#চন্দ্রপুকুর
||২২তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
সারাটা রাত যামিনীর কেটেছে নিরাপত্তাহীন, আক্রমণের ভীতি নিয়ে। সাথে তো মেহমাদ শাহের হতে বিরহের শোক তো আছেই।
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা ভোর হলো এবার তো অশ্রুর পতন রোধ করুন। ক্যানো এতো বেদনা বোধ করছেন, জমিদার বাবু আপনার চৌকাঠে পা রাখবেই দিনশেষে।”
“জানি না দিলরুবা। কেন যেন বোধ হচ্ছে বাবু মশাইকে অতি শিঘ্রই হারিয়ে ফেলবো আমি। এই ভয় আমার অভ্যন্তরে গভীর ভাবে ক্ষত তৈরি করছে।”
আফসোসের সুরে শুধালো যামিনী। দিলরুবার জানা নেই কোন ভাষায় নিজের মনিবকে সান্ত্বনা দিবে সে।
এমন সময় দ্বারে জোরালো করাঘাতের শব্দ। কেঁপে উঠে উভয় নারীই। কেমন এক ভীতি যেন গ্রাস করছে তাদের।
যামিনীর ইশারা পেতেই দেওয়াল হতে তরবারি নামিয়ে দিলরুবা এগিয়ে যায়। এমন অধিক সতর্কতার জন্য দায়ী কোনো এক অজানা কারণে তাদের কক্ষ হতে প্রহরীদের সরানো হয়েছে।
ধীর হস্তে দ্বার খুলতেই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করেন পরিচিত মধ্যবয়সী নারীটি। তাঁকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে যামিনী ও দিলরুবা।
“কেমন আছো চন্দ্রমল্লিকা? বহুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ভাবলাম ভুলে গেলে কি না আমায়, তাই মনে করিয়ে দিতে আসলাম।”
গুলবাহার খাতুনের কথা শুনে বিরক্তিমাখা চোখে তাঁর দিকে তাকালো যামিনী। নারীটি তা দেখে আলতো হাসলো।
“আহা! বিরক্ত, রাগান্বিত হচ্ছো বুঝি? যত্তসব রাগ, বিরক্তি আমার বিষয়েই, আজও অবধি নিজ শ্বশুরালয়ের জন্য বাঁদী হতে রাণী হতে পারলে না তা নিয়ে ক্রোধ নেই কোনো। বাঁদী, বাঁদী, যামিনী বাঁদী।”
“চুপ করুন! সামান্য খাতুন আপনি, আপনার স্পর্ধা কী করে হয় আমাকে এ বলে সম্বোধন করার! আমি বেগম চন্দ্রমল্লিকা, গোটা শেরপুরের জমিদার নবাব মেহমাদ শাহের একমাত্র স্ত্রী। আমাকে বেগম বলুন। বেগম!”
খিলখিল করে হেসে দেন গুলবাহার খাতুন। যামিনী ক্রুব্ধ হওয়ার চাইতে অবাক অধিক হয়।
“হাসালে কন্যা। তোমাকে কে দিয়েছে বেগমের মর্যাদা? নিয়ম মোতাবেক প্রতিটি বেগমকে বেগম লুৎফুন্নেসার উপদেষ্টা স্বরূপ রাখার কথা অন্দরমহলের বৈঠকে বা যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে। আজ অবধি কোন বৈঠকে তুমি উপস্থিত ছিলে বা ডাকা হয়েছিল? বাস্তবতা তো এটাই তুমি সাধারণ এক বাঁদী।”
“চুপ! একদম চুপ! আর একটা শব্দও দু’ঠোঁটের ফাঁক হতে বের হলে জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলবো আমি।”
নারীটি এগিয়ে আসে কিশোরীর দিকে। তাঁর চোখে কোনো ভয় নেই, শুধুই তাচ্ছিল্য ও ক্ষোভ মিশ্রিত চাহনি।
“এতোদিনে এও বোধ করতে পারোনি কিছুতেই ভীতি জাগে না আমার। আর আমি যে মিথ্য কিছু বলিনি তার প্রমাণ তোমার বিনা যুক্তির ক্রোধই। জিভ নাহয় আমার কাটা যাবে, সত্য তো মিথ্যে আর হবে না।”
তিনি গটগট করে বেড়িয়ে যান। মুখে তাঁর জয়ের হাসি। এই রমণীকে শব্দের আগুনে পুড়িয়ে যেন ব্যথা লাঘব হয় তাঁর।
যামিনী ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাঁর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। মানুষটি তো মিথ্যে বলেনি। হুট করেই তার কষ্ট ক্রোধে পরিণত হয়। যা ‘বেগম’ এর প্রাপ্য ক্ষমতা অর্জনের জন্য সকল কিছু জ্বালিয়ে ভস্ম করতেও রাজি।
চোখ জোড়া বন্ধ করে কিছু ভেবেই বলে উঠে,
“দিলরুবা, আজ অন্দরমহলের ভোজনশালায় বিরাট আয়োজন করার আদেশ দাও রন্ধনশালায়। সকলকে বলো আজ আমার জন্মদিন তাদের উপস্থিত। নবাব পরিবারের সদস্যদেরও আমন্ত্রণ করো।”
“যথা আজ্ঞা বেগম।”
দিলরুবা উত্তর দিয়ে কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে বের হয়। যদিও সে অনুধাবন করতে পারছে না কী চলছে যামিনীর মস্তিষ্কে।
___
বেগম নূর বাহার দিলরুবার হতে নিমন্ত্রণ পেয়ে রাগে ফুঁসছেন। অপেক্ষা করছেন শাহাজাদি মেহনূরের আগমনের।
দুশ্চিন্তায় মাথা ব্যথা বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁর। তাই মাথা ও হাত-পা টেপাচ্ছেন দাসীদের দ্বারা। একটু বাদেই আগমন ঘটে শাহাজাদির।
“আসসালামু আলাইকুম মামীজান। আমাকে ডাকিয়েছেন?”
“হ্যাঁ, ডাকিয়েছি। জেনেও না জানার ভান করছো? জানা নেই ক্যানো ডাকিয়েছি?”
“মামীজান।”
অস্ফুটভাবে কথাটা বলে ইশারায় উপস্থিত দাসীদের দেখায় সে। তিনি বুঝতে পেরে আদেশ করেন,
“কক্ষ খালি করা হোক। আমি শাহাজাদির সাথে একান্ত কথা বলতে চাই।”
তারা বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে গেল।
“এখন বলো আমাকে, কী হয়েছে? যেখানে ঐ কন্যার আর্তনাদ পুরো মহলে আলোড়িত হওয়ার কথা প্রভাতে, সেখানে সে আনন্দিত, দিচ্ছে জন্মদিনের দাওয়াত।”
“মামীজান, আল্লাহ নিজ হাতে ঐ ঘুঁটেকুড়ুনিকে বাঁচিয়েছে। আমার লোক তাকে আক্রমণ করতে পারেনি। গুলবাহার খাতুন উপস্থিত ছিল তার কক্ষে।”
“ধুর! এই মেয়েটা বারবার হাতে এসেও হাত হতে পিছলে যাচ্ছে।”
“আপনি চিন্তা করবেন না মামীজান। আমি শাহাজাদি নূর বাহার যখন এ কার্য সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছি। তা সম্পন্ন করেই ছাড়বো।”
“ইনশাআল্লাহ। আমার দোয়া সবসময় তোমার সঙ্গেই আছে আমার চাঁদের আলো।”
উভয় নারী এবার পুনরায় বারান্দায় যেয়ে আলোচনায় বসেন যামিনী নামক অধ্যায়টিকে মেটানোর।
একজন প্রহরী উচ্চ স্বরে জানায়,
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, উপস্থিত হয়েছেন।”
বেগম নূর বাহারের চোখে-মুখে কঠোরতা ছেয়ে যায়। শক্ত কণ্ঠে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়।
“আসসালামু আলাইকুম আম্মিজান। মাশাআল্লাহ অদম্য সৌন্দর্যের মালিক আপনি। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করুক।”
“হুম। কিছু বলতে এসেছো কন্যা? তাহলে আমার মূল্যবান সময় অযথা ব্যয় না করিয়ে বলে ফেলো।”
“অবশ্যই, আম্মিজান। আমার জন্মদিন উপলক্ষে করা আয়োজনে আপনাকে আসার আবেদন করতে এসেছি। আপনি এসে আমার অনুষ্ঠানকে ধন্য করুন।”
“হুম, ঠিক আছে।”
“আমি উঠছি, মামীজান। আমার নিজ কক্ষে যাওয়া লাগবে।” শাহাজাদি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে নেয়।
যামিনী হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রস্তাব রাখে,
“তাহলে চলুন না শাহাজাদি একসাথেই যাওয়া যাক। বিদায় আম্মিজান।”
উভয় রমণী একসঙ্গেই কক্ষ হতে বের হয়। হাঁটার মাঝে কিশোরী শুধায়,
“উপস্থিত হবেন কিন্তু বেগম আমার ছোট্ট আয়োজনে। আমার আয়োজনে আপনার উপস্থিতি আবশ্যম, যতোই হোক আপনার ভ্রাতার একমাত্র স্ত্রী আমি।”
“ভ্রাতা? কী সব উল্টোপাল্টা কথা বলছো! শাহ আমার ভাই না। আমার মায়ের গর্ভে তার বেড়ে উঠা নয়।”
“মায়ের পেটের না হোক মামাতো ভাই তো। কারণ আপনাদের বিয়ে তো আর হচ্ছে না কোনো কালেই। আমি থাকতে কীভাবে সম্ভব তা?”
শাহাজাদি মেহনূর হাঁটা থামিয়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“তুমি না থাকলে তো সম্ভব, তাই না? নবাব শাহ নেই, তোমার কক্ষের বাহিরের প্রহরীরা নেই। ভীতি জাগছে না তোমার? জাগা উচিত।”
কিশোরীর মুখশ্রী বিবর্ণ হয়ে উঠলো। যুবতী বঁচন কটাক্ষ করে চলে যায় সেখান হতে। যামিনী পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে যেন চরণ দুটোতে শক্তি পাচ্ছে না আর।
___
ভোজনশালায় জমজমাট আয়োজন খাবারের। দাসীরা তো তৃপ্ত। যামিনী নিজ উদ্যোগে দাঁড়িয়ে সবার আহার করা ঠিক-ঠাক হচ্ছে কি না সেটা খেয়াল রাখছে।
কিশোরীর রন্ধনশিল্পে দক্ষতার পরিচয়ে বেগম লুৎফুন্নেসাও তৃপ্ত। যদিও মুখে কিছু বলছেন না।
“ধন্যবাদ বেগম। অনেক অনেক ধন্যবাদ। বহুদিন পরে এতো ভালো ভালো খাবার পেট ভরে আহার করলাম। আপনিই আমাদের যোগ্য বেগম। আল্লাহ আপনি সুখ, শান্তি ও মর্যাদা দিক।”
প্রতিটি দাসী যাওয়ারর হওয়ার পূর্বে যামিনীর হাতে চুমু খেয়ে প্রসংশা বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে। সেও খুব আদরের সহিত তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে কিছু অর্থ।
বেগম লুৎফুন্নেসা আড়চোখে তা খেয়াল করছেন, তার ঠোঁটের কোণে হাসি স্থির। শাহাজাদি নূর বাহার তা খেয়াল করে বেগম নূর বাহারকেও ইশারা করে দেখতে।
সকলে আহার শেষে মহাপরিচারিকা উঠে বেগম লুৎফুন্নেসার কাছে এসে দাঁড়ান। যেন হুট করেই জরুরি কিছু মনে পড়েছে তাঁর।
“বেগম লুৎফুন্নেসা, ক্ষমা করবেন। একটা গুরতর বিষয় আপনাকে জানাতে ভুলে গিয়েছি আমি। অন্দরমহলের কিছু দাসীদের মাঝে দ্রোহের শুরু হয়েছে বেতনকে কেন্দ্র করে সহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে। এই বিষয়ে একটু বিচার-আলোচনার প্রয়োজন।”
“কী! এই কথা তুমি আজ জানাচ্ছো আমায়! তোমার থেকে এরূপ দায়িত্বহীনতা আশা করিনি আমি। যাকগে আগামীকালই এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।”
“অবশ্যই বেগম।”
যামিনী বেগম লুৎফুন্নেসার কাছাকাছি বসায় সবই শুনতে পায়। সে বোধ করেছে দাদীজান প্রকাশ না করলেও তার উপর কিছুটা তুষ্ট আজ। তাই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুল করে না সে।
“দাদীজান, আপনি অনুমতি দিলে এই আলোচনায় আমি উপস্থিত থাকতে চাই। আপনাকে দেখেই তো আমি শিখবো কীভাবে যোগ্য হওয়া যায় ‘বেগম’ পদবী এর, কীভাবে সমস্যার মোকাবেলা করা যায়। তাই আপনি যদি অনুমতি দিন…”
“আচ্ছা, তুমিও এসো চন্দ্রমল্লিকা।”
মনে মনে খুশি হলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। মেয়েটা অযোগ্য হলে নিষ্ঠাবান নিজের কর্মের প্রতি।
এদিকে দু’জন নারীর এই দৃশ্য দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে ক্রোধে। উভয়েই ধৈর্য্য রাখতে না পেরে দ্রুত বিদায় জানিয়ে স্থান ত্যাগ করে।
___
বেগম নূর বাহার ও শাহাজাদি মেহনূর গভীর চিন্তায় ডুবে।
“মামীজান, নানীজান যেভাবে ধীরে ধীরে সন্তুষ্ট হচ্ছেন চন্দ্রমল্লিকার প্রতি আমার ভয় লাগছে। কারণ একবার যদি যামিনী তাঁর চোখে যোগ্য প্রমাণিত হয়, তিনি নিজেই হবে যামিনীর ঢাল।”
“সেটা তো আমারও দুঃশ্চিন্তা। তবে তুমি চিন্তা কোরো না। এতো দিন যা করেছে, ভেবেছো, সব তোমার দ্বারাই। তবে এবার আমি যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছি। এমন কিছু ভেবেছি যাতে ঐ মেয়ে নিজেই নিজের কাল ডেকে আনবে, আম্মিজান নিজ হস্তে ঐ মেয়েকে মেটাতে উদ্ধত হবেন।”