গোধূলি বেলায় পর্ব ৪

#গোধূলি_বেলায়
#পর্ব_4

আমি জানতাম তুমি আমাকে ঠিক ফোন করবে।
ফোন ধরেই আনন্দি এই কথাটি বলল। আনুসমি হেসে বলল,, এতো ওভারকনফিডেন্স!

– ওভারকনফিডেন্স না এটাকে ভালবাসা, মায়া, টান বলে।

– আপনার উপর আমার কোন টান নেই।

– আনন্দি হাসল তারপর বলল, টান না থাকলে তুমি গত দুদিন ধরে আমাকে ফোন করা নিয়ে এমন দোটায় থাকতে না।এটাকেই টান বলে।

– আপনি কিভাবে জানলেন আমি আপনাকে দুদিন থেকে ফোন করা নিয়ে দোটায় ছিলাম?

– ওই যে বললাম টান। টান থেকেই,,,

– টান আমার প্রতি আপনার টান, হাসালেন। এই টানের জন্যেই বুঝি ছেড়ে যেতে পেরেছিলেন। যাই হোক আমি আপনার সাথে আরও একদিন দেখা করতে রাজি কিন্তু এবার কথা দিতে হবে আপনি আমাকে সব বলবেন।

– কবে দেখা করবে বল?

– আমার কোন তাড়া নেয়। বাবার সাথে ট্রিপটা ক্যানসেল হয়ে গেছে। আপনি যেদিন বলবেন?

– আচ্ছা এবার তাহলে আমরা বাইরে না মিট করে আমার বাড়িতেই করি। আমি তোমার জন্য তোমার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করব। সারাদিন খাওয়া হবে আর মন ভরে গল্প হবে।

– আচ্ছা আমার আপত্তি নেই।

– কাল গাড়ি পাঠায় তোমাকে আনার জন্য?

– না পরশুদিন পাঠান।

– আচ্ছা ভাল থেক।

– হুম আপনিও। বলে কলটা কেটে দিল আনুসমি।

ফোনটা বেডের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়েই আনুসমি গেল সমাপ্তর ঘরের দিকে। ঘরের সামনে গিয়ে থমকে দাড়াল। দেখন সমাপ্ত ল্যাপটপে চোখ রেখে কোন কোজ করছে। আনুসমি দড়জার বাইরে পায়চারি করতে লাগল। সে কিছুতেই ঘরে ঢুকতে পারছে না। মন হচ্ছে যেন কিছু একটা তাকে বারবার টেনে ধরছে। প্রচন্ড অপরাধ বোধ হচ্ছে, ফলে সমাপ্তর সামনে যাওয়ার সাহস যোগাতে পারছে না।

সমাপ্ত ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল, ঘরে এসো। অহেতুক বাইরে পায়চারি করার কোন মানে হয় না। এটা তোমার বাবার ঘর এতো সংকোচের কিছু নেই।

আনুসমি যেন আরও একটু সংকুচিত হল। ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ওর কোন চুরি ধরা পড়ে গেছে আর ওকে কঠিন শাস্তির জন্য কাঠগড়ায় দাড় করানো হয়েছে। কোন রকমে ধীমী পায়ে ঢুকল ঘরের মধ্যে। ও গিয়ে ওর বাবার পাশে শোফাতে ধপ করে বসে পড়ল। সমাপ্ত তখনও ল্যাপটপ কাজ করে চলেছে। আনুসমির মুখে যেন সুপারগ্লু এটে গেছে। বসার পর থেকে একটা কথাও বলতে পারে নি শুধু ফ্যালফ্যাল করে সমাপ্ত দিকে তাকিয়ে আছে। সমাপ্ত ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল,,,

– আমি জানি তুমি কি বলতে এসেছ। তুমি তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে চাও তাই তো।

বলে একটু থামল। এবার ফিরে আনুসমির দিকে তাকাল। আনুসমি কোন রকমে মাথা নাড়ল। ওর প্রচন্ড অপরাধ বোধ হচ্ছে। ও জানে ওর বাবা ওর মাকে ছাড়া কতোটা কষ্টে থাকে। তাই ও কখনও চায় নি ওই মহিলাটার সাথে আবার কখনও ওদের দেখা হোক আর ওর বাবা আরও বেশী করে কষ্ট পাক। কিন্তু আজ ওর জন্যই ওর মা আবার ওদের জীবনে এসেছে আর বারবার এসে ওর বাবাকে কষ্ট দিচ্ছে। এটাই আনুসমির অপরাধ বোধে মুল কারন।

শুধু মাথা নাড়িয়ে যে সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। তাই অনুসমি ওর বাবাকে আরও কিছু বলতে চাইল,,,

– আসলে বাবা,,,

সমাপ্ত বলে উঠল, এতো তোতলাচ্ছ কেন? আমি সব জানি। এই যে দুই দিন আগেও তুমি ওর সাথে দেখা করে এসেছ এটাও জানি। আর বিশ্বাস কর আমি একটুও কষ্ট পাই নি।

– সরি বাবা আমি আসলে,,,

– সরি বলার কোন প্রয়োজন নেই মামুনি। বললাম তো আমি কষ্ট পাই নি। বরং খুশি হয়েছি। আমি সবসময় চেয়েছি তুমি তোমার মায়ে সাথে থাক, তার ভালবাসা পাও, তার সান্নিধ্য পাও। আমার একটা ভুলে জন্য তুমি কষ্ট পাও এটা আমি চাই না।

– তোমার কোন ভুল ছিল না বাবা। ভুল উনার ছিল যে উনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছিলেন।

– ভুল না সেটা অপরাধ ছিল। আমি তোমার মায়ের সাথে একটা অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছিলাম। আর সেটা যখন বুঝতে পেরেছিলাম তখন অনেক দেরী হয়ে গেছিল। তখন আর সে ফেরে নি। আমি তাকে ফেরাতে পারি নি।

– তো কি হয়েছে মানুষ মাত্রই ভুল হয় তাই বলে উনি আমাদের ছেড়ে যাবে?

– বললাম যে ভুল নয় অপরাধ। অনেক বড় অপরাধ। আমি চাই এ সম্পর্কে তুমি তোমার মায়ের কাছ থেকেই সব শুনবে। কারন আমি বললে হয়তো আমার ভুলগুলো কম করে বলব তাই তাই তুমি ওর থেকেই শুনো।

– সে যে বেশী করে বলবে না তার কি প্রমাণ?

– বলবে না। কখনও বলবে না। ও এমনই ছিল, কখনও কারও খারাপ চাই নি। সবসময় নিজের ঘাড়ে সব দোষ নিয়ে নিত। এভাবে যে ও আমাক কত বার বাচিয়েছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। আমার বিশ্বাস ওর আমার উপর অনেক রাগ আছে, অনেক অভিযোগ আছে কিন্তু তাই বলে আমার নামে খারাপ কিছু কখনও বলবে না। এমটাই ছিল আমার আনন্দি ।

আনুসমি আর কিছু বলল না। নিশব্দে উঠে নিজের ঘরে চলে এলো। এতোদিন বাবার মুখে ওর মা সম্পর্কে এসব কথা শুনলে মনে হতো, এসবই ভণ্ডামি ছিল। বাবা তুমি খুব বোকা বলে উনাকে এতো বিশ্বাস করছ। কিন্তু আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে ওই এতোদিন ভুল ছিল আর বাবা ঠিক ছিল। হয়তো ও ওর মাকে চিনতে পারে নি ঠিক করে। প্রচন্ড দোটানায় ভুগছে। আনুসমি ফলসরুপ চোখে কোন ঘুম নেই।

অনেকক্ষণ বিছানায় এদিক সেদিক করেও যখন ঘুম আসল না তখন আনুসমি উঠে ওর বাবার ঘরে গেল। সমাপ্ত তখনও ঘুমায় নি। দিনের এই সময়টা ওর খুব দুর্বিষহ কাটে। নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব যেন একেবারে ঘিরে ধরে, খুব পোড়ায়। আর বারবার করে মনে হয় এরজন্য ও একা দায়ী। ও এতোটা সর্থপর যদি সেসময় না হতো তাহলে আজ ওর জীবনটা এতোটা একাকীত্বে ঘিরে ধরত না। আজ ওর কর্মফলের জন্য ওর বাবা মাও ওর সাথে থাকে না। সব কিছু হারিয়ে এই মেয়েকে নিয়েই একমাত্র বেঁচে থাকা। আজকাল এটা নিয়েও ভয় হয়। যদি আনুসমি সব জানার পর ওকে ভুল বুঝে? যদি থাকতে না চায় ওক সাথে? এই জীবনে যে বাঁচার আর কোন অবলম্বন থাকবে। আনন্দির উপর বিশ্বাস আছে যে ও আনুসমিকে কখনও ওর থেকে কেড়ে নেবে না কিন্তু যদি আনুসমি নিজে আর ওর সাথে থাকতে না চায় তখন। তখন কি হবে?

– বাবা আসব?

আনুসমির ডাকে পিছন ফিরে তাকায় সমাপ্ত। এতো রাতে আনুসমিকে দেখে বলে,, কি ব্যাপার মামুনি তুমি এখনও ঘুমাও নি?

আনুসমি বিছানার কাছে গিয়ে বিছানাটা ঝাড়তে শুরু করল। বিছানাটা ঝাড়তে ঝাড়তেই বলল, না ঘুম আসছে না। আমি আজ তোমার সাথে ঘুমাবো।

কথাটা শুনে সমাপ্তর বুকে যেন একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেল। সমাপ্ত আর দেরী না করে দ্রুত এসে শুয়ে পড়ল। আর আনুসমি শুলো সমাপ্তর বুকের উপর। ছোট থেকেই মেয়েটা সমাপ্তর বুকে ঘুমাতে পছন্দ করে। সমাপ্তর বুকে একদম চুপটি করে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে ঠিক একটা বাবুই পাখির বাচ্চার মতো।

আনুসমিকে বুকে নিয়ে সমাপ্তর যেন সব চিন্তা নিমিষেই ভ্যানিস হয়ে গেল। মেয়েটা থাকলে যেন ওর পুরো পৃথিবী পরিপূর্ণ থাকে। আর এই পৃথিবীটা ছাড়া ও থাকবে কিভাবে? আজ ওর কোন মতেই ঘুম হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু আনুসমিকে বুকে নিয়ে কয়েক মুহু্র্তের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

পরের দিনটা পুরোটা আনুসমি কাটালো ওর বাবার সাথে। বাবার অফিসের সব কলিগরা ওকে চেনে। আগেও আনুসমির স্কুল ছুটি থাকলে ও প্রায় বাবার সাথে অফিসে চলে যেত। সমাপ্তর সব কলিগরা খুব আদর করে আনুসমিকে। সমাপ্ত অফিসে গিয়ে বেশী সময় থাকল না। বসকে বলে বেড়িয়ে এলো, যদিও নতুন এই প্রজেক্টটার জন্য বস কিছুতেই ছুটি দিতে চাইছিল না। কিন্তু সমাপ্তকে আটকাবে কে? বেশী তেরিবেরি করলে ও জবটাই ছেড়ে দিত তাই বেশী ঘাটল না আর।

পরের সম্পূর্ণটা সময় ওরা শহরের নানা পার্ক আর শপিং মলে কাটালো। লাঞ্চটাও রেস্টুরেন্টে করল। ইচ্ছামতো শপিং করল আনুসমি। প্রায় অনেকদিন পর বের হয়েছে বাবা মেয়ে। রাতে ডিনার করে একোবারে বাসায় ফিরল ওরা দুজন। আজ অনেকদিন পর সমাপ্তর মনটা যেন হালকা লাগছে। সবসময় সবটা জানার পর অানুসমির রিয়াকশান কেমন হবে সেটা ওকে এতোদিন কুড়ে কুড়ে খেত। কিন্তু আজ কেন যেন আর সে সব নিয়ে ভাবছে না সমাপ্ত। মন বলছে যা হবে ভালোর জন্য হবে। কিন্তু তবুও আনুসমির সবটা জানা উচিত।

আজকেও আনুসমি সমাপ্তর কাছেই থাকল। বাবা মেয়েতে অনেকটা সময় গল্প করে তারপর ঘুমাল। আজ যেন একটা প্রশান্তির ঘুম হচ্ছে বাবা মেয়ে দুজনেরই।

সকালে আনুসমি ঘুম থেকে উঠে সমাপ্তকে পেল না। সমাপ্ত প্রত্যেকদিন সকালে জগিং এ যাওয়ার অভ্যাস আছে। আনুসমি উঠতে দেরী করে ফেলেছে তাই সমাপ্তর দেখা পেল না। উঠে নিজের ঘরে গেল আনুসমি।

সমাপ্তর সাথে দেখা হল একেবারে ব্রেকফাস্ট টেবিলে। দুজনেই চুপচাপ খাচ্ছিল। হঠাৎ সমাপ্ত বলল, তুমি কখন বেড়োবে?

আনুসমি হঠাৎ কথা বলাতে চমকে ওঠে। বুকে থুথু দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোথায়?

সমাপ্ত আনুসমির দিকে তাকল তারপর আবার খাওয়াতে মনোযোগ দিল। তারপর বলল, তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে।

– এই তো দশটার দিকে গাড়ি আসবে।

– আচ্ছা রাতে দেখা হচ্ছে মামুনি। আমি এখন আসি।

– আল্লাহ হাফেজ বাবা।

– আল্লাহ্ হাফেজ।

আনন্দির গাড়িটা আজকেও ঠিক দশটায় আসল। আনুসমি রেডী ছিল চটপট গাড়ীতে গিয়ে বসল। গাড়িটা এসে থামল একটা দশতলা অ্যাপাটমেন্টের সামনে। গাড়ি থেকে নামতেই ড্রাইভার বলল, ছয় তলাতে সি ইউনিট।

– কি বললেন?

– ছয়তলার সি ইউনিটে ম্যাডাম থাকে।

– আচ্ছা ধন্যবাদ।

আনুসমি গিয়ে লিফটে উঠল। অজ ওর মনটা বড় ছটপট করছে। মনে হচ্ছে যেন আজ খারাপ কিছু হতে চলেছে। কিন্তু কি সেটা বুঝতে পারছে না। কিন্তু মনটা বড় কু ডাকছে।

চলবে,,,

জাকিয়া সুলতানা

বি দ্রঃ আজকে পর্বটা ছোট হয়েছে আমি জানি। পরের পর্ব বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here