গোধূলি বেলায় পর্ব ৫

#গোধূলি_বেলায়
#পর্ব_5

কলিংবেল দিতেই দড়জাটা খুলে গেল। ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলো একজন মধ্যবয়সী মহিলা। কিছুক্ষণ আনুসমির দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করেই জোরে একটা চিৎকার দিল। হঠাৎ এমন চিৎকারে আনুসমি কানের পর্দাটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। মহিলাটা চিৎকার থামিয়ে আবারও হঠাৎ করে আনুসমিকে জড়িয়ে ধরল। তারপর আবার চিৎকার করে ডাকতে থাকল, ও ম্যাডাম দেহা যান অাফনের ম্যাইয়া আইছে। কি সুন্দর পুতুলের লাহান লাগে গো আল্লাহ্। ও ম্যাডাম দেহা যান।

মহিলার চেচামেচি দৌড়ে এলো আনন্দি। আনন্দিকে দেখে অনুসমিকে ছেড়ে দিল মহিলাটি। আনুসমি এগিয়ে আনন্দির সামনে গেল। আনন্দিকে একটা ছোট্ট হাগ করে সামন থেকে সরে পড়ল। আনন্দি আনুসমিকে নিয়ে ঘরে গেল। ফ্রেস হতে বলে ওর জন্য হালকা কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করতে চলে গেল।

আনুসমি ফ্রেসহ হয়ে এসে দেখলো টেবিল ভর্তি খাবার। এতো কিছু দেখে বলল, আমি অাপনাকে সেদিন বলেছি না আমি ব্রেকফাস্টের পর হেভি কিছু খাই না তবে কফিটা নিব শুধু।

সেই মহিলাটা আবারও বলল,, ক্যান খাইবেন না ক্যা? অাফনে জানেন ম্যাডাম সেই সহাল থাইকা আফনের লাইগা রানধিছে। কত কষ্ট না হইচে, তই কয় কি আমার মাইয়া আইবে গো হাসুনির মা। আজ মুই মন ভইরা রান্ধুম।

– এই হাসুনি টা কে?

– আমার মাইয়ার না গো আফা। হের লাইগাই তো এতো কিছু করি , নাইলে মুই একডা প্যাট। যেহানে রাইত সেইহানেই কাইত। মাইয়াডার লাইগা নিজের কিছু করতে পারি না। তই মুই বুঝি মাইয়ার লাইগা বুকটা কতখানি ফাটে। হসুনিরে যহন হের বাপে লওয়া গেছিল মোর বুকডা ফাইটা যাইতাছিল। হ্যার লাই হেরে লওয়া মোর কাছে রাখছি। ছ্যালা লগে থাকলে তো বাঁশ তলাতো সুখ গো আফা, বাঁশ তলাতেও সুখ।

আনুসমি চোখ মুখ কুচকে তাকালো। তখন আনন্দি বলল, আহ্ হাসুনির মা। তুমি থামো তো। ওর যা মন চায় তাই খাবে এতো কথা বলো না।

– মুই কি সাধে কই গো আফা। তোমারে দেহা মোর বুকটা ফাটে। সহাল থাইকা দেখতাছি মাইয়াডা আইবো হের লাইগা তুমি কত কিছু করছ। মুই বুঝছি তুমি কতোখানি ভালাবাসো হ্যারে। তই কইসি। মোরা ছোটলোক জাত আমাগো মুহে এতো কথা মানায় না। তই সইতে না পারলে কি করুম, তহন মুখ খুইলা কইয়া ফালাই।

– শোনেন আপনার বাংলা ব্যকরনে ব্যাপক সমস্যা আছে। আপনি আমার কাছে বাংলা ব্যকরনে ক্লাস নিবেন বুঝছেন। আগে আপনাকে ভালো করে ভাষার প্রয়োগ শিখাতে হবে। এসব আজগুবি ভাষায় কথা বললে কেউ বুঝবে না। আবারও চোখ মুখ কুচকে বলল আনুসমি

– মোর ওই সব শেহনে দরকার নাই কা। মুই অশিক্ষতি ঠিক আছি।

– ওটা অশিক্ষিত হবে

এবার আনন্দি হাসুনির মার দিকে তাকিয়ে বলল, হাসুনির মা আর কোন কথা না। যাও রান্না ঘরে অনেক কাজ বাকি। সেগুলো কর আমি আসছি।

– হয় আমারে তো চুপ করাবেনই। তই যা বুঝেন করেন মুই আর কিছু কইতাম না।

বলেই হাসুনির মা হনহন করে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল।

আনুসমি টেবিল থেকে সত্যি সত্যি শুধু কফির মগটাই নিল। কফিটা হাতে নিয়ে আনুসমি ঘুরে দাড়াতেই দেখল ডাইনিং রুমের পাশেই একটা বড় বারান্দা রয়েছে। বারান্দাটার একপাশে কাচ দিয়ে ঘেরা আর অন্য পাশটা সম্পূর্ণ খোলা। বারান্দাতে নানা ধরনের গাছ দিয়ে ভর্তি করা। যেন একফালি বাগান করার চেষ্টা করা হয়েছে এই চার দেওয়ালের মাঝে। বারান্দার ঠিক মাঝখানটাই একটা মাঝারি সাইজের দোলনাও আছে। আর যে পাশে কাচ সে পাশটাতে একটা বিশাল বড় বইয়ের আলমারী। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে দোলনায় বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে বই পড়ার জন্য এই আয়োজন।

হাসুনির মাকে সব খাবারগুলো ফ্রিজে তুলে রাখতে বলে আনন্দিও এলো এক মগ কফি হাতে। আনুসমি ততক্ষণে দোলনায় বসে পড়েছে। দোলনাটার অপজিটে অবশ্য একটা মিনি সোফা রাখা। আনন্দি গিয়ে সেখানটাই বসল। আনুসমি তখনও বারান্দাটা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল। আনন্দির কথায় ওর ধ্যান ভাঙ্গে।

– কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।

– আপনার এই বারান্দাটা কিন্তু খুব সুন্দর।

আনন্দি একটু মিস্টি হাসল। আনুসমি আবার বলল, তো গল্প শুরু করেন।

– এখন? প্রায় দুপুর হয়ে এলো। এখন গল্প শুরু করলে দুপুরের খাবারটা মিস হয়ে যাবে। আগে খেয়ে নিই তারপর বলব?

আনুসমি শুধু মাথা নাড়াল। আনন্দি আবার উঠে গিয়ে বলল, আমার এখনও রান্না কিছুটা বাকী। আমি রান্নাটা সেরে নেই। তুমি বরং এখানেই বস। কিংবা টিভি দেখতে চাইলে সেটাও করতে পার।

আনন্দি কথাটা বলে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ আনুসমি পিছন থেকে ডাকল, শুনুন, আমি কি আপনার সাথে আসতে পারি?

– তুমি আমার সাথে রান্না ঘরে গিয়ে কি করবে? গরমে তাপে তোমার স্কিন নষ্ট হয়ে যাবে।

আনুসমি কিছু না বলে বসে রইল। আনন্দি যেন কিছুক্ষণ কিছু একটা ভেবে বলল, এসো আমাকে হেল্প করবে কিন্তু সাবধানে।

আনুসমির মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। সে মগটা হাতে নিয়ে সাথে সাথেই উঠে এলো।

সারাটা সময় মা মেয়েতে রান্না ঘরে নানা ধরনের রান্না করল। এই সময়ে আনুসমি আরও বেশী ফ্রি হয়ে গেছে আনন্দির সাথে। পুরোটা সময় ওরা খুনসুটি করতে করতেই রান্নাটা করল। দুজনেই আটা আর তেল হলুদ মাখিয়ে একাকার অবস্থা। আনন্দির রান্না শেষ হলে ও আনুসমিকে ফ্রেস হতে বলে গোসলে যাচ্ছিল। হঠাৎ আনুসমি পিছন থেকে ডেকে উঠল, মা।

আনন্দির বুকে যেন এক পশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিল । এতোদিনের জলে পুড়ে নিঃশেষ হওয়া বুকটা যেন এক মিনিটে শান্ত হয়ে গেল। সাথে সাথেই পিছন ফিরে তাকলো আনন্দি। আর সাথে সাথেই আনুসমি দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়ল আনন্দির বুকে। আজ মনে হচ্ছে বুকটা সত্যি ঠান্ডা হয়েছে। মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবীর সব শান্তি ওর মধ্যে বিরাজ করছে। এই একটা ডাকে এতো কেন শান্তি তা আনন্দি জানে না তবে এটুকু জানে এর পর ওর মরতে আর কোন আফসোস থাকবে না। একজীবনে যা যা পাওয়ার তা সব আজ পুর্নতা পেল।

কিন্তু ওই যে আনন্দি ওর সব অনুভুতি গুলো নিজের মধ্যেই দাফন করে দেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে তাই আজও কোন অনুভুতির প্রকাশ ঘটাল না। আনুসমি আনন্দিকে ছেড়ে দাড়াতেই আনন্দি বলল,, ওমা তুমি তো একদম ঘেমে গেছ। চলো আজ আমি তোমাকে গোসল করিয়ে দেব।

আনুসমি হাসতে হাসতে যেন কেদে দিল। ওরও দুই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। আনন্দিরও একই অবস্থা। কে বলেছে মা মেয়ের কোন মিল নেই। এই যে এতো এতো মিল, ওদের আবেগ অনুভুতি, সহন ক্ষমতা সব তো এক। এসব কি মিলের মধ্যে পড়ে না। এই জিনিসগুলোই তো মেয়েরা তাদের মায়ের কাছে পায় আর হয়ে ওঠে এক মহিওষী নারী।

আনুসমি সেভাবে কিছুক্ষণ আনন্দির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কিন্তু আমার তো কেন জামা আনি নি।

– আমার কাছে আছে, এসো।

আনুসমিও কোন কথা না বলে চলে গেল।

গোসল শেষে ওরা তিন জন একসাথে খেতে বসল। আজকেও আনন্দি আনুসমিকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। আজকে খাইয়ে দেওয়ার মধ্যে যেন এক আলাদা প্রশান্তি পাচ্ছে আনন্দি। আজ প্রকৃতরুপে নিজেকে মা বলে মনে হচ্ছে। একজন মায়ের তো তখনই সার্থকতা যখন তার সন্তান তাকে মা বলে ডাকে। জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় এটা যেমন ঠিক তেমনই মা ডাকে মাধ্যমে মা হয়ে ওঠা যায়। তা না হলে হাজার হাজার মায়েরা যারা অন্যের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে মা হওয়ার সপ্ন দেখছে তারা কোন দিন মা হতে পারত না। মা ডাকে মাধ্যমে মা হওয়ার একটা আলাদা মাত্রা থাকে।

আজ আনুসমি বেশ খুশি মনে খাচ্ছে আর আর রাজ্যে যতো কথা আছে বলে চলেছে। আনন্দির বেশ ভাল লাগছে ওর পুতুলটার কথাগুলো শুনতে কিন্তু খেতে খেতে কথা বললে তো গলায় আটকে যাবে। তাই আনন্দি কথা বলতে নিষেধ করছে কিন্তু কে শোনে কার কথা আনুসমি কথা বলেই চলেছে।

খাওয়া শেষে দুজনেই গ্রিন টি’র মগ হাতে নিয়ে আবার বারান্দায় গিয়ে বসল। আনুসমি এখনও চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখছে। তারপর আনন্দির দিকে তাকিয়ে বলল,, আচ্ছা আম্মু তুমি বই পড়তে খুব পছন্দ কর?

– হুম। আমার ভাল লাগে। আর একাকীত্বের সঙ্গীও বলতে পার।

– এখানে যতো বই রাখা সব তোমার পড়া?

– হুম, আর সব বইগুলো তোমার বাবার কিনে দেওয়া। আমার জন্মদিনে কিংবা আমাদের ম্যারেজ এনিভার্সারিতে ও সব সময় আমাকে বই গিফট করত। এমনকি ঈদের সময় অন্যরা জামাকপড় কিনে দেয় সেখানে তোমার বাবা দিত বই। ও নাকি আমার জন্য কি কিনবে বুঝত না তাই বই এনে ধরিয়ে দিত।

– বাবা তো এখনও এমন। আজ পর্যন্ত আমাকে ঠিক মতো কোন গিফট কিনে দিতে পারে নি। যখনই কিনতে গেছে কোন না কোন ঝামেলা বাধিয়েছে। তাই বাবা আমাকে টাকা দিয়ে দেয় আমি নিজে শপিং করি।

আনন্দি একটু মৃদু হাসল। মানুষটা এখনও পাল্টালো না। একটা বাচ্চার বাবা হয়ে গেছে এখনও নাকি কারও জন্য গিফট কিনতে পারে। কথাগুলো ভেবে হাসিটা আরও একটু চওড়া হল।

– তুমি বাবার দেওয়া বইগুলো এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছ। অবাক হয়ে বলল আনুসমি।

– তোমার বাবার দেওয়া এইটুকুই তো আমার সাথে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল আনন্দি।

– বল না আম্মু তুমি কেন আমাদের ছেড়ে গেছিলে?

– এটা অনেক বড় একটা গল্প মা। তোমার বাবার সাথে আমার শুরুটাই ঠিক ছিল না তাই আমাদের সম্পর্কটা টিকে নি। এইটা জানতে গেলে তোমাকে প্রথম থেকে সবটা শুনতে হবে। তুমি কি শুনবে?

আনুসমি বেশ দৃড় ভাবে বলল, হ্যা শুনব।

– বললাম তো বেশ বড় একটা গল্প। এতোটা ধৈর্য রাখতে পারবে?

অানুসমি অধৈর্য হয়ে বলল, পারব তো বললাম আম্মু। আর জানো আমার না বেশ এক্সসাইটেড লাগছে আমি আমার মা বাবার লাভ স্টোরি শুনতে পারব। কারও এমন ভাগ্য আছে।

আনন্দি একটু হাসল তারপর বলল, বেশ শুন তাহলে।

অতীত~~~~

আনন্দির মা মারা যায় খুব ছোটতে তখন ওর বয়স নয় বছর। ওর মা মারা যাওয়াতে ওর বাবা প্রচন্ড রকমের ভেঙ্গে পড়ে। ওর বাবা ওর মাকে খুব ভালবাসত। যদিও উনাদের এ্যারেন্জ ম্যারেজ তবুও ভালবাসা কখন হয় তা বলা যায় না। আনন্দির আর কোন ভাই বোন ছিল না। আনন্দির মা মারা যাওয়ার পর ওর বাবা আগে যে জবটা করত তা ছেড়ে দিয়ে একটা ছন্নছাড়া জীবন যাপন শুরু করে। তিনি কিছুতেই স্ত্রী শোক কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না। এমন কি সে সময়ে উনার আনন্দির দিকেও কোন নজর থাকত না। আনন্দিকে সে সময়টা ওর দাদু দিদাই পালন করেছে।

এভাবেই কাটে প্রায় একটা বছর। আনন্দির দাদু দিদা তখনও বেঁচে ছিলেন। ছেলের এমন ছন্নছাড়া জীবন দেখে তারা সিধান্ত নেয় যে ছেলের আবার বিয়ে দেবে। এতো যদি ছেলে আবার সংসারী হয়, আর আনন্দি তখন অনেক ছোট তাই ওর দেখা শোনার জন্য একজনকে দরকার । কিন্তু আনন্দির বাবা আহসান হোসেন কিছুতেই বিয়ে করবে না। আর তাই উনি আনন্দিকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যায়। আর সেখানে গিয়ে ব্যবসা করার সিধান্ত নেয়।

কিন্তু একবছর চেষ্টা করেও তিনি কোন ব্যবসাতে উন্নতি করতে পারছিলেন না। কারন তখনও তিনি স্ত্রী শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন নি, ফলে ব্যবসাতে তার কোন মনোযোগ থাকত না। ফলে প্রচুর লস গুনতে থাকেন।

অন্যদিকে তখনও বাসায় বিয়ে জন্য চাপ আসছিল। বিয়ে করছিলেন না বলে বাসা থেকে তাকে কোন সাহায্যও করা হচ্ছিল না। ফলে তিনি একদম অথৈ সাগরে পড়ে যান। তিনি একপ্রকার রাগ করে বিয়েতে মত দেন আর এও বলে দেন যে আনন্দির যেন কোন কষ্ট না হয়।

মেয়ে ঠিক করা হয় সেই গ্রামেরই। মেয়ের বাবা গরীব ছিল বিধায় এমন সন্তান সম্রেত পাত্রর সাথে বিয়ে দিতে রাজী হয়ে যায়। বিয়ের পর কিছুদিন ভালই চলছিল। আহসান হোসেন বিয়ে করে আবারও শহরে চলে আসেন বউ নিয়ে। কিন্তু ব্যবসা থেকে কোন উন্নতি না হওয়াতে তারই এক বন্ধুর পরামর্শে তিনি বিদেশ যাওয়ার সিধান্ত নেন।

এমনিতে তখনও অন্য কাওকে তিনি আনন্দির মায়ের জায়গায় বসাতে পারছিলেন না। কিন্তু বাসায় যাওয়ার পর দেখতে হয় অন্য একটা মেয়ে তার বউয়ের জায়গায় দিব্যি সংসার করছে, তা সহ্য করতে পারেছিলেন না তিনি। কিন্তু এই মেয়েটাকেও উনি বিয়ে করেছিলেন তাই ফেলেও দিতে পারছিলেন না। আর আনন্দিরও দেখা শোনার জন্য কাউকে দরকার। তাই তিনি সিধান্ত নেন যে তিনি এই সব ছেড়ে দুরে কোথাও চলে যাবেন ফলে তাকে অন্য কোন মেয়েকে তার সংসারে সহ্য করতে হবে না। আর বিদেশে গিয়ে টাকা পয়সা রোজগার করে বাসায় পাঠালে তার সংসারটাতেও আর টানাপোড়ন থাকবে। এককথাই তিনি এই সংসার জীবন থেকে পালাতে চাইলেন।

বিয়ের প্রায় বছর দুই পরে উনি পাড়ি জমায় বিদেশে। তখন উনার দ্বীতিয় পক্ষের কোলে একটা ছেলে ছিল। এতো দিন আনন্দির দ্বীতিয় মা ওকে বেশ আদর যত্ন করলেও ওর বাবা চলে যাওয়ার পর শুরু হয় উনার আসল রুপ।

একজন সৎ মা যেমন হয় তিনিও তেমটাই হয়ে ওঠেন খুব অল্প সময়ে। আনন্দি তার এই হঠাৎ পরিবর্তন যেন একেবারে সহ্য করতে পারল না। কিন্তু কিছু করার ছিল না। বাবা অনেক দুরে আর ততদিনে দাদা দাদুও মারা গেছেন। তাই আনন্দিকে মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়। আনন্দিকে উনি পড়াশোনার অনুমতি দিয়েছিলেন কারন ওর বাবা চায় তাই। কিন্তু বাড়ির সব কাজ শেষ করে তবেই ও স্কুলে যেতে পারত।

এভাবেই কেটে যায় তিনটে বছর। আনন্দি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে আসে। এই তিন বছরে আহসান হোসেন একবারও দেশে আসেন নি। কথা হয় মেয়ের সাথে তবুও হাতে গোনা বেশ কয়েকবার। মেয়ে ছোট বিধায় তাকে ফোন দেওয়া হয় নি আর উনার বউকে ফোন দিলে নানা অজুহাতে কথা বলতে দেয় না। বিষয়টা তাকে পোড়ায় তবুও তিনি দেশে আসার সিধান্ত নেন না।

কলেজে প্রথম দেখা হয় সমাপ্তর সাথে আনন্দির। যদিও সমাপ্ত ছিল বিজ্ঞান বিভাগের আর আনুসমি মানবিক। তবে এক ক্যাম্পাসে প্রায় দেখা হতো দুজনের। সমাপ্তদের একটা একটা ফ্রেন্ড গ্যাং ছিল। ওরা প্রায় দশ বারো জন মিলে সবসময় হাসি মজা আড্ডায় মেতে থাকত। ক্যাম্পাসে ওদের দেখে আনন্দির বেশ ভাল লাগত। মনে হতো ওদের সাথে গিয়ে আড্ডা দিতে কিন্তু পারত না।

আনন্দিও একটা ছোট্ট মেয়ে ছিল কতো বয়স আর তখন হতো। এবয়সের ছেলে মেয়েরা তো এমনই হাসি আড্ডায় সময় কাটানোর কথা। কিন্তু ওর জীবনটা আলাদা ছিল। ওকে ওর মা ভাল জামা কাপড় কিনে দিত না। ও সবসময় একটা কাজের মেয়ের মতোই থাকত। ময়লা জামা, এলোমেলো চুল, উস্কোখুস্কো চেহারা। আর তার জন্য ওর সাথে কেউ মিশতে চায় তো না। ফলে কলেজে ও একাই থাকত পুরোটা সময়। তাই তো সমাপ্তদের এমন হাসতে, মজা করতে দেখলে ওর ভাল লাগত। মনে হতো ওর ও যেতে। কিন্তু ভয়ে যেতে পারত না। কলেজে কেউ মিশে না ওর সাথে আর কেন মিশে না তা ও জানে। ওরা যদি ওকে অপমান করে, ভয়ে দুর থেকে ওদের দেখত আনন্দি।

তার কিছুদিন পরের ঘটনা~~

একদিন আনন্দি কলেজে থেকে ফেরার সময় কলেজের সামনে রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা গাড়িতে ধাক্কা খায়। ও আগে খেয়াল করে নি অন্য পাশ থেকে যে গাড়ি আসছে। গাড়িটা আনন্দিকে ধাক্কা দিয়েই পালিয়ে যায়। আর আনন্দি গিয়ে পড়ে রাস্তার মাঝখানটাই। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পায়, ফলে রক্তে পুরো রাস্তা যেন ভরে গেছে। রাস্তা লোকজন এগিয়ে এলেও একে ধরতে ভয় পাচ্ছিল। কারন যেমন ভাবে এক্সিডেন্টটা হয়েছে সবাই ভেবেছিল ও মারা যাবে।

ঠিক সেই সময় কলেজ থেকে বের হচ্ছিল সমাপ্তদের গ্যাংটা। ওরা আনন্দিকে দেখে চিনতে পারে যে মেয়েটা ওদের কলেজের। আসেপাশের মানুষের এমন নির্বিকার ভাবে দাড়িয়ে থাকা দেখে প্রচন্ড রাগ হয় তাদের। ওরা সবাই মিলে আনন্দিকে হসপিটালে নিয়ে যায়।

কলেজে কারও সাথে আনন্দির কখনও কথা না হওয়ার আনন্দির পরিচয় কেউ জানত না। ফলে ওর বাড়িতে কেউ কোন খবর পাঠাতে পারে নি। আর পেসেন্ট ভর্তির সময় তো পরিবারকে থাকা লাগে। ওরা কোন উপায় না দেখে ওদের মধ্যে দুইজন অানন্দির ভাই বলে পরিচয় দিয়ে হসপিটালে ভর্তি করে।

আনন্দিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। টাকার কথা ওদের বললে ওরা বলে অপাতত চিকিৎসা শুরু করতে। রিলিজের সময় পুরোটাকা দিয়ে দেবে। হসপিটাল থেকে আর কোন চাপ দেওয়া হয় নি।

আনন্দিকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে যখন অাই সি ইউ তে সিফট করে তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। কিন্তু আনন্দির তখনও জ্ঞান ফেরে নি। তবে ডাক্তাররা বলেছেন আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসবে। আনন্দির জ্ঞান না ফেরায় ডাক্তার বলে যে কেউ যেন রাতে হসপিটালেই থাকে। কারন রাতে যদি কোন বাড়াবাড়ি হয় তো উনারা তার দ্বায়িত্ব নিতে পারবেন না।

ওদের মধ্যে যে মেয়েগুলো ছিল ওদেরকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে বাকিরা রাতে সেখানে থাকার সিধান্ত নেয়। আর এতোটা সময়ে কেউ করারও বাসায় জানানোর কথা মনে আসে নি। সারা রাত ওরা হসপিটালের ওয়েটিং রুমে থাকে। রাতে আর কোন বাড়াবাড়ি হয় নি তবে এখনও জ্ঞান ফেরে নি।

সকাল হতে মেয়েগুলো রেডি হয়ে কলেজ ড্রস পড়ে হসপিটাল আসে। আর যারা রাতে ছিল তাদের বলে তারা যেন বাসায় যেয়ে ফ্রেস হয়ে আসে। ততটা সময় ওরা এখানে থাকবে।

সমাপ্ত সহ ওর ফ্রেন্ডরা সারা রাত হসপিটালের ওয়েটিং রুমে কাটিয়ে বেশ ক্লান্ত তাই ফ্রেস হওয়ার জন্য বাসায় যায়। আর সারা রাত কোন খাবারও পড়ে নি পেটে, ফলে খিদাও লেগেছে।

সমাপ্ত বাসায় গিয়ে ঢুকতেই দেখে ওর বাবা মা সহ বাসার সবাই ড্রয়িং রুমে সোফাতে বসে আছে। ওর বাবা মা দুজনেরই চোখ লাল বর্ণ হয়ে আছে। সমাপ্তর হঠাৎ মনে পড়ে যায় ও যে সারারাত বাসায় ফেরে নি এটা ও বাসায় বলতে ভুলে গেছিল। হয়তো সারা রাত ওর বাবা মা অনেক চিন্তা করেছে। আর কেউ যে ঘুমায় নি তা তাদের চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে।

সমাপ্ত ওর কাজের জন্য অনুতপ্ত কিন্তু বাবা মা যেভাব রেগে আছে আজকে কি কুরুক্ষেত্র করে তা ভেবে ওর হাত পা কাপতে শুরু করে। কোন রকমে ভয়ে এক জায়গাতেই গুটসুটি হয়ে দাড়িয়ে থাকে ও,,,

চলবে,,,,

জাকিয়া সুলতানা

বি দ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here