চন্দ্রপুকুর পর্ব -৩৫

#চন্দ্রপুকুর
||৩৫তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
বারান্দায় হাটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে যামিনী। উদাসীন ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে খাঁচাটির দিকে। চোখ হতে অবিরাম ধারায় নোনা জল বইলেও কোথায় একটা স্বস্তি।

দিলরুবা এগিয়ে আসে। রমণীর কাঁধে হস্ত খানা রেখে সান্ত্বনার সুরে বলে,

“বেগম আপনি দয়া করে এমন বিরস মুখে বসে থাকবেন না। নিজেকে অপরাধী ভাববেন না। আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনার অসহায়ত্ব বোধ করতে পারবে।”

“মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ো না দিলরুবা। তুমি নিজেও নিজ হৃদয়ে আমায় হৃদয়হীনাই বলে ডাকছো। আমিও মানি আমি নির্দয়। তবে প্রয়োজনে আমি নির্দয় হব, তবুও আমি আমার শত্রুদের ধ্বংস করবই।

তুমি জানো না দিলরুবা তাঁরা আমাকে সর্বস্বান্ত করার কী জঘন্য উপয় এঁটেছে! আমার মাতৃত্বে আঘাত করতে চেয়েছেন শাহাজাদি মেহনূর।”

দিলরুবার ললাটে চিন্তার ভাঁজ। বেশ দ্বিধাগ্রস্তও সে।

“কীসের বিষয়ে কথা বলছেন বেগম?”

“তুমি খেয়াল করেছো রত্মাকে আমি যখন আমার পা হতে উঠাচ্ছিলাম তখন সে আমার কানের নিকট কিছু ফিসফিসাচ্ছিল? সে তখন বলেছিল, সে ভুলবশত শুনে ফেলেছে শাহাজাদি মেহনূর ও আম্মিজানকে আমার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করতে।

তাঁরা আমাকে নিঃসন্তান রাখার ব্যবস্থা করবেন। আমার খাবারে এমন কিছু ঔষধি মিলিয়ে দিয়ে আমাকে খাওয়াবেন যা আমাকে মা হওয়া হতে রোধ করবে। আর বাবু মশাইকে আমি কোনো উত্তরাধিকার দিতে পারব না এবং তালাক হয়ে যাবে।”

এ কথা শ্রবণগোচর হতেই হতবাক যুবতী। প্রায় প্রতিটি বাঙালি নারীর জন্য মাতৃত্ব এক অদম্য সুখানুভূতি ও আল্লাহর পরম বরকত স্বরূপ। সে জ্ঞাত নিঃসন্তান থাকা কষ্ট সম্পর্কে।

“বেগম এখন কী করবেন? কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন এত ষড়যন্ত্র হতে?”

“করে নিব রক্ষা, ইনশা আল্লাহ। প্রথম চাল তো দিয়েই ফেলেছি শাহাজাদিকে বহিষ্কার করিয়ে। যদিও এক নিষ্পাপকে হত্যা করে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি, তবে আমি আরও নির্দয় হতে পারি নিজের ক্ষমতা ও নিজেকে রক্ষার্থে।

যতো টুকু আমি খেয়াল করেছি আম্মিজান অর্থাৎ বেগম নূর বাহারকে বাবু মশাই তেমন একটা মূল্য দেন না, অপছন্দও করেন কোনো এক অজানা কারণবশত। আর দাদীজান তো ইদানীংকাল বেশ আমায় বেশ স্নেহই করেন। তাছাড়া তাঁর বয়সও হয়েছে, ক্ষমতা তো আমার হস্তেই যাবে।”

দিলরুবার ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠে।

“আর ক্ষমতা আপনার হাতে আসলে নিজেকে রক্ষা করা আপনার নিকট অনেক সহজতর হয়ে যাবে। তাই না বেগম?”

“হু, তবে তার পূর্বে বেগম নূর বাহারের হাঁকডাক কমানোর ব্যবস্থা করা লাগবে নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে, দেখিয়ে, সবাইকে দাবিয়ে। আর হ্যাঁ, আমার আহার করার জন্য তৈরি খাবার খুব দেখে-শুনে এবং পর্যবেক্ষণ করে আমার চক্ষু সম্মুখে রাখবে। আমি কোনো ঝুঁকি নিতে একদমই ইচ্ছুক নয়।”

“অবশ্যই, বেগম চন্দ্রমল্লিকা। আপনাকে রক্ষা করাই আমার প্রথম কর্ম।”

“হুম, আমি তো জানি। তাই তো সেই মুহূর্তে মোহিনী ও বাকি দাস-দাসীদের মাঝে না বলে তোমায় এখন জানালাম। তবে আমার খুব ভয় হয় বুঝলে? আমি যার ভালোবাসাকে, যাকে নিজের করে রাখার জন্য রক্তে হাত রাঙিয়েছি তারই না ঘৃণা উপহার পাই!”

তীব্র আক্ষেপ যামিনীর কণ্ঠে। দিলরুবার নিকট সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। তবুও তাকে কোনোরকম বুঝিয়ে সামলায় সে।

কিশোরী যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত তখন মহলের এক কোণে বসে কেউ একজন মনে মনে বলছে,

“শাহাজাদি পাঠিয়ে ভাবছিস তুই রক্ষা পাবি? তোর মাতৃত্বের স্বাদ তুই পাবি না কভু। অতঃপর হারাবি জমিদারের সমর্থনও।”

___

মেহমাদ শাহ নিজের কক্ষে বসে শেক্সপিয়ারের একটি বই পড়ছে। বহুদিন পর নিজের সংরক্ষিত বইয়ের ঘরটিতে গিয়েছে সে। যদিও উদ্দেশ্য ছিল মন ভুলানো, তবুও পারছে না। সেই কিশোরী কন্যা এতো গভীর ভাবে নিজের প্রতি আসক্ত করেছে তাকে যা বলার ভাষা রাখে না।

যামিনীর হৃদয়ে পোষণ করা সন্দেহ দূর করার পর হতেই তাকে এড়িয়ে চলে যুবক। বারবার ক্ষমার আকুতি শুনেও উপেক্ষা করেছে। শয্যায় তো স্থান দেয়নিই, বিপরীতে অবশ্য নিজেও নির্ঘুম রাত্রি কাটিয়েছে।

তবে আজ যেন কিছুতেই হৃদয় মানছে না। হয়তো আজ মাঝবেলায় চাঁদনির মৃত্যুতে যামিনীর ক্রন্দনরত মুখশ্রীই তাকে এতোটা পোড়াচ্ছে।

নিজেই নিজেকে বোঝায়,

“চন্দ্রমল্লিকা আমায় অতিরিক্ত ভালোবাসে তাই তো আমায় নিয়ে ভয় তার। হারিয়ে ফেলতে চায়, এজন্যই সন্দেহ ডানা মেলে বক্ষে। আজ বাচ্চা হরিণীটির ভীষণ মন খারাপ, সঙ্গ দিতেও আমার সেখানে উপস্থিত থাকা উচিত।”

নিদ্রার জন্য পরিধান করা সাধারণ পোশাকেই বেড়িয়ে পড়ে সে। মিনার দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল, সে মিটমিট করে হাসে মনিবের পাগলামিতে। আবার দীর্ঘশ্বাসও ফেলে।

ভাবে,

– তাদের জীবনে ভালোবাসা নেই। ভালোবাসার সময় কোথায়? তাদের গোটা জীবন সেবা করতে করতেই কেটে যাবে। ভালোবাসা উচ্চবিত্তদের জন্যই ঠিক।

মেহমাদ শাহ দোয়ার খুলে ঢুকে দেখে যামিনী পালঙ্কে শায়িত। দিলরুবা তেল মালিস করে দিচ্ছে তার মাথায়। বিবর্ণ মুখশ্রী কিশোরীর।

তাকে দেখেই নজর ঝুঁকিয়ে বিদায় জানায় দিলরুবা। স্থান ত্যাগের পূর্বে ইশারায় বুঝিয়ে দেয় যামিনীকে সে যেন জমিদারকে বুঝতে না দেয় কিছু।

“আসসালামু আলাইকুম, বাবু মশাই। কেমন আছেন? আর কী মনে করেই বা এই নগণ্য নারীর কক্ষে চরণ রাখলেন?”

“আমার চন্দ্রমল্লিকা, আমি কি আসতে পারি না তোমার কামরায়? ঠিক আছে, তবে চলে যাচ্ছি।”

দরজার দিকে ঘুরে মেহমাদ শাহ। যামিনী ছুটে যেয়ে তাকে পিছন হতে জড়িয়ে ধরে।

“বাবু মশাই ভালোবাসা না হোক, একটু তো সহানুভূতি দেখান আপনার চন্দ্রমল্লিকার উপর। পূর্বে চাঁদনিকে দেখে আপনার ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির দাবানলে হওয়া ক্ষত লাঘব করতাম। এখন তো সেও নেই। আপনি কি পূর্ণরূপে একাকিত্বের স্বাদ দিতে চাচ্ছেন আমাকে? তবে তো আমি মরে…”

রমণীকে নিজের হতে ছাড়িয়ে নেয় যুবক। ললাটে ভালোবাসা সিক্ত চুমু খেয়ে শুধায়,

“আজ আমাদের মাঝে শুধু ভালোবাসার প্রতিযোগিতা হবে। কোনো অশুভ বা মন খারাপের কথোপকথন নয় ”

যামিনীকে কোলে তুলে নিয়ে শয্যার দিকে এগিয়ে যায় সে। কিশোরী তার বক্ষে মিশে আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রার্থণা করে,

“ইয়া আল্লাহ, আমাদের ভালোবাসায় তুমি এভাবেই সহিহ-সালামাত রেখো। কারো বাজে দৃষ্টি যেন না আঘাত করতে পারে আমার বন্ধনে। তুমি জানো আমার ভালোবাসার পবিত্রতা ও সত্যতা। আমাকে ও আমার ভালোবাসাকে তুমি রক্ষা কোরো।”

___

কেটে গিয়েছে পাঁচ-পাঁচটি বছর। অন্দরমহল পূর্বের ন্যায়ই জমজমাট ভাবে চললেও পরিবর্তন এসেছে শাসনকার্যের মাঝে।

বেগম নূর বাহার সব কিছু হতে বিমুখ হয়ে অনেকটা নৈশব্দে থাকেন নিজ কামরা। এখন আর তাঁর গলাবাজি শ্রবণ করা যায় না। অবশ্য সে এখন পূর্ণাঙ্গ যুবতী। এর পিছনে একটাই কারণ, সেই কিশোরী যামিনী। নিজের ক্ষমতা, কূটনীতি ও জনমতের সহায়তায় সে আজ জয় করে নিয়েছে প্রায় অনেক কিছুই।

এমন কী বেগম লুৎফুন্নেসার মতও অনেকটাই জয় করে নিয়েছে সে। তার প্রমাণ আজকাল প্রায়শয়ই সভায় বা বৈঠকে দর্শন পাওয়া যায় না বেগমের, যামিনী একাই সামলায় শাসনভার।

বর্তমানে ভঙ্গ হৃদয়ে বাগানে বসে আছে তরুণী যামিনী। সামনে লোভনীয় সব খাবার, এতো এতো দাসীদের সেবা কিছুই তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না।

একটাই ভীতি তার। বৈদ্য তাকে একদম স্বাভাবিক গণ্য করার পরও প্রায় দুই বছরের অনবরত চেষ্টার পরও অন্তঃসত্ত্বা হতে পারছে না সে। যদিও এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে এখন সন্তান নিতে চাচ্ছে না বলে এড়িয়ে যায়, তবুও কেউ বাস্তবতা জানলে পরিণাম ভয়ংকর হবে তা সম্পর্কে সে জ্ঞাত।

“বেগম কী হয়েছে? আপনাকে বেশ বিষণ্ণ লাগছে।”

“তুমি তো জানো দিলরুবা আমার বিষণ্ণতার কারণ। এতো চাওয়ার পরও আল্লাহ আমার কোলটা শূন্য রেখেছে। আমার তো এখন ভয় হয় দিলরুবা, শাহাজাদির অনুপস্থিতিতে কেউ তার হয়ে দূরে না রাখছে আমাকে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া হতে।”

“তা কী করে সম্ভব বেগম? বৈদ্য তো আপনাকে পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ করে জানালো আপনি একদম সুস্থ আছেন। তাছাড়া আপনার আহার করা খাদ্য সহ ব্যবহার্য সব জিনিসপত্তর কঠোর নজরদারি ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর আপনার নিকট আসে।”

এর মধ্যে মোহিনী আসলো। সে জানালো,

“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, জমিদার বাবুকে বেগম লুৎফুন্নেসা জরুরি ভাবে তার কামরায় ডাকিয়েছেন। তাঁকে প্রচণ্ড রাগান্বিতও দেখাচ্ছিল।”

ধ্বক করে উঠে যামিনীর হৃদয়। তার সমস্যার বিষয়ে কোনো ভাবে জানতে তো পারেননি? তবে তো তার বাবু মশাইকে হারানো অপরিবর্তনীয় সত্য। কারণ উইল ও নিয়ম অনুযায়ী জমিদারদের স্ত্রী উত্তরাধিকার দিতে অক্ষম হলে তারা বেগম ও স্ত্রী হিসেবে অযোগ্য এবং সিংহাসন নিজের অধীনে রাখতে হলে তালাক দেওয়া আবশ্যক।
অবস্থা হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here