গোধূলী আকাশ লাজুক লাজুক ২ পর্ব -১৬

#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৬)
সিজন ২
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৩৫.
একটা বড় শাড়ির দোকানে সবাই বসে আছে। লেহেঙ্গা কেনা শেষ। এখন বিয়ের পর পরার জন্য শাড়ি দেখা হচ্ছে। ইরফান এক ঘন্টা হতে না হতেই বিরক্ত হয়ে গেছে। মেহজারও একই অবস্থা। ইচ্ছে করছে সব ছেড়ে ছুড়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে লম্বা এক ঘুম দিতে।
ইরা বলছে এই তো আর একটু, আর একটু। সেই আর একটুর আর শেষ নেই। শাড়ি কেনা শেষ হতেই আবার জুয়েলারি আর কসমেটিক্স কেনা হলো। সব শেষে মেহজার আর পা চলল না। কিন্তু ইরফানের চার বোনের মধ্যে কোনো ক্লান্তি নেই। ইনায়া ফেরার সময় বলল,
-‘পারফিউম নেওয়া বাকি রইল এখনো। মনে করিয়ে দিতে পারলিনা কেউ?’
ইরফান বলল,
-‘আপা এবার গাড়িতে ওঠ। অনেক কেনাকাটা হয়েছে। দরকার পরলে কাল আবার আসবি। তবুও আজ চল।’
-‘এই জন্য আমি তোকে সাথে নিয়ে কোথাও যেতে চাইনা। সবকিছুতেই তোর বিরক্তি। পার্টি করতে গেলে তো তোর বিরক্তি আসেনা।’

ইরফান চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। এই বোনগুলো শুধু তার রাজনীতি নিয়ে খোঁচা মারে সবসময়। এদের এত সমস্যা কেন তার পার্টি নিয়ে?

যা যা শপিং করা হলো সবকিছুই ইরফানের গাড়িতে তোলা হলো। প্রচন্ড রা’গ হলেও সে সামলে নিলো। বিয়ে করা এত ভেজালের কেন?

গাড়িতে উঠার পর ইকরা আবার কল দিল। ইরফান বলল,
-‘এখন আবার কি!’
-‘সামনের রেস্টরন্টটাতে নামব। কারোই লাঞ্চ করা হয়নি।’
-‘সেটা এখন মনে পড়ল!’

ইরফান কলটা কেটে দিল। পাশে থাকা মেহজার দিকে তাকালো। মেহজা তার থেকেও বেশি ক্লান্ত যা তার চোখ মুখে স্পষ্ট। ইরফান বুঝতে পারল মেহজা তার বোনদের মতো শপিং এ গিয়ে এত ছোটাছুটি করার মানুষ নয়। তার মতোই! যাক ভালো হলো। ছেলেরা তো এমন বউ-ই চায়।

গাড়ি থামিয়ে সবাই খাবার খেয়ে নিলো। মেহজার এত খারাপ লাগছিল যে ফ্রাইড রাইস একটু মুখে দিয়ে আর খেতে পারল না। তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। সকালেও সে ঠিক মতো খেয়ে বের হয়নি। সারাদিন ছোটাছুটি করায় আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে সে।
ইরা মেহজার জন্য কিছু খাবার পার্সেল করে নিলো। বলল যখন ভালো লাগবে তখন খেয়ে নিতে। মেহজা
মনে মনে হাসে। তার আজ আর ভালো লাগবেনা। এগুলো সেই রাফসান আর খালামণির পেটেই পড়বে।

বাসায় ফিরে মেহজা শাওয়ার নিয়েই ঘুম দিলো। আর রাতে ঘুম থেকে উঠে ভাত খেলো ঘন ডাল আর রুই মাছ ভাজা দিয়ে। ইরার পার্সেল করে দেওয়া খাবার খালামণি, রাফসান আর খালামণির মেয়ে আয়রা খেয়েছে।

যেহেতু সারা সন্ধ্যা ঘুমিয়ে রাতে উঠেছিল সে তাই আর তার ঘুম আসছিল না। খালামণি তার পাশেই শুয়ে আছে। আর বেশ জোরে জোরে নাক ডাকছে। মেহজার এত বিরক্ত লাগছিল। দুইবার খালামণিকে ঝাকি দিলেও সে নড়েনা, চড়েনা, নাক ডাকাও বন্ধ করেনা। অগত্যা এই বিরক্তির বোঝা মাথায় নিয়েই সে শুয়ে আছে।

রাতের তখন একটা ছুঁই ছুঁই। মেহজা সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। তখনই টুং করে তার ফোনটা কেঁপে উঠল। মেহজা সচরাচর মেসেজ এলে চেইক করেনা। সিম কোম্পানি ছাড়া আর কেউ যে মেসেজ দেয়না তাই। তবে আজ কি মনে করে ফোনটা হাতে নিলো। স্ক্রিনে ভাসছে এগারো সংখ্যার একটি ফোন নাম্বার। যে নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে,
-‘জেগে আছো?’

মেহজা ভাবল এটা আবার কে! কোন পাগল? এত রাতে মেসেজ দিয়ে বলছে জেগে আছো। সে ভাবল রিপ্লাই দিবেনা নাম্বারটা ব্লক করে দিবে। কিন্তু সে তার ইচ্ছার পুরো বিপরীত কাজ করে রিপ্লাই দিলো,
-‘তুই কে?’

ওপাশ থেকে আর কোনো মেসেজ এলো না। মেহজার হাসি পেলো। এই কাজটা কে করতে পারে ভাবতে থাকে। তখনিই তার ফোনটা জোরে শব্দ করে উঠল। কল এসেছে। আননোন নাম্বার। মেহজা চেইক করে দেখে মেসেজ দেওয়া সেই নাম্বারটাই। সে কি করবে বুঝতে পারছেনা। তবে ফোনটা সাইলেন্ট করে ফেলল সাথে সাথেই। খালামণি শুনলে খবর আছে। কলটা কেটে গিয়ে আবারও এলো। মেহজা কি করবে বুঝতে পারছেনা। সে শোয়া থেকে উঠে বসে। ফোনটা হাতে নিয়ে বেলকনির গ্লাস খুলে বেলকনিতে চলে গেল। রাতের শহরটা দেখে সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। কি স্নিগ্ধ! আজ একটা চাঁদ ও উঠেছে। চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে চারিপাশে। দ্বিতীয়বারেও কলটা কেটে গেল। সে রিসিভ করার অবকাশ পেল না। কিছুক্ষণ পর আবারও কল এলো। মেহজার মনে হলো ওই পাশের মানুষটা নিজেকে বুঝিয়েছে এটাই শেষবার এরকম ভেবে চিন্তে এখন কল করেছে। ভেবেই সে মৃদু হাসে। তবে এবার আর দেরি করল না। চট করেই কলটা রিসিভ করল। তখনিই ওপাশ থেকে এক গম্ভীর পুরুষ গলা মৃদু ধ’ম’কে সুরে বলে উঠল,
-‘একটা কল ধরতে এত সময় লাগে?’
আকস্মিক মেহজা ধরতে পারল না মানুষটা কে। সে বলল,
-‘আপনি কে?’
-‘আপনি! একটু আগে তো তুই বলছিলে।’
-‘এখনও বলব। তুই কে?’
-‘মেহজা!’

মেহজা একটু কেঁপে উঠল। ইরফান মনে হলো না? এটা ইরফান! কিন্তু সে কল দিবে কেন? নাম্বার পেয়েছে কোথায়? একটু সময় নিয়ে বলল,
-‘ইয়াজিদ ভাইয়া বলছেন?’
ওপাশ থেকে ছোট করেই উত্তর এলো,
-‘হু।’
-‘ওহ। আপনি হঠাৎ মেসেজ দিচ্ছেন যে? আসলে আমি তো চিনতে পারিনি তাই ওইভাবে বলে ফেলেছি।’
-‘চিনতে না পারলেই এমন করবে? তুমি ভীষণ ম্যানারলেস।’
মেহজার মাথায় দপ করে আ’গু’ন জ্ব’লে উঠল। এত বড় কথা! সে ম্যানারলেস? হাউ ডেয়ার হি! ভালো হয়েছে তুই বলেছে। দরকার পড়লে আরো বলবে। বেশি বেশি করে বলবে।
ইরফান বলল,
-‘চুপ করে আছো কেন? কথা বলছ না কেন? কথা না বলাও একটা বেয়াদবির মধ্যে পড়ে। তুমি ম্যানারলেস তারই সাথে বেয়াদবও বটে।’
মেহজার ইচ্ছে করছিল ইরফানের মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে। নিজে থেকে কল দিয়ে এত অ’প’মা’ন করছে? তারও কি ঠ্যাকা পড়ছে যেচে পড়ে অপমানিত হওয়ার? সে ফট করে বলল,
-‘তা বেয়াদব আর ম্যানারলেস মেয়ের সাথে কি কথা? আপনি ভালো মানুষ। ভালো মানুষের সাথেই কথা বলেন।’

কলটা কেটে দিয়ে সে ইরফানের নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্টেড করে দিলো। আর ইরফান ফোনের স্ক্রিনে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। সে পুনরায় কল করতে গেলে ব্যস্ত বলছে ওপাশ থেকে। সে বুঝল তার নাম্বার ব্লক করা হয়েছে। সে চাইলেই অন্য নাম্বার থেকে কল করতে পারে। তবে দরকার কী! মেহজা তার ঘরে আসুক একবার। সামনে বসিয়ে সে ব্লক ছুটাবে। পাঁজি মেয়ে! কোথায় সে ভেবেছিল কিছু সুন্দর কথা বলে আর নানান কথার ছলে মেহজাকে বিরক্ত করবে ল’জ্জায় ফেলবে। সেইসব আর হলো কোথায়? এই মেয়ের ঝাঁঝ কমার নয়। তাকেই এবার নিজ দায়িত্ব নিয়ে অঙ্গের সেই বি’ষ ছাড়াতে হবে।

৩৬.
ইরফানদের পরিবার থেকে মেহেদি অনুষ্ঠান আর সংগীত অনুষ্ঠান করার কথা বললেও মেহজা রাজি হলো না। তার শরীর ভালো যাচ্ছেনা। গতরাতে জ্বর এসেছে। তাই একেবারে হলুদের আয়োজনই করা হলো। আগামীকাল হলুদ। সেই ভাবেই আয়োজন চলছে। দাওয়াত পর্ব শেষ হয়েছে। অতিথি বলতে কাছের আত্মীয় স্বজনরাই। তারা কেউ কেউ এসে পড়েছে। মেহজার জ্বর শুনে ইরফানের পরিবারের সদস্যরা তাকে দেখে গেল। সবাই এলেও ইরফান আসেনি। সবাই বলছে কাজের চাপে এই কয়দিন ব্যস্ত ভীষণ। সময় পেলে আসবে। মেহজা জানে সময় পেলেও ইরফান আসবেনা। ইরফান যে রে’গে আছে তা সে ভালোই বুঝতে পেরেছে।

পরদিন হলুদ অনুষ্ঠান হলো বেশ আয়োজন করে। ইরফানকে দেখল পাশাপাশি থাকল ছবি তুলল তবে কথা হলো না। মেহজা মনে মনে ভাবে এত কীসের ভাব? পুরুষ মানুষের ভাব দেখলে গা জ্ব’লে যায়।

পরদিন পার্লারে সাজানো হলো তাকে। অনা আর প্রথিও এলো। সেখান থেকে সোজা কমিউনিটি সেন্টারে নেওয়া হলো তাকে। মেহজার যে কি রকম অনুভূতি হচ্ছিল। ভ’য়ে, চিন্তায় সে অস্থির। বিয়ে এত জটিল সে আগে কখনো বুঝতে পারেনি। আগে শুধু তার কাছে আনন্দ মনে হতো। এখন মনে হচ্ছে আতঙ্ক।
ইরফানের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের মধ্যে অয়নও এলো তাকে একবার দেখতে। এসে কেমন মুখ কালো করে বলল।
-‘তোমার আর ইয়াজ ভাইয়ের মধ্যে যে কিছু চলছিল তা আগেই বলতে।’

মেহজা বুঝতে পারল না কি বলবে। সে ভ্যাবলার মতো তাকিয়েই রইল।

বিয়ে পড়ানো হলো যথাসময়ে। কবুল বলার সময় মেহজার এত কান্না পেল! অথচ সেই তো ইরফানকে বিয়ে করতে চাইত সবসময়। রেজিস্ট্রি পেপারের সাইনটা সুন্দর হলো না বলেও তার খুব ক’ষ্ট হলো। অনা আর প্রথিকে সেই ক’ষ্টের কথা বলতেই তারা হেসে কু’পো’কা’ত।

বিদায় আর কি! অপর তলা আর নিচ তলা। মেহজা সেটা নিয়ে ভাবল না। তবে মেহজার ভাবা উচিত ছিল। কেননা বিদায় বেলায় সে শুনতে পেল তাকে নেওয়া হবে ইরফানের বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে। নব দম্পতি আজকের রাত সেখানেই কাটাবে। এই খবরটা শুনে মেহজা ম’রি ম’রি যা’ই যা’ই অবস্থা। সে বারবার তার মা খালামণিকে বলছে যাবেনা। তারা বলল এত আয়োজন করল এখন সে না গেলে কীভাবে হয়! ইরা ইমা সবাই বোঝালো। মেহজা ইমার জোরাজুরির উপরে কথা বলতে পারল না।

গাড়িতে উঠার সময় ইরফানের চোখে মুখে সে দুষ্টু হাসি দেখেছিল। যা দেখার পর সে রীতিমত ঘামতে থাকে। তাদের সাথে আপাতত চার পাঁচ জন গেলেও সবাই ফিরে আসবে। তখন একা এই লোকের সাথে থাকবে কি করে! ওই দিন রাতের ব্যবহারের জন্য যদি উত্তম মধ্যম দেয়! তবে?

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here