#চন্দ্রপুকুর
||৩৪তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
আধো আলো আসছে। অন্ধকারচ্ছন্ন কামরা। ঠিক কামরা নয়, চিলেকোঠা মনে হচ্ছে। কাল রাত হতে আহার করেনি রত্না।
দেহ ঝিমঝিম করছে তার। প্রায় দুইদিন পেড়িয়ে গিয়েছে এই বন্দীদশায়। পেটে এক বিন্দু অন্ন তো দূরে থাকুক জলও পড়েনি।
“হে আল্লাহ! কী অপরাধে আমায় এই পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করালে আমি জানি না। তবে আমি আর সইতে পারছি না। আমাকে ক্ষম করো, মুক্তি দাও।”
আল্লাহ তায়ালা হয়তো তার দোয়া শ্রবণ করলেন। কারণ এক মুহূর্তে পেড়িয়ে যেতে না যেতেই বন্ধ দোয়ার খুলে যায়। এক ঝাঁক আলোর প্রবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে যুবতী।
পিটপিট করে চোখ খুলে রত্না। সামনে বাঁকা হাসি সমেত দাঁড়িয়ে আছে যামিনী, মোহিনী ও দিলরুবা।
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা?”
“হুম, আমি। অন্যকাউকে অবশ্যই আশা করা উচিত হয়নি।”
“আমাকে মুক্তি দিন বেগম। কোন ত্রুটির জন্য আমাকে এমন ভাবে আটক করেছেন?”
“জানো না তুমি? তোমার ভুল তো গণনা করে সমাপ্ত করা যাবে না। সবচেয়ে বড়ো ভুল তো করেছিলে আমায় হত্যা করার পরিকল্পনায় নিজের মনিবের সাথে হাত মিলিয়ে। আমার চাঁদনি, কোথায় সে?”
হচকচিয়ে গেল যেন যুবতী দাসী। ঘাবড়েও গেল বটে।
“ক্ষমা করবেন বেগম। আমি এ বিষয়ে কিচ্ছু জানি না। সত্যিই জানি না।”
“নিজের মনিবকে বাঁচানোর জন্য এসব বলছো? হাস্যকর! তোমার মনিবের বাস্তবতা তো দেখে নেও।”
অবাক দৃষ্টিতে তাকায় নারী। যামীণী মোহিনীকে ইশারা করে রত্নার হাতের বাঁধন খুলতে। দিলরুবার হতে চিঠিটি হাতে নিয়ে রত্নার হাতে ধরায় সে।
“তোমার মনিবকে বেনামী চিঠি লিখেছিলাম তোমাকে বন্দী করা হয়েছিল জানিয়ে। মূলত তোমার বিপরীত আমার চাঁদনিকে ফেরত চেয়েছিলাম।
তিনি পরিস্কার ভাবে চিঠিতে জানিয়েছেন, তুমি তাঁর নিকট নিছকই মূল্যহীক এক গোলাম। তুমি বাঁচো আর মরো তাঁর কিছুই যায় আসে না। অদ্ভুৎ না ব্যাপার খানা!”
যামিনী একের পর এক শব্দের তীর ছুঁড়ে যাচ্ছে। তাতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রত্না। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারলো না কৈশোর বয়স হতে সেবা করছে যার, তিনি এমন মনোভাব পোষণ করতে পারেন তাঁর বিষয়ে। বারবার চিঠিটা দেখছে, যদি একখান প্রমাণ পায় এই চিঠির মিথ্যে প্রমাণ হওয়ার।
তা হয়তো কিছুটা অনুধাবণ করতে পারে যামিনী।
“সন্দেহ হলো শাহাজাদির সিলমোহর খানা দেখে নিয়ো। নিজের মালিকের সিলমোহর তো চিনতে তোমার ভুল হওয়ার কথা না। এখন বলো এমন কাউকে বাঁচাতে নিজে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে চাও না কি নিজের প্রাণ রক্ষা করতে চাও?”
অনেকটা সময় নৈশব্দে বসে থাকে সামনের নারীটির। সে পরিকল্পনা করছে না কি বিচার-বিশ্লেষণ না কি নিজেকে সামলাচ্ছে বোধগম্য হয় না কিশোরীর।
“আমি আমার প্রাণ বাঁচাতে চাই বেগম। আমাকে মুক্তি দিন। বিপরীতে যা বলবেন তা-ই করব।”
আকস্মাৎ পা জড়িয়ে ধরে মিনতি করে রত্না। যামিনী বিজয়ীর হাসি দেয়।
___
মেহমাদ শাহ নিজের কামরায় বসে কাগজপত্রে ডুবেছিল। বহুদিন ধরে ধান বিক্রির হিসেবটা ধরা হয় না, আজ ধরে দেখলে কেমন যেন গড়মিল মনে হচ্ছে তার।
তার ব্যস্ততার মাঝে কামরার দোয়ার খুলে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে ছুটে আসে যামিনী। আঁকড়ে ধরে তার বক্ষে অশ্রু বিসর্জন দিতে শুরু করে।
“কী হয়েছে আমার চাঁদের মল্লিকার? আমার সোনালি হরিণ এভাবে কাঁদছো ক্যানো?”
“বাবু মশাই আমার চাঁদনি… আমার চাঁদনি…” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে যামিনী।
আদুরে ভঙ্গিতে পিঠে হাত বুলায় যুবক। যেন একটু শক্ত স্পর্শ পেলেই আঘাত পাবে তার প্রেয়সী।
“আমি মিনারকে আদেশ করেছি তো আমার চন্দ্রমল্লিকা। খুব শিঘ্রই তাকে ফিরে পাবে তুমি।”
“চাঁদনি আর নেই বাবু মশাই। কী করে আমি ফিরে পাব তাকে? মানুষ এতোটা নির্দয় কী করে হতে পারে! প্রতিশোধের নেশায় একটা মাসুম জীবকে…!”
আবারও ক্রন্দনধ্বনি শোনা যায়। মেহমাদ শাহ স্তম্ভিত।
“মানে? কী বলতে চাচ্ছো তুমি? কী হয়েছে সোজাসুজি বলো চন্দ্রমল্লিকা।”
“বাবু মশাই আমি দিলরুবা আর মোহিনীর সাথে মহল ঘুরে দেখতে বের হয়েছিলাম। মহলের পিছন ভাগে জঙ্গলের দিকটায় যেয়ে দেখতে পাই চাঁদনিকে ছুড়ি দিয়ে হত্যা করছে কেউ।”
আরও জোরে শব্দ করে ক্রন্দনক্রিয়ায় লিপ্ত হয় রমণী। যুবক উত্তেজিত।
“কার এতো দুঃসাহস জানাও আমাকে! কাকে দেখেছো তুমি? আর সে এখন কোথায়?”
যামিনী কান্না মৃদু হয়। কোনোরকম দরজার দিকে ঘুরে সে। সেখানে দাঁড়ানো দিলরুবা তার ইশারা পেলেই মোহিনীর সাথে রত্নাকে নিয়ে কামরায় প্রবেশ করে।
“আসসালামু আলাইকুম জমিদার বাবু। শাহাজাদি মেহনূরের খাঁস দাসীকেই আমরা পেয়েছিলাম জঙ্গলের দিকে, অনেক কষ্টে পেয়েছি।”
রত্না চরণ জড়িয়ে ধরে জমিদারের। ক্ষমার আকুতি করতে শুরু করে,
“আমার কোনো দোষ নেই, জমিদার বাবু। আমাকে শাহাজাদি বাধ্য করেছিল এ কাজ করতে। ক্ষমা করুন আমায়। ক্ষমা ভিক্ষে দিন।”
মেহমাদ শাহের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। চিৎকার করে উঠে,
“মিনার! মিনার! এই মেয়ে সহ মেহনূরকে এখনই মহল হতে বহিষ্কার করো। আর এই মুহূর্ত মেহনূরকে পাঠিয়ে দাও তার বাড়ির উদ্দেশ্যে।”
হনহন করে চলে যায় যুবক। হয়তো বেগম লুৎফুন্নেসার কামরাই তার গন্তব্য।
তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দেয় যামিনী। এই অবধি যতোটুকু হৃদয় পুড়ছিল নিজের অপকর্মের উদ্দেশ্যে।
এখন ততোটাই শান্তি বোধ করছে। জয় আর ক্ষমতা পাওয়ার মাঝে যে তৃপ্তি ও শান্তি তা এই পরিকল্পনা সফল হওয়ার পর বোধগম্য হচ্ছে তার।
অতীত,
যামিনীর কথায় রাজি হওয়ার পর রত্নাকে দাঁড় করায়। প্রশ্ন করে,
“আমার চাঁদনিকে কোথায় রাখা হয়েছে? আমাকে তার নিকট নিয়ে যাও।”
“টিয়া পাখিটি মহলের পিছনের দিকে রাখা হয়েছে এক ভৃত্যের অধীনে।”
“ঠিক আছে, তুমি তাদের থেকে পক্ষীটি নিয়ে আসবে। মোটেও ধূর্ততা দেখিয়ে কিছু জানতে দিবে না তাদের। আমার লোকের দৃষ্টি তোমার উপর থাকবে, মনে রেখো।”
“যথা আজ্ঞা বেগম।”
দিলরুবা ও মোহিনী সহ কয়েকজন প্রহরী রত্নার চোখে কাপড় বেঁধে তাকে নিয়ে বের হয়। যামিনী সেখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। একটু বাদেই চাঁদনি সহ সেই অন্ধকার কামরায় প্রবেশ করে রত্না, মোহিনী ও দিলরুবা।
“আমার চাঁদনি, কেমন আছো তুমি?” আদুরে গলায় রমণী দু’হাতে আগলে নেয় টিয়া পাখিটিকে। তারপর রত্নার দিকে দৃষ্টিপাত করে।
“তুমি যেয়ে জমিদার বাবুকে সব স্বীকার করবে। আর ভুলেও দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে যেন আমার নাম না বের হয়।”
মোহিনী বলে উঠে,
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। তবে জমিদার বাবুকে বলে খুব বেশি কিছুই হবে না। বেগম লুৎফুন্নেসার সাথে আলোচনা করে আগের মতোই অপেক্ষা করবেন শাহাজাদির ভ্রাতার আগমনের। তবে শাহাজাদি মেহনূরকে এভাবে এখানে রাখা ভীষণ বিপদজনক।
তাকে দ্রুতো বের করতে হবে। যে আপনার কক্ষে ঢুকে চাঁদনিকে চুরি করতে পারে, সে বড়ো কোনো ধরনের ক্ষতিসাধনও করতে পারে। ছিনিয়ে নিতে পারে আপনার হতে আরও অনেক কিছু। এমন কী জমিদার বাবুকেও!”
যামিনী ভাবে, খুব করে ভাবে। অতঃপর ঐ কামরা হতে বের হয়ে জঙ্গলের দিকে যায়। কোমরে গুঁজে রাখা ছোটো ছুড়িটা দিয়ে এক আঘাতে হত্যা করে চাঁদনিকে। রক্তে ছিটকে পড়ে মাটিতে, সাথে পড়ে যায় চাঁদনিও হাত ফসকে। মাটিতে বসে ঝরঝরিয়ে কেঁদেও দেয় সে। কী পাপ না করতে হচ্ছে তাকে জীবনের এ পর্যায়ে এসে!
চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। রত্নার বাহু ধরে কঠোরভাবে আদেশ করে,
“বাবু মশাইকে বলবে তুমি হত্যা করেছো চাঁদনিকে শাহাজাদির আদেশে, মনে থাকে যেন। আর চিন্তা কোরো না এর বিপরীতে মোটা অংকের অর্থও পেয়ে যাবে।”
“জী, বেগম। শুধু আমার জীবন খানা ভিক্ষে দিয়েন। বাড়িতে আমার এতিম এক পুত্রও আছে।”
___
শাহাজাদি মেহনূর শেষবার নবাববাড়িকে দেখে নিচ্ছে গাড়িতে উঠার পূর্বে। কী এক নির্মম পড়িহাস ভাগ্যের! যখন সে এসেছিল তখন তাকে স্বাগাতম জানাতে এগিয়ে এসেছিল গোটা নবাবপরিবার। অথচ, আজ কেউ নেই।
অনেকটা অপরাধীর বেশেই তাকে চলে যেতে হচ্ছে। সে পাপের শাস্তিও পাচ্ছে যে পাপ সে করেনি কখনও। যুবতী অজ্ঞাত নয় যামিনীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে।
তবুও তার হস্তে কিছু নেই। নানীজানও তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই নৈশব্দে সহ্য করে নিল এই পাপের কালিমা লেপণ। মনে প্রতিশোধের আগুন আরও দাউদাউ করে জ্বলছে তার।
চোখের জল মুছে গাড়িতে উঠে বসে শাহাজাদি। শক্ত মুখে বিড়বিড়ায়,
“আমি চলে যাচ্ছি যামিনী। তবে ফিরে আসবো প্রলয় হয়ে। ধ্বংস হবে তোমার জীবনের সুখের পাতার অস্তিত্ব আমার হাত আঁকড়ে ধরে।”