঁপে উঠল তার। কী করবে ভেবে আর পাচ্ছে না। নোমানের দিকে দৃষ্টি পড়তেই মুচকি হাসলো। ছুটল নোমানের দিকে। তাকে পেছন থেকে ধরে মিনতির সুরে বলল,
“ম্যানেজ করে দে এবারের মতো প্লিজ! প্লিজ!”
আকস্মিক ঘটনায় হতবাক হয়ে নোমান নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। সেও এখানে থাকতে চায় না। এখানে থাকা মানে বিপদ বয়ে আনা। তাই সে বলল,
“ইম্পসিবল। যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বিদায় নেওয়া যায় তত ভালো। পারলে আমি আরো কল করে আঙ্কেল কে বলব যাতে দ্রুত দেশে ফিরতে পারি।”
“এমন করিস কেন আমার সাথে? দ্যাটস্ নট ফেয়ার ইয়ার।”
“ফেয়ার আনফেয়ার বুঝি না। ছাড় তো আমাকে।”
দুজনের একপ্রকার ধস্তাধস্তি লেগে যায়। ফ্লোরে দুজনই শুয়ে পড়ে। অভিরূপ নোমানকে চেপে ধরে বলে,
“দে না ভাই প্লিজ! আমার এদেশে থাকা দরকার। ওই মেয়েটার দেখা না পেলে তোর বন্ধুর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!”
“তুই উঠবি আমার উপর থেকে? নাকি খাবি কয়েকটা কি’ল ঘু’ষি? দেখ এই মূহুর্তে আমার উপর থেকে না উঠলে আমার টাওয়াল খুলে যাবে। ইজ্জত রাখ একটু।”
অভিরূপ ছাড়ার পাত্র নয়। টাওয়াল কথা টা শুনে শয়তানি বুদ্ধি মাথায় চাপে তার। ফট করেই নোমানের পড়ে থাকা টাওয়ালে হাত দিয়ে বলে,
“আজ তুই আমাকে বাঁচাবি নয়ত তোর ইজ্জতও বাঁচবে না!”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৫
“সাইকোর বাচ্চা! সর বলছি। ইজ্জত নিয়ে টানাটানি শুরু করছে। অভি, ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
অভিরূপকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল নোমান। তবে কে শোনে কার কথা। অভিরূপের বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটেই গেছে। আবারও নাদিম সাহেব কল করছেন। অভিরূপ জোর গলায় বলল,
“তুই যদি না চাস তোর বউয়ের আগে আমিই সব দফারফা করে ফেলি তাহলে আমাকে হেল্প কর। হেল্প মি অ্যান্ড টেক ইউর ইজ্জত ফর ইউর ফিউচার বউ।”
নোমান ক্লান্ত প্রায়। হাত-পা ছেড়ে দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকে। অভিরূপ তার এমন আচরণ দেখে টাওয়াল আরেকটু টেনে বলে,
“কী হলো? কী চাচ্ছিস?”
নোমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত উঠিয়ে বলে,
“দে। তোর ফোনটা দে আমাকে।”
বিশ্ব জয়ের হাসি ফোটে অভিরূপের মুখে। কী ঝলক তার হাসির! ফোনটা সেভাবেই হাত থেকে নোমানের হাতে তুলে দেয়। নোমান ফোনটা কোনোরকমে রিসিভ করতে যাবে সেই সময় এক চিৎকারে দুজনেই ঘাবড়ে দরজার কাছে তাকায়। দরজায় ট্রে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। সম্ভবত হোটেলের সার্ভেন্ট হবে। মেয়েটির রসগোল্লার মতো চোখ বলেই দিচ্ছে অভিরূপ আর নোমানের এই ভঙ্গি সে অন্য কিছুই ভেবে নিয়েছে। নোমান আর অভিরূপ দুজন দুজনের দিকে ভ্যাবলার মতো তাকায়। তখনি মেয়েটির হাতে থেকে হুড়মুড় করে ট্রে সহ কাঁচের চায়ের কাপ ফ্লোরে পড়ে খন্ড খন্ড হয়ে যায়। বিকট শব্দ হয়। দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলে মেয়েটি। কাঁপা এবং উত্তেজিত সুরে বলে,
“আই এম সরি, আই এম সরি। আমি বোধহয় ভুল সময় এসে পড়েছি। ক্ষমা করবেন।”
মেয়েটিকে আর পায় কে? ধড়ফড় করে বেরিয়ে যায় মেয়েটি। নোমান এবার এক পা আর দুটো হাত দিয়ে অভিরূপকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে বলে,
“হলো তো? মেয়েটা কি না কি ভেবে নিয়েছে গড নোজ! ছি! অভি, তোর জন্য কোনো আজব খবরে ফেঁসে যাই তাহলে কিন্তু সব মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থুথু মারবে, সাথে তোকেও!”
অভিরূপ তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটাকে আটকাতে যায়। বাহিরে বেরিয়েই দেখে মেয়েটা করিডোরের শেষ মাথায়। একটু জোরেই অভিরূপ ডেকে ওঠে,
“ওহ হ্যালো!”
অভিরূপের ডাকে হাঁটা থামে মেয়েটার। পেছন ফিরে তাকিয়ে অভিরূপকে দেখে আরো জোরে হাঁটা ধরতেই অভিরূপ এবার আরো জোর সুরে ডেকে ওঠে,
“আই সেইড স্টপ!”
অভিরূপ চৌধুরী! তার জনপ্রিয়তা যে কত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই হোটেলে তার কথা অগ্রাহ্য করা মানে চরম সাজাও পেতে হতে পারে। তাই হয়ত মেয়েটা থামে। কাঁপতে কাঁপতে অভিরূপের দিকে ফিরে। অভিরূপ দূর থেকেই বলে,
“আপনি কিছু দেখেন নি ওকে? উই আর বেস্টফ্রেন্ড! জাস্ট কিডিং! সো প্লিজ আজগুবি কিছু ভেবে নিজের মাথা খারাপ করবেন না।”
মেয়েটা জোরে জোরে মাথা নাড়াতেই অভিরূপ আবারও বলে,
“আর যেসব ফেলে দিয়েছেন তা পরিষ্কার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। ডোন্ট প্যানিক! আই উইল পে। যা ভেঙেছে তার জন্য চিন্তা করবেন না।”
মেয়েটি এবারও মুখে কোনো কথা না বলে শুধু মাথা ঝাঁকিয়েই তড়িঘড়ি করে চলে গেল। অভিরূপ হাঁপ ছেড়ে রুমে ফিরে আসে। নোমানের দিকে চোখ পড়তেই খেয়াল করে নোমান টাওজার পড়ে নিয়েছে। অভিরূপকে দেখে বাঁকা হাসি দিল নোমান। তার হাসির অর্থ, অভিরূপ আর তার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করতে পারবে না। কিন্তু অভিরূপ কি কম যায়? দুজনেই যেন আবারও ধস্তাধস্তি লেগে যায়। যে জিতবে সে ঠিক করবে নিজের দেশে ফিরবে কি না!
উপুড় হয়ে পেট ধরে মুখটা বালিশের সঙ্গে চেপে শুয়ে আছে কোহিনূর। নড়াচড়া করাও তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পেটে পাথর রেখে দিয়েছে কেউ। মাঝে মাঝে হালকা করে ‘উহ’ করে শব্দ করে উঠছে সে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে একবার মাথা এদিক আর একবার ওদিক করছে। সামনেই ঠোঁট চেপে হেঁসে দাঁড়িয়ে আছে রাগিনী। একটু একটু করে পেটে সব খাবার ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে সে। এবার কোহিনূরের অবস্থা দেখে হাসিটা এসে যাচ্ছে বার বার। গত আধঘন্টা ধরে সে এভাবেই শুয়ে রয়েছে। আর মাঝে মাঝে পেট ধরে মোচড়াচ্ছে। রাগিনী মিটমিটিয়ে হেঁসে জিজ্ঞেস করল,
“আর ইউ ওকে?”
কোহিনূর ব্যথিত সুরে বলে,
“মানুষ কাউকে বি’ষ দিয়ে মা’রে। কাউকে রি’ভলবার দিয়ে মা’রে আবার কাউকে ছু’রি দিয়েও মারে। কিন্তু ভালো ভালো খাবার খাইয়ে কী করে কাউকে মা’রতে হয় সেটা তোমার থেকে শেখা উচিত।”
রাগিনী এবার হাসতে গিয়েও থামে। এখন হাসা মোটেও ঠিক হবে না। ঠোঁট কামড়ে হাসি নিবারণ করার চেষ্টা করে। কোহিনূরের চোখে এই দৃশ্য আঁটকায়। সে আগ বাড়িয়ে বলে,
“হাসো হাসো। আরো হাসো। এবার হাসির মাধ্যমেও খু’ন করে দাও। এটাই বাকি রেখেছিলে।”
এবার আশ্চর্য হয়ে হাসি থামায় রাগিনী। উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে,
“হাসিতে আবার কে খু’ন হয়? এবার বলবেন না আমার হাসিতে বি’ষ মিশিয়ে রেখেছি।”
কোহিনূর আধশোয়া হয়ে ধীরে মাথা ঝাঁকায়। উত্তরে বলে,
“এটার বি’ষের মারাত্মক কিছু। এটা হতে পারে আসক্তি। যেখানে আমি বাঁধা পড়েছি।”
“আপনার মনে কী এমন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতির আগমন ঘটেছে আমার জন্য?”
বাঁধাবিহীন বলে ফেলা কথাগুলো এবার কোহিনূরকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয় যেন। ঢক গিলে চোখ বন্ধ করে আবারও পেট চেপে ধরে ‘উহু’ বলে ওঠে। রাগিনীর বুঝতে সময় লাগে না যে এই ব্যক্তি হতে পারে তার কথার কিছুই বোঝেনি আবার হতে পারে বুঝতে চেয়েও সেটা এড়িয়ে যাচ্ছে। তাই সেও আর না ঘাঁটিয়ে নিজেকে সংবরণ করে বলে,
“আরো খাবেন না খাবার?”
“প্রশ্নই ওঠে না। পেট ব্যথা করা শুরু করে দিয়েছে। আমি এবার থেকে পারলে না খেয়ে থাকব তাও তোমার মতো বিপদজনক নারীকে খাবার আনতে বলব না।”
“আচ্ছা শুনুন। চলুন একটু সিটি হসপিটাল থেকে ঘুরে আসি। এই বাহানায় আপনাকে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার জন্য চেক আপও করিয়ে নেওয়া যাবে!”
“তোমার সাথে গিয়ে আরো রিস্ক বাড়াতে পারব না সরি। বলা যায় না আবার গাড়ির ব্রেকফেল করিয়ে আমাকে মা’রার পরিকল্পনা করতে পারো!”
রাগিনী চোখমুখ জড়িয়ে বিরক্তির সুরে বলে,
“ধুর। আমি সিরিয়াস। আমাকে ওই বাচ্চা ছেলেকে দেখতে যেতে হবে। আমি ওকে কাল রেসকিউ করেছিলাম। আজকে দেখতে না গেলেই নয়। আপনিও যাবেন আমার সঙ্গে।”
কোহিনূর পেট ধরেই উঠে বসে। বাধ্য ছেলের মতো বলে,
“আপনি যখন বলেছেন তখন কোহিনূর যেতে বাধ্য। এখন সেটা হসপিটাল হক বা এভারেস্ট! রাগিনী তাজরীনের আদেশ শিরোধার্য!”
কোহিনূর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে যখন হাতে একটা টিশার্ট নিতে যায় তখন তার হাতের ব্যান্ডেজ এবার নজর এড়ায় না রাগিনীর। হুট করেই এমন ব্যান্ডেজে কিছুটা অস্থির ভঙ্গিতেই ছুটে এসে কোহিনূরের ব্যান্ডেজ করা স্থান আলতো স্পর্শ করে সে। অস্থিরতার সাথে বলে,
“কী করে এমন হলো?”
“তেমন কিছু না। হুট করেই কাঁচ লেগে কে’টে গেছে।”
রাগিনীর মুখটা নিমিষে বিষিয়ে যাওয়া লক্ষ্য করে কোহিনূর। মেয়েটা এতো নরম মনের কেন? সামান্য আ’ঘাতের কারণে বুঝি এতো ব্যাকুল হতে হয়? রাগিনী বলে,
“নিজের একটুও খেয়াল রাখেন না তাই না?”
ব্যাকুলতায় ভরা সেই কন্ঠ। মেয়েটা বুঝি জানে না তার এমন কন্ঠ কোহিনূরের অন্তর কাঁপিয়ে তোলে? কোহিনূর একটু মাথা ঝুকিয়ে ধীর গলায় বলে,
“খেয়াল রাখার জন্য যখন এতো সুন্দর একটা মানবী থাকে তখন আর নিজের খেয়াল রাখতে ইচ্ছে করে না।”
মুখটা ভেঙ্গিয়ে কোহিনূরের বাহুতে হালকা ধাক্কা মারে রাগিনী। বিষণ্ণ হয়ে বলে,
“সবসময় মজা করেন আপনি।”
“আর করব না। তাহলে কি আমরা যেতে পারি?”
রাগিনী কোহিনূরের দিকে একটু তাকায়। তারপর পায়ের গোড়ালি উঁচু করে একটু উঁচু হয়ে কোহিনূরের চুলে হাত দিয়ে চুলগুলো একপাশ করে দিয়ে বলে,
“এবার চলুন।”
অন্ধকার ঘর। ঠিক ঘর নয়। একটা গুমোট জায়গা। অদ্ভুত একটা গন্ধ। জায়গাটির চারিপাশে বস্তা সাজিয়ে রাখা। আলো বলতে শুধুমাত্র উপরে থাকা এক ফাঁকা জায়গা থেকে আলো প্রবেশ করছে। যা দিয়ে একটু ঝাপ্সা দেখাচ্ছে সবটা। মাঝখানে রাখা দুটো কাঠের চেয়ার। আর পাশে একটা টেবিল। দুটো চেয়ারই দখল করে বসে আছে এক কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি। প্রসারিত তার দেহ। ঘাড় বাঁকিয়ে রাখা। পা দুটো অন্য চেয়ারে রেখে দিয়ে এক হাতে গ্লাস আর অন্যহাতে সিগারেট ধরিয়ে বসে আছে সে। চোখ দুটো বন্ধ। ঘাড় কাঁত করেই বসে থাকা সেই অজানা মানব চোখ বুঁজেই একবার সিগারেটে মুখ লাগাচ্ছে আর একবার হুইস্কি ভরা গ্লাসে। দরজায় একটু শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল নেত্রপল্লব। কড়া এবং ধারালো দৃষ্টি চলে গেল দরজার কাছে। ধীর পায়ে প্রবেশ ঘটল এক নারীর। স্বভাবতই মুখে মাস্ক আর মাথাটা স্কার্ফ দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা। চোখে আজ সানগ্লাসও রয়েছে। সেখানে প্রবেশ করার সাথে সাথে সানগ্লাস খুলে হাত নিল সে। মাস্ক খুলল। দৃশ্যমান হলো তার ফ্যাকাশে, চুপসে যাওয়া মুখ। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো সেই ধারালো দৃষ্টির দিকে চাইতেই। নিজের চোখ নামিয়ে নিল সে। না চাইতেও সেই মানবের সামনে এসে দাঁড়াতে হলো। লোকটির নিরবতা দেখে সে নিজেই বলে উঠল,
“আ…আসলে আমরা বু…বুঝতে পারিনি আমাদের প্ল্যানিং এভাবে ফেল করবে। স…সরি ডার্ক…”
অসম্পূর্ণ থেকে যায় মানবীর কথা। ডার্ক ম্যাক্স তার পা রাখা চেয়ারটা পা দিয়ে ঠেলে দিয়ে শান্ত গলায় বলে,
“বস, লেডি বস।”
দাঁড়িয়েই রইল লেডি বস নামক নারী। আসলে তার বসতেও ভয় করছে। সে জানে এখানে ভালো কোনো কিছুর জন্যই ডাকা হয়নি। তার কোনোরকম হেলদোল না দেখে ডার্ক এবার কিছুটা চিৎকার করেই বলল,
“বস বলছি।”
এবার চমকে উঠল সে। চেয়ার টেনে নিয়ে আস্তে করে বসল। তার বসা দেখে সোজা হলো ডার্ক ম্যাক্স। সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরে আবারও টান দিতেই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হলো আশপাশ। মেয়েটি মাথা নত করে বসে রইল। এবার তাকে শান্তভাবে প্রশ্ন করা হলো,
“এবার বল। কেন প্ল্যানিং ফেল হলো?”
“আমাদের আ’ক্রমণের আশঙ্কা ধরতে পেরে হয়ত ইন্সপেক্টর রায়ান আগে থেকেই আমাদের বোকা বানানো শুরু করে। অভিরূপের যেই গাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল সেটা হাইড রাখা হয়। অন্য একটা গাড়িকে এতোটাই প্রায়োরিটি দেওয়া হয় আর বলা হয় সেই গাড়িতেই অভিরূপ যাবে। তাই আমি কথা অনুযায়ী সেই গাড়ির নিচে বো’ম ভর্তি ব্যাগ রেখে দিই। কিন্তু লাভ হয় না। অভিরূপের একটুও ক্ষতি হলো না। আমরা হা’মলা করি। অভিরূপের গাড়িটাকে আঁটকায়। ভেবেছিলাম, পরিস্থিতি আমাদের হাতেই আসবে। কারণ পসিবিলিটি আমাদেরই ছিল। কিন্তু হুট করে আরেক টিম এলো। পুলিশ টিম শক্ত হলো। আমরা পেরে উঠলাম না। আর আমাদের টিমের অনেকজনের মৃ’ত্যু হলো। কেউ কেউ এখন কাস্টারিতে।”
উঠে দাঁড়ালো ডার্ক ম্যাক্স। তা দেখে ধড়ফড়িয়ে মেয়েটিও উঠতে লাগল তবে তার কাঁধে হাত রেখে জোর করে বসিয়ে রাখা হলো। চমকে উঠল সে। সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল। ডার্ক তার চেয়ারের চারিপাশে হাঁটতে লাগল। সবশেষে তার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে তার চিবুক চেপে ধরে ডার্ক বলতে লাগল,
“এজন্যই তোকে আমি একটা আলাদা কাজ দিয়েছিলাম! ওই রায়ানকে শেষ না করতে পারিস। অন্তত একটু হসপিটালে কয়েকদিনের জন্য পাঠিয়ে দিতে পারতিস। সেটাও তুই পারিস নি।”
তার চিবুক জোরে চেপে ধরা হয়েছে। চোখমুখ খিঁচে রেখেছে সে। কথাটির উত্তর দিতে সে উদ্যত হচ্ছে তবে তার আগেই গলায় চলে গেল ডার্কের বলিষ্ঠ হাত। চেপে ধরা হলো গলা। শ্বাসরোধ হতে লাগল স্কার্ফ পরিহিতা মেয়েটির। ছটফটিয়ে উঠল। হাত-পা চারিদিকে ছুটতে শুরু করল। ছটফটানিতে মাথা থেকে পড়ে গেল স্কার্ফ। বেরিয়ে এলো তার ছোট সিল্কি চুল। খুব একটা বড় নয় তার চুল। স্ট্রেইট কাঁধ অবধি। একটা সময় ছিল যখন ডার্ক তার চুলও কেটে দিয়েছিল। তবে আজ সে বাঁচার আশা দেখতে পাচ্ছে না। চিৎকার করার চেষ্টা করছে তবে ব্যর্থ হচ্ছে। যখন তার সবটা অন্ধকার তখন তার গলা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল ডার্ক। একটা হাত নিজের প্যান্টের পকেটে গুঁজে পিছন ফিরে হাতে কাঁচের গ্লাসটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে টেবিলে বাড়ি দিয়ে ভাঙতেই গ্লাসটা টুকরো হয়। তার অর্ধেকটা ভেঙে যায় আর অর্ধেকটা থেকে যায় ডার্কের হাতে। বিকট শব্দে চমকে গিয়েও মুখ দিয়ে টু শব্দও বের করতে পারে না লেডি বস। চোখ বুঁজে বড় বড় শ্বাস নিতেই সে ব্যতিব্যস্ত। সেই সুযোগে গ্লাসের ভাঙা এবং ধারালো অংশ হুট করেই চেপে ধরা হয় লেডি বসের হাতে। প্রাণ ফিরে পেতেই যেন আবারও প্রাণ হারা’তে বসেছে সে। নিজের মুখ চেপে ধরেছে সে অন্যহাত দিয়ে। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পড়ে যাচ্ছে অশ্রু। চিৎকার করলে আরো ভয়াবহ কিছু দাঁড় করাবে ডার্ক তার সামনে। চলছে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা। কিন্তু ডার্ক ম্যাক্স হয়ে উঠেছে হিংস্র। চোখে স্পষ্ট নিষ্ঠুরতার ছাপ। পাগল হয়ে উঠেছে একপ্রকার।
মিনিট দুয়েক এভাবে চলে। লেডি বসের হাত থেকে গলগল করে র’ক্ত পড়তে থাকে। ডার্ক তাকে ছেড়ে দিয়ে গ্লাসের বাকি অংশও ছুঁড়ে মে’রে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নিজের হাতটা দেখে নিজেই আঁতকে ওঠে লেডি বস। তার চাপা আর্তনাদ শোনার মতো কেউ নেই। সে স্বেচ্ছায় এই দলে যুক্ত হয়েছে। তার মৃ’ত্যুও হবে এই ভয়ানক মানুষটির হাতেই। হাত দিয়ে চাপা আর্তনাদ করে ওঠে সে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মুখে দেখা যায় লাল আভা। ব্যথিত দৃষ্টি! ডার্ক তার দিকে ফিরে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে,
“অভিরূপের মৃ’ত্যু না দেখে আমার শান্তি নেই। তোরও রেহাই নেই। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ। অভিরূপ চৌধুরীর মৃ’তদেহ যাবে এই দেশ থেকে। ভয় দেখতে চাই আমি। মানুষের চোখে ভয় আমার খুবই প্রিয়। কখন কীভাবে অভিরূপকে মারবি আমি জানি না। শুধু চাই র’ক্ত আর ভয়!”
গাড়ি থেকে নামল রাগিনী আর কোহিনূর। চোখমুখটা দেখার মতো হয়েছে কোহিনূরের। এতো খাবার পেটে রয়েছে যেন নড়তেও কষ্ট হচ্ছে। হাঁটতে গেলেই আগে বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। তা দেখে ক্ষণে ক্ষণে হাসছে রাগিনী। কোহিনূর আঁড়চোখে তাকাতেই হাসি আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। এভাবেই দুজন হসপিটালের ভেতরে চলে আসে। রিসেপশন পার হয়ে লিফটের কাছে আসতেই তাদের পাশেই তড়িঘড়ি করে এসে দাঁড়ায় একটা মেয়ে। হাইটে রাগিনীর চেয়েও একটু ছোট। কোঁকড়া চুলগুলো সুন্দর করে ঘাড়ে পড়ে আছে। পরনে কিছুটা আধুনিক পোশাক। তাকে খেয়াল করে না রাগিনী এবং কোহিনূর। লিফট খুলতেই যখন দুজনেই প্রবেশ করতে যায় তখনি তাড়াহুড়ো করে তাদের ঠেলে মেয়েটিও প্রবেশ করতে চাইলেই রাগিনীর একটু ধাক্কা লাগায় কোহিনূর ফট করেই রাগিনীর হাতটা ধরে নেয় নিজের মুঠোয়। এবার বিরক্ত হয়ে তাকায় কোহিনূর। মেয়েটির দৃষ্টিও যখন কোহিনূরের দিকে পড়ে তখন যেন দুজনেই থ হয়ে যায়। মেয়েটির মুখ আপনাআপনি হা হয়ে যায়। কোহিনূরের কপাল কুঁচকে যায়। আশ্চর্য হয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটি বিস্ময় নিয়ে এক চিৎকার করে বলে ওঠে,
“বিগ ব্রাদার!”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৬
হাত মুঠো করে ফেলে কোহিনূর। সারা শরীরে যেন তরঙ্গ বয়ে যায়। এ যেন ভয়ের তরঙ্গ। চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। মুখের ফ্যাকাশে বর্ণ ফুটে ওঠে। অন্যদিকে রাগিনী বিষয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে একবার কোহিনূরের পানে চাইছে আর একবার সেই মেয়েটির পানে চাইছে। লিফটে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। এবার রাগিনী বিস্ময়ের সাথে কোহিনূরের দিকে ইশারা করে বলে ওঠে,
“এক্সকিউজ মি! আপনি কি উনাকে বিগ ব্রাদার বলে ডাকলেন?”
আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে থাকা নয়নতাঁরা এবার ভ্যাবাচেকা খেয়ে রাগিনির দিকে পলক ফেলে তাকালো। রাগিনীর আপাতমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। কি সুন্দর মেয়েটা! ডাগরডাগর হরিণীর চোখ তার। সেই টানা টানা চোখে অনেক বিস্ময়। কথা বলার সময় যখন ঠোঁটজোড়া নড়তে থাকে তখন তার হালকা ফোলা গাল দুটোও নড়তে থাকে। নয়ন বিমোহিত হলো। কিছু বলতে গিয়েও লক্ষ্য করল কোহিনূরের কঠিন দুটো চোখ। নয়নতাঁরা ঢক গিললো। বুঝতে সময় লাগলো না তার খবর খারাপ আছে। রাগিনী নয়নতাঁরার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করল,
“কি হলো বলুন আপনি কি উনাকে চেনেন?”
নয়নতাঁরা কিছু বলার আগেই কোহিনূর হুড়মুড়িয়ে বলে উঠলো,
“প্রশ্নই আসে না। হেই গার্ল, হু আর ইউ? ডু ইউ নো মি?”
বলেই নয়নতাঁরার দিকে হালকা ঝুঁকে পড়লো কোহিনুর। তার কঠোর দৃষ্টি নয়নতাঁরাকে অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিল। সেই মুহূর্তেই লিফটের দরজা খুলে গেল। ব্যাস… নয়নতাঁরাকে আর পায় কে! সে হম্বিতম্বি করে বেরিয়ে যেতেই পিছু ডেকে উঠলো রাগিনী। রাগিনী মেয়েটা নাছোড়বান্দা। রাগিনী ওর লিফটের বাইরে বেরিয়ে আসে সেই সঙ্গে কোহিনূরও। কোহিনূর আবারো তড়িঘড়ি করে কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল,
“তোমার বিগ ব্রাদারের নাম কি?”
“উমম…পেন্সিল!”
এবার রাগিনী ও কোহিনূর উভয়েই বিস্ময়ের সাথে একই সঙ্গে বলে উঠল,
“হোয়াট?”
নয়নতাঁরা সঙ্গে সঙ্গে চমকে বলে উঠল,
“না! সরি। জায়ান্ট। মানে দৈত্য।”
বাকহীন হয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে কোহিনূর। তার দৃষ্টি যেন নয়নকে বলছে, ‘অন্তত নামটা তো ঠিক বল! দফারফা আর করিস না।’
রাগিনী বা কোহিনূরের কিছু বলার আগে নয়নতাঁরা আবারও যেচে বলে উঠল,
“আরে না! ডেভিল। নাউ ইট ইজ পারফেক্ট!”
রাগিনী বেশ ভাবলেশহীন হয়ে রইল। আদেও বুঝলো না আসলে মেয়েটা কী বলছে? তার মাথায় আবার সমস্যা নেই তো? তাহলে তো মহা বিপদ! কিছু বলার মতো পাচ্ছেই না সে। আসলে কী বলা উচিত? তৎক্ষনাৎ কোহিনূর দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
“আমি আপনার বিগ ব্রাদার আসল নাম জানতে চেয়েছি মিস.!”
“নির্জন… নির্জন আহমেদ…”
কোহিনুর তার কথার মাঝখানেই বলে ওঠে,
“ইটস ক্লিয়ার। আমি কোহিনূর। নাউ ইউ ক্যান গো।”
বললেই আর তীব্র করা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কহিনুর নয়ন তারার দিকে। নয়ন তারার মাথায় যেন বাজ পড়েছে। তবে কহিনুরের ইঙ্গিত বুঝতে পারল সে। মুখটা কোনরকমে চোরের মত ঢেকে ছুট লাগালো। রাগিনী হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো সেই মেয়েটার দিকে। আশ্চর্যিত হয়ে বলল,
“মেয়েটা এমন করল কেন?”
“আমার মনে হয় মেয়েটা বুঝে গিয়েছে তুমি বিপদজনক একটা মেয়ে। মানুষের খাইতে শহীদ করে ফেলতে পারো। তাই রিস্ক নিতে চায়নি।”
বেশ উদ্বেলিত হয়ে রাগিনীর প্রশ্নের উত্তর দেয় কোহিনূর। চোখ রাঙিয়ে তাকায় রাগিনী। তবে সে কথার প্রতিত্তোর না করে রাগে গজগজ করে বলল,
“লিফট থেকে তো বেরিয়েই এসেছি। বাকিটা সিঁড়ি দিয়ে যাই। আর একটা ফ্লোর উপরে যেতে হবে।”
“এজ ইউর উইশ!”
রাগিনী রাগে কটমট করে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে সিঁড়ির দিকে। কোহিনূরের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির নিকট যায়। কোহিনূরের হৃদয়ে যেন প্রাণ আসে। একবার ফিরে করিডোরের কিনারায় তাকায়। বিরবির করে কিছু একটা বলে। অতঃপর দ্রুত হেঁটে নিজেও সিঁড়ির দিকে যায়।
কেবিনে প্রবেশ করা মাত্রই সেখানকার বেডে বসে থাকা বাচ্চা ছেলেটি মাথা উঠিয়ে তাকায় উৎকন্ঠা হয়ে। যেন সেও রাগিনীর অপেক্ষাতেই ছিল। রাগিনী তাকে বসে থাকা অবস্থার দেখেই কিছুটা আগ্রহের সাথে বলে উঠল,
“এখন কেমন আছো? শরীর ভালো?”
“আমি তো এখন ভালাই আছি। এখানের ভালা ভালা খাবার, কত যত্ন নিতাছে। ঠান্ডা ঘর। আমি এমনিতেই ভালা হইয়া গেছি ম্যাডাম।”
বলেই সুন্দর করে হাসে ছেলেটি। তারপর রাগিনীর সঙ্গে থাকা কোহিনূরকে দেখেই ফট করে বলে ওঠে,
“কাল তো অন্য স্যাররে দেখছিলাম। এইডা আপনার সোয়ামি বুঝি?”
সঙ্গে সঙ্গেই কোহিনূর রাগিনীর দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে কেশে উঠল। রাগিনীর নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল। কেমন যেন লজ্জা লাগলো। অস্বস্তি লাগলো। ‘সোয়ামি’ শব্দটাই তার গায়ের লোম শিউরে ওঠার কারণ হয়ে দাঁড়াল। কান গরম হয়ে উঠল। নিজেকে সংযত রেখে কিছু একটা বলার জন্য উদ্যত হতেই কোহিনূর তার আগেই আগ বাড়িয়ে বলে ফেলল,
“নো লিটল বয়। আমিও তোমার মতোই এক অসহায় মানব। পার্থক্য একটাই। এই ম্যাডাম তোমার সেবা করে আর আমাকে সেবা করার নামে অত্যা’চার চালায়।”
“চুপ করুন তো আপনি। একবার মুখ খুললে যা-তা বলে বসেন।”
রাগ ঝেড়ে বলল রাগিনী। তারপর গিয়ে ছেলেটির পাশে বসল। ছেলেটিও দুজনের চাপা ঝগড়া দেখে নিজের হাসি প্রসারিত করেছে। রাগিনী ছেলেটির উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার মা কোথায়? কাল উনার সাথে ভালো করে কথা বলা হয়নি।”
“এখনি এখানেই আছিল। বাইরে গেছে মনে হয়। আপনে একটু বসেন আম্মা আইসা পড়বে।”
কোহিনূর দরজার কাছেই বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে একভাবে। তার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না। দূর থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে সামনে থাকা সেই মুগ্ধময়ীকে। সেই কোমলিনীকে দূর থেকে অনুভব করতে মনটা টানছে। দূর থেকে তার কোমলতা অনুভব করতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা কীভাবে যেন সকলের প্রিয় হয়ে ওঠে! তবে কোহিনূর কি মারাত্মক ভুল করে বসল? এখন এই ভুলের সমাধানের উপায় কী?
“পারো কী করে কারোর জন্য এতো কিছু করতে?”
আনমনেই প্রশ্নটা করে ফেলল কোহিনূর। রাগিনী ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল তখনি তার ব্যস্ততা ভেঙে দিল সেই প্রশ্নটি। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ছোট্ট করে জবাব দিল,
“বিশ্বাস! বিশ্বাস থাকলে সবকিছুই করা যায়।”
“আমাকে বিশ্বাস করো?”
বেশ উৎসুক হয়ে রইল এবার কোহিনূর জবাব শুনতে। রাগিনী ফিচেল হেঁসে বলল,
“কী মনে হয়?”
কোহিনূর কোনো কথা বলা ছাড়া শুধু মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ, সে মনে করে রাগিনী তাকে বিশ্বাস করে না। তা দেখে রাগিনী স্পষ্ট জবাব দিলো,
“মি. কোহিনূর! বিশ্বাস একটা স্বচ্ছ, সূক্ষ্ম কাঁচের মতো। যেটা অতি দৃঢ় হলেও একটু অবিশ্বাসের ছোঁয়া লাগলেই তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আর আপনি আমার কাছে একটা স্বচ্ছতায় পরিপূর্ণ মানুষ। আপনাকে বিশ্বাস করি বলেই আপনার সঙ্গে থাকলে নিজেকে নিরাপদ লাগে আমার। আপনার সংলগ্নে এলে কোনো অস্বস্তি লাগে না। আপনার ছোঁয়ায় কখনো আমি খারাপ উদ্দেশ্য অনুভব করিনি। তবুও বলবেন আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না?”
বাকরুদ্ধ কোহিনূর। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনে থাকা রাগিনী নামক মেয়েটির দিকে। চোখের পলক ফেলতেও আর ইচ্ছে না কোহিনূরের। রাগিনী ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। কোহিনূরের সংলগ্নে এসেছে। শান্ত গলায় বলল,
“পৃথিবীতে দুটো পুরুষের কাছে নিজেকে সবথেকে নিরাপদ মনে করি আমি। প্রথমজন আমার বাবা। দ্বিতীয়জন কোহিনূর সাহেব।”
কথার মাঝে নিঃশ্বাস নিয়ে থামে সে। থেমে থেমে আবারও বলে,
“আমি চাই না এই বিশ্বাসে কখনো অবিশ্বাসের ছোঁয়া লাগুক। দয়া করে কখনো এটা হতে দেবেন না।”
কোহিনূর কোনো জবাব খুঁজে পাচ্ছে না। কেন যেন নিজেকে দিশেহারা লাগছে এবার। হারিয়ে যেতে মন চাইছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে। তখন রাগিনী অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করে,
“আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন?”
শুঁকনো ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিল কোহিনূর। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে বাঁচতে চতুর্পাশ তাকালো। তারপর বেডে মাথা ব্যান্ডেজ লাগানো নিয়ে বসে থাকা ছেলেটির দিকে চোখ পড়তেই ফট করে বলল,
“বাচ্চা ছেলেটাকে এখনি পাকিয়ে দিও না। আমাদের দিকেই চেয়ে আছে।”
প্রসঙ্গ পাল্টাতেই ইতস্তত বোধ করে পিছু ফিরে তাকায় রাগিনী। কোহিনূর এমন কেন? তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে অন্য কোনো দিক থেকে তার খেয়াল হারায় কেন এভাবে? এটা একদমই ঠিক না। নিরবতার মাঝে এবার ভেসে এলো অন্য মহিলার গলা। মহিলাটি দরজার কাছ থেকে বলে উঠলেন,
“ম্যাডাম, আপনে আসছেন!”
উচ্ছ্বাস নিয়ে বলা কথাগুলো শুনে দরজার দিকে চোখ পড়ল রাগিনীর। মহিলাটিকে দেখে সে এক গাল হেঁসে জবাব দিল,
“না এসে পারি? আপনার ছেলে তো মায়ায় বেঁধে রাখতে জানে।”
“কী যে বলেন! আমাগো গরীবের প্রতি আবার মায়া!”
“কেন আপনারা মানুষ নন বুঝি?”
“সবাই তো মনে করে না। করলে তো আমার পোলাডার উপরে একটু মায়া করতো।”
শেষ কথা গুলো হতাশা নিয়ে বললেন মহিলাটি। তবে রাগিনী শক্ত কন্ঠে বলল,
“সবার কথা বাদ দিন। আগে নিজে মনে করবেন আপনি মানুষ। শ্রেষ্ঠ জীব! যারা আপনাদের মানুষ মনে করে না তারা নিজেরাই কোনো মানুষের কাতারে পড়ে না।”
রাগিনীর কথায় মহিলাটি আশ্বস্ত হয়ে একটু হাসেন। নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে আবার চিন্তিত হয়ে বলেন,
“কিন্তু ম্যাডাম, আমার পোলাডারে এতো ভালা হসপিটালে ভর্তি করছেন। এখানে তো অনেক বিল উঠবো। এতো টাকা…”
কথার মাঝখানে থামায় রাগিনী। মাথা নাড়িয়ে বলে,
“টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করে মাথা খারাপ করবেন না। আমি ম্যাডাম নই। আপনার ছোট বোনের মতো। তাই ছোট বোন হয়ে না হয় এতটুকু করলাম। আর ছেলেকে না খাটিয়ে ভালো স্কুলে লেখাপড়া শেখান। অনেক বড় হবে সে।”
“তাইলে আমাগো পেটের ভাত কেমনে ঘরে আসবে?”
“এতটুকুও আমাকে ভাবতে দিন।”
এবার মহিলাটি কঠোর হয়ে বলল,
“না ম্যাডাম। এগুলা অনেক খরচের ব্যাপার। আমি আপনের থেকে এতো খরচ কেমনে নিমু? পারমু না।”
রাগিনী আর কোহিনূর অবাক হলো কিছুটা। গরীব, নিম্নবিত্ত হলেও তারা কি সুন্দর নিজেদের আত্মসম্মান বজায় রেখেছে। এখন কোহিনূর ভাবছে যে রাগিনী কী জবাব দেবে। সে বেশ আগ্রহের সঙ্গে কথাগুলো শুনছে। তৎক্ষনাৎ রাগিনী কিছুটা ভেবে বলল,
“মোটেও না। আপনাকে এমনি এমনি খরচ তো দেবোই না। আপনাকেও কিছু করতে হবে এর বদলে। শুনুন, আমার বাড়ির পেছনে একটা কাঠগোলাপের গাছ আছে। গাছটার যত্ন নেওয়ার জন্য বাড়িতে তেমন কেউ নেই। আপনার দায়িত্ব আপনি কাল থেকেই আমার বাড়িতে গিয়ে সেই গাছটার যত্ন নেওয়া।”
এবার ভ্যাবাচেকা খেলেন মহিলাটি। কোহিনূর মিটমিটিয়ে হাসছে। মেয়েটার বুদ্ধি আছে বলতে হবে। কীভাবে কৌশলে কথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। মহিলাটি বিস্ময়ের সুরে বললেন,
“এতটুকু কাম?”
“এতটুকু মানে? এটা অনেক বড় কাজ। আমার সবথেকে প্রিয় গাছটা। কত নজরে রাখতে হবে বুঝতে পারছেন? আমার নম্বর লিখে নিন তো। কাল ঠিক সময়ে এসে পড়বেন।”
মহিলাটি না চাইতেও নম্বর দেওয়া নেওয়া করল। আরো কথাবার্তা হলো। একটু গল্প হলো। সবশেষে রাগিনী ও কোহিনূর বিদায় জানিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ল। দুজন পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। হাঁটার মাঝে হঠাৎ কোহিনূর বলে ওঠে,
“তোমাকে যতটা ভেবেছিলাম ততটাও বোকা নও তুমি!”
হাঁটার মাঝে দাঁড়িয়ে যায় রাগিনী। ভ্রু কুঁচকে বলে,
“মানে?”
“মানে একটু আধটু চালাক আছো। কীভাবে উনাকে তাক লাগিয়ে দিলে।”
“এটা প্রশংসা করছেন নাকি ইনসাল্ট করছেন?”
“অবশ্যই প্রশংসা। তোমার মতো মেয়ের প্রশংসা না করে ইনসাল্ট করা যায়?”
রাগিনী এবার কোহিনূরের কথায় পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল। দুজনই লিফটের কাছে এসে দাঁড়াল। কোহিনূর মুচকি হেঁসে রাগিনীর বাঁধা চুল টান দিয়ে আবারও চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাগিনী কটমট করে তাকিয়ে লিফট খোলার বাটনে চাপ দিল। কোহিনূর বিরবিরিয়ে বলল,
“চলো! উনি কাঠগোলাপের গাছ সামলাতে থাকুক আর আমি আমার জীবন্ত কাঠগোলাপকে সামলাই!”
বড়সড় সাদা রঙ করা বাড়ি। বাড়ির আশেপাশের পাঁচিলও সাদা রঙের। বাড়ির সদর দরজার পাশে সুন্দর করে নেম প্লেট লাগানো। বাড়ির নাম ‘আহমেদ মেনশন’। কেমন যেন উঁচু উঁচু লাগছে পাঁচিলগুলো নয়নতাঁরার কাছে। মাঝে মাঝে লাফ দিয়ে পাঁচিল দিয়ে ওপাশ দেখার চেষ্টা করছে সে। উদ্দেশ্য পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢোকা। যেই ভাবা সেই কাজ। কোনোরকমে পাঁচিলে হাত রেখে পা দিয়ে নিজেকে ঠেলে উপরে ওঠার চেষ্টা করল সে। ধড়ফড় করে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। বড় একটা দম ফেলে পাঁচিলের গায়ে একটা লা’ত্থি মে’রে বলল,
“কী কপাল আমার! নিজের বাড়িতে চোরের মতো ঢুকতে হচ্ছে।”
নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে এবার নয়নতাঁরার। আবার পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে ওঠার চেষ্টা করল সে। এবার সফল হলো। পাঁচিল টপকে পেছনের দিকে লাফ নামতেই একটা শব্দ হলো। এবার পায়ের শব্দ কানে এলো। চোখ বড় বড় করে সামনের দিকে চাইলো নয়নতাঁরা। দুটো লোক ফট করেই এগিয়ে এসে তার দিকে রি’ভলবার তাক করতেই হকচকিয়ে উঠল নয়নতাঁরা। হাত দিয়ে নিজেকে দ্রুত আড়াল করে বলল,
“আরে আরে কী হচ্ছে! আমি এ বাড়ির মেয়ে। কোনো চোর নই।”
রি’ভলবার তাক করে থাকা দুজন লোক দুজনের দিকে তাকাতাকি করল। তারপর কঠোর সুরে বলল,
“মেয়েই যদি হন তাহলে চোরের মতো আসলেন কেন বাড়িতে? কে আপনি সত্যি করে বলুন। নয়তো…”
নয়নতাঁরা চুপসানো মুখে হাত দুটো উঁচু করে। জোর দিয়ে বলে,
“আমি নয়ন। নয়নতাঁরা আহমেদ। নির্জন আহমেদের একমাত্র আদরের, ভোলাভালা, সাধাসিধা, সরল, প্যাঁচবিহীন ছোট বোন।”
এক নিঃশ্বাসে বলা নয়নতাঁরার কথাগুলো যেন বিশ্বাসযোগ্য লাগলো না দুজনের কাছে। তারা নয়নের নিকটে গিয়ে জোর করে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে দিল। চেঁচামেচি করে উঠল নয়ন। কিন্তু তাদের কানে কথা গেলে তো!
অন্ধকার ঘরে দিনের আলো এসে ঘরটা খানিকটা আলোকিত করেছে। ছিমছাম একটা ঘর। অতিরিক্ত আসবাবপত্র নেই। বড় একটা বেড। বেডের দুপাশে সুন্দর ল্যাম্পশিট। জানালার পর্দা সরিয়ে রাখা। জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসেছে নির্জন। হাতে কফির কাপ। মাঝে মাঝে শব্দবিহীন হালকা করে চুমুক লাগাচ্ছে কফির কাপে আর মুখে বিরাজ করছে অদ্ভুত গাম্ভীর্য। দরজায় টোকা পড়ে তখন। নির্জন গম্ভীর সুরে জবাব দেয়,
“কাম ইন।”
দরজা খুলতেই চেঁচামেচি কানে আসে নির্জনের। মেয়েলি কন্ঠ চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয় না তার। কফির কাপটা রেখে চেয়ার নিয়ে ঘুরে বসে নির্জন। তাকে দেখে ছটফটাতে থাকা নয়নতাঁরা শান্ত হয়। দাঁত কেলিয়ে হাঁসে আর বলে,
“বিগ ব্রাদার!”
“কেন আমাকে এখানে এক্সপেক্ট করো নি?”
“না। মানে হ্যাঁ। তোমার বাড়ি। তুমিই তো থাকবে।”
পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে ঘাড় কাঁত করে নির্জন জবাব দিল,
“তুমি আমাকে বাহিরে দেখেছো সেকারণেই তো এখানে এসেছো।”
ঠোঁট উল্টিয়ে অসহায় পানে চায় নয়নতাঁরা। তার ভাইটা এতো বুদ্ধিমান কেন? তার মতো একটু বোকাসোকা হলে কি পারতো না? নির্জন ইশারা করে নয়নকে ছেড়ে দিতে বলে। হ্যান্ডকাপ খুলে দিতেই নয়ন ফোঁসফোঁস করে বলে,
“বলেছিলাম না? আমাকে না ধরতে। মিলল তো আমার কথা। যার বাড়ি তাকেই চোর বানিয়ে দিচ্ছে।”
“ওদের উপর চেঁচিয়ে লাভ নেই নয়ন! আমি ওদেরকে বলেছিলাম তোমার ছবি দিয়ে যাতে তোমাকে দেখামাত্র আমার কাছে ধরে বেঁধে নিয়ে আসে।”
নয়ন এবার কান্না করার ভান ধরে। নির্জনের দিকে এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,
“তুমি এমনটা করতে পারলে?”
“না করার কী আছে? কম নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছো আমাকে? কোন সাহসে লন্ডন থেকে পালিয়ে এসেছো?”
নয়নের বুঝতে বাকি থাকে না তার ভাইয়ের মেজাজ এবার চড়ে যাচ্ছে। তাকে যে করে হোক ঠান্ডা করতে হবে। ফট করেই নির্জনের কোলে বসে নিষ্পাপ চাহনি নিয়ে তাকায় সে। আর আদুরে ভঙ্গিতে বলে,
“বিকজ আই মিসড ইউ।”
“হুমম। কত মিস করো সেটা আমার জানা আছে। সেকারণেই তো আগে আমার সাথে দেখা করা বাদ দিয়ে ইন্সপেক্টর রায়ানের সঙ্গে দেখা করতে হসপিটালে ছুটছিলে।”
নয়নতাঁরা এবার শয়তানি হাসে। হাতের কনুই দিয়ে নির্জনের বুকে গুঁতো দিয়ে বলে,
“তুমি কী করছিলে শুনি? আজকে যা দেখলাম দেশে এসে। না আসলে তো মিস করে যেতাম।”
“শাট আপ! যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলবে না।”
নয়নতাঁরা মিটমিটিয়ে হাসে। নির্জনের এক গাল টেনে ধরে বলে,
“কোনটা বুঝি না? একটা মেয়ের কত সুন্দর করে ধরে ছিলে সেটার মানে বুঝি না? নাকি লাজুক চেহারা বুঝি না? ইউ নো হোয়াট বিগ ব্রাদার? এই প্রথম তোমাকে লজ্জা পেতে দেখছি। যাক ওই কিউট মেয়েটা আই মিন হবু ভাবির দৌলতে জীবনে নির্জন আহমেদের ব্লাশিং ফেসও দেখা গেল।”
নির্জন যেন থতমত খেলো নয়নতাঁরার কথায়। আসলেই কি তার লজ্জা লাগছে? ফেস ব্লাশ করছে? তবুও সে না দমে নয়নতাঁরাকে একটু ধাক্কা দিয়ে বলল,
“আই এম নট জোকিং নয়ন! এটা কেস সংক্রান্ত ব্যাপার।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমিও বা কোথায় জোক করলাম? কেস সংক্রান্ত ব্যাপার আমিও বুঝলাম। কিন্তু যেমন তেমন কেস নয় এবার লাভ কেসে ফেঁ’সে গিয়েছো।”
“উফফ…আসলে কী বলো তো! তোমাকে বোঝানোর জন্য মুখ নাড়ানোর থেকে একটা গাছের সঙ্গে মুখ নাড়ানো অনেক ভালো। দেখি সরো। অনেক ভারি হয়ে গিয়েছো। পায়ের হাড় ভাঙবে এবার আমার।”
নয়নতাঁরা নাছোড়বান্দা। সে আরো নির্জনের কোলে ভালো করে বসে বলল,
“না উঠব না। তুমি যদি সত্যি না বলো আমি উঠছি না আজকে।”
“তুমি যা ভাবছো তা নয়। ব্যাপারটা অন্যরকম। গল্পটা অন্য। গোধূলি বেলার গল্প। রাগিনী জানেও না আমার পুরো নাম নির্জন আহমেদ কোহিনূর। তার ধারণাও নেই আমার পরিচয় সম্পর্কে। সে যেটা জানে সেটা আমি নই। আর যেটা জানে না সেটাই নির্জন আহমেদ কোহিনূর!”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৭
“কিন্তু তার সাথে এভাবে লুকোচুরি খেলে কি হাসিল করতে চাইছো তুমি, বিগ ব্রাদার?”
নির্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে হতাশা। মুখটা কেমন জানি ভার হয়ে যায়। গাম্ভীর্যের সাথে বলে ওঠে,
“আমার মনে হচ্ছে আমি বড় কোন ভুল করে ফেলেছি। তার মতো মেয়েকে আমি সন্দেহ করেছি। আমি মনে করেছি সে টে’রোরিস্ট টিমের সাথে যুক্ত। ট্রেনে থাকা সেই আই উইকনেসের স্কেচ অনুযায়ী তাকে সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি। কিন্তু রাগিনী তাজরীন নামক মেয়েটিকে যত কাছ থেকে দেখেছি ততই অবাক হয়েছি। সে কখনো কারো প্রাণ নেওয়ার কথা ভাবতেও পারে না। সে মানুষের জীবন বাঁচায়। এমন কি সে ছোট্ট একটা প্রাণীর জীবনও বাঁচাতে অস্থির হয়ে ওঠে। সে কখনো মানুষের চোখে ভয় দেখতে এমনটা করবে না।”
“তাহলে এখনো তুমি কি কারণে নিজেকে তার সামনে নিয়ে আসো নি? আমি কিন্তু অন্য কিছুর ইঙ্গিত পাচ্ছি।”
কথাটুকু বলেই সন্দেহের নজরে তাকালো নয়নতাঁরা। নির্জন চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। নয়ন জোর করে নির্জনের চিবুক ধরে তার দৃষ্টি নিজের সামনাসামনি করে। নির্জন যেন নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে,
“কারণ পুলিশের প্রমাণ দরকার। আমরা প্রমাণে বিশ্বাসী। আমার বিশ্বাস বা ধারণাই কেউ বিশ্বাসী নয়। উই নিড প্রুফ।”
চোখ জোড়া সরু হয়ে আসে নয়নতাঁরার। ঠোঁট কামড়ে হেসে তার ভাইয়ের খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গাল দুটো টেনে বলে ওঠে,
“তোমার বাহানা তুমি নিজের কাছে রাখো। সামান্য আমার ধাক্কায় তুমি যেভাবে তাকে হাত দিয়ে আগলে ধরেছিলে সেটাও কি শুধুই তদন্ত সংক্রান্ত কারণে? এখন অন্তত এই কথা বলো না। তাহলে কিন্তু তদন্ত নামক শব্দটি লজ্জা পাবে।”
“বড্ড বেশি কথা বলতে শিখে গেছো তুমি, নয়ন। দেখি সরো। আমার কাজ আছে।”
বলেই নির্জন প্রসঙ্গ পাল্টাতে নয়নকে জোর করে তুলে দেয়। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নির্জন চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
“যেন আস্ত একটা আলুর বস্তা কোলে বসেছিল। পা দুটো একেবারে অবশ হয়ে গেছে।”
এবার অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় নয়নতাঁরা। সে না হয় দেখতে একটু গোলুমোলু। একটু গোলগাল। তাই বলে কি তার ভাই এভাবে কথা শোনাবে? এটা মানা যায় না। নয়ন তড়তড় করে বলে ওঠে,
“নিজেকে একবার দেখেছো? মনে তো হচ্ছে সুন্দরী মেয়েটার সেবা পেয়ে কয়েক বছর ধরে জিম করো না। ভুঁড়ি বাড়তে শুরু করেছে। দৈত্য, ডেভিল একটা।”
কথাটা শুনে নির্জন চটে গিয়ে নয়নের দিকে তেড়ে যেতেই দরজায় আবারও টোকা পড়ে। নির্জন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“ভেতরে এসো।”
মেহরাজ ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করলো। তার চোখ নয়নতাঁরার দিকে পড়া মাত্রই সে কিছুটা চমকে বলে উঠলো,
“মিস. আহমেদ! স্যারের প্ল্যানটা তাহলে কাজ করেছে।”
নয়নতা্ঁরা মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি চুপ করুন। আপনাকে যতবারই ফোন করেছি কোন কাজের কাজই হয়নি।”
“আমাকে বলে কী লাভ? স্যার আপনাকে ইচ্ছে করে কল ব্যাক করতেন না।”
নয়নতাঁরা বাঁকা হাসল এবার। সামনের ছোট ছোট চুলগুলোতে ফুঁ দিয়ে বেশ ভাব নিয়ে বলল,
“তাতে কি এমন লাভ হয়েছে? আমাকে কী আঁটকাতে পেরেছে? সি! আমি দেশে এসে পড়েছি।”
মেহরাজ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ, যেমন বোন তার তেমন ভাই! কেউ কারোর থেকে কম যায় না।”
“কথা কম কাজ বেশি। আমি তোমাকে যা যা বলেছিলাম সেসব কি কালেক্ট করেছো?”
এবার নিরবতা ভেঙে মেহরাজের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে উঠল নির্জন। মেহরাজ একটা পেনড্রাইভ এগিয়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গেই। আর এক নিঃশ্বাসে বলে,
“ইয়েস স্যার। এটা এয়ারপোর্ট আর তার আশেপাশের ক্যামেরাগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ।”
নির্জন পেনড্রাইভ হাতে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টি দিয়ে তার ল্যাপটপ খুঁজতে থাকে। বেডের বালিশের উপর ল্যাপটপের দিকে চোখ পড়তেই ইশারায় সেটা দেখিয়ে নয়নতাঁরাকে ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
“ল্যাপটপ নিয়ে এসো।”
নয়ন ছুটে গিয়েই ল্যাপটপ নিয়ে আসে বেশ আগ্রহের সাথে। তার এসব তদন্ত দেখতে দারুণ লাগে। কেমন একটা উত্তেজনা কাজ করে। নির্জন এবার গিয়ে ঘরের উত্তর দিকের টেবিলটার উপর ল্যাপটপ রেখে চেয়ার টেনে বসে। জড়ো হয় মেহরাজ ও নয়নতাঁরা। পেনড্রাইভ কানেক্ট করে একের পর এক ফুটেজ বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখেও কোনোরকম সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না নির্জন বা মেহরাজের। আচমকায় চেঁচিয়ে উঠল নয়নতাঁরা। লাফিয়ে বলল,
“এই সিনটাতে স্টপ করো!”
তাড়াহুড়ো করে সিনটা স্টপ করল নির্জন। সিনটায় দেখার চেষ্টা করল আশেপাশে কিছু সন্দেহজনক আছে নাকি! কিছুই চোখে না পড়ায় ঘাড় বাঁকিয়ে নয়নের দিকে তাকাতেই তার দৃষ্টির ধরণ দেখে বুঝতে সময় লাগলো না সে রায়ানের জন্য সিনটাকে স্টপ করতে বলেছে। সোজা হয়ে নির্জন আবারও স্টার্ট করতেই মুখটা ভার হয় নয়নতাঁরার। নির্জন ফুটেজ দেখতে দেখতে বলে,
“দ্যা গ্রেট ইন্সপেক্টর রায়ানকে দেখার সময় আমার। মুখটা বন্ধ রাখবে নয়ত নিজের ঘরে যাও। অনেকদিন নিজের রুমকে দর্শন দাওনি। রুমটা শান্তিতে আছে। রুমটাকে অশান্তি দিয়ে এসো।”
“ধুর! তুমি সবসময় এমন করো কেন বলো তো? জন্মের সময় মা তোমার মুখে মধু দেয়নি তাই না? মনে হয় নিমের রস দিয়ে গিয়েছিল। কি কিউট লোকটা! একবার মনোযোগ দিয়ে দেখো তুমিও প্রেমে পড়ে যাবা।”
ফুটেজ আবারও স্টপ করে নির্জন। থম মেরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। কঠিন সুরে বলে,
“আমি ছেলে, নয়ন।”
নির্জনের কন্ঠসুর আর কথা শুনে ঢক গিলে নয়নতাঁরা। তাই তো! তার ভাই তো ছেলে! ছেলে হয়ে ছেলের প্রেমে পড়লে ব্যাপারটা কেমন লাগে? ছিঃ ছিঃ! সে নিচু সুরে জবাব দেয়,
“আর একটাও কথা বলব না। প্রমিস!”
নির্জন এবার নিজের কাজে মন দেয়। একটা জায়গায় সিন স্টপ করে সে। তার তীক্ষ্ণ নজর পড়ে অভিরূপকে নিয়ে যাওয়া গাড়িটার দিকে। তার গাড়ির সামনে হঠাৎ করেই একটা বাচ্চা ছেলের আগমন ঘটল। আর একটা মেয়ে তাকে খপ করে ধরল। সেখানে স্টপ করল সে। সিনটা বেশ দূরের। তাই মেয়েটার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। বেশ অস্পষ্ট! মুখটা অর্ধেক ঢাকা। দূর থেকেই অস্পষ্ট মুখটা দেখেই কেমন যেন অদ্ভুত লাগলো নির্জনের। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। কেমন চোখের ধরণটা চেহারা। আবারও ফুটেজ স্টার্ট করতেই এবার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মেয়েটির মুখের কাপড় যখন নেমে গেল তখন চমকে উঠল নির্জন। সারা অঙ্গ কেঁপে উঠল। দ্রুত জুম করল মুখটার উপর। কাঁপতে থাকল টেবিলের উপর রাখা হাত। ঘেমে একাকার হলো এতটুকু সময়ের মাঝেই। মেহরাজ হতবাক হয়ে বলল,
“আরে ইনি তো রাগিনী তাজরীন!”
নয়নতাঁরা কিছুক্ষণ ড্যাপড্যাপ করে চেয়ে থাকে ফুটেজের দিকে। অতঃপর সেও জোরে বলল,
“হ্যাঁ। তাই তো। এটা তো সে! রাগিনী…”
“এটা অসম্ভব! এটা হয় না। রাগিনী এখানে উপস্থিত থাকতে পারে না।”
কাঠকাঠ গলায় বলল নির্জন। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। মুখটা এখনো অস্পষ্ট হলেও রাগিনীর মুখশ্রী সকলের কমবেশি চেনা। বিশেষ করে নির্জনের। যে ক্ষণে ক্ষণে রাগিনীর দিকে কতবার যে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকেছে তার ঠিক নেই। তাই রাগিনীর সঙ্গে অন্য কোনো মেয়েকে গুলিয়ে ফেলার সম্ভবনা নেই। মেহরাজ নিজেও অবিশ্বাস্য হয়ে জবাব দেয়,
“স্যার, কেন হতে পারে না? চোখের সামনে এই ফুটেজ কি মিথ্যে? এটা রিয়েল ফুটেজ।”
“হোক রিয়েল ফুটেজ। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি এটা রাগিনী তাজরীন নয়। কারণ তাকে আমি সবসময় নজরে রেখেছি। এসময় সে একটা বাচ্চা ছেলেকে হসপিটালে ভর্তি করতে ব্যস্ত ছিলো। তার এখানে আসার সময় কোথায়? তার ফোনের লোকেশন এয়ারপোর্টের ধারের কাছেও নেই। আর মেয়েটার পোশাকে এতোটা ভিন্নতা। রাগিনী এমন পোশাক পড়েনি।”
“তাহলে এটা কে স্যার? রাগিনীর মতো কেন দেখতে? আমার তো মাথা আর কাজ করছে না।”
নয়নতাঁরা এতোক্ষণ চুপচাপ তাদের কথোপকথন শুনছিল। এবার যেন কথা বলার জন্য মনটা আকুপাকু করতে থাকল। ফট করে সে বলেই ফেলল,
“আরে ভুলে যাচ্ছো কেন? পৃথিবীতে জমজ শব্দটাও এক্সিস্ট করে।”
নয়নতাঁরার কথাগুলো অযৌক্তিক হলেও এবার টনক নড়ে নির্জনের। গভীর ভাবনায় ডুব দেয়। হাতটা মুঠো করে থুতনির কাছে রেখে চোখজোড়া স্থির রাখে ল্যাপটপে। একে একে মিলাতে থাকে সব হিসেব। যদিও বা রাগিনীর মতো আরেকজন থাকে তাহলে সে-ই কি রায়ানের গাড়ির ব্লা’স্ট ঘটিয়েছে? রায়ানের কথা অনুযায়ী সেও রাগিনীর মতোই দেখতে। একটু একটু করে হিসেব মিলিয়ে চলেছে নির্জন। ঘরে বিরাজমান পিনপতন নীরবতা। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নির্জন উঠে দাঁড়াল। চেয়ার ছেড়ে একটু দূরে পায়চারি করতে করতে বলল,
“যদি রাগিনীর মতো অন্য একজন মেয়ে এক্সিস্ট করে থাকে আর সে যদি রাগিনীর বোন হয় তাহলে প্রশ্ন অনেকগুলো বেরিয়ে আসছে। প্রথম প্রশ্ন, রাগিনীর জমজ বোন থাকলে রাগিনীদের সঙ্গে থাকে না কেন? দ্বিতীয়ত, ট্রেনে দুটো রাগিনী তাজরীন নামে টিকিট কাটা হয়েছিল। একজন রাগিনী আর অন্যজন রাগিনীর বোন হলে সে কেন রাগিনীর নামটা ইউজ করবে? আর দ্যা গ্রেট সাইকোলজিস্ট শাহ্ রাশেদের মেয়ে হয়ে সে কেন এই পুরো টে’রোরিস্ট চক্রের সাথে যুক্ত হবে? আর ফুটেজ দেখে যদি বিচার করি তাহলে মনে হচ্ছে মেয়েটা এখানে অভিরূপের গাড়ি থামানোর জন্য এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। হিসেব আরো গোলমেলে হয়ে গেল!”
মেহরাজের মাথা এবার ভনভন করে ঘুরছে। আর একটু হলেই যেন জ্ঞান হারাবে। নিজের মাথাটা ধরে নিয়ে একটু ঝাঁকুনি দেয় সে। নির্জন এবার থেমে থেমে বলে,
“মেহরাজ! একটা কাজ করে। শাহ্ রাশেদ সাহেবের ব্যাকগ্রাউন্ড সার্চ করো। বিশেষ করে উনার স্ত্রী যখন প্রেগন্যান্ট ছিলেন তখনকার সময়টা আমার জানা প্রয়োজন। আদেও কি দুটো জমজ মেয়ের জন্ম হয়েছিল?”
মেহরাজ মাথা নাড়ায়। রুম থেকে হনহন করে বেরিয়ে যায়। নয়নতাঁরা চুপ করে তার ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া দেখে কিছুক্ষণ। নির্জন ধীর পায়ে বেডের দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মুখ নিচু করে বসে। দৃঢ় ও সুগভীর চোখটা নিমিষে বন্ধ করে। নয়নতাঁরা বুঝেছে এবার তার ভাইয়ের মনে এই মূহুর্তে কি চলছে। সে পা টিপে টিপে গিয়ে নির্জনের সাথে গা ঘেঁষে বসে। খপ করে নির্জনের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী হয়ে বলে,
“কী ভাবছো এতো?”
“উফফ…নয়ন, এখনো আর উল্টাপাল্টা কোনো কথা বলতে এসো না প্লিজ!”
বিরক্ত হয়ে বলে নির্জন। নয়নতাঁরার কোনো হেলদোল হয় না। সে আগের মতোই থেকে বলে,
“তুমি তাকে নিয়ে ভাবছো তাই না? গিল্টি ফিল করছো?”
চোখ মেলে তাকায় নির্জন। দৃঢ় সুরে বলে,
“গিল্টি ফিল করার কী আছে?”
“তুমি বুকে হাত রেখে বলতে পারবে? যে সেই রাগিনী তাজরীনের দিকে তুমি কখনো মুগ্ধ হয়ে তাকাও নি? এটা তুমি জোর দিয়ে বলতে পারবে? যে তার প্রতি তোমার একটুও টান নেই? এটা তুমি কঠিন সুরে বলতে পারবে যে তাকে তুমি তোমার ভাবনায় কখনোই নিয়ে আসো নি? এটা বলতে পারবে, যে সে তোমার কাছে অন্য সব মেয়েদের মতোই? এটা বলতে কি তোমার কণ্ঠস্বর কাঁপবে না? যে তার সামান্য আঘাতে তোমার কিছুই যায় আসে না?”
“আমি বলতে পারবো না কখনোই যে তার প্রতি আমি মুগ্ধ ছিলাম না। সে সম্পূর্ণটাই মুগ্ধতায় ঘেরা আমার কাছে। আমি তার নিকটে গেলেই দুর্বল হয়ে পড়ি। হৃদয় কম্পন ধরে যায়। সে আমার সামনে থাকুক বা না থাকুক আমার ভাবনায় সবসময় তারই বিচরণ। সে আমার কাছে অন্য কোনো মেয়ের মতো নয়। তাকে আমার নিজের একান্ত জীবন্ত কাঠগোলাপ মনে হয়। যে আমার নিজস্ব। তার সামান্য আঘাতে না চাইতেও এই অবাধ্য মনে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এক গোধূলি বেলায় এসে এমন অঘটন কেন ঘটালো মেয়েটা?”
নয়নতাঁরা ঠোঁট টিপে হাসলো। তবে হাসিটা লুকিয়ে কিছুটা নরম গলায় বলল,
“তার আর কী দোষ বলো? সব দোষ তোমার মনের। অযথা তাকে দোষারোপ করছো কেন?”
এতক্ষণ যেন অন্য ঘোরের মধ্যে ভেসে ছিল নির্জন। নিজের ভাবনা ভাঙতেই মনে হলো সে বেশ কিছুটা দেরি করে ফেলেছে। গড়গড় করে এই বাচাল মেয়েটাকে অনেক কথা বলে ফেলেছে। মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে। চোখে মুখে কঠিন ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে সে বলল,
“সরো তো। তোমার সাথে বকবক করে অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি।”
বলে নির্জন উঠে দাঁড়ায়। পা বাড়ায় বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পিছু ডাকে নয়নতাঁরা। মলিন সুরে বলে ওঠে,
“কেন যে ওমন সুইট একটা মেয়েকে সন্দেহ করলে কে জানে!”
“সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ ছিল। পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। এডিশনাল এসপি স্যারের বাড়ি যখন ব্লা’স্ট হয়। সেদিন রাতে রাগিনীর ফোনের লোকেশন স্যারের বাড়ির আশেপাশে ছিল। ফ্যাক্টরিতে ব্লাস্ট হওয়ার রাতেও তার লোকেশন ফ্যাক্টরির আশেপাশেই ছিল। আমি নিজের সন্দেহ দমিয়ে রাখতে পারিনি।”
“আজকে যখন প্রমাণ পেয়ে গিয়েছো তখন বলে দাও তোমার পরিচয় তাকে। বলে দাও তোমার উদ্দেশ্য কী ছিল। বলে দাও তুমি তা নও সে যেটা ভাবছে।”
“তার বিশ্বাস যে ভেঙে যাবে, নয়ন। আজকে সে আমায় বলেছিল, তার বিশ্বাস কখনোই না ভাঙতে। তাহলে সেও ভেঙে যাবে। সে তো আর আমাকে বিশ্বাস করবে না।”
নির্জনের কন্ঠে মলিনতা। যেন সে নিরুপায়। নয়নতাঁরা দমে না। আবারও বলে,
“হোক যা হওয়ার। সত্যিটা চাপা থাকে না। সে অন্য কোনোভাবে জানার আগে তুমি জানিয়ে দাও। বুঝিয়ে বলো।”
“বুঝবে না। তখন আমার প্রতি তার মনে ঘৃণা জাগবে।”
নয়নতাঁরার মুখটাও কালো হয় এবার। মিনমিন করে বলে,
“যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। শেষে তোমাকে পস্তাতে না হয়।”
রাতটা বেড়েছে। রাগিনীর ঘরে টিমটিম করে ল্যাপশিটের আলো জ্বলছে এখনো। উর্মিলার দেওয়া পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের পেশেন্ট সম্মন্ধে সব তথ্য ঘেঁটে দেখছে বেশ মনোযোগ দিয়ে। নিঝুম রাতে সে একা জেগে নেই অবশ্য। সঙ্গে রয়েছে তার ছোট্ট রিও। চুপটি করে রাগিনীর পাশে একমনে বসে রয়েছে লেট গুটিয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাগিনীর দিকে তাকাচ্ছে আর রাগিনীর কাজকর্ম দেখছে। যেন প্রতিজ্ঞা করেছে রাগিনী না ঘুমোলে সেও ঘুমোবে না। বিগত দুই ঘন্টা ধরে সব তথ্য জানার পর ক্লান্ত চোখে রিও এর দিকে তাকালো রাগিনী। তার ছোট্ট লোম ভর্তি মাথায় আলতো করে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল,
“চোখে ঘুম নেই কেন সুইটি? অনেক বেজে গিয়েছে!”
রিও রাগিনীর দিকে একটু নিষ্পাপ চাহনি দিয়ে নিজের গা চুলকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাগিনী মুচকি হেঁসে তার পুরো শরীর বুলিয়ে দিতেই রিও উঠে এসে তার হাতের সাথে শরীর ঘষতে থাকলো। এবার বোধহয় ছোট্ট মহারাজের ঘুম পেয়েছে। রাগিনী তাকে কোলে নিয়ে আস্তে করে যত্নের সাথে সারা শরীর বুলিয়ে দিতে আরম্ভ করল। শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে ফাইল আর ল্যাপটপের দিকে খেয়াল করল। হাসতে চাইতেও মনটায় কেন যেন বিষণ্ণতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। কোহিনূর নামক ব্যক্তিটাকে এবার সন্দেহের নজরে দেখছে। তার বিশ্বাসের পরিণাম কি তবে বিষাক্ত হয়ে উঠবে? চোখমুখ জড়িয়ে আসে রাগিনীর। সৃষ্টি হয় মনের মাঝে অজানা এক ভয়ের। আঁতকে ওঠে। সে যে চায় না মানুষটা ভুল প্রমাণিত হক!
“কোহিনূর! আপনি কি নিজে ধরা দিচ্ছেন নাকি ভুল করে ধরা দিয়ে ফেলছেন নিজেকে? আপনি নাকি এক্সিডেন্ট করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাহলে তো নরমালি যানবাহন দেখে ভয় পাওয়া উচিত আপনার। কারণ যেখান থেকে পেশেন্টদের অসুস্থতার সৃষ্টি হয় সেটাই পেশেন্ট ভয় পায়। অথচ আপনি সেদিন গাড়ি সামলে নিলেন খুব সহজে। আপনার কথায় আমি সেই বাচ্চামো আর দেখতে পাই না। এসব কীসের ইঙ্গিত?”
কথাগুলো আনমনে আওড়াতে আওড়াতে রাগিনী দেখে রিও ঘুমিয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। সে খুব সাবধানে রিও কে বেডে রেখে হালকা করে গায়ের উপর চাদর তুলে দেয়। রিমোট দিয়ে এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দেয়। উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে তার করা কোহিনূরের স্কেচের সামনে আসে। ল্যাম্পশিটের হালকা আলোয় জ্বলজ্বল করছে স্কেচ। সে একহাতে স্কেচটা স্পর্শ করে বলে,
“আপনাকে সন্দেহ করতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করে না। কিন্তু আপনার ব্যবহার আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। আপনি স্বাভাবিক মানুষ হলে অস্বাভাবিক পরিবেশে কেন এসেছেন? কী উদ্দেশ্য আপনার? নাকি বরাবরের মতো সব আমার হ্যালুসিনেশন? আমিই কি কোনো ট্রমার মাঝে আটকা পড়েছি? আবারও বলছি, কোহিনূর সাহেব! বিশ্বাসটাকে বিষে পরিণত করবেন না।”
রাত হলো। নিস্তব্ধতা বাড়লো। রাগিনীর ভাবনা কমলো না। ঘুম সহজে এলো না। একদিকে রাজ্য জুড়ে থাকলো কোহিনূর এবং বিশ্বাস। অন্যদিকে অবিশ্বাসের বীজ বুনে গেল তার মনের অভ্যন্তরে।
সকালবেলা। বদ্ধ ঘরে এসি চলছে। ঘরের ভেতর থাকা বিছানায় ঘুমন্ত নোমান ও অভিরূপ। নোমানের ঘুমও যা জেগে থাকাও তা। কারণটা হচ্ছে অভিরূপ। তার সাথে ঘুমানো বেশ মুশকিল ব্যাপার স্যাপার। বর্তমানে বিছানার ছোট্ট এক জায়গায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে নোমান। এসিতে ঠান্ডা লাগছে। উপায় নেই তবুও। ব্ল্যাঙ্কেট পুরোটা অভিরূপের কাছে। মাঝরাতে দুজন ব্ল্যাঙ্কেট নিয়ে তৃতীয় বি’শ্বযুদ্ধ লেগে অভিরূপ জিতে গিয়ে পুরোটা নিয়ে নিয়েছিল। নোমান অন্য কোনো ব্ল্যাঙ্কেট আনায় নি আর। সে জানে সেটাও অভিরূপের দখলেই যাবে। অভিরূপের ঘুমানোর স্টাইলটাও দেখার মতোই। হাত-পা ছড়িয়ে মাথা নোমানের পেটে উপর রেখে দেদারসে ঘুমাচ্ছে।
দরজায় টোকা পড়ল। নড়েচড়ে উঠল ঘুমন্ত দুজনই। নোমানের ঘুমটা বেশ হালকা হলো। পেটে ভারি কিছু অনুভব করল। বুঝতে সময় লাগলো না এটা অভিরূপের মাথা। পা উপরে তুলে অভিরূপকে পা দিয়ে হালকা লা’ত্থি মে’রে ঠেলে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টায় থাকলো সে। দরজায় আবারও টোকা পড়ল। নোমানের ঘুমটা এবার পুরোপুরি ভাঙলো। পাশ ফিরে দরজার দিকে তাকালো। অভিরূপ তখনো ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে ঘুমে আধম’রা। হঠাৎ ঘুমের মাঝেই চেঁচিয়ে সে গেয়ে উঠল,
“ও ক্রিং ক্রিং বাজে রে এই মনের কলিংবেল!”
নোমান উঠে বসলো এবার। অভিরূপকে পা দিয়ে আবারও জোরে ঠেলা মে’রে বলল,
“তোর মনে না। দরজায় কেউ বাজাচ্ছে।”
এবার জোরে জোরে দরজায় টোকা পড়ায় নোমান বিরক্ত হয়ে উঠে গেল দরজা খুলতে। সকাল সকাল সার্ভেন্ট গুলো রুম পরিষ্কার করতে চলে আসে। আর কোনো কাজ নেই বোধহয়। দরজাটা খুলেই না খেয়াল করেই নোমান অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে,
“এখনি আপনাদের রুম পরিষ্কার…. ”
কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যায় এক অর্ধবয়স্ক লোককে দেখে। নোমান লোকটির আপাদমস্তক দেখে নেয়। পরনে ভেতরের সাদা শার্ট ইন করা। উপরে এ্যাশ কালার কোট। পায়ে দামি জুতো। হাতে দামি ঘড়ি। দেখেই মনে হচ্ছে ভদ্রলোক। নোমান বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,
“সরি। আমি ভেবেছিলাম…! যাই হোক। আপনাকে তো চিনলাম না আঙ্কেল।”
“হ্যালো ইয়াং ম্যান। আই এম শাহ্ রাশেদ। এটা অভিরূপের রুম না?”
চলবে…
[বি